ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৩

#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৩
লেখা : মান্নাত মিম

বন্ধু সোলাইমান মেসে থাকে। বাড়ি তার কুমিল্লা। বাবা-মা, ছোট ভাই তার পরিবার ছিল। কিন্তু মাথার ওপর থেকে বাবা নামক ছায়াটা শেষ হয়ে যাওয়ার দরুণ ঢাকাতে আসা টাকা কামাতে। মেজবাহর সাথে পরিচয় হয়েছিল ঢাকাতে’ই। পকেট চুরি যাওয়াতে মেজবাহ তাকে সাহায্য করেছিল। নতুন যখন ঢাকায় এলো, অচেনা শহরে হঠাৎই দরকারে থাকা স্বল্প টাকা চুরি যায়। এতে বেশ হতাশ হয়ে বিপাকে পড়ে সোলাইমান। অসহায়ের মতো গ্রামাঞ্চলের সহজসরল সোলাইমান রাস্তায় পড়ে কান্না শুরু করে দেয়। কিন্তু এটা ঢাকা, সেখানে মানবতা দেখানোর মতো তুচ্ছ সময় কারোরই নেই। আর যাদের আছে তারা দাঁড়িয়ে ফ্রি-তে চিড়িয়াখানা ভ্রমণের মতো ক্রদনরত হনুমান দেখতে দাঁড়িয়ে ভিড় জমায়। তবে সেসব অমানুষের ভিড়ে মেজবাহ নামক মানুষটা এগিয়ে এসে তাকে সাহায্য করে। সাথে করে নিয়ে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয়। এরপর থেকেই দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্কের তৈরি হয়। ঢাকা আসলে প্রায়ই সোলাইমানের বাসায় ওঠে মেজবাহ।

‘কিরে! মুড অফ কেন?’

সোলাইমান রুমে ঢুকে উদাসীন মেজবাহকে জিজ্ঞেস করে। উত্তরে মেজবাহ গালে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল,

‘আর বলিস না। আজ থাপ্পড় পড়েছে গালে। ভালোবাসার শব্দ উচ্চারণ করতেও দেয়নি।’

‘বলিস কি ব্যাটা! মেয়ে দেখি পুরাই বোম্বাই মরিচ!’

আঁতকে চোখ কপালে ওঠিয়ে সোলাইমান বলল।

‘সেটাই তো, ভালো তো বাসছে’ই না। আর না আমাকে ভালোবাসতে দিচ্ছে। উলটো রাগ ঝাড়ার অধিকার আদায় করে নিচ্ছে।’

আফসোস ঝরে পড়ে মেজবাহর গলায়।

‘চিন্তা করিস না। লেগে থাক একসময় করে মাইয়া তোর হাতে ধরা দিবেই।’

সোলাইমানের আশ্বাস বাণীতে মেজবাহ বলল,

‘দেখি কি হয়!’

মেজবাহর গলায় ফের উদাসীনতার বাণী শোনে সোলাইমানের মনে বেশ খারাপ লাগল। বাবা-মা’হীন ছেলেটার জীবনে ভালোবাসার পায়রা এসে ধরা দিয়েও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। লিলি নানের মেয়েটাকে পেলে সে দেখিয়েসহ বুঝিয়ে দিতো মেজবাহর মতো ভালো মানুষ হয় না। বাবা-মা নেই বলেও ছেলেটা বিফলে যায়নি। এমন স্বর্ণের টুকরো অবিবাহিত ছেলে পাবে কোথায় মেয়েটা? মেজবাহর জন্য অন্যসব মেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ রাজা-রানি বিহীন রাজত্ব পুরো স্ত্রী’র হাতে থাকবে। কেউ-ই কটু কথা বা ভাগ দখল করে অধিকার ফলানোর জন্য নেই।
_____

‘কিরে! সেই কখন থেকে তোকে ডেকে যাচ্ছি। খেতে আয়। তোর দুলাভাই আর রিম্পি বসে আছে তোর সাথে খাবে বলে।’

বড়ো বোন মিলির কথার উত্তর না দিয়ে কিছু একটা ভেবে লিলি শুধু বলল,

‘শোন না, আমি বাড়িতে যেতে চাই। অনেক তো হলো বেড়ানো।’

লিলির কথাতে খানিক অবাক হয়েও হলো না মিলি। বুঝতে পারল তীক্ষ্ণ অতীতের রোমন্থন করায় লিলির মন খারাপের কারণটা। অতঃপর তাকে একান্ত সময় কাটানোর জন্য রেখে গেল সে, কিছু না বলে। বিছানার মাঝে হাঁটুতে মাথা দিয়ে লিলি অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে ভাবছে,

‘একাকী বেঁচে থাকা জীবন সুখের নয়,
মৃত্যু আমাকে শাস্তি দিয়েছে জীবন্মৃত হয়ে থাকার মতো কঠিন শাস্তি।’
______

‘তুমি তাড়াতাড়ি আসবে কি না সেটা বলো এখন?’

লিলির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে শাহেদ জানায়,

‘বললাম তো আজ প্রচুর চাপ আছে কাজের। লক্ষী মেয়ের মতো কথা শুনো, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বে। আমি যেন এসে না দেখি, আমার জন্য না খেয়ে বসে রয়েছ।’

শাহেদের আদর মাখা শাসন তো গায়ে মাখলই না উলটো রাগ ঝেড়ে বলে ওঠে,

‘তোমাকে আসতে বলেছি। আমি খাই বা নাই সেটা দেখতে বলিনি। তুমি যেভাবে হোক আসবে। জানো না তোমাকে ছাড়া আমার একমুহূর্ত একা থাকতে কষ্ট হয়?’

ফোন ডিসকানেক্ট করে দিলো শাহেদ। সে জানে, তার প্রিয়তমা স্ত্রী তাকে কতটুকু ভালোবাসে। তাই তো কলটা কেটে দিলো। ভালোবাসার পরিমাপ যে, সে করতে পারবে না। ফোনটা না রাখলে দেখা যেত, ওপাশে বোকা মেয়েটা কথা বলার কিছুক্ষণের মাঝেই কেঁদে গা ভাসিয়ে দিতো। অবশ্য ফোন রাখার পরেও কাঁদবে কিছুক্ষণ পাগলিটা, তার জানা আছে সেটা।

ঠান্ডা পড়েছে বেশ। তাও রাগ-ক্ষোভে পাতলা শিফনের শাড়ি জড়িয়ে লিলি। খাবার-দাবার সব ফ্রিজে রেখে না খেয়ে রুমে এসে শুয়ে রইল। আজও এলো না সময় করে তার জন্য। আগেও যদি প্রথম প্রথম যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি আসত অফিস সেরে। কিন্তু ইদানীং আসা কম হয়ে যাচ্ছে। জানে তার পুরুষটা কর্মক্ষেত্রে প্রচুর সৎ এবং কর্মঠ। তাই তো সকলের প্রিয় পাত্র অফিসে তার স্বামীর নাম বেশ উচ্চারিত হয়। তবুও মন খারাপ বলে কিছুটা রাগ একা একা ঝাড়তে শুরু করে দিলো সে।

‘হবেই তো এখন আর আমাকে ভালো লাগে না যে৷ ভালো লাগবে তাে অফিসের সুন্দর সুন্দর টাইট ফিট পরা পোশাকের মেয়ে কলিগদের। বিয়ের দু’বছর না গড়াতেই এই অধঃপতন হয়ে গেছে। বাকি জীবন তো পড়েই রইল।’

নাক টেনে টেনে কান্নার ফোয়ারা তুলে লিলি কথাগুলো বলছে। বিষয়টা কান্নার নয়, তবুও বেচারির কষ্টে কান্না এসে গেলো। কী করবে সে? স্বামী যখন প্রেমিক পুরুষে রূপান্তরিত হয়, তখন বিপরীত লিঙ্গের স্ত্রী-ও অভিমানী প্রেমিকা হয়ে যায়। যখন-তখন প্রেমিকাদেী মতো বায়না ধরে প্রেমিক পুরুষকে কাছে পাবার। হঠাৎই গায়ে পরা শাড়ি ভেদ করে নিজের কটিদেশে কারো হাতের ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল সে। আগন্তুক ব্যক্তিটা যখন তাকে নিজের দিকে ঘুরালো, তখন পুরুষালী ব্যক্তিত্বের বুকের ঘামার্ত গন্ধে বুঝতে পারল এ-যে নিজেরই লোক। নিজ আপনের থেকেও আপনতর। নাহ, তবে রাগকে দমানো যাবে না। এ পুরুষ যে, তার মনের চাওয়াকে দাম দেয়নি। সেটা ভুললে চলবে না। রাগের বশিভূত হয়ে শাহেদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে যখন দেখে পেরে ওঠে না, তখন শান্ত, নিশ্চল, শিথিল হয়ে পড়ে রইল শাহেদের বলিষ্ঠ দেহের ওপর। আর নাসিকাপথ দিয়ে গন্ধ নিতে লাগল তার প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসার জন্য ঝরানো ঘামের গন্ধকে। বাড়ির একস্ট্রা চাবি সবসময় থাকে শাহেদের কাছে। তাই যখন দেখল এত বেল বাজানোর পরেও লিলি দরজা খুলছে না, তখন সেই চাবির সদ্য ব্যবহার করল শাহেদ। চুপিসারে হাঁটার শব্দ না করে ভেতরে এসেই সে লিলির অভিমান ভরা নিজে নিজে বলা কথাগুলো শুনতে পেল।

‘কে বলল এমন পঁচা কথা? তোমাকে ভালো লাগবে না! অর্থাৎ আমার নিশ্বাস নিতেই ভালো লাগবে না। তোমাকে ভালোবাসা আমার বেঁচে থাকার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো না লাগা মানে মৃত্যু আমার পছন্দনীয়। তোমাকে ছাড়া অন্য কারো দিকে যে আমার নজর নেই, সেটা কি তোমার অজানা?’

কথাগুলো বলার সাথে সাথে লিলির কটিদেশে শাহেদ নিজের হাতের স্পর্শ আরো গভীর করতে লাগল। এতে করে লিলি ব্যথায় মুখ বিকৃত করল। তা দেখেও কোন ভাবান্তর নেই শাহেদের মুখে। উলটো আরো দৃঢ় তবে গাম্ভীর্যের কণ্ঠস্বরে বলল,

‘এতোই যখন আমায় ভালোবাসো৷ তাহলে সে ভালোবাসার ওপর বিশ্বাসও থাকা উচিত আরো বেশি। আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম বলে ফোনে এমনটা বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে নিয়ে এমনটা ভাবতে পারলে!’

শেষোক্ত কথায় শাহেদের গলায় কষ্টরা এসে যেন জমাটবদ্ধ হলো।

‘না, না সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। শুধু তোমাকে ছাড়া একা ভালো লাগে না। তখন আমার সাথে ওভাবে কথা বলায় আর মুখের ওপর ফোন রেখে দেওয়ায় আমার একটু রাগ হয়েছিল। তাই তোমাকে ওভাবে বলেছিলাম। তাই বলে বিশ্বাস করি না এমনটা না। তোমাকে ভালোবাসা যে আমার কাছে জান্নাত পাওয়ার মত।’

কথাগুলো বলার সময় আবেগরা হানা দিয়ে অশ্রু হয়ে ঝরে পরে লিলির গলায়। তা দেখে অতি আদরে সহিত খুব সন্তর্পণে লিলির চোখের জলগুলো নিজের ওষ্ঠে তুলে নেয় শাহেদ। তারপর আদুরে আলিঙ্গনে লিলিকে নিয়ে বলল,।

‘এতো ভালোবেসো না আমায়। পরে আমার না থাকায় কষ্ট পাবে অনেক। তখন কিন্তু তুমি নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার জন্য নিজের জীবনকে সাদা’য় রাঙাবে না।’

‘মনটা বলো না দয়া করে। তোমাকে ছাড়া একা বেঁচে থাকা আমার কাছে মৃত্যুসম।’

শাহেদের মজার ছলে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো শোনে আতংকে আঁতকে ওঠে লিলি। ঝাঁপিয়ে পড়ে শাহেদের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। সেটা দেখে দু’হাতের আঁজলায় লিলির মুখ তুলে আলতো করে আবারও চোখের জল মুছে দেয় শাহেদ। ভেবে পায় না সে, মেয়েটা এতো কাঁদতে পারে, ভাবারও বাইরে৷ অবশ্য ভালোই লাগে, নিজেকে নিয়ে অহংকার হয়। কেউ একজন তাকে ভালোবেসে কাঁদছে, ভাবতেও শরীরে রোমাঞ্চ অনুভব হয়। ভাবনার মাঝেই লিলির অদৃষ্টে তার ওষ্ঠের উষ্ণ ছোঁয়া আঁকে শাহেদ। ভালোবাসার মানুষের এমন আদর মাখানো স্পর্শে আবেশে দু’চোখের পাতা’রা নিজ দায়িত্বে বন্ধ হয়ে যায়। কান্না’রা তখন পালিয়ে যায় এমন ভালোবাসার আলিঙ্গন দেখে। শাহেদ তার প্রিয়তমার কান্নার বদলে ঠোঁটের কোণে লাজে লজ্জিত মাখা হাসি দেখে তাকে আরো লজ্জায় ফেলতে সারা মুখে নিজের ওষ্ঠের পরশ বুলাতে লাগে। লিলিও তখন আবেশে নিজের ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ অনুভব করতে করতে অজানা সুখে স্থানান্তরিত হয়।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here