অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত – ৬
এ রহমান
রুফ টপ রেস্টুরেন্টের সেই চেনা টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে দুজন মানব মানবী। একজন নিজের ভেতরের হাহাকার নিয়ে ভীষন ব্যাস্ত। বাকি কোনো কিছুর দিকেই তার খেয়াল নেই। আর একজন অপরপাশের মানুষটার উপরে ভীষন বিরক্ত। কিন্তু বিরক্তির চেয়ে অসহায়ত্ব টাই বেশী। হতাশ শ্বাস ছাড়লো ইভান।
— ইফতিকে কি বলেছ তুমি?
ইভান এর গুরু গম্ভীর আওয়াজ নীরবতার দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলো। ঈশা চমকে উঠলো কিছুটা। কোমল দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানে আবারও দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভান কোন উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো। গম্ভীর কণ্ঠ নরম করে নিয়ে বলল
— ইফতিকে বলেছিলে তুমি সুইসাইড করবে?
ঈশা কয়েকবার অস্থির পলক ফেলে মাথা নাড়লো। ইভান ধমকে উঠে বলল
— কেনো?
ঈশার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে তাকাল। কঠিন গলায় বলল
— বলবো না কেনো? আমি এখানে এসেছি সেটার কারণ কেনো ইফতিকে জানতে হবে। সে কারণ জানার জন্য আমাকে ফোর্স করেছিলো। তাই রাগ করে বলেছি সুইসাইড করতে এসেছি।
ঈশা থেমে যেতেই ইভান বলল
— তুমি এখানে কেনো এসেছো?
ঈশা ভীষন অসহায়ের মতো তাকাল। এই প্রশ্নের উত্তরটা তার নিজের কাছেই নেই। সে কিভাবে এই উত্তর দিবে? ভার্সিটির ক্লাসের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। কিন্তু তার ভীষন মন খারাপ হয়। আর এই রেস্টুরেন্টে চলে আসে। একা একা বসে ভাবছিল সে। তখনই ইফতি ফোন দিয়ে জানতে চায় ক্লাসে কখন যাবে। ঈশা সহজ সাভাবিক ভাবে জানিয়ে দেয় ক্লাসে যাবে না। ইফতি কারণ জানতে চাইলে সে এখানে আসার কথা বলে। সেটার কারণ জানতে চাইলে ঈশা ভীষন রাগ করে আর বলে সুইসাইড করতে এসেছে। ইফতি ভয় পেয়ে যায় আর সাথে সাথে ইভান কে জানায়। ইভান জানতে পেরেই আর দেরি না করেই সেই রেস্টুরেন্টে চলে আসে। এই অবস্থায় ইভান কে দেখে ঈশা অবাক হলেও মনে মনে বেশ খুশি হয়। ইভান আবারও বলল
— আমার কথার উত্তর দাও ঈশা।
ঈশা চোখ তুলে তাকাল। মৃদু স্বরে বলল
— জানি না।
ইভান এর দৃষ্টি অসহায় হয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল
— এরকম পাগলামির কোন দরকার ছিল কি? তোমার জন্য আমাকে এই সকাল বেলা এখানে আসতে হলো।
ঈশা রাগে ফুঁসে উঠলো। বলল
— কেনো এসেছেন? আপনাকে আমি আসতে বলেছি?
ইভান ভীষন আদুরে কণ্ঠে বলল
— বলোনি?
ঈশা থেমে গেলো। সমস্ত কথা কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। কি ভীষন আবেগ কথার মাঝে। সমস্ত অনুভূতি মিশিয়ে দিয়েছে কণ্ঠে। চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান বুঝতে পেরেই মুচকি হাসলো। বলল
— সব কথা মুখেই যদি শুনতে হয় তাহলে এতদিন কি করলাম আমি? আমার তো পুরো জীবনটাই বৃথা। এ জীবন রেখে কি লাভ? তবে এটা সুইসাইড করার জন্য পারফেক্ট জায়গা নয়। অন্য কোন জায়গা খুঁজতে হবে।
ইভান এর এমন কৌতুক পূর্ণ কথা শুনে ঈশা আরো রেগে গেলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
— মজা করছেন আমার সাথে?
ইভান সহজ সাভাবিক ভাবেই বলল
— মোটেই না। আমি মজা করার মতো ছেলেই না। চলো।
ঈশা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— কোথায় যাবো?
ইভান উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল
— সুইসাইড করার জন্য পারফেক্ট জায়গা খুঁজতে যাবো। তারপর নিজের খেয়াল খুশী মতো সুইসাইড করবো। মরার জন্য হলেও এট লিস্ট নিজের মনের কথাটাকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।
ঈশা হতভম্ভ হয়ে গেলো। ইভান এমন ভাবে কথাটা বলল যেনো একদম সত্যিই সে এমন কিছুই করতে যাচ্ছে। ঈশা কে বসে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
— বসে আছো কেনো? সুইসাইড করবে না বুঝি? প্ল্যান ক্যানসেল করেছো?
ঈশা রেগে গেলো। ইভান কঠিন গলায় বলল
— আসো।
ঈশা প্রচন্ড রাগ নিয়ে উঠে দাড়ালো। ইভান এর পিছু পিছু গেলো। গাড়িতে উঠে বসে ইভান স্টার্ট দেয়ার আগ মুহূর্তে খেয়াল করলো ঈশার পাশের জানালাটা খোলা। সেদিক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। সামনে তাকিয়ে বলল
— জানালাটা লাগাও। ঠান্ডা লাগবে।
ঈশা সেদিকে ঘুরে তাকাল। মৃদু স্বরে বলল
— লাগুক।
ঈশার এমন জেদ ইভানের পছন্দ হলো না। ঈশার দিকে ঝুঁকে জানালা বন্ধ করে দিলো। এর ফলে দুজনে অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। ইভান এর পারফিউমের সৌরভে চারিদিক কেমন মো মো করছে। দু পাশের জানালা বন্ধ থাকায় ভেতরের আবদ্ধ বাতাসে সেই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ইভান জানালা বন্ধ করে ঈশার কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো অবস্থা তার। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। ইভান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ঈশার মুখের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো সাবধানে কানের পেছনে গুঁজে দিলো। এতটাই সাবধানে যে তার আঙ্গুল ঈশার গাল পর্যন্ত স্পর্শ করলো না। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইভান নিঃশব্দে হেসে সরে গেলো। গাড়ি চলতে শুরু করতেই ঈশা চোখ মেলে তাকাল। ইভান সামনে তাকিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তার মুখভঙ্গি বেশ সাভাবিক। ঈশা লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলো। যেনো এতক্ষণ ভারী কোন কিছুর চাপে তার নিশ্বাস একদম আটকে ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সভাব বশত ঈশা বলল
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ইভান বেশ সাভাবিক ভাবেই বলল
— বিশ্বাস নাই নাকি করতে চাইছো না?
ঈশা মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— সেরকম কিছু না। এমনিতেই জানতে ইচ্ছা করছিলো। তাছাড়া আমার ক্লাস আছে।
— এতক্ষণ মনে হয়নি ক্লাস আছে? এখন হুট করেই মনোযোগী স্টুডেন্ট হয়ে গেলে যে?
ঈশা সামনে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল
— আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।
— কেনো?
ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল
— কারো সাথে যাওয়ার জন্য একটা সম্পর্কের দরকার পড়ে। আমি তো আপনার কেউ না। গার্ল ফ্রেন্ড হলেও একটা কথা ছিলো।
— গার্ল ফ্রেন্ড!
শব্দটা উচ্চারণ করেই ইভান হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল
— যদি বলি তার থেকেও বেশী কিছু। তাহলে চলবে?
ঈশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলল
— মানে?
ইভান কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি এসে থামলো। ঈশা আশেপাশে তাকাল। নদীর পাশে ছোটো একটা রেস্টুরেন্টের মতো। জায়গাটা খুব সুন্দর। ঈশার খুব ভালো লাগলো। ইভান গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঈশা ভীষন অসস্তিতে পড়ে গেলো। হাতের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। সূক্ষ্ম গভীর দৃষ্টি তার ভেতরে কোথাও যেনো আঘাত করলো। অনুভূতি গুলো কেমন অগোছালো হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান কঠিন গলায় বলল
— হাতটা দাও।
ঈশা নির্বাক তাকাল। সূক্ষ্ম অধিকারবোধের চাপে মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরোলো না। কাপা কাপা হাতটা ইভানের হাতের উপরে রাখলো। ইভান মুচকি হেসে আলতো করে চেপে ধরলো। ঈশা বের হয়ে ইভানের সামনে দাড়ালো। তার হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাপছে। ইভান হাতের জোর বাড়িয়ে দিলো। দরজা বন্ধ করে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল
— আসো।
দুজন হেঁটে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে গেল। একটা ফাঁকা টেবিলে বসলো সামনা সামনি। ইভান হাত ধরেই রেখেছে। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান মুচকি হেসে বলল
— বাবার পছন্দের ছেলেকে কেমন লেগেছে সেটা বললে না যে?
ঈশা এবার চোখ তুলে তাকাল। অভিমানী কণ্ঠে বললো
— আমার কেমন লাগলো সেটাতে কি কিছু যায় আসে। আপনার তো আমাকে ভালো লাগেনি।
ইভান হাত ছেড়ে দিলো। বলল
— একদম ঠিক। কিন্তু সব থেকে বড়ো সমস্যা হলো মেয়েটা ভীষন জালাচ্ছে। তাকে এটা কোনভাবেই বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না যে আমার তাকে পছন্দ হয়নি। আমাকে নিজের প্রতি দূর্বল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কি যে করি ভেবেই পাচ্ছি না। যদি আমি কোনভাবে দূর্বল হয়ে পড়ি তখন কি হবে?
ঈশা টলমলে চোখে তাকাল। ইভান ভাবলেশহীন ভাবে অন্যদিকে তাকাল। ঈশা ভীষন হতাশ কণ্ঠে বললো
— এখানে কেনো এনেছেন?
ইভান গম্ভীর মুখে তাকাল। বলল
— সুইসাইড করার জন্য জায়গাটা একদম পারফেক্ট। পাশেই নদী আছে। তুমি তো সাঁতার জানোনা। কোন ঝামেলা ছাড়াই নদীতে লাফ দিতে পারবে।
ঈশা সবটা শুনলেও একটা কথাতেই আটকে গেলো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো
— আপনি কিভাবে জানেন আমি সাঁতার জানি না?
ইভান চমৎকার হাসলো। ঈশা মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইভান টেবিলে দুই হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলল
— আমার প্রতিটা ব্যাক্তিগত জিনিস সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা আমি রাখি। এতটাই সূক্ষ্ম ধারণা যা সে নিজেও তার সম্পর্কে জানে না।
ঈশা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান হাত বাড়িয়ে ঈশার হাতটা টেনে নিলো। পকেট থেকে একটা রিং বের করে পরিয়ে দিলো। দুই হাতে শক্ত করে ঈশার হাতটা চেপে ধরে ভীষন আদুরে কণ্ঠে বললো
— আমার ব্যাক্তিগত জিনিসগুলো শুধুই আমার। আর সেগুলোর উপরে শুধুই আমার অধিকার থাকবে। আমার মনে হয়না এখন আর আমার সাথে কোথাও যেতে তোমার সমস্যা থাকতে পারে।
চলবে….