#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১৭,১৮
#সাবিকুন নাহার নিপা
পর্ব-১৭
শিশির চলে আসার কারনে বিন্তীর মন, মেজাজ সব ঠিক হয়ে গেল। বাড়িতে এসে মন খারাপ হলেও একবারও ভাবে নি যে শিশির এভাবে হুট করে চলে আসবে। শুধু এসেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। ভোর রাতে স্টেশনে নেমে একা একা বাড়ি আসার বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে পুকুরে পড়ে পঁচা পানিতে গোসল করেও এসেছে। বাড়িতে কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না ঠিকই কিন্তু সবাই ই ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো।
শিশির এসে বিন্তীর মায়ের কাছে অভিযোগ করলো যে, বিন্তী ওর ফোনের চার্জার নিয়ে এসেছে। এখন ও কী দিয়ে মোবাইল চার্জ দিবে! তাই চলে এলো।
বিন্তীর মা হাসি লুকিয়ে বিন্তীকে খানিকক্ষন বকাবকি করলো। শিশির তখন আমতা আমতা করে বলল,
“সমস্যা নেই মা, আমি চার্জার নিয়ে কাল ই চলে যাব। আপনার মেয়ে যতো ইচ্ছে হয় থাকুক। ”
বিন্তী অবাক হয়ে গেল। কী অবলীলায় মিথ্যে কথা বলছে। বিন্তী সবার সামনে কিছু বলল না। ঘরে যেতেই শিশির কে ধরলো। বলল,
“আমি তোমার চার্জার নিয়ে এসেছি?”
শিশির নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আনো নি? কিন্তু তুমি আসার পর থেকে চার্জার খুঁজে পাচ্ছি না। ”
বিন্তী চোখ কপালে তুলে বলল,
“কী মিথ্যুক ছেলে তুমি?”
“মোটেও মিথ্যে বলছি না। আর তুমি এখানে বসে ভালো, মন্দ খাবে একা একা কেউ ভাগ বসাতে আসবে না তাই ভেবেছো!”
“তুমি যে বললে কাল চলে যাবে?”
“সে দেখা যাবে। ”
বিন্তী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। শিশির জিজ্ঞেস করলো,
“ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছ? তুমি কী ভাবছ তোমাকে না দেখে থাকতে পেরে আমি এসেছি! মোটেও না। নিজেকে নায়িকা ভাবা বন্ধ করো। ”
“আমি নিজেকে নায়িকা ভাবি না। তুমিই সবসময় হিরোদের মতো হাবভাব করো। ঘরে বসেও সেজেগুজে বসে থাকো। ”
শিশির থতমত খেয়ে গেল। ভালোও লাগলো। বিন্তী তাহলে ও’কে খেয়াল করে। নিশ্চয়ই ভালোও লাগে। তাহলে এখন থেকে আরও বেশি করে সেজেগুজে বসে থাকবে।
****
শিশিরের চার্জারের গল্প আরও কয়েকদফা হলো। প্রতিবারই বলে চার্জার নিয়ে চলে যাবে কিন্তু তিন দিনেও যাওয়া হয়ে উঠলো না। আর ওর চার্জারের গল্প কেউ বিশ্বাসও করলো না। সবাই ই বিন্তীকে খোঁচা মেরে বলতে লাগলো,
জামাই তো তোকে না দেখে থাকতেই পারছিল না রে বিন্তী।
লজ্জায় বিন্তীর মাথা কাটা যাবার পালা। তবুও ওর ভালো লাগছে। ঝগড়ুটে, অসভ্য পাজি ছেলেটা ভাব করে যে ও’কে দেখতেই পারে না। অথচ দেখতে না পেরেই একদিনে ছুটে এলো। দেখতে পারলে কী অবস্থা হতো!
***
শিরিন তিন দিন পর ছেলেকে ফোন করলো। যদিও বিন্তীর থেকে এখানে আসার খবর জেনেছে কিন্তু শিশিরের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা হয় নি। শিরিন ফোন করে বলল,
“কি রে তুই কোথায়?”
“বিন্তীদের বাড়িতে।”
“ওখানে কী করছিস?”
“চার্জার নিতে এসেছিলাম। বিন্তী বদমায়েশী করে চার্জার নিয়ে এসেছে। এদিকে আমার ফোনে চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে গেলে কেউ তো যোগাযোগ করতে পারবে না, তাই চলে আসতে বাধ্য হলাম। ”
“ভালো করেছিস। তুই আবার প্রাইম মিনিস্টার কী না। তোকে ছাড়া সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশন গুলো কিভাবে নিবে। ফোন টা তো সেজন্য দরকার। ভালো করেছিস।”
শিশির চুপ করে থাকে। কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। শিরিন মিটিমিটি হাসে। আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ফিরছিস কবে?”
“আমি তো ফিরতেই চাই। কিন্তু বিন্তীর মা রোজ এতো এতো খাবার বানায় যে ফেরার কথা বলতে লজ্জা লাগে। ভদ্রমহিলা কষ্ট পাবে।”
“হ্যাঁ ঠিকই তো। তাহলে ফেরার দরকার নেই। একবারে বিন্তীকে নিয়ে ফিরিস কেমন! ”
“আচ্ছা। তুমি যখন বলছ তাই হবে। ”
“হ্যাঁ। তুই তো সবসময় অক্ষরে অক্ষরে আমার কথা শুনিস। ”
শিশির আবারও চুপ করে রইলো। শিরিন বলল,
“শোন, তোর বাপ জীবনেও দুদিনের বেশি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকে নি। সেখানে তুই তো অনেক বেশী স্মার্ট। সন্দেহ হচ্ছে তুই আসলেই আমার ছেলে তো! নাকি হসপিটালে কারোর সঙ্গে পাল্টে গেছিলো। ”
শিশির চুপ করে রইলো। সব দোষ ওই বিন্তীর। ওর কী দরকার ছিলো এখানে আসার।
শিরিন আবারও বলল,
“অবশ্য আমি বিন্তীর মতো চোর ছিলাম না। চার্জার তো দূরে থাক, একটা সুতাও চুরি করে নেই নি তোর বাপের। ”
শিশির ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, রাখছি এখন।
শিরিন হেসে ফেলল। বলল,
“আচ্ছা রাখ। বিন্তীকে আনতে ভুলে গেলেও চার্জার আনতে কিন্তু ভুলবি না কেমন! ”
শিশির ফোন টা রেখে দিলো। শিরিন ফোন রেখেও হাসতে লাগলো। তুষারও পাশে ছিলো। শিরিন হাসতে হাসতে বলল,
“তোর বাবা ঠিক মানুষের সঙ্গেই শিশিরের বিয়ে দিয়েছে বুঝলি। শুধু শুধু টেনশন করছিলাম। ”
তুষার হেসে বলল, হ্যাঁ একটা চার্জার চোরের সঙ্গে।
শিরিন ও তুষার দুজন এক সঙ্গেই হাসতে লাগলো।
***
শিশিরের বাবা বাড়িতে থাকেন কম। বেশীর ভাগ সময়ই বাইরে থাকেন। সংসারের খবরাখবর সব ই শিরিনের কাছ থেকে পান। শিরিন অবশ্য খারাপ কিছু ঘটলে বলে না তবে ভালো টা বলতে ভুল করে না। কিছু দিন আগে যখন শিশিরের খালার সঙ্গে ঝামেলা শুনলো তখন শিরিন হেসে বলেছিল,
“বউপাগল ছেলে বউয়ের নিন্দে সহ্য করতে পারে নি। ”
আজ যখন শিশিরের ঘটনা শুনলো তখন নিশ্চিন্ত হলো। দুজনের ভাব ভালোবাসা হলে খুব ভালো। শিশিরের অগোছালো জীবনে বিন্তীর মতো বুদ্ধিমতি ঠান্ডা মাথার মেয়ে দরকার। তবে যদি ছেলেটার একটু গতি হয়। নাহলে এই ছেলে বাপের পয়সায় আজীবন বসে বসে খেয়ে ঘুমাবে।
শিশিরের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন বিন্তীর সঙ্গে কথা বলবেন। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলের যদি একটা গতি করা যায়! বিন্তী বললে হয়তো শুনবে। দায়িত্ব নিতে শিখে যাবে।
***
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে যখন দুজন ঘুমাতে গেল তখন বিন্তী বলল,
“তুমি যাবে কবে?”
শিশির ফোন দেখছিল। সেই অবস্থায়ই বলল,
“মা থেকে যেতে বলেছে। বলেছে তোমাকে নিয়ে ফিরতে। ”
“আমি কিন্তু শিগগির ফিরব না।”
শিশির কথা না বলে বিন্তী কে একবার দেখলো। তারপর বলল,
“কেন আমি থাকলে কী সমস্যা? ”
“সমস্যা নেই। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি এতোদিন থাকলে লোকে কী ভালো চোখে দেখবে!’
শিশিরের মেজাজ খারাপ হলো। উঠে বসে বলল,
“তুমি যখন আমাদের বাড়ি থাকো! তখন কেউ কিছু বলে?”
“দুটো ব্যাপার কী এক?”
শিশির রাগী গলায় বলল,
“তোমার সমস্যা কী? আমি কী রাতে নাক ডাকি যে তোমার সমস্যা হচ্ছে! ”
“আমি কী বলেছি আমার কোনো সমস্যা? সব সময় এতো রাগ দেখাও কেন!”
“তোমাদের বাড়ির সবাই খুব ভালো। কারোর কোনো সমস্যা নেই। যদি কেউ কিছু বলেও থাকে আমি শিওর যে তুমি তাদের শিখিয়ে দিয়েছো। ”
“আমি কেন শিখিয়ে দেব!’
“কারণ তুমি একটা হিংসুটে মহিলা। ”
“আমি হিংসুটে।”
“হ্যাঁ। ঝুম্পার কাহিনী আমি ভুলি নি। ”
বিন্তী খানিকক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি মীরজাফরের শ্বশুর। এইজন্যই কারোর ভালো করতে হয় না। ”
“ভালো করেছো তার জন্য গিফট দিয়েছি। এতো প্যান প্যান করো কেন? তোমার সমস্যা কী। আমি বিছানায় থাকলে সমস্যা? আচ্ছে নেমে যাচ্ছি। ”
শিশির বালিশ নিয়ে নেমে গেল। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়লো। বিন্তী বাঁধাও দিলো না আর কোনো কথাও বলল না। শিশির শুয়ে শুয়ে বিন্তীর ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলো। দশ মিনিট হয়ে যাবার পরও বিন্তী ডাকলো না। শিশির মনে মনে বলল,
“নিষ্ঠুর কালনাগিনী! মনে একটু দয়ামায়া নেই। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে অভিশাপ দিলাম তোর ঘর ছানাপোনায় ভরে যাবে। চারদিকে হাসের বাচ্চার মতো পিলপিল করবে। কোলে উঠে পিশাব, পায়খানা করবে। কেঁদেও কুল পাবি না, আর আমি শিশির তখন একটা টিস্যুও এগিয়ে দেব না দেখিস। ”
আরও দশ মিনিট এভাবে কেটে গেল। শিশিরের এবার ইচ্ছে করলো উঠে গিয়ে গায়ে হাত পা তুলে ঘুমের ভান করে থাকতে। শয়তান টার স্বাদের ঘুম ছুটে যাবে।
শিশির এক থেকে দশ গুনতে লাগলো। এরমধ্যে না ডাকলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাবে আজ।
সাত অবধি গোনার পর বিন্তী ডাকলো,
“শিশির নাটক শেষ হলে উঠে আসো। ”
শিশির রাগে ফোসফোস করে বলতে লাগলো,
“না। কাল সকালে বিদায় হবো৷ বাস, ট্রেন না পেলে হেটে যাব। আর বলে যাব যে সারারাত আমাকে মেঝেতে ঘুমাতে দিয়েছে। ”
বিন্তী উঠে এসে বলল,
“চলো। কাল সকালে কী হবে সেটা কাল দেখব। এসো। ”
শিশির বলল,
“না।”
বিন্তী নরম গলায় বলল, চলো শিশির। ঠান্ডা লাগবে। তুমি এখানে ঘুমালে আমারও ঘুম হবে না।
শিশিরের মন মেজাজ মুহুর্তেই ভালো হয়ে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“একটা শর্তে যাব। ”
“কী শর্ত?”
“তুমি যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাও।”
শিশির বিন্তীর রিয়েকশন দেখার জন্য তাকিয়ে আছে। বিন্তীর নাকের পাটা ফুলে উঠছে। রাগী গলায় বলল,
“এখানেই ঘুমাও। ঠান্ডা লাগিয়ে কঠিন অসুখ বাঁধালে বস্তা ভরে স্টেশনে ফেলে রেখে আসব। ”
বিন্তী গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে শিশির বিছানায় আসলো। এসে ভয়ংকর এক কান্ড ঘটালো। বিন্তীকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো। বিন্তী ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বিরক্ত হলো। ইশ! গায়ে কী জোর!
চলবে….
#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১৮
শিশির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো। বিন্তী নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করলে শিশির আরও ভয়ংকর কান্ড ঘটালো। এলোপাথাড়ি কয়েকটা চুমু দিলো। বিন্তী ফিসফিস করে বলল,
“শিশির কী অসভ্যতা হচ্ছে?”
শিশিরও ফিসফিস করে জবাব দিলো,
“অসভ্য বলেই তো অসভ্যতা করছি। ”
“ছাড়ো। ”
“না। ”
“তুমি আসলেই অসভ্য।”
“আরও আগে হওয়া উচিত ছিলো। তাহলে তোমার বাড়াবাড়ি ছুটে যেত। ”
বিন্তী আর কথা বলল না। নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। শিশির ওভাবে আরও কিছুক্ষন ছিলো। কিছু সময় বাদে ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো।
বিন্তী এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। ছেলেটার কী সাহস! আশ্চর্য ব্যাপার হলো বিন্তীর যতটা রাগ হবার কথা ততোটা হচ্ছে না। এমনকি খারাপও লাগছে না। বিন্তী নিঃশব্দে হাসলো। শিশির ওর প্রেমে পড়েছে। কী ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার! উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু এক সঙ্গে! ভাবা যায়!
বিন্তীর রাতে ভালো করে ঘুমও হলো না। শিশির এপাশ ওপাশ করে ভালোই ঘুমিয়েছে। বিন্তী কিছু সময় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো, আবার কিছু সময় হাতের আঙুল গুলো ধরলো।
ভোরের আলো খানিকটা স্পষ্ট হবার পর শিশিরের মুখ টা স্পষ্ট দেখতে পেল। ঘুমানো অবস্থায় দেখতে কতো শান্ত মনে হয়! অথচ এই ছেলেটাই পাড়ার দুষ্ট মহিলাদের মতো পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করতে পারে। বিন্তী আবারও নিঃশব্দে হাসলো। হাত বাড়িয়ে শিশিরের ঠোঁট টা ছুঁয়ে দিলো। অমনি সঙ্গে সঙ্গে শিশির চোখ খুলে হাসি দিলো। বিন্তী হাত সরিয়ে নিতে গেলে শিশির ওর হাত টা চেপে ধরলো। এক চোখ টিপে জিজ্ঞেস করলো,
“তারমানে আমার আদর তোমার খুব ভালো লেগেছে তাই তো?”
বিন্তী চোখ বড় বড় করে তাকালো। শিশির বিন্তীর হাতে একটা চুমু খেল। বিন্তী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“অসভ্য ছেলে। ইতরামির আর জায়গা পাও না?”
শিশির শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
“আমার অসভ্যতা তো তোমার ভারী ভালো লেগেছে। ”
বিন্তী রাগ দেখিয়ে বলল,
“এক থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেব পাজি ছেলে। ”
শিশির হাসতে লাগলো। বলল,
“সমস্যা নেই দাঁত ফেলে দিলে। তোমার যেগুলো আছে সেগুলো ভাগ করে নেব। ”
বিন্তী উঠে চলে গেল। শিশির আবারও হেসে ফেলল। আজ সকাল টা এতো সুন্দরভাবে শুরু হলো। সারাদিন টা মনে হয় খুব ভালোভাবে যাবে।
****
সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে শিশির আর বিন্তী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। শিশিরের অবশ্য যাবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু বিন্তী নিজে থেকেই বলল যে ওর আর ভালো লাগছে না তাই ফিরে যাবে। শিশিরও শেষমেস রাজী হলো।
বিন্তী অবশ্য ফিরতে চাইলো অন্য কারনে। একদিন ওর ছোট বোন ঐশী এসে বলল,
“আপা যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ। বল।”
“ভাইয়া কী পড়াশোনা আর কন্টিনিউ করবে না?”
বিন্তী স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তা তো জানিনা। কেন?”
“আপা রাগ কোরো না। ভাইয়ার কিন্তু অন্তত গ্রাজুয়েশন টা কমপ্লিট করা উচিত। ”
বিন্তীর চোয়াল শক্ত হলো। বলল,
“পড়াশোনা করবে কী করবে না সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোর সেটা না ভাবলেও চলবে। তোর আমার উচিত অনুচিতে নিশ্চয়ই শিশির চলবে না। ”
“আপা রাগ কোরো না। আত্মীয় স্বজন রা দেখা হলেই আগে জিজ্ঞেস করে ভাইয়া কী করে, পড়াশোনা কতদূর। যখন সত্যি টা শোনে তখন ভাবে আমরা ভাইয়াদের টাকা দেখে বিয়ে দিয়েছি। এই ব্যাপার গুলো আমাদের ফেস করতে হয় তাই বললাম। ”
বিন্তী চুপ করে যায়। কিছু বলার খুঁজে পায় না। ঐশীর কথায় লজিক আছে। কিন্তু ও বা কী করবে! শিশির আগেই ওকে বলে দিয়েছে যে ওর লাইফস্টাইল আর পারসোনাল বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করা যাবে না। আর বিন্তী ই বা কেন করতে যাবে। শিশির অন্য বিষয়ে পাগলামী করলেও বিন্তীর এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত কখনো বলে না। ওর বাড়ির লোকও কখনো বলেনি। সেখানে ও কিভাবে বলবে।
বিন্তীকে চুপ থাকতে দেখে ঐশী বলল,
“আমাকে ভুল বুঝো না। আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো। ”
শুধু এখানেই থামলো না। বিন্তীর মায়ের সঙ্গে শিশির গল্প করছিল তখন হঠাৎ করে বলে ফেলল,
“একটু কাজ বাজে সিরিয়াস হও বাবা। বিয়ে করেছো এখন একটু সিরিয়াস হও।”
বিন্তীর মন টা খারাপ হয়ে গেল। শিশির অবশ্য কিছু বুঝলো না। ও ওর মতো বলতে লাগলো যে, কাজবাজ ওর ভালো লাগে না, ঘুরেফিরে শুয়ে বসে মজার মজার খাবার খেতেই ওর ভালো লাগে।
বিন্তীর মা আবারও বলল,
“তাই বললে কী হয়! তোমাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না। বিন্তীর একটা ভবিষ্যৎ আছে। ”
মা কথাগুলো আর দশ টা সাধারণ মায়ের মতো বললেও বিন্তীর খুব স্বার্থপর মনে হলো। এই মায়ের মেয়েটার সম্মান বাঁচাতে ছেলেটা বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর ছেলেটা ভালো না হয়ে খারাপও তো হতে পারতো। বিন্তীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করতে পারতো।
ফেরার সময় আরও কয়েকজন বলল,
“একি জামাই তোমরা এখনই যাও ক্যান? মোটে তো এক সপ্তাহ থাকলা। আর তোমার তো চাকরি বাকরি নাই। বাপের হোটেলে খাও। আর কয়টা দিন থাকো।”
শিশির কিছু মনেই করলো না। হেসে বলল,
“আবার যখন বিন্তীর বাড়ির কথা মনে পড়বে তখন চলে আসব। ”
বিন্তী মনে মনে বলল, শিশির দুনিয়ার মানুষ গুলো তোমার মতো সোজাসাপটা না। এদের প্যাচগোছ তুমি বুঝবে না। তুমি বড্ড ভালো!
***
স্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। ট্রেন আসবে ঘন্টাখানেক পর। দুজনে প্ল্যাটফর্মে বসে রইলো। শিশির বলল,
“ট্রেনে ওঠার সময় তুমি আমার হাত ধরে থেকো। ”
“কেন? আবার যদি তুমি ট্রেন মিস করে ফেলো এইজন্য? ”
“না। যদি তুমি ভীরের মধ্যে হারিয়ে যাও।”
বিন্তী মৃদু হাসলো। এর আগে অসংখ্য বার ট্রেনে আসা যাওয়া করেছে কিন্তু তখন ও’কে হারানোর ভয় কারো হয় নি।
শিশির লক্ষ্য করলো বিন্তীর মুখ টা ভার। বলল,
“তোমার কী মন খারাপ? ”
“না। ”
“তাহলে মুখ ভার কেন!”
“এমনি।”
“বাড়ির লোকের জন্য খারাপ লাগছে? আর ক’টা দিন থাকলেই পারতে।”
“ঢাকা শহর টা’কে খুব মিস করছিলাম।”
“ধ্যাৎ! ধূলোর শহর টা’কে মিস করার কী আছে! আমার তো তোমাদের গ্রাম খুব ভালো লাগে। তোমাদের বাড়ির লোকগুলোকেও। ওরা খুব ভালো লাগে।”
বিন্তী শিশিরের চোখের দিকে তাকালো। বলল,
“আমার ওই ধূলোর শহর ই ভালো লাগে। ধূলো মাখা রাস্তার খাবার। ইট, পাথরের বড় বাড়ি। আর সেখানকার ঝগড়ুটে মানুষগুলো। বেশী ভালো মানুষ সহ্য হয় না। আমি আবার একটু খারাপ তো তাই। ”
শিশির ঠোঁট টিপে হেসে অন্যদিকে তাকালো। বিন্তী তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
“পবিত্রতা, সরলতা, ভালো মানুষের কোনো দাম নেই শিশির। দাম শুধুই কেবল যোগ্যতা আর টাকা পয়সায়।”
চলবে….