#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্বঃ ৯
লেখা : মান্নাত মিম
গ্রাম হোক কিংবা শহরাঞ্চল সব জায়গাতেই মেয়েদের কথার এখনও কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। তারা পুরুষ মানুষের পদতলেরই যোগ্য মনে করে সকলে। হাজার হোক মেয়ে মানুষ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, তারা পুরুষের সংসারে গিয়ে সেই চুলো গুঁতাতেই হবে। আর সেটা যৌবনে থাকতেই হতে হয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ এই তথ্যটা এখনো কিছু কিছু উন্নত শহরাঞ্চলে বহমান। নাহলে নারী হয়ে গেলে বুড়ি থুড়থুড়ে চামড়ার মহিলাদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। জোয়ান থেকে বুড়ো সকলেই চায় নবযৌবনপ্রাপ্ত কিশোরী মধু পান করতে। বয়স্ক খালাম্মার কথার পিঠে লিলির কড়া জবাব,
‘কুড়িতে যখন বুড়ি, তখন তো দেখতে গেলে আমি কুড়ির ওপরে। তাহলে এই বুড়ি মাইয়ার জন্য আপনাদের এত চিন্তা করে ঘুম হারাম করতে কে বলেছে?’
‘দেখছনি তোমার মাইয়ার কারবার! মুখে মুখে কেমতে তক্ক করে! এমন কথার লেগা তো মাইয়ারে আরো আগে বিয়া থা দিবার পারবা না।’
বলেই প্রতিবেশী খাল্লামা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। তখন মিসেস সালেহা রেগে গিয়ে লিলিকে বললেন,
‘এমনটা না করলেও পারতি। সমস্যা কী? ভাবি তো সত্যিই বলেছে। আর কতদিন এভাবে পার করবি? একটা লতারও কোনকিছুর উপর ভর দিয়ে চলতে হয়। আর পৃথিবীতে মেয়ে মানুষরা তো স্বামী ছাড়া অচল।’
মা’য়ের কথায় কিছুই বলল না লিলি। নিশ্চুপ, নিরলস ভঙ্গিতে পা বাড়ালো নিজের কক্ষের দিকে। তা দেখে মিসেস সালেহা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আজ রান্না চাপাতে হবে হাঁড়িতে। এতদিন মেয়ে ছিল না বলে একবেলা রান্না করতেন। আর তাতেই সারাবেলা তাঁর চলে যেত।
‘কেন এমনটা করলে তুমি আমার সাথে? আমার ভালোবাসার এই মূল্য দিলে! তাহলে কেন তোমাকে ভালোবাসতে শিখালে? আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। চলে তো গেলে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনও সাথে করে নিয়ে গেলে। বাবা-সন্তান মিলে পরিকল্পনা করেছিলে বোধহয়। সেজন্যই তো আমাকে ধোঁকা দিয়ে এভাবে চলে গেলে। বলতে পারো আমাকে কোন কারণে এমন শাস্তি হিসেবে জীবন্মৃত বানিয়ে দিয়ে গেলে? আমি সত্যিই এত শাস্তি পাওয়ার যোগ্য ছিলাম?’
বদ্ধ অন্ধকারে শুধু আঁধারের ঘনত্ব বাড়ে। সেখানেই নিস্তব্ধতাকে চিরে একবুক অভিমানের পসরা সাজিয়ে ব্যক্ত করছে নিজের ভেতরের লালিত কষ্টের কাব্যমালা। হু হু শব্দ আর নিশ্বাস টানার বেগতিক শব্দ চলছে সারা ঘরময়। কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই, যে ছিল তার কাছে জবাবের আশার বদলে কেবল একঝাঁক অভিমান ভরা প্রশ্ন করা যায়। তবুও একটু নতুন শব্দের উৎস খুঁজে পায় লিলি এই আবদ্ধ হওয়া চার দেয়ালের অন্ধকারের মাঝে। উৎস অনুসন্ধানে খেয়াল হয় শব্দ আসছে জানালার থেকে। তার রুমে বারান্দা নেই যে সেখান থেকে শব্দ আসবে। আর না দরজায় কারো করাঘাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফুলে যাওয়া চোখগুলো মুছে এগিয়ে বদ্ধ জানালার কপাট খুলে দেখতে পায় মেজবাহকে। জীবনে আর কতো অবাক হওয়া যে বাকি৷ তাও এমন অবাক মনে হয় সে কখনো হয়নি। তাই তো অক্ষিযুগলের আকৃতি তুলনামূলকভাবে অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে গেছে। সেখানে কিছুটা ভয়েরও আভাস দেখা যাচ্ছে।
‘আপনি!’
লিলির অবাক হওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিটমিট হাসি পেলেও ফোলে যাওয়া চােখ দেখে হৃদয়ে সুক্ষ্ম ব্যথার অনুভব হয় মেজবাহর। তবুও মুখটাকে হাসি হাসি আমেজে মিলিয়ে উত্তর দেয়,
‘আমি ছাড়া কে-ই বা আছে গো তোমার?’
বিরক্তিকর ভরা শব্দে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে লিলি,
‘আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি করতে এসেছেন?’
মেজবাহর মতো রসিকতা করার মানুষ রসিকতাপূর্ণ জবাব দেয়,
‘তোমার তা-ই মনে হলে তা-ই সই।’
এবার রেগে কিয়ৎপরিমাণ উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে লিলি,
‘আর একবার ফালতু কথা উচ্চারণ করলে, দেখেন আপনার কি হাল করি। সোজাসুজি বলুন কী চাই? কেন এসেছেন এখানে?’
লিলির রেগে যাওয়া রক্তিম মুখশ্রী দেখে তাকে আর জ্বালানোর ইচ্ছে হলো না মেজবাহর, তাই এবার সোজাসুজি উত্তর দিয়ে নিজের মনোকামনার ইচ্ছে ব্যক্ত করল,
‘তোমাকে চাই প্রিয়তমা। তাই তো ছুটে এসেছি সুদূর ঢাকা থেকে সোজা তোমার কাছেই।’
লিলি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে মেজবাহর পানে তা দেখে ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে সে বলে,
‘উহুরে! ভয় পাই তো এভাবে বড়ো বড়ো চোখ করে কেউ তাকায়?’
রাগে-ক্ষোভে জানালার পাশে থাকা টি-টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে সেখানে থাকা পানি ছুঁড়ে মারে মেজবাহর দিকে। নাকেমুখে পানি গিয়ে কাশি শুরু হয়ে যায় তার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখ নিমিষেই রক্তাভাব ধারণ করে। অপরদিকে পাশের বাড়ির খালাম্মা যিনি কি না কিছুক্ষণ আগেই লিলিদের বাড়ি থেকে তর্কাতর্কি করে গেল। তাঁর বাড়ির পেছন দিকে লিলির জানালার পাশেই। দু’বাড়ির মাঝের চিপাগলিতেই দাঁড়িয়ে মেজবাহ। তার কাশির শব্দ শুনে সেই খালাম্মা নিজের ঘর থেকে চিল্লিয়ে বলতে শুরু করেন,
‘কেডায়-রে চিপাডাত, হ্যাঁ কেডায়?’
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে হকচকিয়ে গিয়ে লিলি জানালার ফাঁক গলিয়ে নিজ হাতে মেজবাহর মুখ চেপে ধরে। আর ফিসফিসিয়ে বলে,
‘চুপ একদম চুপ।’
কী শুনবে, কী চুপ থাকবে? তার স্পর্শে মেজবাহ নিজ দুনিয়াতে নেই, এতটাই স্তম্ভিত, হতভম্ব। অথচ এর আগেও পেয়েছিল সেই স্পর্শ। কিন্তু তখনকার মতো তার তেমন অনুভূত হয়নি লিলির অতীত কাল শুনে, এখন যতটা অনুভূতি হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে। পাশের বাড়ির খালাম্মা আর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে চুপ হয়ে গেলেন। তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মেজবাহর দিকে তাকিয়ে নিজ হাত তার মুখে দেখে সরাতে নিবে, এমন সময় মেজবাহ তার হাত ধরে আঁটকে ফেলে। সুযোগের সদ্য ব্যবহার করে মেজবাহ। অগুনিত ওষ্ঠ স্পর্শ করায় তাতে। লিলি চেয়েও হাতখানা টেনে ভেতরে আনতে পারে না। যতই টানাটানি করছে মেজবাহর পুরুষালি হাতের কাছে পেরে উঠছে না।
‘দয়া করে ছাড়েন। আপনি এমন করছেন কেন? আল্লাহর দোহায় লাগে আর কলঙ্কিত করেন না আমায়।’
কান্না করতে করতে জানালার নিচে বসে পড়ে লিলি। মেজবাহও ততক্ষণে তার হাত ছেড়ে দিয়েছে।
‘আপনাদের মতো পুরুষের শুধু নারীদের শরীর’ই কাম্য। এছাড়া তো আরকিছু নাই। এই শরীরের জন্যই তাদের আগে-পিছে ঘুরে ভালোবাসার জাহির করেন। শরীরটা পেলে তখন ভালোবাসা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেন, সাথে নারীর শরীর-ও।’
বুক কেঁপে উঠল মেজবাহর। এত ঘৃণা ভরা পুরুষদের নিয়ে লিলির মনে! কেন? সব পুরুষ তো আর এক না। সত্যিই সে কিছুক্ষণের জন্য অনুভূতির কষাঘাতে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে কিয়ৎ পলের জন্য। তাই বলে তার ভালোবাসা তো শরীরে বিচরণরত নেই, এই স্পর্শ কি এতই ঘৃণার যোগ্য?
‘তোমার শাহেদকে-ও এমনটা ভাবো?’
হঠাৎই কী যেন ভেবে প্রশ্নটা করে বসে লিলির পানে,
‘নাহ তার সাথে আপনাদের তুলনা হয় না। সে ছিল নারীদের সম্মানের প্রতীক। সে নারীদের সমাদর করত। অসহায়, দুঃস্থ নারীদের সাহায্য করত। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমে আর্থিক সাহায্য করত।’
কথাগুলো বলার সময় অশ্রু চোখে মৃদু হাসির রেখা দেখা গেল লিলির ঠোঁটের কোণে। যেন শাহেদের সাথে থাকা স্মৃতি সম্মুখে উন্মোচিত হওয়া, বিচরণরত সারা ঘর জুড়ে। তা দেখে মেজবাহর বুক চিরে যেন এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবুও সে শক্ত মুখে বলল,
‘তাহলে কেন সবাইকে একই কাতারে ফেলছ?’
‘কারণ আপনাদের মতো মানুষ শরীর ছুঁয়া ছাড়া আরকিছুই পান না।’
ঘৃণ্য দৃষ্টিতে রাগান্বিত শব্দযুগলে মেজবাহর দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা লিলি। মেজবাহ বুঝতে পারল; লিলিকে দেখে নিজের ভেতরের আবেগ বশত হয়ে স্পর্শ করাটা ঠিক হয়নি। লিলি তো আর তাকে এখনো পছন্দই করে না ভালোবাসা তো দূরের কথা। তবুও এখানে আরো কিছু আছে, যা লিলি তাকে সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট করে বলেনি। সেই কথাগুলো তার পেট থেকে বের করতে হবে। মেয়েটাকে দেখে অন্তত ভালো করে চিনে গেছে যে, মেয়েটা কিছুটা চাপা স্বভাবের তবে সেটা কেবল অপরদের ক্ষেত্রে প্রিয়জনের কাছে সে উন্মুক্ত, উন্মোচিত।
‘জানালাটা বন্ধ করে দাও। আমি চলে যাচ্ছি।’
সেভাবেই বসে রইল লিলি। তা দেখে ছোট্ট করে এক নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেল মেজবাহ। জানে কথা শোনার মতো আপাতত লিলির কোন ইচ্ছা নেই। তাই তার চলে যাওয়াই শ্রেয়।
_____
লিলির আসার দিন বারান্দা বন্ধ পেয়ে মেজবাহ বুঝে গিয়েছিল তার বাড়ি চলে যাওয়াটা। তাই সে-ও রওনা দিয়েছিল সেখান থেকে সাথে সাথেই। মেজবাহর কাজ সেখানে বেশিদিনের ছিল না। ছোট একটা কাজ দু’দিনের মতো ছিল। অথচ লিলির জন্য সে এতদিন ঢাকায় অবস্থান করেছিল। একই গ্রামের মধ্যে দু’জনের বাড়ি থাকায় বেশ বেগ পেতে হলো না লিলি’কে খুঁজে বের করতে। আর তারপরই দেখা করল মেজবাহ লিলির সাথে।
‘তুমি কখনো দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছ?
দ্বিতীয়জন’কে কি তোমার কাছে প্রথম প্রেমিকের মতো করে অনুভব হয়?’
নিশ্চুপ অপরপ্রান্তের ব্যক্তি মিলি। শেষ চেষ্টা করেও বোনকে রাজি করাতে পারল না মিলি। মিসেস সালেহা তাকে দিয়ে রাজি করাতে বলেছেন লিলিকে। কিন্তু লিলি অটল কিছুতেই বিয়ে করবে না। উল্টো তাকে নানাপ্রশ্ন করে চুপ করিয়ে দেয়। এবারের প্রস্তাব এসেছে বাড়ির পাশের এলাকা থেকো, ছেলেও মোটামুটি ভালো। বলতে গেলে তার পছন্দ হয়েছে। উপরন্তু বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই রয়ে গেল মানে পাশের এলাকায় থাকায় যাতায়াতে সুবিধা হলো আরকি যাওয়া-আসার। কিন্তু লিলি যে মানছে না। আবার হুমকি স্বরূপ বলেছে; এবার যদি মিলি-ও তাকে জোরজবরদস্তি করে তাহলে দু-চোখ যেখানে যায়, সেখানে চলে যাবে, হাজার খোঁজেও পাবে না। অগত্যা ফোন কেটে দিলো পরাজয় সৈনিকের মতো।
‘ছেলেপক্ষ শুক্রবার তোরে দেখতে আসবে।’
মিসেস সাহেলার কথায় লিলির দায়সারা জবাব,
‘তো আমাকে জানাচ্ছ কেন?’
‘দেখ লিলি ঘাড়ত্যাড়ামি করবি না। বিয়ে করবি না তো কী করবি? তোর জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। তুই কি চাস গলায় দড়ি দেই? তাহলে বল তা-ই করি। এত জ্বালা সহ্য করতে পারছি না।’
এবার বেশ ক্ষেপে গিয়ে উচ্চস্বরে রাগকে জাহির করলেন মেয়ের ওপর মিসেস সালেহা।
‘তোমার দেওয়া লাগবে না। আমি-ই দিয়ে তোমাদের শান্তি দিয়ে যাই।’
ঘর ছেড়ে বাইরে উঠানে বসেছিল লিলি। এমন সময় তার মা’কে বাইরে থেকে গেইট দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখে। এসেই উঠানের মাঝেই সরাসরি বিয়ের সম্মন্ধে বলা শুরু করে দেয়। দু’দিন ধরে এসব বিয়ের কথার জ্বালা সহ্য হচ্ছে না তার। আর না সহ্য করতে পারছেন সমাজের নানা কটুক্তি মিসেস সালেহা। তাই বিয়ে এবার মেয়েকে তিনি যে করেই হোক দিয়ে ছাড়বেন। আর এসব শুনে লিলি-ও বুঝে যায় তার মা ঘটকদের বাড়ি থেকে পাকা কথা সেরে এসেছেন। এবার আটঘাট বেঁধে তার বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। কিন্তু তা তো সে হতে দেবে না, মনে যে শাহেদ গভীর ছাপ ফেলেছে, সেখানে কী করে অন্যকে ঠায় দেবে সে? অতঃপর শেষ কথা বলে লিলি নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।
চলবে……….