#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-২৩
শিরিন হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। রওশন আরা যেগুলো বলছে সেগুলো সব ই স্বাভাবিক ঘটনা। সব বাবা মা’ই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এগুলো করে। সবার ই কী এমন সমস্যা হয়! রওশন আরা জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কী আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে চান?”
“আপনি যে ব্যাপারগুলো বললেন সেগুলো তো সবার ক্ষেত্রেই হয়। শিশিরের ক্ষেত্রে এটার ইফেক্ট পড়লো! ”
রওশন আরা বললেন,
“এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কম বেশী সব বাচ্চারাই কষ্ট পায়। কেউ কেউ বড় হতে হতে ভুলে যায়। কেউ কেউ পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারনে ভুলতে পারে না। ”
“আমরা তাহলে এখন কী করব।”
“আপনাদের এখন কাজ হলো শিশির যা কিছুই করবে তাতে সাপোর্ট করা। ”
“এই কাজ তো আমরা আগেও করেছি। ও যেমন চেয়েছে তেমনই হয়েছে। ও পড়াশোনা না করে ঘরে বসে থেকেছে তার জন্যও তো কখনো প্রেশার দেই নি। ভেবেছি মতিগতি ঠিক হলে আবার শুরু করবে।”
“এটাকে ঠিক সাপোর্ট দেয়া বলে না। এটা হলো ওর অন্যায় আবদার মেনে নেয়া। শিশির কে বুঝাতে পারতেন যে পড়াশোনা সর্বস্ব জীবনের বাইরেও অনেক কিছু করা যায়। ও যা কিছু ভালো পারে সেগুলো নিয়ে আনন্দে থাকুক। ছেলেমেয়েরা যা কিছুই করুক সবসময় ইতিবাচক কথা বললে, প্রশংসা করলে সেল্ফ কনফিডেন্স বাড়ে। ফ্যামিলি থেকে ইন্সপায়ারেশন পেলে বাইরের দুই একটা মন্দ কথায় খুব একটা খারাপ লাগে না। ”
শিরিন নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো। বলল,
“আমি আপনার কথা মনে রাখব। ”
“আমি শিশিরের সঙ্গে আরও একদিন বসব। আপনি চিন্তা করবেন না, শিশির খুব ই স্ট্রং ছেলে। জীবনের জটিলতা গুলো আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠবে। ”
শিরিন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
***
বিন্তী এই ক’দিনে অস্থির হয়ে উঠলো। ও ভেবেছিল সবসময়ের মতো শিশির এসে হাজির হবে। ও’কে এসে বলবে, ফিরে চলো বিন্তী। আমি একদম ভালো হয়ে যাব। কিন্তু আসা তো দূরে থাক! শিশির একটা ফোন অবধি করে নি। তুষার ফোন করে খোঁজ নিয়েছিল। ওর থেকে শিশিরের খবর পেয়েছে। এর বাইরে আর কোনো কথা নেই।
বাড়ির লোকের একের পর এক প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে বিন্তী। খেতে হয় বলে খায়। বাকীটা সময় বিছানায় শুয়েই থাকে। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বিন্তীর মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিন্তী নিজেও কিছু বলছে না দেখে শিরিন কে ফোন করেছিল। শিরিন শিশিরের দোষটুকু না বলে শুধু বলেছে যে ঝগড়াঝাটি, মান, অভিমান কোন সম্পর্কে না হয়! ওদেরও হয়েছে। কিন্তু বিন্তীর মায়ের মন মানে না। তার মনে হয় বড়সড় একটা ঝামেলা হয়েছে। বিন্তী নিশ্চয়ই মানিয়ে নিতে পারছে না। এই ভেবে বিন্তীকে বলল,
“তুই কী ভাবলি?”
বিন্তী বুঝতে না পেরে বলল,
“কী ভাবব?”
“তুই কী এখানে থেকে যাবি?”
“এখানে থাকলে তোমাদের সমস্যা আছে?”
“না। যদি ভেবে থাকিস এখানেই থাকবি তাহলে সব সম্পর্ক চুকিয়ে আয়। মানুষের জীবনে এক্সিডেন্ট তো হয় ই। ”
বিন্তী আঁতকে উঠলো। বলল,
“এসব কী বলছ মা?”
“তোর অবস্থা দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি।”
বিন্তী তীর্যক হেসে বলল, মা শিশিরের সঙ্গে আমার নরমাল ঝগড়া হয়েছে। তাতেই তুমি এই কথা বলছ!
বিন্তীর মা আরও কিছু বলতে চাইছিলেন। বিন্তী সেই সুযোগ দিলো না। সেই সন্ধ্যায় বিন্তী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
***
শিশির কে দেখে রওশন আরা বললেন,
“কেমন আছ শিশির?”
“ভালো। ”
“তুমি আজ একা এলে?”
“হ্যাঁ। ”
“বাহ! আমি ভেবেছিলাম আসবে না।”
“আসার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু একটা কারনে আসলাম। ”
“কী কারণ? ”
“আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে সেটা বলার জন্য। ”
রওশন আরা হেসে বললেন,
“থ্যাংক ইউ। তারপর কী ভাবলে?”
“কোন ব্যাপারে? ”
“ওই যে বলেছিলাম তোমার সমস্যা তুমি নিজে সমাধান করবে।”
“হ্যাঁ ভেবে রেখেছি। কিন্তু আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।”
“বেশ। তোমাকে জোর করব না। কিন্তু তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। ”
“বলুন। ”
“শিশির কাউকে দেখানোর জন্য না, নিজের কাছে ভালো হয়ে ওঠা আগে জরুরী। তুমি যা কিছু করবে সেটা নিজের জন্য করবে। কে কী ভাবে সেটা নিয়ে একদম ভাববে না। আর বাইরের সব মানুষ স্বার্থপর না। তারপরও কারো কাছ থেকে কোনোরকম প্রত্যাশা করবে না। সবক্ষেত্রেই যে একশতে একশ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সফলতা যেখানে আছে সেখানে ব্যর্থতা থাকবেই। তোমার এখন প্রথম কাজ হচ্ছে বিইং শিশির হয়ে ওঠা।
শিশির সব টা শুনতে লাগলো। রওশন আরা বললেন,
“একটু শুনতে জ্ঞানের মতো লাগলেও তোমার কাজে লাগবে শিশির। তোমার একজন বড়লোক বাবা আছে সেটা আজ থেকে ভুলে যেতে চেষ্টা করো। নিজের ক্রাইসিস নিজে মেটাতে চেষ্টা করো। একটা ব্যাপার কী জানো শিশির, আমাদের জীবনে যদি ক্রাইসিস না থাকে তাহলে লক্ষ্যও থাকে না। বড় গাড়ি, পরিপাটি রুম, মায়ের আদর এগুলো বাদ দিয়ে অন্যরকম একটা জীবন তৈরী করো। জীবনে বৈচিত্র্যতা আনা দরকার। একঘেয়ে জীবন কী আর ভালো লাগে!
শিশির আস্তে করে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”
“তুমি তো তোমার জীবনে যা কিছু পেয়েছো সেগুলো সবাই পায় না। কেউ কেউ আছে যারা এমন একটা জীবনের জন্য দিন রাত ছুটে বেড়ায়। কারো কাছে তো আবার একবেলার জায়গায় দুইবেলা ভাত যোগাড়ের সামর্থ্যও থাকে না। তাই তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সৃষ্টিকর্তার অনেক বড় ব্লেসিং যে তুমি এমন একটা জীবন পেয়েছো। তোমার যেসব আত্মীয়দের ভালোবাসা তোমার কাছে ফেক মনে হয়েছে, অনেকে সেসব পায়ও না। তারা হয়তো ভাবে যে শিশিরের বাবার মতো টাকা থাকলে আমিও এমন গুরুত্ব পেতাম।
শিশির নত মস্তকে বলল,
“আমি এভাবে কোনোদিন ভেবে দেখিনি আসলে।”
“এখন থেকে ভাববে। যে ভুলগুলো তোমার ক্ষেত্রে হয়েছে সেগুলো যেন তোমার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে না হয়। অংকে ষাট পেলে তুমি তোমার ছেলেকে কখনো বলবে না যে এতো কম নাম্বার কেন পেয়েছে! বরং তাকে এপ্রিশিয়েট করবে যে ষাট সংখ্যাটা ভালো তবে এরচেয়েও বেশী পরিশ্রম করলে সংখ্যাটা ষাট থেকে বেড়ে আশি হবে।”
রওশন আরা খানিক থেমে বলল,
“তোমাকে বলা এটাই আমার লাস্ট কথা শিশির। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাকে আর তোমার প্রয়োজন হবে না। শিশির মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমাদের বাবা, মায়েরাও মানুষ। একজন বাবা কিংবা মা একদিনেই বাবা, মা হয়ে ওঠে না। তোমার বাবা নিজেও একদিন ছেলে ছিলো। সে তোমার সঙ্গে যা করেছে তার সঙ্গেও কিন্তু তাই হয়েছে। তোমার বাবা ছেলে হয়ে যা শিখেছিল তোমাকেও তাই শেখাতে চেয়েছে। এটা দোষের কিছু না। তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। তোমার বাবার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তোমার বাবা বলেছেন যে বিন্তীর সঙ্গে তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন একটা কারনে। নিজের ছেলের প্রতি তার বিশ্বাস আছে। শিশির বেয়াদব, উচ্ছৃঙখল হতে পারে কিন্তু খারাপ না। ঠিক মানুষের হাতে পড়লে খাটি সোনায় পরিনত হবে।”
শিশিরের চোখ চকচক করে উঠলো। রওশন আরা হেসে বললেন,
“তুমি যেতে পারো শিশির।”
শিশির চেয়ার ছেড়ে উঠলো না। রওশন আরা বললেন,
“যাও শিশির। এখান থেকে বেরিয়ে স্টেশন অবধি হেটে যাবে। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বাবাকে ফোন করে বলবে যেন ওখানে আসে। এরপর বাবা এলে দুজন মিলে একটা ঝালমুড়ি ভাগ করে খাবে। ঝালমুড়িতে ঝাল যেন বেশী দেয় সেটা বলে দেবে। ঝালে যখন মুখ জ্বলবে তখন সাহস করে বাবাকে বলবে, বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আর হ্যাঁ বিন্তী ভালোবাসে না এটা নিয়ে আর ভেবো না। বিন্তী যেন তোমাকেই ভালোবাসে তেমন ভাবে নিজেকে তৈরী করো।
চলবে….