সুখের_অ-সুখ-১৮,১৯

#সুখের_অ-সুখ-১৮,১৯
#মম_সাহা
রহস্যময়ঃ আঠারো

কুঠির ঘরের সামনে দরজায় ঝুলছে বড্ড পুরোনো এবং বিশাল একটি তালা। সুখ তালা’টার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। কতক্ষণ দরজায় টুকটাক শব্দ করলো নিজের হাত দিয়ে। অপরপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় কিনা সেই আশায়, কিন্তু কোনোরূপ সাড়া পাওয়া গেলো না। হঠাৎ সুখ খেয়াল করলো দরজার বা’পাশে একটা জানালা রয়েছে। জানালাটা আটকানো তবে মাঝে একটু ফাঁকা আছে। কিছু দেখা যায় কিনা সেই চেষ্টায় সুখ জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুপুরের কড়া রোদে শরীরে একটা উষ্ণ ভাব ভড় করলো সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ভেবে ভয় ধরলো হৃদয় গহীনে। দুপুরের রোদে বাড়ির ছাদে বসে এক আধাঁরিয়া কাক বেসুরে কন্ঠে কা কা করে যাচ্ছে। কাকের ডাক অকল্যাণের সুর,তবে এ বেলাও কী কাক অকল্যাণের সংকেত জানাচ্ছে!

সুখ মাথা নামালো জানালা বরাবর,ফাঁকাটার দিকে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ভেতরের পরিস্থিতি। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস। গভীর পর্যবেক্ষণার মাঝে ঘাঁড়ে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করলো,ছিটকে উঠলো ক্ষানিকটা। পিছে তাকাতে দেখে কাজের মেয়েটা দাঁড়িয়ে বিষ্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে।

সুখ চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। অন্য কেউ হলে তাকে লজ্জা আর অস্বস্তিতে পরতে হতো নিজের সন্দেহের জন্য। সুখের ভাবনার মাঝে কাজের মেয়েটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘আরে ভাবী! আপনি এইখানে কী দেখেন? ভাগ্য ভালো আমি এসেছি অন্য কেউ না, তা নাহলে তো এই কাজের জন্য বড় মূল্য দিতে হইতো।’

কাজের মেয়েটার কথায় ভ্রু কুঁচকায় সুখ। এখানে আসার জন্য বড় মূল্য দিতে হতো মানে! সে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘এখানে আসার জন্য বড় মূল্য দিতে হতো কেন? কী আছে এখানে?’

-‘এখানে আছে এই বাড়ির রহস্য। ধূলোর মাঝে গড়া রাজ প্রাসাদের আন্তঃ খবর।’

সুখ আরও কিছু বলার আগে পেছন থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো,
-‘মিনা, তুই আবারও উল্টাপাল্টা বকছিস?’

সুখ কন্ঠের অধিকারী ব্যাক্তিটার দিকে তাকালো,মেঘ সাহেব। সুখ অবাক কন্ঠে বলল,
-‘উল্টাপাল্টা কথা বলছে মানে?’

মেঘ মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো। মিনা নামের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
-‘আর কী বলবো অপরিচিতা, এই মিনা এমন উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে জানেন না। আমাদের বাড়িতে গত বছরের মাঝা মাঝি সময়ে দুইটা কাজের মেয়ে নেওয়া হয়েছিলো তারপর একদিন ওরা আমাদের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। তার দু একদিন বাদে এই স্টোর রুমে নাকি ও তাদের’কে দেখেছে। পরে রুমে তালা খোলার পর দেখে কিছু নেই। এমন আরও নানান রকম কথা ও ছড়ায়। আমাদের এখানের অনেক মানুষের কাছে বলে বেড়ায় আমাদের বাড়িতে অনেক রাতে নাকি মানুষের শব্দ শোনা যায়, গাড়ির শব্দ শোনা যায়, কান্নার শব্দ আসে। আরও কত কী।’

সুখ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কী পাগল! প্রথম দিন যে বলেছিলো অদ্ভুত কথা টা, সেটাও কী এমনেই বলেছিলো? নাকি সব কিছুর পিছে কারণ আছে?

-‘কী করছিস তোরা এখানে? আর মিনু,তোকে না বলেছিলাম এখানে আসতে না? এখানে কী করছিস? কাজ নেই তোর?’

একটা মেয়েলী কন্ঠে সবাই ঘুরে তাকায়। মসৃনের মা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পিছে মেঘের মা রেহেনা বেগম। মিনা নামের মেয়েটি মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘হ্যাঁ, আমি এখানে আসলেই তো রহস্য ফাঁশ হয়ে যাবে। কবে জানি নির্মম ভাবে আমিও উধাও হয়ে যাই। এ মানুষ গুলোর মাঝে কিছু তো লুকিয়ে আছে।’

মিনুর সাথে সুখ দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায় সে সবটাই সুন্দর পরিষ্কার শুনতে পেরেছে। বাকিরা অবশ্য বুঝতে পারে নি কী বলেছে এ মেয়ে। সুখ আনমনেই ভাবে,মেয়েটা কী উন্মাদ!

মেঘের মা মিনাকে চুপ থাকতে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘কী বিড়বিড় করছিস! তোকে না বলা হয়েছে এখানে আসবি না। এখানে আসলেই তুই নতুন গল্প বানিয়ে ফেলিস।’

মিনা আর কথা বলে নি কোনো,গটগট পায়ে ভেতরে চলে গেলো। সুখ মিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলল,
-‘যেহেতু ও ভুল’ই রটে তবে ওকে রেখে দিছেন কেনো? আমি তো শুনেছি যা রটে তা কিছু ঘটে।’

মেঘ অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সুখের পানে, অবিশ্বাস্যকর কন্ঠেই সামান্য হেসে বলল,
-‘আপনিও কী ওর সাথে পাগল হলেন অপরিচিতা! ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাই ভাবে উল্টোপাল্টা। আর,ও অনেক বছর পুরোনো প্রায় তিনবছর হবে তাই মায়ার বশে ওকে ছাড়তে পারি না। ও অবুঝ বলে আমরাও কি অবুঝ হবে! পনেরো বছরের মিনা’কে বাসায় এনেছিলো। কীভাবে মেয়েটাকে বের করি বলেন!’

-‘আরে মেঘ! তুমিও না, মেয়েটা নতুন এসেছে আমাদের পরিবারে। আমাদের ব্যাপারে জানতে বুঝতে ওর তো একটু সময় প্রয়োজন তাই? আমাদের সাথে মিশলেই ওর সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।’

রেহানা বেগমের এমন সুমিষ্ট আচরণে মুগ্ধ নাহয়ে পারলো না সুখ। কী সুন্দর তার আচরণ। মেঘ মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘না মা, আমি তো কেবল এমনেই বললাম। আমিও জানি অপরিচিতার সময় প্রয়োজন।’

সুখ সবার অগোচরে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। মিনা মেয়েটা এতটাও অবুঝ না। সব কথা কী কেবল হাওয়ায় গড়া প্রাসাদ নাকি মাটির উপরে ভিত্তি আছে? কোনটা বিশ্বাস করবে সে?

___

“আমার ভাইকে জালে ফাঁসালে কেনো সুখোবতী? আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য? ছিহ্! তুমিও তোমার বাবার মতন।”

কথাটির পর ভীষণ জোড়ে একটা চড়ের শব্দ হলো এবং তারপর নিরবতায় ঘিরে গেলো রুমটা।

সন্ধ্যার মুহূর্ত বারান্দায় বসে অনুভব করছিলো সুখ। মেঘ বাহিরে গিয়েছিলো একটু কাজে। সেই সময়’ই মসৃনের আগমনে সুখ একটু অস্বস্তি অনুভব করলো কিন্তু পরক্ষণেই মসৃনের বলা কথা টাই অস্বস্তি সরিয়ে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, অতঃপর সশব্দে চড়।

মসৃন গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি,তুমি আমাকে চড় মারলে সুখোবতী? আমাকে?’

-‘কেনো? চড় কী আপনাকে মারার কথা ছিলো না? এই চড়টা সেদিন বিয়ের আসরে মারা উচিৎ ছিলো। আমি আমার বাবার মতন হয়েছি তাই না! তা আপনি কী মহাপুরুষ? আপনার ঐ মুখে আমার বাবার নাম নিবেন না। আপনার চেয়ে আমার বাবা হাজার হাজার গুণ ভালো ছিলো। তখন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে হয়তো বিয়েটা করতে পারে নি তাই বলে তার জীবন সবটাই খারাপ কাজে অতিবাহিত হয় নি। আর আপনি, আপনি কী করেছেন বলুন! একটা কাজের রেশ ধরে রেখে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন, আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করলেন। আর আপনার এই কৃতকর্মের জন্য আমার বাবাটা আমায় এই পুরো দুনিয়ায় একা ছেড়ে চলে গেলো। আপনি আমার বিষন্নতার কারণ। আপনি আমার আকাশসম অ-সুখের কারণ।’

মসৃন জেনো একটু থমকে যায়। দু’কদম পিছিয়ে যায়। অবাক কন্ঠে বলে,
-‘তোমার বাবা আর বেঁচে নেই!’

-”আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন, তাহলে অবাক হচ্ছেন কেনো? খুশি হোন। মিথ্যে কথার মায়ায় ফেলে বিয়ের আসর অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আমায় তাই না? মেঘের মা একা কাটাচ্ছে দিন, এটাই বলেছিলেন তাই না? তাহলে, মেঘ এর পরিচয় কী মসৃন?যার প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিলেন সে তো আমায় নির্দ্বিধায় মেনে নিলো। আর আপনি কিনা আমাদের জীবনটা শেষ করে দিলেন।”

মসৃন উত্তর দেয় না। কিছুটা সময় নিশ্চুপ রয়। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই সুখের দিকে তাকায়। চারপাশে তখন সন্ধ্যা গাঢ়ো হয়ে রাত নেমেছিলো। সুখের অশ্রুসিক্ত চোখ গুলো তবুও জানান দিচ্ছে অশ্রুর উপস্থিতি। মসৃন সেখাে পাত্তা না দিয়ে অবাক কন্ঠে বলে,
-‘তোমাদের জীবন মানে? ওয়েট ওয়েট,একটু আগে বললে তোমার বোনের জীবনও নষ্ট করেছি। কী করেছি আমি?’

সুখ দ্বিগুণ রেগে কিছু বলতে গেলেই বারান্দার দরজায় মেঘের উপস্থিতি টের পায়। মেঘ তড়িৎগতিতে এগিয়ে আসে সুখের দিকে। সুখ থমকে যায় সাথে ভড়কেও যায়। মসৃনও ভয় পেয়ে যায়। ভাই সবটা শুনে ফেলল না তো?

মেঘ সুখের সামনে এসে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘আপনি কান্না করছেন কেনো অপরিচিতা? কী হয়েছে? ঘরের লাইট অব্দি জ্বালান নি।’

এবার মসৃনের দিকে তাকিয়ে মেঘ অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
-‘তুই তো অন্তত বল বিহঙ্গ। তোর ভাবী কান্না করছিলো কেনো? কী বলেছিস তুই?’

মেঘের হাত পা কাপিয়ে ঘাম দেয় শরীরে। আমতা-আমতা করে বলে,
-‘আসলে, আসলে ভাইয়া,,

-‘আসলে উনি আমার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করাতে আমার কান্না চলে আসছে। সবাইকে খুব মনে পড়ছে তো।’

মেঘ এগিয়ে যায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অপরিচিতা’কে। সুখ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,যাক মেঘ অন্তত কিছু শুনে নি।

মসৃন আলগোছে বেরিয়ে আসে। তার জন্য একজন মানুষ আত্মহত্যা করেছে সে ভাবতে পারে নি। সে তো একা দোষী না। আরেকজনও সে দোষের ভাগীদার। আর এমন হওয়াটা কী স্বাভাবিক না? মানুষটা অপমানে আত্মহত্যা করতে পারে সেটা তো আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো। ভালোবাসা আর ক্রোধে অন্ধ না হলেও পারতো। আজ কেনো ব্যাথা হচ্ছে গোপনে? কেনো সুখকে ভাই এর পাশে সহ্য হচ্ছে না? মায়া নাকি প্রতিশোধ থেকে এ খারাপ লাগা?

_____

গভীর রাতে একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে হলো সুখের কানে। আধো নিদ্রা আধো জাগরণের কারণে ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না শব্দের উৎসটা। তবে খুব পরিচিত শব্দ এটা। চোখে রাজ্যের ঘুমের আবরণের কারণে শব্দের সন্ধানে যেতে পারে নি সুখ। ঘুমটা আরও গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে অতলে তলিয়ে নিলো তাকে।

সকাল হতে হৈ হুল্লোড়ে সুখের শ্বশুরবাড়ি রমরমা। সুখ চিৎকার চেঁচামেচিতে আর টিকতে না পেরে উঠে বসলো। ড্রয়িং রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসতেই সেখানে পা বাড়ালো।

ঘুমো ঘুমো কন্ঠে অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে?’

মেঘ সুখের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘দেখছেন,মিনা মায়ের সব গয়না নিয়ে পালিয়েছে। ওর এসব উদ্ভট কথার কারণ এটাই। কত বিশ্বাস করতাম ওরে। এবার বুঝলেন তো ও কতটুকু সত্যি বলে?’,

সুখের মস্তিষ্ক অব্দি কথাটা পৌঁছাতেই আৎকে উঠলো সে। মিনা পালিয়েছে? মিনা মেয়েটাকে যতটুকু মনে হয়েছে সে তো এমন না। তবে? হঠাৎ কাল রাতের অস্পষ্ট শব্দের কথা মনে পড়লো সুখের। শব্দের উৎসটা পরিষ্কার হলো। এটা গাড়ির শব্দ ছিলো। তবে কী মিনা পালায় নি। তার সাথে অন্য কিছু হয়েছে?

#চলবে

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ উনিশ

মেঘের মায়ের কিছু জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই বাড়ি থেকে নেয় নি মিনা। সুখ বুঝতে পারছে না এহেন রহস্য। গতকালকে যে মেয়েটা আকষ্মিক আতঙ্কে আৎকে উঠেছিলো, আজ সে মেয়েটা উধাও! মেয়েটা কী তবে আতঙ্ক থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলো নাকি তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে! এমন হাজারখানেক প্রশ্ন নিয়ে সুখ দাদীর রুমে বসে আছে। দাদী তার ছোট্ট ব্যাগটা নেড়েচেড়ে দেখছে। সে ঐ বাড়ি থেকে খালি হাতেই বের হয়েছিলো, নাতজামাই তাকে কত গুলো শাড়ি কিনে দিয়েছে।

ব্যাগটা বেশ খানিকক্ষণ হাতিয়ে দাদীজানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। একটা বিশ্ব জয় করার মতন হাসি দিয়ে সাদা ছোট্ট কাপড় বের করলো।

সুখ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল দাদীর পানে। দাদীর আচরণ ঠিক বোধগম্য হলো না তার। এতক্ষণ এই ছোট্ট কাপড়টা’ই খুঁজছিলো দাদী? কী আছে কাপড়টাতে? এই কাপড়টা দেখানোর জন্য’ই কী তাকে ডেকে আনলো!

সুখ বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-“তুমি কী এটা দেখানোর জন্য আমায় ডেকেছো দাদীজান!”

-“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এই রুমালটা আমি অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছিলাম তুমি যেদিন বাড়ি ছাড়লা হেইদিন। আসলে এইটা খোঁজার ইচ্ছা জাগে নাই কহনো, কিন্তু হঠাৎ মনে হইলো তোমার জন্য যেহেতু এই জিনিসটা বানানো হইছিলো তাই এইটা তোমার দেখার অধিকার আছে। নেও দেখো।”

শেষের কথাটা বলতে বলতেই হাতের রুমালটা দাদীজান সুখের দিকে এগিয়ে দিলো। সুখ আশ্চর্য বনে রুমালটা হাতের মুঠোই ধরলো। সাদা রুমালটা অবশ্য একবারে সাদা নেই, সময়ের বিবর্তনে সাদা রঙটাও ফিঁকে হয়ে হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। সুখ রুমালটা খুললো। কি সুন্দর কারুকাজ। হাতে সেলাই করা ডিজাইন বুঝাই যাচ্ছে না। রুমালটায় যত্ন করে হাত বুলাতেই ডানপাশের কোণায় ছোট দু’লাইনের লেখা চোখে পড়লো যা সুতো দিয়েই বুনন করা হয়েছে।

সুখ রুমালটা আরেকটৃ উপরে তুললো। সুতো দিয়ে এত ছোট নিঁখুত লিখা যায় এ লেখাটা না দেখলে জানতোই না। লেখাটা বোধগম্য করার জন্য গভীরে দৃষ্টি দিলো সে। গুটি গুটি অক্ষরে লিখা,
“মা-বাবা কখনো মরে না, একদিন তারা আমাদেরকে তাদের গর্ভে ধারণ করে আর বড় হওয়ার পর আমাদের গর্ভে আমরা তাদের ধারণ করি। বাবা-মা মানেই আমার সন্তান আর সন্তান মানেই আমার বাবা-মা।”

সুখ এই দু’টি লাইনের লেখায় বিমোহিত হয় আর সাথে সাথে অবাক হয় বা’পাশের কোণায় আরও দু’লাইন লিখা দেখে। লাইন গুলো এমন,
“লোকে বলে আমার মা নেই, কিন্তু লোকে তো জানে না আমি আমার মা’কে আমার গর্ভে ধারণ করেছি। আমার মেয়ে,সে’ই তো আমার মা।”

সুখ অবাক চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রয়। এই কথা গুলোর মাঝে কী যে মুগ্ধতা অনুভব করছে সে! কিন্তু তার ঝাপসা স্মৃতির ধূলো পড়া এক রহস্য হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লেখা গুলো সে এর আগেও দেখেছে। এমন লেখার সাথে সে পরিচিত। স্মৃতির কোণা থেকে বেরিয়ে আসলো লাইব্রেরীর সে রহস্যময় রজনী। ধূলোমাখা আলমারীর কোণায় সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটার আড়ালে শুভ্র রাঙা এক গভীর রহস্যমাখা চিরকুট,যা সময়ের বিবর্তনে ঠিক রুমালটার মতন হলদেটে রঙ ধারণ করেছিলো। কিন্তু তার ভিতরে থাকা গোটা গোটা অক্ষরে লিখা রহস্য গুলো এক চুলও কমে নি বরং বেশ ভয়াবহ ছিলো।

সুখ হন্তদন্ত পায়ে দাদীর কাছে গেলো। আকষ্মিক অনাকাঙ্খিত ভয়ে হৃদয়টা কাঁপছে যেনো। মনে হচ্ছে আজ এমন কিছু শুনবে যা হয়তো গোটা জীবন’কে বদলিয়ে দিতে পারে। তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করলো। গলার কাছটাতে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। কন্ঠটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এগুলো কার লেখা দাদীজান?”

-“আর কার! তোমার মায়ের। তুমি একমাসের থাকতে সে এটা বানইছিলো। তোমারে ম্যালা ভালোবাসতো কি না। হাহ্! হঠাৎ কেমন বদলায় গেলো মানুষটা। একদম হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন উধাও হইয়া গেলো। তবে এটা মানতে হইবো, মাইয়াটা বড় ভালা ছিলো।”

সুখ যেনো আর কিছু শোনার মতন অবস্থাতে নেই। মাত্রই গলায় জমা মুছে ফেলা ঘাম গুলো নতুন করে চিলিক দিলো। মস্তিষ্কের নিউরন গুলোও বোধহয় কথাটা সহ্য করতে না পেরে কার্যক্ষমতা হ্রাস করে দিলো। নিঃশ্বাসটা যেনো বের না হওয়ার তীব্র পণ নেয়। সে ভুল ভাবে নি তবে, তার মন তো আগে থেকেই এমন কিছু শুনবে বলে তাকে সংকেত দিয়েছিলো তবে মানতে কেনো পারছে না সে? দীর্ঘ একুশ বছর যাবত মা’কে নিয়ে গড়া কথা গুলো ভুলের মঞ্জিল ছিলো? তার মা তবে বিশ্বাসঘাতক নয়! জীবন যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যায় নি?

সুখ রুমালটা হাতে নিয়ে বাগানের দিকে ছুট লাগায়। বাড়ির দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের মতন জায়গায় চলে যায়। ভিতরে চলে নিরব বিস্ফোরণ। মা পালিয়ে যায় নি, মা হারিয়ে গেছে তবে!

সে অনুভব করে, একুশ বছর ধরে গড়া জীবনটা কেবল ভুলের সমাহার। হিসেব করেও শেষ করা যাবে না সেই ভুলের নামতা। রুমালটা নিজের মুখে চেঁপে ধরে সুখ। বহু যুগের পরিচিত ঘ্রাণ যেনো ভেসে আসলো সেখান থেকে। মায়ের ঘ্রাণ নিতে না পারলেও রুমালের সুভাষ টা কেমন মা মা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। অনেক বছর পর তার মনে হলো মা নামক মানুষটিকে না দেখার আফসোস এ জীবনে সকল দুঃখকে ছাপিয়ে গেছে। যার মা নেই তার কাছে পৃথিবী’টা নীল। কারণ বেদনার রঙ নাকি নীল!

—-

পুরো একটা দিন সুখের ঘোরের মাঝে কেটে গেলো। স্বাভাবিক, এমন নিঠুর সত্য সামনে এসেছে সামলাতে তো সময় লাগবেই। কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। সে সারাদিন নিজের মতন কাটালো। এ রহস্য উন্মোচন করতেই হবে যেকোনো মূল্যে। তার আগে তাকে এ বাড়ির রহস্য পরিষ্কার করে বাবার বাড়ি যেতে হবে। মসৃনকেও উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে।

সন্ধ্যা বেলায়, সুখ অনুভব করলো সে কিছু জানার আগেই ভেঙে পড়ছে। সে উঠে বসলো, কা-বার্ড থেকে একটা শুভ্র রাঙা শাড়ি নামিয়ে স্নানাগারে চলে গেলো। সবার আগে শরীরে স্নিগ্ধতা প্রয়োজন তারপর সবটা সুন্দর করে করা যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।

বেশ খানিকটা সময় লাগিয়ে এই অবেলায় স্নান করলো সুখ। শুভ্রা রাঙা শাড়ি পড়েই বের হলো। কোমড়ের নিচ অব্দি লম্বা চুল গুলো ভিজে টপ টপ করে পানি পড়ছে। স্নানাগার থেকে বের হতেই সুখের ডাক পড়লো নিচ থেকে। আজ মেঘও দিনের বেশিরভাগ সময় বাহিরে ছিলো। মিনা’কে খুঁজছে সাথে মিসিং ডাইরিও করেছে থানায়। তাই সুখ নিজের মতন কিছুটা সময় কাটাতে পেরেছে।

সুখ দ্রুত হাতের জামাকাপড় গুলো বারান্দায় দড়িটাতে দিয়ে নিচে ছুটে গেলো।

মেঘও একটু আগে এসে কেবল বসেছে। এখনো রুম অব্দি যায় নি। হঠাৎ সিঁড়ির পানে তাকাতে সে হা হয়ে গেলো। স্নিগ্ধ রমনীর পদার্পণে সিঁড়ির সাথে সাথে তার হৃদয় কোণে যেনো শীতল স্রোত বয়ে গেলো। এ কেমন ধ্বংসাত্মক রূপ রমনীর!

সুখ সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে সোফার দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে বলল,
-“আরে স্যার আপনি! কেইসের ইনভেস্টিগেটশন করতে করতে শহর অব্দি চলে আসলেন নাকি?”

পুলিশ অফিসার হেসে দিলেন সাথে মেঘও চাঁপা হাসলো। রেদোয়ানের খুনের তদন্ত যিনি করছেন শেখ আরশাদ, তিনিই এখানে উপস্থিত।

সুখ এগিয়ে গেলো। অফিসার হেসে বললো,
-“এসেছিলাম তো ঢাকায় একটা কাজে কিন্তু ইয়াং ম্যান এর সাথে দেখা হলো তাই চলে আসলাম। এমনেতেও একটা ইনফরমেশন জনানোর ছিলো তাই চলে আসলাম।”

মেঘের মা ততক্ষণে হালকা খাবার নিয়ে হাজির হন। সেন্ট্রাল টেবিলে খাবারের ট্রে টা রাখলেন। আরশাদ সাহেব একটু চাঁপা হাসলো কুশলাদি বিনিময় করলো তারপর সবার সম্মুখে একটা আর্জি রাখলেন,
-”আমি সুখোবতীর সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।”

সবাই সম্মতি জানাতেই সুখ নিজের রুমে নিয়ে গেলো আরশাদ শেখ’কে।

সুখের রুমে এসে আরশাদ সাহেব সুখের সাথে স্বাভাবিক কথা বললো কতক্ষণ তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে বিস্ফোরণের ন্যায় একটা কথা উচ্চারণ করলেন,
-“সুৃখোবতী, তুমি বোধহয় বেঁচে গেছো রেদোয়ানের মৃত্যুতে। এই প্রথম দেখলাম, কারো মৃত্যু কাউকে এমন ভাবে বাঁচিয়ে দেয়।”

সুখ অবাক হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
-“মানে! কী বলছেন স্যার?”

-“রেদোয়ান তোমাকে নিয়ে জঘন্য প্ল্যান করেছিলো,সুখোবতী। রেদোয়ান নারী পাচারের দলের সদস্য ছিলো। ও তোমাকেও পাচার করাে চিন্তা ভাবনা করেছিলো। রীতিমতো তোমাকে কত টাকায় বিক্রি করা হবে কোথায় পাঠানো হবে তাও প্ল্যান করা হয়ে গেছিলো। যে-ই মেরেছে ওকে, সে এক হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে খুন তো আর আইনের চোখে ক্ষমা যোগ্য না তাই তাকে খুঁজতে হবে।”

সুখ সোফায় বসে পড়লো। এত বড় ধামাকা তার জন্য অপেক্ষারত ছিলো! এটাও শোনার ছিলো?

আরশাদ সাহেব সুখের মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
-“যতটুকু জানতে পেরেছি মেঘও এটা জানতো। তোমাকে কেনো বলে নি আমি জানিনা। ও আমাদের কাছেও এটা লুকিয়েছে। যাই হোক তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো ঠান্ডা মাথায়। আমিও আমার ইনভেস্টিগেশনের সূত্রে জানার চেষ্টা করবো তবে সেটা পরে। আসছি। সাবধান হও। আমাদের সন্দেহের বাহিরে কেউ নেই। এমনকি মেঘও না।”

সুখ প্রথম কথায় যতটা না অবাক হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে দ্বিতীয় কথাটাই। মেঘ এসব জেনেও তাকে জানায় নি কেনো? তবে কী সে আবারও ভুল পথে পা বাড়ালো!

নিরবতায় কেটে গেলো মিনিট বিশ। সুখ ঠাঁই বসে রইল। মেঘ রুমে এসে ভ্রু কুঁচকালো, একটু আগের সুখ আর এখনের সুখের মাঝে বহুত পার্থক্য। অফিসার সুখকে কী এমন বললো!

মেঘ ধীরে এগিয়ে আসলো। সুখের পাশে বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে অপরিচিতা! কী বলেছে আংকেল আপনাকে?”

সুখ মৃত দৃষ্টিতে তাকালো মেঘের দিকে, মেঘের আচমকা ভয় হতে শুরু করলো। তবে কী সুখ,, না না, সে এসব কী ভাবছে!

সুখ আহত কন্ঠে বললো,
-‘আপনি সব জানতেন মেঘ সাহেব! তবুও আমায় বলেন নি কেনো?’

মেঘ যা আন্দাজ করেছে তার মানে তাই হয়েছে। মেঘকে চুপ থাকতে দেখে সুখ আবার বললো,
-‘আপনিই খুন করেছেন রেদোয়ান ভাইয়াকে তাই না?’

মেঘ আৎকে উঠে। কিছু বলার আগেই তার ফোনটা উচ্চশব্দে বেজে ওঠে। ইউসুফের কল দেখে রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়। হঠাৎ সুখের কানে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে। সুখ কন্ঠের অধিকারীকে চেনে। তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় রুমের বাহিরে।

মেঘ বারান্দায় ইউসুফের সাথে কথা বলার সময় সুখকে ছুটতে দেখে দু বার পিছু ডাকে। কিন্তু কোনো ফল না পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে সেও বাহিরে চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। হাতের ফোনটা পরে যায় আলগোছে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে সুখের শুভ্র রাঙা শাড়ি’টা তাজা রক্তে লালবর্ণ ধারণ করেছে। আর তার কোলে বৃদ্ধ মরোয়ারার নিথর শরীরটা।

#চলবে

[আজ কিছু রহস্য সামনে এসেছে আর কিছু রহস্য নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। রহস্য ছড়ানো শেষ এবার আপনাদের ভাবনার পালা শুরু।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here