প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_৩

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৩
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

“চাচাচা।”

জুবায়ের আহমেদ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঁচকে সাবলীল স্বরেই লিলিকে বললেন,,

“লিলি। তুই এখানে?”

চোখে, মুখে খুশি আর উত্তেজনা নিয়ে লিলি ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে জুবায়ের আহমেদের ডান হাতটা চেঁপে ধরে বলল,,

“হ্যাঁ চাচা আমি এখানে। তোমার কাছে সারাজীবনের জন্য চলে এসেছি আমি।”

কুঁচকানো ভ্রু জোড়া জুবায়ের আহমেদ আরো দ্বিগুন কুঁচকে বললেন,,

“কি বললি তুই? সারা জীবনের জন্য চলে এসেছিস মানে?”

প্রসারিত হাসিটা সংকুচিত করে লিলি অস্থির দৃষ্টিতে জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কেনো চাচা? তুমি খুশি হও নি?”

চিন্তিত মুখে ও জুবায়ের আহমেদ জোর পূর্বক হাসি টেনে লিলির হাতটা ছেড়ে বললেন,,

“খুখুশি হয়েছি। খুশি হবো না কেনো? আমি তো জানি তুই কয়েকদিনের জন্যই এখানে বেড়াতে এসেছিস। থাকা, খাওয়া হয়ে গেলেই গ্রামে ফিরে যাবি।”

“না চাচা। আমি কয়েকদিনের জন্যে এখানে বেড়াতে আসি নি। আমি আকাশজোড়া স্বপ্ন নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। তোমার হাত ধরেই সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে এসেছি।”

“কি স্বপ্ন? কি বলছিস তুই?”

“আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি চাচা।”

“মানে? এসব তুই কি বলছিস লিলি?”

“হ্যাঁ চাচা৷ আমি সত্যি বলছি। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি আমি। বাবা জোর করে আমাকে গ্রামের মেম্বারের লুচু ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলেন। তুমি তো জানোই চাচা, ছেলেটা কতোটা খারাপ আর বাউন্ডুলে। তাছাড়া ও মেম্বার বাড়ির প্রতিটা মানুষই খুব অসৎ প্রকৃতির আর রক্তচোষা স্বভাবের। গ্রামের সিংহভাগ লোকরাই উনাদের অত্যাচারে অতিষ্ট। তাদের সাথে গ্রামের কোনো লোকরাই পেরে উঠে না। তাই তো বাবা অপারগ হয়ে ঐ অসভ্য ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা জানতেন, বাধ্য হয়ে এই বিয়েতে রাজি না হলে ও মেম্বারের ঐ অসভ্য ছেলে জোর করে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হলে ও বিয়ে করতেন, আমার ক্ষতি করতেন, আমার উপর অত্যাচার করতেন। এই অল্প একটু বয়সেই আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যেতো চাচা। পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাটা ও ধুলিসাৎ হয়ে যেতো। তাই তো আমি নিজের জীবন নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছি এখানে। তোমাকে ভরসা করে এই অচেনা শহরে ছুটে এসেছি। তোমার ছায়ায় থেকে জীবনের সবচে দামী স্বপ্নটা পূরণ করতে এসেছি। সমাজে নিজের আত্নপরিচয় গড়ে তুলতে এসেছি। তুমি তো জানো চাচা, আত্নপরিচয়ের জ্বালা কতোটা। তুমি ও তো সেই আঠারো বছর বয়সে নিজের ভাইকে ছেড়ে পরিবারকে ছেড়ে সেই সুদূর নড়াইল থেকে এই ঢাকা শহরে ছুটে এসেছিলে পড়ালেখা করে নিজের আত্নপরিচয় তৈরী করতে। তাহলে আমি কেনো নিজের আত্নপরিচয়ের তাগিদে আপন চাচার কাছে আসতে পারি না? তার কাছে একটু ছাঁয়া খুঁজতে পারি না। তার থেকে সাহায্য চাইতে পারি না?”

লিলি অল্প সময় থেকে ফের বলল,,

“তুমি আমার ছায়া হয়ে পাশে থাকবে তো চাচা? আমার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করতে তো?”

জুবায়ের আহমেদ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে উনার প্রবল ইতস্ততার ভাব। মাথা নিচু করে উনি লিলিকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীণ স্বরে বললেন,,

“আমার মনে হয় লিলি, তোর গ্রামে ফিরে যাওয়া উচিত!”

লিলি অপার বিস্ময় নিয়ে চোখে অশ্রুকণা জমিয়ে তার চাচাকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,,

“এএসব তুমি কি বলছ চাচা? আআমাকে আবার ঐ জাহান্নামে ফিরে যেতে বলছ?”

“এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই লিলি। ভাগ্যকে মেনে নে।”

“আআমি বিশ্বাস করতে পারছি না চাচা, তুতুমি আমাকে এসব বলছ? টানা বিশ বছর তুমি এই শহরে থাকছ। শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া তোমার গাঁয়ে লেগে আছে। তোমার চিন্তাধারা অবশ্যই সভ্য সমাজের মানুষদের মতো যুক্তিবাদী আর রুচিসম্মত। গ্রামের বিবেকহীন মানুষদের মতো অযৌক্তিত কথা বলছ কেনো তুমি? তুমি তো জানো চাচা, ভাগ্যকে নিজের চেষ্টা, একাগ্রতা, নিয়ত আর দো’আ দ্বারা পাল্টানো যায়। তাহলে আমি কেনো আমার চেষ্টা আর একাগ্রতা দিয়ে আমার ভাগ্য বদলাতে পারব না?”

জুবায়ের আহমেদ শুকনো মুখে লিলির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। আচমকা লিলি চোখের জল ছেড়ে জুবায়ের আহমেদের পা চেঁপে ধরে কান্নাসিক্ত কন্ঠে বলল,,

“চাচা প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না। বড্ড আশা নিয়ে আমি তোমার দ্বারে নতজানু হয়েছি। অনেক সংগ্রাম করে আমাকে এই শহরে আসতে হয়েছে। একজন ছাড়া এই শহরের প্রতিটা লোকের কাছে আমাকে পদে পদে হেনস্তা হতে হয়েছে। দয়া করে মাঝপথে আমাকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দিও না চাচা। এখন আমি চাইলে ও গ্রামে ফিরে যেতে পারব না। গ্রামের লোকরা আমার মুখে চুন, কালি মেখে দিবেন। হয়তো ন্যাঁড়া ও করে দিবেন। তুমি তো জানো চাচা, আমাদের অজপাড়া গ্রামের নিয়ম কতোটা জঘন্য আর হৃদয়বিদারক।”

জুবায়ের আহমেদ তড়িঘড়ি করে লিলিকে পা থেকে উঠিয়ে লিলির দু কাঁধে হাত রেখে খানিক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বললেন,,

“তোকে আমি কি করে বুঝাই মা, আমি চাইলেই তোকে এই বাড়িতে জায়গা দিতে পারব না। তুই তো জানিস, আমি নিজেই এই বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকি। আমার ছেলে, মেয়ে, বৌ, শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী সবাই এই বাড়িতেই থাকে। তারা যদি তোকে গ্রহণ না করে, তখন আমি কি করব বল?”

লিলি কেঁদে কেটে কিছু বলার পূর্বেই ববি গলা খাঁকিয়ে জুবায়ের আহমেদের সম্মুখীন হয়ে ক্ষীণ হেসে বলল,,

“আঙ্কেল। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি একটা কথা বলি?”

জুবায়ের আহমেদ ববিকে দেখে খানিক হকচকিয়ে বললেন,,

“আআরে ববি তুমি? তুতুমি এখানে কি করছ।”

“চাচা, ভাতিজীর বাক বিতন্ডা শুনছিলাম।”

“কককখন এলে তুমি? খেয়ালই করলাম না!”

“অনেক আগেই। লিলির সাথে কথায় লিপ্ত ছিলেন তাই হয়তো খেয়াল করেন নি।”

জুবায়ের আহমেদ শুকনো মুখে ও জোরপূর্বক হেসে বললেন,,

“হ্যাঁ বাবা। বলো কি বলবে?”

লিলির চুপসে যাওয়া মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে ববি জুবায়ের আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আচ্ছা আঙ্কেল, লিলি আপনার রক্তের সম্পর্কের ভাতিজী তো?”

জুবায়ের আহমেদ মুখ ভঙ্গি পাল্টিয়ে ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঁচকে বললেন,,

“অবশ্যই। লিলি আমার রক্তের সম্পর্কের ভাতিজী। তুমি হঠাৎ আমাকে এ প্রশ্ন করলে কেনো? তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে তুমি আগে থেকেই লিলিকে চিনো। কিন্তু কিভাবে?”

“লিলিকে আমি মাএ একদিন হলো চিনি আঙ্কেল। লিলি আমাকে সব বলেছে, কেনো সে গ্রাম থেকে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে, কেনোই বা সে এই অচেনা শহরে এসেছে, কার কাছেই বা এসেছে। লিলির স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্খা সব আমাকে বলেছে।”

জুনায়েদ আহমেদ চোখজোড়া কৌতুহল নিয়ে ববির দিকে তাকিয়ে আছে। ববি অল্প সময় থেমে ফের বলল,,

“আসলে আঙ্কেল, মাঝরাতের দিকে লিলির সাথে আমার দেখা হয় সামনের গলিতে। বৃষ্টিতে ভিজে কান্নারত অবস্থায় লিলি সম্পূর্ণ অসহায়, নিরুপায়, অবলা একজন মেয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যখন আমি ঢাল হয়ে ওর কাছে যাই তখনই জানতে পারি লিলি আপনার ভাতিজী। গ্রাম থেকে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে সে আপনার কাছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়, আকাশ জোড়া স্বপ্ন পূরণের আশায়, সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত আশায়। বুঝুন এবার, মেয়েটা আপনাকে ঠিক কতোটা ভরসা করে এতদূর ছুটে এসেছে। তার মনে অগাধ বিশ্বাস ছিলো যে, তার চাচা তাকে ঠিক আশ্রয় দিবে, তার ছাঁয়া হয়ে দাঁড়ায়, স্বপ্ন পূরনের এক জোড়া বিশ্বস্ত হাত হয়ে তাকে সামনে এগিয়ে দিবে। আর আপনি কিনা তার পুঁজি করা সমস্ত আশা, ভরসা, বিশ্বাস এভাবে ভেঙ্গে দিচ্ছেন? মানে রক্তের টানে ও তো একজন চাচা তার ভাতিজীকে সাহায্য করে। আপনার কি সেই রক্তের টান টা ফিল হচ্ছে না?”

জুবায়ের আহমেদ ববির থেকে চোখ ফিরিয়ে চোখে, মুখে অনুতপ্ততার ছাপ নিয়ে লিলির চোখের জল গুলো মুছে দিয়ে বললেন,,

“আমি ছোট একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি লিলি। দেখি কতোটা কি করা যায়। তুই চল আমার সাথে।”

জুবায়ের আহমেদ লিলিকে নিয়ে বাড়ির গেইটের ভেতর ঢুকার আগে একবার ববির দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললেন,,

“আমি চেষ্টা করব ববি। লিলির আশা, ভরসা, বিশ্বাসের পূর্ণ মর্যাদা দিতে। আসলে আমি জোর পাচ্ছিলাম না লিলিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে। জানোই তো, সোনিয়ার পরিবার সম্পর্কে। সোনিয়া সম্পর্কে। সারাক্ষণ আমাকে নখে তুলে মারে।”

“কেনো চলে যাচ্ছেন না এই বাড়ি ছেড়ে? জব স্যালারি তো ভালোই পান আপনি।”

“বাড়ি ছেড়ে গেলে ও বৌ তো আর ছাড়তে পারব না! এই স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে সোনিয়া অস্থায়ী কোনো ঠিকানায় যেতে চাইছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ও ছেলে, মেয়ে নিয়ে এই স্থায়ী ঠিকানাতেই থাকতে হচ্ছে। মাসে মাসে মোটা টাকা এই সংসারে দিয়ে ও প্রতি বেলা হেনস্তা হতে হচ্ছে৷ সংসার বড় মায়ার জিনিস বুঝলে? এতো সহজে এই মায়া কাটানো যায় না! বিয়ে শাদি করো,এরপর বুঝবে!”

ববি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। জুবায়ের আহমেদ ও লিলিকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। ববি পেছনের চুল গুলো টেনে নিজের বাড়ির দিকে এগুচ্ছে আর মুখে বেশ ভাবুক ভাব ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,,

“জানি না, ভেতরে কি হবে। সোনিয়া আন্টিসহ উনার পরিবার যা ন্যারো ম্যান্টালিটির। আঙ্কেল তো সোনিয়া আন্টির স্বামী হিসেবেই ঐ বাড়িতে যথেষ্ট মূল্যায়ন পাচ্ছে না, প্রতি পদে উনাকে ভোগতে হচ্ছে। প্রতি বেলা শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, বৌয়ের কথা শুনতে হচ্ছে। না জানি লিলির সাথে কি হয়। লিলি তো এখন তাদের পরিবারের এক্সট্রা একজন মানুষ, তার মানেই বাড়তি খরচ। নির্ঘাত সোনিয়া আন্টি ভীষণ চটে যাবেন। যা হিসাবি উনি। তার উপর লিলি গ্রামের মেয়ে, জুবায়ের আঙ্কেলের ভাতিজী।”

ববি অল্প সময় থেমে ফের বলল,,

“তবে চাইব, যা হয়, সব যেনো ভালো হয়। লিলি যেনো তার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়। তার স্বপ্ন পূরণের সঠিক ঠিকানার সন্ধান পায়। এতটুকু সময়েই মেয়েটার প্রতি খুব মায়া পড়ে গেছে। আমার থেকে দূরে যেয়ে ও আমাকে খুব কাছ থেকে টানছে।”

ববি হঠাৎ মৃদ্যু হেসে বলল,,

“কোয়ি বাত নেহি। “পুতুল বৌ” এর সাথে খুব শীঘ্রই দেখা হবে আমার। রাতে তো জুবায়ের চাচার মেয়েকে পড়াতে যাবোই তখন না হয় লিলি অরূপে “পুতুল বৌয়ের” সাথে কথা বলে নিবো।”

ববি বাড়ি ফিরে রুমে প্রবেশ করতেই ঘড়িতে সকাল সাতটার এলার্ম বাজল। এলার্ম বন্ধ করে ববি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। দশটায় ঘুম থেকে উঠে সে ভার্সিটিতে যাবে। বন্ধুদের সাথে সারাদিন আড্ডা মেরে রাতে জুবায়ের আহমেদের বাড়িতে যাবে।

,
,

লিলিকে নিয়ে জুবায়ের আহমেদ বাড়ির ড্রইং প্রবেশ করলেন। ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজলে ও এ বাড়ির লোকজনদের জন্য মাএ ভোর হওয়া। এই বাড়ির সবাই সকাল নয়টা, দশটায় উঠতে অভ্যস্ত। জুবায়ের আহমেদ সকাল আটটায় জগিং করে এসে নিজের হাতে চা বানিয়ে বিস্কিট ভিজিয়ে খেয়ে অফিসে চলে যান। আর বাড়ি ফিরেন রাত দশটায়। খুব ব্যস্তময় জীবন উনার। তবে আজ শুক্রবার বলে উনার তাড়া খুব কম ছিলো। ভেবেছিলো আজ অনেক বেলা অব্দি জগিং করবেন, হোটেলে চা, নাস্তা খেয়ে আসবেন। কিন্তু অকস্মাৎ লিলির আগমনে উনার ভাবনা ভন্ডুল হয়ে গেলো। লিলিকে নিয়ে ফের বাড়িতে ঢুকতে হলো।

ড্রইং রুমটা একদম ফাঁকা এবং অন্ধকার৷ শুধু খোলা জানালা দিয়ে সূর্য্যের তীর্যক কিরণ রুমে ঢুকছে। সেই কিরণ দিয়ে লিলি পুরো বাড়িটা চোখ বুলিয়ে দেখছে। ড্রইং রুমটা ছোট খাটো হলে ও ইউনিক ডিজাইনের দুটো সোফা সেট, সোফা গুলোর মাঝখানে কাঁচের একটা টি টেবিল, ছয় জনের চেয়ারযুক্ত একটা ডাইনিং টেবিল, চারপাশটা আবার নানা ধরনের রঙ্গিন ফুলদানি দিয়ে সাজানো। বাড়ির ধরনটা স্কয়ার সিস্টেম। উওর পাশে ড্রইং রুম, পূর্ব পাশে দুটো রুম, দু রুমের মাঝখানে একটা ওয়াশরুম। পশ্চিম পাশে আবার দুটো রুম এর মাঝখানে আরো একটা ওয়াশরুম। দক্ষিন পাশে মিডিয়াম সাইজের একটা কিচেন রুম। ড্রইং রুমের মতোই হয়তো বেড রুম গুলো ও ছোট খাট খুপড়ীর মতো।

ধ্যান ভেঙ্গে লিলি জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকালো। জুবায়ের আহমেদ নিচু আওয়াজে লিলির কানের কাছে এসে বললেন,,

“সোনিয়াকে ভুলে ও বলিস না, তুই গ্রাম থেকে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিস। সোনিয়া যদি এ কথা জানতে পারে, তাহলে আজই তোকে ধরে, বেঁধে গ্রামে পাঠিয়ে দিবে। শেষ সর্বনাশটা ও করে ছাড়বে। তাই বলছি বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবি না। বুঝেছিস?”

লিলি অবুঝ ভঙ্গিতে ডানে বায়ে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। জুবায়ের আহমেদ লিলিকে নিয়ে উনার বেড রুমে প্রবেশ করলেন। বেড রুমটা ও পুরো অন্ধকার। দুপাশের দুটো জানালাই বন্ধ। অন্ধকারে রুমে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে বুঝা যাচ্ছে ভেতরটা খুব গিন্জ্ঞিকর। আসবাবপএে ঠাঁসা ঠাঁসা। লিলির হাতটা ছেড়ে জুবায়ের আহমেদ রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। অমনি বেডে শুয়ে থাকা জুবায়ের আহমেদের ওয়াইফ সোনিয়া আহমেদ পিটপিট চোখে সামনের দিকে তাকালেন। লিলি খানিক শঙ্কাগ্রস্থ হয়ে অনেকটা পিছিয়ে জুবায়ের আহমেদের পিছনে এসে দাঁড়ালো। লিলিকে দেখামাএই সোনিয়া আহমেদ চোখ গুলো মুহূর্তের মধ্যেই প্রকান্ড করে হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। উনার চোখে, মুখে অতি অবিশ্বাস্যতা আর আশ্চর্যের ছাপ স্পষ্ট। জুবায়ের আহমেদ গলা খাঁকিয়ে চোখ দুটো খর্বাকৃতির করে সোনিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে অপরিস্ফুট স্বরে বললেন,,

“লিলি গ্রাম থেকে এসেছে সোনিয়া। আমাদের এখানে কয়েকদিনের জন্য থাকবে বলে।”

লিলি বিস্তর বিস্মিত চোখে জুবায়ের আহমেদের দিকে দৃষ্টিপাত করল। জুবায়ের আহমেদ ফিসফিসিয়ে লিলির কানে বলল,,

“আগে কয়েকটা দিনের জন্য এখানে থাক। মাথা গোঁজার জায়গাটা করে নে, এরপর না হয় আমি সোনিয়ার সাথে আস্তে ধীরে কথা বলে এই বাড়িতে তোর স্থায়ী ঠিকানা করে দিবো।”

লিলি স্বস্তিমূলক হাসি দিয়ে জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাঁড়ালো। সোনিয়া আহমেদ ছটফটিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে লিলি এবং জুবায়ের আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ক্ষীপ্ত চোখে উনি কোমড়ে হাত দিয়ে জুবায়ের আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“কয়েকদিনের জন্য থাকবে মানে? আমাদের বাড়িতে জায়গা কোথায়? খুপড়ীর মতো চারটা রুম। কোথায় থাকবে তোমার ভাইয়ের মেয়ে?”

লিলি মুখটা কালো করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জুবায়ের আহমেদ খানিক শঙ্কিত হয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বললেন,,

“এতো রেগে যাচ্ছ কেনো সোনিয়া? রেশমি আর রনকের স্টাডি রুমটা তো রাতের বেলায় ফাঁকাই থাকে। ঐ রুমটাতে না হয় কয়েকদিনের জন্য লিলি থাকবে। কয়েকদিন পর তো মেয়েটা চলেই যাবে।”

সোনিয়া আহমেদ জুবায়ের আহমেদের থেকে চোখ ফিরিয়ে পাশেই চুপসে দাঁড়িয়ে থাকা লিলির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে লিলিকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীপ্ত স্বরে বলল,,

“এই তুই এমন লাল বেনারসি পড়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বাড়ি থেকে কি এই লাল বেনারসি পড়েই এসেছিস?”

লিলি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সোনিয়ার আহমেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,

“হুহুহুম চাচি।”

সোনিয়া আহমেদ হেয় স্বরে বললেন,,

“শহরে আসবি বলে খুব সেজে গুজে এসেছিস তাই না? রঙ্গচঙ্গে শাড়ি। আহ্ কি ভাব। আমাদের শহরে তোর বয়সী মেয়েরা শাড়ি পড়ে এভাবে ঘুড়ে বেড়ায় না বুঝেছিস? এখানে মেয়েরা বিয়ের পরে ও শাড়ি পড়তে চায় না।”

লিলি মাথা নিচু করে ক্ষীন স্বরে বলল,,

“শাড়িটা পাল্টে নিবো চাচি। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।”

“তাড়াতাড়ি পাল্টে নে। আর শোন, সাতদিনের বেশি আমাদের বাড়িতে থাকা যাবে না। তোর চাচার কি এটা নিজস্ব বাড়ি যে, সারাজীবন থাকলে ও সমস্যা হবে না। এটা আমার বাপের বাড়ি৷ দু দুটো পরিবার এই বাড়িতে থাকি। আমাদের নিজেদেরই এখানে থাকতে, চলতে, ফিরতে খুব অসুবিধে হয়।”

লিলি কান্না মিশ্রিত স্বরে বলল,,

“চলে যাবো চাচি৷ খুব শীঘ্রই চলে যাবো।”

“ঠিকাছে যা। শাড়িটা পাল্টে নে। তোকে এই ভারী শাড়িতে দেখে আমার নিজেরই অসহ্য লাগছে।”

লিলি আতঙ্ক মিশ্রিত কন্ঠে সোনিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া ঈষৎ ছোট করে বলল,,

“আমি তো বাড়তি কোনো জামা আনি নি চাচী। শাড়ি পাল্টে কি পড়ব?”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here