নাগিন_কন্যা ৫ম পর্ব

#নাগিন_কন্যা
৫ম পর্ব

এই ভয়ঙ্কর আর অবিশ্বাস্য ঘটনা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। পুরো ঘর জুড়ে সাপেদের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে। বিশাল আকৃতির কালাচ সাপটা সামনে অন্য যে সাপই পাচ্ছে ওটার ধর কামড়ে ধরছে , তারপর ছুড়ে মারছে ঘরের টিনের দেয়ালের দিকে। মুহূর্তেই মারা যাচ্ছে ওগুলো। কালাচের লেজটাও তীক্ষ্ণ রূপে ফিরে গেছে। লেজের সরু অংশ সমানে পেছন থেকে কাবু করছে অন্য সাপ গুলোকে। যেটাকেই পাচ্ছে লেজটা গেঁথে দিচ্ছে ওটার উপর। অভিশপ্ত পিশাচ ক্ষমতার সাপটির আক্রমণে তাই সমানে মারা যাচ্ছে ঘরের ভেতর চন্দ্রকে পাহারা দেওয়া সাপগুলো। তবুও ওগুলোর সংখ্যা যেন কমছে না। অদৃশ্য কোনো পথ দিয়ে একের পর এক সাপ আসছেই। ঝাঁপিয়ে পড়ছে কালাচের উপর।

হাত কাটা ওঝা মালেক তার উপর আক্রমণ করা দুটো সাপকেই মেরে ফেলেছে। ধর চেপে যেটাকে ধরেছিল ওটাকে মাটির সঙ্গে কয়েকটা বারি খাইয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছে। বাম হাতটার অনুপস্থিতি ভোগালো তাকে। যেই সাপটা তার কান কামড়ে ধরেছিল ওটাকে ছুটাতে গিয়ে তার অর্ধেক প্রাণ বেরিয়ে গেল , জোরে ওটার ধর চেপে টান দিতেই তার কানের খানিক অংশও সাপের মুখের সাথে ছিড়ে উঠে এসেছে। তাই তার পুরো মুখ , ঘাড় রক্তে ভিজে আছে। শরীরে অদ্ভুত যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে। মালেক বুঝতে পারছে আর বেশি সময় নেই , বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে শরীরে এরমধ্যেই । যত দ্রুত সম্ভব বিষ নামাতে হবে। নাহলে এতো কাছে এসেও সব শেষ হয়ে যাবে। এই বিষ নামানোর ক্ষমতা একমাত্র ঐ কালাচের আছে। কিন্তু ওটাতো ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মত্ত।

উঠে দাঁড়িয়ে সাবধানে জানালা দিয়ে উকি দিল সে। নিজের সব শক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছে পিশাচ অভিশপ্ত কালাচ সাপটা। এই অমাবস্যার রাতে ওটার সাথে লড়ে জিতবে এমন সাপ এই দুনিয়ায় আরেকটিও নেই। সমস্ত পৈশাচিক শক্তি এসে ভর করেছে ওটার উপর। একে এর দানবাকৃতি , তার উপর সুচালো লেজ আর দ্রুত নড়তে সক্ষম মুখ দিয়ে আক্রমণ। ঘরের একটা সাপও টিকতে পারছে না ওটার কাছে। তবুও যেন ওটা সাপ মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠেছে। এত সাপ! ঘরের চারপাশে মৃত সাপের স্তুপ পরে রয়েছে , তবুও সাপের সংখ্যা কমছে না কেন? বিছানার নীচে কোনো একটা গর্ত থেকে উঠে আসছে আরো অগণিত সাপ। কিসের গর্ত ওখানে,এত সাপ ধারণ করতে পারে যেটা!

এসব ভাবার সময় এটা নয়। বিষক্রিয়াও বেড়ে গেছে। ওঝা মালেক বুঝতে পারলো মৃত্যু থেকে বাঁচতে এবার পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর । যেহেতু চন্দ্র কিংবা তার দাদি কেউই জেগে নেই তাই এইসব কিছু যে তার কাণ্ড সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। এই যা স্বস্তির কথা! মাটি কাঁপিয়ে সেই অদ্ভুত ছন্দময় শব্দ তুললো মালেক , মুহূর্তেই আক্রমণ থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালো কালাচ সাপটা। ওঝার বিপদটা যেন আচঁ করতে পেরেছে!

চন্দ্রের শরীরকে ঢেকে রাখা সাপগুলোও রক্ত হিম করা নজরে তার দিকে তাকিয়ে , জিহ্বা বের করে , হিসহিস করে উঠলো। মাথা কাঁপছে এবার ওঝা মালেকের , চোখের সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। মৃত্যু ডাকছে তাকে। ঘুরে কয়েক পা ছুটেই উপুড় হয়ে পড়লো। পুরো স্থির , অবশ হয়ে পড়ে রইলো তার শরীর। বিষক্রিয়ায় সামান্য নড়ার শক্তিও কেড়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। হালকা জ্ঞান তখনো আছে তার , ভোঁতা একটা অনুভূতি মাথাকে গিলে খাচ্ছে। অনুভব করলো পায়ের পাতা বেয়ে একটা সাপ তার মাথার দিকে উঠে আসছে , গা শিরশির করে উঠলো। ইচ্ছা করলো ঘাড় গুড়িয়ে দেখে ওটাকে। কিন্তু অপারক সে। তীক্ষ্ণ সুইয়ের মতো কিছু একটা তার ঘাড়ের উপরে কানের কাছে ঢুকে গেল। সামান্য গোঙানি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। একটু প্রশান্তিও অনুভব করলো এই প্রথম সে। ওকে বাঁচাতে কালাচটা এসেছে! বিষ নামাচ্ছে!

প্রায় আধ-ঘণ্টা ওভাবে পরে থাকার পর শরীরে শক্তি ফিরে পেল ওঝা মালেক। ধীরে ধীরে উঠে বসলো। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখতে পেল না। শুধু পায়ের কাছে বসে থাকা কালাচটার উপস্থিতি অনুভব করলো। ওটা স্বাভাবিক আকারে ফিরে এসেছে। ঝোলাটা এখনো কোমরে ঝুলে আছে। দ্রুত সাপটাকে তুলে ঝোলায় পুড়ে নিল। চন্দ্রের ঘরের জানলার পাশে পরে থাকা টর্চ থেকে মৃদু আলো বের হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে ওখানে গিয়ে টর্চটা তুলে নিল। জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকাতেই আশ্চর্য্য বনে গেল। কোথায় সেই শত , শত মৃত-জীবিত সাপ! সাপের স্তুপ! পুরো ঘরে একটা সাপও নেই। চন্দ্র নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় ঘুমাচ্ছে একা। কিন্তু ওর কপালে ওটা কী? পাথরের মতো যেটা ঠিকরে আলো বেরোচ্ছে। নাগমণি ? অবিশ্বাস্য! সাধারণ নাগিনদের ওটা থাকে না। এটাকে সর্পরাজ্যে রাজকীয় বস্তু বলা হয়। সে তো এই গ্রামে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটা সাধারণ নাগিনকে ধরতে এসেছিল কিন্তু এত দেখা যাচ্ছে সাপ রাজ্যের ক্ষমতাবান এক নাগিন কন্যা! যাকে রক্ষা করার জন্য এত বড় পাহারার ব্যবস্থা!

চন্দ্র আসলে কে? এত ক্ষমতা বান একজন নাগিন কন্যা হওয়ার পরেও সে এমন একটা সাধারণ পরিবারে মানুষ রূপে কী করে জন্মগ্রহণ করলো! একজন সাধারণ নারীর গর্ভে এমন ক্ষমতাবান নাগিনের জন্ম অবিশ্বাস্য ব্যাপার! চন্দ্রের নাগিন হওয়ার পেছনের সব ইতিহাস জানতে হবে তাকে , তারপর যা করার করবে সে। আপাতত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ওর কাছ থেকে। এমন ক্ষমতা বান এক নাগিনের শরীর থেকে যদি সে ঔষধ তৈরি করে তাহলে তার ক্ষমতা আরো কতটা বেড়ে যাবে ভাবতেই পুলকিত বোধ করল। আবার ভয় হলো চন্দ্রের এই ভয়ঙ্কর ক্ষমতার উৎসের কথা স্মরণ হয়ে।

দ্রুত মেম্বার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে তাকে। রাত এখনো অনেক বাকি। তাকে ঘরে না দেখলে সন্দেহ করবে যে কেউ। এখন আর ঝামেলা পাকিয়ে লাভ নেই। ধীরে ধীরে টর্চের মৃদু আলোয় পথ চলতে লাগলো ওঝা মালেক। শরীর পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কানের জ্বালাটা ভোগাবে কিছুদিন। উত্তেজনায় পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেল চন্দ্র। বাইরে ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। অথচ ভোর থেকে ধীরে ধীরে সকাল হওয়ার কথা! মাথাটাও কেমন ব্যথা করছে, ঘুম ভাব কাটেনি। বাইরে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারলো সন্ধ্যা নেমে আসছে। তার মানে সারারাত ঘুমিয়ে আজ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে। এত গভীর ঘুম! দাদি ওকে ডেকে তোলেনি কেন? দাদির ঘরে গিয়ে আরো অবাক হলো। দাদিও এখনো ঘুমিয়ে আছে। ডেকে তুলতে কষ্ট হলো অনেক। ঘুম জড়ানো দৃষ্টিতে তিনিও তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রের দিকে। দুইজনেই এই অস্বাভাবিক ঘুমের পেছনে কোনো যুক্তিই খুঁজে পেল না চন্দ্র। এমনতো হয় না! শুধু অনুভব করলো প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। খাওয়ার পর ঘুম ঘুম ভাবটা আরো যেন বেড়ে গেল। দাদি আর ও দুজনেই ঘুমানোর জন্য চলে গেলো যার যার ঘরে। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে ওদের।

রাত একটু গভীর হতেই মাথাটা যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হলো তখন চন্দ্র খেয়াল করলো তার ঘরে কোনো সাপ নেই। পুরো ঘরে উকি-ঝুঁকি দিয়েএকটিরও দেখা পেল না। অনেকক্ষণ মেঝেতে শব্দ করে সেই পরিচিত ছন্দে সাপগুলোকে ডাকলো , কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো , ওগুলো গেলো কথায়! আজও কী ঐ সর্প মানব আর মানবী আসবে তাই ওগুলো সেদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে! মনে আতংক থাকলেও শরীরের অদ্ভুত ক্লান্তির কাছে তা হার মেনে গেল। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যেই।

কপালের মাঝামাঝি গরম কিছুর স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল চন্দ্রের। তাকিয়ে দেখলো অদ্ভুত একটা আলোয় ঘর ভরে গেছে। আলোটা আসছে তার শরীর থেকেই। উঠে বসে বুঝতে পারলো তার কপাল থেকেই উৎপত্তি আলোটার। সেই সর্প নারীর হাতে থাকা বড় উজ্জ্বল পাথরটাই যেন কেউ ওর কপালে খোদাই করে দিয়ে গেছে। কিছুতেই কপাল থেকে সেটা তুলতে পারলো না। ঘরের এক কোণ থেকে এবার সেই নগ্ন , ঘাড়ের উপর থেকে সাপের ফণার আকৃতির মাথার সেই নর-নারী তার দিকে এগিয়ে এলো তার দিকে। এরা কারা, ওর কাছে কী চায় আবার! ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রের। একজন বিছানার ডান পাশে আরেকজন বাম পাশে চলে এলো। চন্দ্রকে ধাক্কা দিয়ে বিছানার মাঝামাঝি শুইয়ে দিল। কন্ঠ কিংবা শরীরে , সামান্য পরিমাণ প্রতিবাদ করার জোরও তার নেই। তার ডানপাশে সর্পনারী এবং বাপ পাশে সর্প পুরুষ বিছানায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।

এরপর দুপাশ থেকে ওরা চন্দ্রের দিকে ঘুরে ওকে জড়িয়ে ধরলো। চন্দ্রের পুরো শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। কী ঘটছে! চারপাশের সব কিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। বুঝতে পারলো শুধু , বিছানাটা যেন ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে ওদের নিয়ে। নামছে তো নামছেই। কোথায় যাচ্ছে!

হঠাৎ করেই তীব্র ধাক্কা খেল কিছুর সাথে চৌকিটা। ছিটকে পড়লো কোথাও চন্দ্র। বুঝতে পারলো তার পাশের নর-নারীও ছিটকে দূরে কোথাও পরে গেছে। প্রচণ্ড আলোর ধাক্কায় চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে রেখে তারপর চোখ খুললো সে ধীরে ধীরে। আলো সয়ে আসলো।

তবুও সব কিছু কেমন অদ্ভুত , ঘোলাটে আর সমতল বরাবর দেখলো সে। কয়েক মুহূর্ত লাগলো এটা বুঝতে যে , সে একটা সাপে রূপান্তর হয়েছে। স্বপ্ন নাকি বাস্তব! চারপাশে তাকিয়েই বুঝতে পারলো সে এই মুহূর্তে আছে একটা জঙ্গলের ভেতরে। তার দুই পাশে মুহূর্তেই দুটো শঙ্খচূড় সাপ এসে হাজির হলো। মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইলো। চেহারার মিল না পেলেও চন্দ্র বুঝতে পারলো এরাই সেই সর্প নর-নারী। মাটিতে ওরা দুজন একত্রে আঘাত করতেই অদ্ভুত এক কম্পন সৃষ্টি হলো। চন্দ্র অবাক হয়ে দেখলো এই কম্পনের অর্থ সে বুঝতে পারছে। ওরা তাকে তার সাথে চলতে বলছে , চন্দ্রের জীবনের সব রহস্য ওর কাছে পরিষ্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। চন্দ্রও তাদের অনুসরণ করলো। কিছুক্ষণ চলার পর ভুলেই গেল সে একটা সাপের রূপে আছে , সবকিছু তার কাছে খুব স্বাভাবিক লাগতে লাগলো। যেন সে জন্মের সময় মানুষ নয় , সাপ হয়েই জন্মেছিল। ……………………….
.
.
. . . চলবে . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here