শিউলিবেলা,পর্বঃ ১৬,১৭
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৬
পিথিউশা যন্ত্রমানবের মতো ঠোঁট নেড়ে বলে,
-“আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম একটা বেগুনী সুতি শাড়ী পরা অবস্থায়। রাস্তার পাশে বাচ্চাদের আইসক্রিম কিনে দিচ্ছিলেন আপনি… প্রথম দেখাতেই আপনাকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো আমার।”
অতসীর মলিন বদনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে, গম্ভীর স্বরে বলে,
-“আপনি প্রথমবার যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সে মানুষটাও অরিত্রী ছিলো। আমি কখনো এসবে আগ্রহী ছিলামই না…”
আস্তে আস্তে পিথিউশার মাথার জট খুলতে শুরু করলো, যে মেয়েটাকে সে অতসী ভেবেছে তাকে বেশিরভাগ সময়েই অতি সাধারন সাজ পোশাকে দেখে অভ্যস্ত সে। কখনো ভাবেই নি, সে দুটো ভিন্ন মানুষকে দেখছে বা একজন সেলিব্রেটি এতঁ সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে না। তাছাড়া যেদিন রাতে অমিত তাকে দুঃসংবাদটা দিলো সেদিন সারাদিন তো অরিত্রী তার সঙ্গে ছিলো, একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে অনেক আগেই ব্যাপারটা তার কাছে ধরা পড়তে পারতো। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই মনে মনে গালি দিলোো পিথিউশা। কিন্তু অরিত্রী সব জেনে চুপ রইলো কেনো? তাকে কিছু জানালো না কেনো? তবে কি অরিত্রীও সবার মতো ভাবছে যে পিথিউশা অতসীকে ভালোবাসে? পিথিউশা অতসীর মুখের কাছে ঝুঁকে ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-“অরিত্রী এখন কোথায়? ওনার সঙ্গে আমার কথা বলাটা ভীষণ জরুরি।”
চোখের জল মুছে অতসী বলে,
-“আপনাকে আমি অরিত্রীর কাছে নিয়ে যাবো। তার আগে বিয়ের পাকাকথা আটকাতে হবে…”
পিথিউশা আর অতসী দ্রুত নিচে নেমে আসে, কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেছে… ওরা নিচে নামতেই আরজু হক অতসীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়ালেন। মুচকি হেসে বললেন,
-“ওয়েলকাম টু আওয়ার ফ্যামেলি অতসী, আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার তোমাদের বিয়ে।”
২২
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সময় বয়ে চলে, বয়ে চলছে অরিত্রীর জীবন তরীও। ঢাকা ছাড়ার পর তার সঙ্গে পিথিউশার আর কথা হয় নি, তবে মনে মনে সে প্রতিনিয়ত পিথিউশার সঙ্গে কথা বলে… আজও অন্ধকার রাতে তার মনের জানলায় পিথিউশার আবছা মূর্তিটা বারংবার উঁকি দেয়, সে মুহূর্তে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলোকে বেশ জীবন্ত মনে হয় অরিত্রীর। মনে হয় এইতো কিছুদিন আগের কথা, মানুষটা তাকে কতো গভীর দৃষ্টিতেই না পর্যবেক্ষণ করতো! পরমুহূর্তে মনের কার্ণিশে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি তাকে দেখতো পিথিউশা? নাকি অতসী নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অরিত্রীর মনটা তাকে কখনো ছুঁতেই পারে নি! যদি পারতো তবে এতো সহজে অতসীকে বিয়ে করলো কি করে পিথিউশা? নাম না জানুক, মানুষটাকে তো সে জেনেছিলো, ভালোবেসেছিলো… থমকে যায় অরিত্রীর পৃথিবী, মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, পিথিউশা কি তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছিলো? যদি ভালোই বাসবে তবে, দুটো মানুষের পার্থক্য কেনো তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করলো না? পরমূহূর্তে নিজের চিন্তা দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসে অরিত্রী। তাচ্ছিল্যের সুরে বিড়বিড় করে বলে, “এমনটা তো হবারই ছিলো, সে তো শুরু থেকেই অতসীকে চাইতো। তুমিই তো উপযাচক হয়ে বোনের ভালোবাসায় নিজের নামের সিলমোহর বসাতে গিয়েছিলে অরিত্রী। হলো তো এবার তোমার শিক্ষা? তুমি এতো নিচ অরিত্রী? শেষমেশ কিনা তোমায় ঠেকে শিখতে হলো! ধিক, তোমায় শত ধিক…”
সকালের নাস্তা শেষে নানাভাইকে পত্রিকা পড়ে শুনাচ্ছিলো অরিত্রী, মোসাদ্দেক হাওলাদারের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি লোপ পেলেও জানার ইচ্ছা বিন্দুমাত্র কমে নি। এখনো হাতের কাছে কোনো বই বা ম্যাগাজিন পেলে উল্টে পাল্টে দেখেন। নিয়ম করে কবিতা আবৃত্তি করেন, ডাক্তারের বারনও শোনেন না। অরিত্রী আসার পর যদিও তার রোজকার রুটিনে পরিবর্তন ঘটেছে, সকালের নাস্তার পর নানাভাইকে পত্রিকা পড়ে শোনানোর দায়িত্ব নিয়েছে সে। কাজটা করতে তার ভালো লাগে, বেশ কিছুটা সময়ের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। আজও প্রতিদিনের মতো পত্রিকা পড়ে শুনাচ্ছিলো সে কিন্তু যে মুহূর্তে অরিত্রীর দৃষ্টি আজকের তারিখটার দিকে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে তার নিঃশ্বাস থেমে গেলো। অমিতের কাছে সে অতসী আর পিথিউশার বিয়ের তারিখটা শুনেছিলো, কিন্তু মন বারংবার চাইছিলো দিনটি না আসুক, ক্যালেন্ডার থেকে দিনটি মুছে যাক। এক মুহূর্তের জন্য অরিত্রীর মনে হলো সে পৃথিবীর বাহিরে অন্য কোনো গ্রহে আছে। যেখানে তার কানে কোনো শব্দ পৌঁছায় না, তার দৃষ্টি সীমানায় কোনোকিছু স্পষ্ট দেখায় না… সে থমকে গেলো এবং একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
জ্ঞান ফেরার পর অরিত্রী কাউকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না, প্রতিদিনের মতো নানাভাই-নানুআপুর সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলো। বাড়ির সবাই ঘুমানোর পর ত্রস্ত পায়ে অরিত্রী বাড়ির পেছনের শিউলি গাছতলায় এসে বসলো। ছোটবেলায় নানাভাই তাকে এ গাছটা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “যতোবার তুমি এ গ্রামে আসবে ততোবার এ গাছটা তোমায় কুর্ণিশ করে স্বাগতম জানাবে। পৃথিবীর অন্য কোথাও তুমি রানীর সম্মান না পেলেও এ গাছটার মালিক তুমি, এ গাছটার জন্য তুমিই তার রানী।” এখন শরৎ এর মাঝামাঝি, শিউলি গাছটা আজ ফুলে ফুলে সুবাসিত। অথচ তার সুবাস, মাধুর্য, এই অপরূপ সৌন্দর্যের কিছুই অরিত্রীকে ছুঁতে পারলো না। এমনই এক শরৎ মাসে গতবছর পিথিউশার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিলো, সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়… তখনও শরৎকাল ছিলো এখনও শরৎকাল তবে পার্থক্যটা এই তখন পিথিউশার পাশে গুপ্ত পরিচয়ে অরিত্রী ছিলো আর এখন নিজের সত্য পরিচয়ে অতসী আছে! সে সময়টায় অরিত্রী ছিলো সাতরঙ্গা অনুভূতিতে টইটুম্বুর আর আজ যন্ত্রমানবের মতো অনুভূতিশূণ্য…
হাতে ধরা কাঠের বাক্স থেকে একগুচ্ছ শুকনো শিউলি ফুল মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো অরিত্রী। সঙ্গে তার আর পিথিউশার কিছু ছবি, এ ছবিগুলো ওদের বাড়িতে আসার পর তুলেছিলো অমিত। পিথিউশার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় সবকিছু মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো অরিত্রী। একের পর এক দিয়াশলাই এর কাঠি জ্বালিয়ে ফেলছিলো সে জিনিসগুলোর মধ্যে… চোখের সামনে জ্বলছিলো কিছু নির্জীব বস্তু কিন্তু বাস্তবে পুঁড়ছিলো অরিত্রীর মন। শোকাহত মানুষের মতো বিলাপ করে সে মাটিতে বসে কাঁদছিলো, একসময় আগুনের ধোঁয়া বাড়ির ভেতরের মানুষগুলোর নিদ্রাভঙ্গ করে। ছুটে আসে তারা, অরিত্রী তখনও কাঁদছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের অগ্নিশিখার দিকে। তার আর পিথিউশার মাঝে যা ছিলো আজ যে তা অনন্তকালের জন্য চুকে গেলো! আজ থেকে পিথিউশা তার বোনের বর, তার ভগ্নীপতি। নিজের বোনের সংসারে তৃতীয় পক্ষ হতে সে কখনোই যাবে না, পিথিউশাকে নিয়ে তার ভাবনাটাও আজ থেকে নিষিদ্ধ হলো, এ তো পাপ… এ পাপমোচন করতেই তো সে সব স্মৃতি জ্বালালো, তার উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলো না। তবে এমন মরণ কান্নায় পেলো কেনো তাকে? কেনো এক হৃদয় বিদারক হাহাকারে তার ভেতর বাহির নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে বাঁচার আর কোনো কারনই বাকি রইলো না! কেনো?
অরিত্রীকে একপ্রকার জোর করেই বাড়ির ভেতরে আনা হলো, সে তখনও কাঁদছে। কান্নার দমকে একটু পরপর শরীর কেঁপে উঠছে… সে রাতে মর্জিনা অরিত্রীর পাশে শুলেন। সারারাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো অরিত্রী। অরিত্রী ঘুমানোর পর মর্জিনা নিজের ঘরে গেলেন। মোসাদ্দেক হাওলাদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“আপনে মিনতিরে কন ছোড নাতিনে যা চায় তাই দিয়া দিতে। বড় নাতিনের জন্য আমরা না হয় ভালো পাত্র খুঁজবো… তাছাড়া আমাদের তো টাকা আছে, আইজকাইল কতো কিরিম আছে দাগ যাওনের… ঠিক ঠিক বড় নাতীনের মুখের দাগ যাইবো গা। বুঝতাছি না, মিনতির বুদ্ধি-সুদ্ধি এতো কমলো কেমনে! এক বইনের পেরেম আরেক বইনেরে দেয় কেউ? অরিত্রীডাও ছাগল, যার জন্য কাইন্দা মরোস তারে কেন দিল দরদী হইয়া বইনরে দিতে গেলি? কইতে পারলি না, আমার ভালোবাসা আমার।”
মোসাদ্দেক হাওলাদারের কপালে চিন্তার ভাজ, মর্জিনার কথা তিনি ফেলতে পারছেন না আবার অতি আদরের কন্যার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করতে পারছেন না। মা-বাবার সন্তানকে শাসন করার, তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নিঃসন্দেহে আছে তবে সে সন্তান যখন নিজে মা বা বাবা হয়ে যায় তখন কি অধিকার ফলানো খাটে বা তাদের ভুল ধরা সাজে? মোসাদ্দেক হাওলাদার মর্জিনাকে ইশারায় বসতে বললেন, নিজেও নড়েচড়ে বসলেন। দু’বার কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
-“ছোড নাতিনের লগে যা হইতাছে তা আমারও পছন্দ না তবে মিনতি তো ওর মা… সে তার সন্তানদের ভালো চাইবো। সে তো সব জাইনাই সিদ্ধান্ত নিছে তাই না? মা-বাপ হিসাবে আমাদের উচিত তার উপর ভরসা রাখা, নিজের সন্তানের উপর ভরসা রাখতে না পারলে হইবো?”
-“পোলাডার জইন্য খারাপ লাগে, দুই বইনের মাঝখানে পইড়াতো চ্যাপ্টা হই যাইবো। না পারবো ডানে যাইতে, না পারবো বামে… মাঝখানে কাকতারুয়ার মতো খাড়াই থাকোন লাগবো। এ জন্যই কয়, পোলা মাইনশের বেশি ডকের হওন ভালো না। চৌদ্দ নারীর নজর পড়ে… নজর দোষ বড় দোষ, এই দুই নারীর মাঝখান থেইকা পোলাডারে বাইর করবো কে?”
চলবে…
শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৭
মোসাদ্দেক হওলাদার বিরক্ত হয়ে বলেন,
-“তুমি নিজের মেয়ে আর নাতিনদের কথা না ভেবে ওই বাইরের ছেলের কথা ভাবতে যাচ্ছো কেনো? ঘরের খেয়ে বনের মশা তাড়ানোর অভ্যাস বাদ দাও তো।”
-“বাদ দিতাম মানে? আমার মাইয়া, আমার দুই নাতিন একটা মানুষরে ঠকাইবো আর আমি চুপচাপ দেখমু আর সইয়া যামু? এমন অধর্ম নিজ চোক্ষে দেইখা মুখে কুলপ আটতে কন আপনে আমারে? এই আপনের তিরিশ বছরের শিক্ষকতার ফল? যার নিজের জ্ঞান সংক্ষিপ্ত সে অন্যরে কোন ঘোড়ার ডিমটা শিখাইবো? নিজের ভালো তো সকলেই বুঝে পরের ভালো কয়জনে বুঝে শুনি? পরের ভালো চায় যে জন, সদা সর্বদা তার ভালো হবে এ তো বাণী চিরন্তন। বুঝছেন?”
মোসাদ্দেক হাওলাদার বিরক্তির চরম পর্যায়ে গেছেন, তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,
-“বুঝলাম, এবার চুপ করে ঘুমাও। পারলে আজ রাতটা অরিত্রীর সঙ্গে থাকো, ওর একা থাকাটা ঠিক মনে হচ্ছে না। আর দয়া করে নিজের অদ্ভুত যুক্তিগুলো দেয়া বন্ধ করো। আমার আর ভালো লাগছে না…”
মর্জিনা আর কথা বাড়ায় না, ধীর পায়ে অরিত্রীর ঘরের দিকে রওনা দেয়… এ মুহূর্তে সে কিছুতেই অরিত্রীকে একা ছাড়তে পারবে না। তার অনেক কষ্টের সন্তান মিনতি, সেই মিনতির মেয়ে অরিত্রী। তাকে কষ্ট পেতে দেখলে তো মর্জিনারও হৃদয় হাহাকার করে… মর্জিনা সারারাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে, আল্লাহর দরবারে আঁচল পেতে অরিত্রীর মানসিক প্রশান্তি কামনা করে, সুখ ও সমৃদ্ধি চায়…
২৩
খোলা জানলা দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করে অরিত্রীর মুখস্পর্শ করছে… আধো ঘুম, আধো জাগরণে অরিত্রী পাশ ফিরে শুলো। পিটপিট করে চোখ খুলে অরিত্রী দেখলো জানলার কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে পিথিউশা, তার হাতে একগুচ্ছ শিউলি ফুল। প্রশান্তিতে অরিত্রীর মন ভরে গেলো, সে এখন শিউলি ফুলের সুবাস পাচ্ছে, চোখের সামনে পিথিউশাকে দেখতে পাচ্ছে, আর কি চাই! এ যদি স্বপ্ন হয় তবে সে এই স্বপ্নে সারাজীবন থাকতে চায়। যেখানে পিথিউশা তার ভগ্নীপতি নয়, নিজের মানুষ, একান্ত নিজের। যে প্রতিদিন সকালে অরিত্রীর ঘুম ভাঙার জন্য একমুঠো শিউলি ফুল হাতে অপেক্ষা করে…
অরিত্রী সিদ্ধান্ত নিলো সে আর কাঁদবে না, সে তার মনের পিথিউশাকে সারাজীবন ভালোবাসবে, কারন বাস্তবের পিথিউশার চেয়ে তার কল্পনার পিথিউশা অনেক বেশি জীবন্ত এবং আপন।
অরিত্রী হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির পেছনে গেলো, শিউলি গাছতলা ফুলে ফুলে সমাদৃত… অরিত্রী হাত বাড়িয়ে একগুচ্ছ শিউলি ফুল তুলে নিলো। তখন ভোরের নরম আলো বাড়ির ঘাটবাঁধা পুকুরের পানিতে দোল খাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে অরিত্রীর ভারি অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হলো, একটা কলা গাছ থেকে পাতা কেটে সেগুলোকে টুকরো টুকরো করে নিলো। তারপর এই খন্ড খন্ড কলা পাতায় শিউলিগুচ্ছ নিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিতে লাগলো। ক্ষণিকের মাঝেই পুকুর জুড়ে শিউলি ভাসতে লাগলো, সূর্যরশ্মি সেই শিউলিগুলোকে বারংবার ছুঁয়ে দিচ্ছিলো… অরিত্রীর মনে হলো, এ দৃশ্য পৃথিবী নামক ভূখন্ডের হতেই পারে না। এ দৃশ্য দৈবিক, এ দৃশ্য স্বর্গীয়…
সে মুহূর্তে অরিত্রী নিজের পাশে একটা ছায়ামূর্তি টের পেলো, তার ঠিক পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ভূতগ্রস্তের মতো অরিত্রী ঘুরে তাকালো, সামনের মানুষটাকে দেখামাত্র সে স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেলো। মৃগী রোগীর মতো তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো… ছুটে এসে তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো পিথিউশা। ছিটকে দু’হাত পিছিয়ে গেলো অরিত্রী। বিড়বিড় করে বললো, “আমাকে স্পর্শ করবেন না, এ পাপ। ঘোর পাপ…” অরিত্রীর কথা পিথিউশার কানে গেলো কি না ঠিক বুঝা গেলো না, সে শেখানো বুলির মতো প্রশ্ন করলো,
-“আমার সঙ্গে যার দেখা হয়েছিলো সে অতসী নয় অরিত্রী এ সত্যটা গোপন করলে কেনো? এটা জানার অধিকার কি আমার ছিলো না?”
মানুষ কোনো অন্যায় করলে সে অন্যায়ের জবাবদিহিও তাকে এই এক জীবনেই করে যেতে হয়। অরিত্রী মনে মনে জানতো, কখনো না কখনো এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে, তবে সে দিনটা যে এতো দ্রুত তার জীবনে আসবে তা জানা ছিলো না তার। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অরিত্রী বললো,
-“আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয় নি তাই জানাই নি। তাছাড়া আমি তো মিথ্যা বলি নি, কেবল সত্যটা প্রকাশ করি নি…”
পিথিউশা তার স্বাভাবসুলভ গম্ভীর স্বরে বললো,
-“আমার স্পর্শে যদি পাপ থাকে তবে সত্য লুকানোও তো পাপ।”
-“আমার অন্যায় হয়ে গেছে, ক্ষমা করবেন ভাইয়া।”
পিথিউশা রহস্যময় হাসে, তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা গালে সুন্দর ভাজ পড়ে। আলতো হাতে গাল চুলকে বলে,
-“তোমার ভাইয়া হতে আমার বয়েই গেছে, আমার যে ক্ষতি হলো তার ক্ষতিপূরণ না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না, তোমাকেও যেতে দেবো না।”
অরিত্রী কি বুঝলো কে জানে, হাতে ধরা কলাপাতা ফেলে বাড়ির দিকে দৌঁড়ে চলে গেলো। দিগ্বিদিক শূণ্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছে অরিত্রী, হঠাৎ ধাক্কায় তার হুঁশ হলো। সামনে মূর্তিমান অতসীকে দেখে ভয়ে ঢোক গিললো সে, এখন যদি অতসী জানে অরিত্রী পিথিউশার সঙ্গে ছিলো এতোক্ষণ তবে নির্ঘাত যা তা বলবে। অতসীকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো অরিত্রী, অতসীই পথ আটকালো। খুব সাবধানি গলায় বললো,
-“বিয়েটা হয় নি অরিত্রী, আমরা একটা মিথ্যা সম্পর্ককে বিয়ে অবধি টেনে নিতে পারি নি।”
মুহূর্তেই অরিত্রীর বুকে চেপে বসা পাথরটা সরে গেলো, যে ভাবনাটাকে কিছুক্ষণ আগেও সে পাপ ভাবছিলো সে ভাবটাকেই এখন তার স্বর্গীয় মনে হতে লাগলো। অতসীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অরিত্রী ছুটে গেলো পুকুর পাড়ে। ঘাটলা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করছে পিথিউশা। মুঠোভর্তি শিউলি ফুল কলাপাতায় নিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে পুকুরের জলে। অতসীর মনে হলো, সামনের মানুষটা কোনো অচিন রাজ্যের রাজপুত্র। যার ভেতর বাহির সবটাতেই মাধুর্যের ছড়াছড়ি। অরিত্রী খুব সাবধানে পিথিউশার পাশে গিয়ে সিঁড়িতে বসলো। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
-“আপনি যে আপুকে বিয়ে করেন নি সে কথাটা আমায় জানালেন না কেনো?”
-“তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয় নি তাই জানাই নি। তাছাড়া আমি তো মিথ্যা বলি নি, কেবল সত্যটা প্রকাশ করি নি…”
অরিত্রীর কিছুক্ষণ আগের কথাটাই তাকে ব্যঙ্গবাণীর মতো করে শোনালো পিথিউশা, তবে তাতে তার বিশেষ কষ্ট হলো না। বরং এ মুহূর্তে তার সুখই হচ্ছে… ওই যে, হারাতে হারাতেও পেয়ে যাবার সুখ, ঠিক তেমন। অরিত্রী মুখ টিপে হেসে আবার প্রশ্ন করলো,
-“যদি সত্যিটা না জানানোরই হবে তবে এতোটা পথ জার্নি করে এলেন কেনো?”
পিথিউশা গমগম স্বরে বললো,
-“একজন আমার অনেক বড় ক্ষতি করে কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছে। আমি আমার ক্ষতির ক্ষতিপূরণ নিতে এসেছি।”
অরিত্রী বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কি ক্ষতিপূরণ চাই আপনার মহামান্য পিথিউশা?”
-“ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার একটা রানী আর একজোড়া রাজকন্যা বা রাজপুত্র চাই। যে আমার রাজ্য খালি করে পালিয়ে এসেছে তাকে সারাজীবনের জন্য আমার বন্দিনী বানাতে চাই…”
এবার শব্দ করে হাসে অরিত্রী, পিথিউশার হাত থেকে কলাপাতা নিয়ে তাতে একমুঠো শিউলি ফুল দিয়ে পানিতে ভাসাতে ভাসাতে বলে,
-“এ শিউলিবেলায় কথা দিচ্ছি, আমি আপনার যে ক্ষতি করেছি তার ক্ষতিপূরণ আমার বাকি জীবন দিয়ে দেবো…”
পিথিউশা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে,
-“শিউলিবেলা!”
অরিত্রী মুচকি হাসে, তার সে হাসির ঝলক চোখে মুখে পড়ে, বেশ ভূমিকা করে বলে,
-“এই যে সকালের নরম রদ্দুর পানিতে ভাসতে থাকা শিউলি ফুলে পড়ছে এ সময়টা কি স্বর্গীয় নয়? এ স্বর্গীয় মুহূর্তের নাম আমি দিলাম শিউলিবেলা। এ স্বর্গীয় মুহূর্তে কথা দিচ্ছি, আমার বাকি জীবনটা আমি আপনার নামে সঁপে দিলাম।”
একটু থেমে দম নেয় অরিত্রী, তারপর শিউলি গাছটার দিকে আঙুল তাক করে বলে,
-“এ গাছটা যেদিন নানাভাই রোপণ করেছিলেন, সেদিন নানাভাই বলেছিলেন আমি এ গাছটার রানী। আমি এ গ্রামে আসলেই এ গাছটা আমায় কুর্ণিশ করবে। আজ, এ মুহূর্ত থেকে আপনি এ গাছটার রাজা, দেখুন না কেমন কুর্ণিশ করে স্বাগতম জানাচ্ছে গাছটা আপনাকে…”
মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে যায় পিথিউশা, গাছ তলা থেকে একমুঠো শিউলি ফুল তুলে অরিত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-“আজ থেকে তোমার চোখে সুখের অশ্রু ঝরবে অরিত্রী, তোমার দুঃখের অশ্রুরা আজ এই স্বর্গীয় মুহূ্র্তে চির বিদায় নিলো…”
অরিত্রী প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারলো না, কেবল হাত বাড়িয়ে শিউলি ফুলগুলো নিলো। তারপর বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো। পিথিউশা ধীর পায়ে তার পিছু পিছু হাঁটছে, অরিত্রীর ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, এটুকু সুখই তো সে সারাজীবন চেয়েছে… তবে কি বিধাতা তার প্রতি সুপ্রসন্ন? এই যে যা কখনো পাবে না ভেবেছিলো, তা হুট করেই পেয়ে গেলো! জীবনটা এতো সুখের কেনো?
চলবে…