হারানো সুর (১২ সমাপ্তি পর্ব ​)

হারানো সুর (১২ সমাপ্তি পর্ব )
সানজিদা ইসলাম সেতু

হলুদ-সবুজ শাড়ি কি অপরূপাই না লাগছে বিন্দুকে। আহসান সাহেবের মুখে চওড়া হাসি। বাকি কারো মুখেই মনের হাসি নাই, মুখে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে ঘুরছে সবাই। রিধি বিন্দুর পাশে বসে আছে। বিন্দুর মুখে কোনো রা নেই। কক্সবাজার থেকে ফেরার পর থেকে নিজেকে একরকমের ঘরবন্দী করে রেখেছে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলে না। বিশ্ব খুব রেগে অাছে বিন্দুর উপর। কোনো কথাই বলছে না ও, যদিও বিন্দু অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। বিশ্ব ওর বাবার সাথেও কোনো কথা বলে নি। এ নিয়ে আহসান সাহেবের তেমন কোনো মাথা ব্যথাও নেই, সে মেয়েকে নিয়েই বেশ সন্তুষ্ট।

মেয়ের সিদ্ধান্তে আহসান সাহেব বেজায় খুশি। বিন্দু রা কক্সবাজার থাকাকালীনই মৃণাল ওরফে অর্পনের পরিবারের সাথে সব কথা সেরে রাখে আহসান সাহেব। ফেরার ১ মাসের মধ্যেই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়।

বৃত্ত সেই রাতের পর আর বিন্দুর সাথে কোনো কথা বলে নি।

শেষ বারের মতো বিন্দুর সামনে দাড়ায় বিশ্ব।
‘তুই বললে কিন্তু আমি এখনও বাবার সাথে কথা বলতে রাজি আছি।’
‘না ভাইয়া। আমি মেয়ে হয়ে বাবার সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারব না। যা হচ্ছে হতে তে।’
‘বৃত্তর কথা একবারও ভাববি না? এই কথা গুলো অন্তত বৃত্তকে জানাতে দে। ছেলেটা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। ‘
‘সময়ের সাথে সাথে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তুই যদি মেয়ে হয়ে বাবার সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করতে না পারিস, তবে অামিও আমার বোনের বোনের জীবন এভাবে শেষ হতে দেব না। এবার যা করার অামি অার বৃত্ত করব।’
‘বৃত্ত কে ভাইয়া? ও এখন আমার অতীত ছাড়া অার কিছু না।’
‘তোকে শেষ বারের মতো বলছি, সবটা বৃত্তর সামনে বল।’
‘না।’
‘ইচ্ছে করছে তোকে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় মারি।’
‘এখনও সময় আছে, ইচ্ছে পূরণ করতে পারিস
‘সরি মৃত্তিকা। এবার যা হবে সবটা বৃত্ত অার ওর ভালোবাসার পক্ষে হবে। অার অর্পণ ওর আসল যায়গায় ফিরে যাবে।’

বিন্দু আস্তে করে চোখের পানি মুছে নেয়। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছে। মন সাজতে চাইছে একজনের জন্য, আর পরিস্থিতি বাধ্য করছে অন্য আরেকজনের জন্য সাজতে।
বীনা রুমে এসে বিন্দুর হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। ইউএস থেকে রিজভী ফোন করেছে।
[রিজভী-কে নিশ্চয়ই ভুলে জাননি]
হাসি মুখে ফোন রিসিভ করে। রিজভীর মুখ দেখে হেসে দেয় বিন্দু।
‘বিয়ে আমার অার মুখ গোমড়া করে তুই বসে আছিস।’
‘দূরে আছি বলে এটা ভাবিস না যে আমি কিছু জানি না। বিশ্ব ভাইয়া আমাকে সবটা বলেছে। আমি যদি ওখানে থাকতাম না মেরে তোর গাল লাল করে দিতাম।’
‘সবাই এটাই বলছে।’
‘এমন কাজই তুই করেছিস। আচ্ছা মৃত্তিকা এখনও তো সময় আছে, মামাকে সবটা বল।’
‘কিছুক্ষণ পরই বরের বাড়ির সবাই হলুদের অনুষ্ঠানে এসে যাবে। তোর সঙ্গে পরে কথা হচ্ছে।’
‘যা করছিস তা ভালো করছিস না।’
কিছু না বলে ফোন কেটে দেয় রিজভী। এর পরই ফোন করে বৃত্তকে।

‘এ সব কি হচ্ছে ভাইয়া? মৃত্তিকা না হয় ভুল করছে তাই বলে তুমিও ওর সাথ দেবে?’
‘জোর করে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না রিজভী।’
‘তুমি কি জানো তোমার বিন্দু তোমার কতটা ভালোবাসে?’
‘সবটা জানি আমি।’
‘তাহলে কেন নিজেদের জীবন শেষ করছ? তুমি চাইলেই কিন্তু সবটা ঠিক হতে পারে। আজ তো হলুদের অনুষ্ঠান, বিয়েতে এখনও অনেকটা সময় আছে। তুমি বিন্দুকে তুলে আনো প্রথম দিন যেমন ভাবে নিয়েছিলে।’
‘না রিজভী, সেটা হয় না। আমি এখন ওর জীবনে এক্সজিস্ট করি না। রিজভী, আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে, সে পথ আর কোনোদিন মিলবার নয়।’
‘আর কিছু বলার নেই তোমাদের। তবে যা হল তা একদমই ভালো হল না।’

‘মনে করো, আমি যদি কোনোদিন হারিয়ে যাই তুমি কি আমাকে মিস করবে?’
‘এসব কথা ছাড়া আপনার যদি আর কোনো কথা না থাকে তবে আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। বল না তুমি কি আমাকে মিস করবে?’
‘আপনি কি ছোট বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবেন।’
‘একবার বল না ভালোবাসি।’
‘মুখে বললেই কি ভালোবাসা হয়? অনুভবেও অনেক কিছু থাকে।’
,’বাহ কি সুন্দর কথা।’
‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’
‘ইস, যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম কতটা ভালোবাসি।’
‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।’
‘সেটা সময়ই বলে দেবে। তুমি শুধু একটা কথা মনে রেখ, তুমি শুধু আমার শুধু আমার।’

‘আমাকে ক্ষমা করবেন বৃত্ত। ২২ বছরের ভালোবাসার দাম রাখতে গিয়ে ৩ বছরের ভালোবাসাকে দাফন করে দিলাম। কি করব বলুন? মেয়েদের জীবন তো এতোটা সহজ না। মেয়েদের জীবন টিভির মতো, অার সেই টিভির রিমোট থাকে অন্যের হাতে। রিমোট যার হাতে থাকবে সে যেমন চাইবে তেমন ভাবেই টিভি চলবে। বর্তমানে আমি তেমনই চলছি।
দেখুন যে হাতে সব সময় আপনার নামে মেহিদি পরতাম সে হাতে আজ অন্যের নামের মেহিদি লাগিয়ে দিল। আপনি বারন করার পর আমি সাজি নি, আজ ওরা অন্যের জন্য সাজিয়ে দিল।
সব কিছু পাল্টে গেছে বৃত্ত। পথ আলাদা হয়ে গেছে, কিন্তু মন, মন কি আলাদা হয়েছে? জানি না। তবে এটা জানি বিন্দু আপনাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আপনার অনুপস্থিতি আবারও আমাকে জিন্দা লাশ করে দেবে।
কি আর করার? আমি যে সম্পকের জালে বাঁঁধা পরে গেছি, সে জাল কেটে বের হওয়া আমার কাছে অসম্ভব।
মাফ করে দেবেন আমাকে। ‘

‘তুমি আর আমার নও বিন্দু, আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছ। অামার ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে তুমি চলে গেছ। সেদিন তোমাকে খুব ভালোকরে দেখেছিলাম। নিরদ্বিধায় তুমি ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে দিয়েছিলে। এতোদিনেও কি আমি তোমাকে আমার ভালোবাসা বুঝাতে পারি নি? তুমি তো নিজ মুখে স্বীকার করেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে অর্পণকে বিয়ে করার জন্য আমার সাথে ডিভোর্স করলে কেন?’

বিন্দুর সামনে দাড়িয়ে আছে বৃত্ত। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের ভাষায় না বলা অনেক কথা চোখের ভাষায় অাদানপ্রদান করছে ওরা। কাজি বারবার বিন্দুকে কবুল বলতে বলছে অার বিন্দু বৃত্তর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কবুল বলে দাও বিন্দু, বলে দাও। এটা একমাত্র উপায় সবার মুখে হাসি ফোটানোর, এমনকি আমারও। এই দেখ আমি হাসছি, আমি কত খুশি তোমার বিয়েতে। তবে তুমি কেন খুশি হতে পারছ না?
তোমার কাছে তো কখনো কিছু চাইনি, আজ চাইছি। কবুল বলে দাও প্লিজ।’
‘জীবন দশায় বিন্দু বৃত্ত ছাড়া আর কারোর হতে পারে না। বিন্দুর জীবনে বৃত্ত ছাড়া আর কারোর কোনো কোনো জায়গা নেই।’
আসর ছেড়ে বিন্দু উঠে এসে বৃত্তর সামনে দাড়ায়। টলছে ওর। বৃত্ত ধরে বিন্দুকে।
‘শুধু আপনাকেই ভালোবাসি। কি করে অন্যের সাথে জীবন জরাই বলুন। অাপনি বলতেন না, বিন্দু ছাড়া বৃত্ত অসম্পূর্ণ। আজ অামি বলছি, আপনাকে ছাড়া অামি অসম্পূর্ণ।’
কথা বলতে বলতে বিন্দু মাটিতে বসে পরে।
‘আপনি তো আমার থেকে অনেক কথা আদায় করে নিয়েছেন, এবার আমার পালা। কথা দিন, নিজের খেয়াল রাখবেন। একদম খাবারে অনিয়মিত হবেন না।’
কথা বলার সময় বিন্দুর শ্বাস আটকে আটকে যাচ্ছিল। দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।
‘তুমি এতো কথা বলছ কেন? তোমার তো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। চুপ করে থাক প্লিজ।’
‘প্লিজ আটকাবেন না। এখন বলতে না পারলে, আর সময় পাব না। আমার যে সময় কমে অাসছে যে।’
‘তুমি এমন বলছ কেন? কি হয়েছে তোমার?’
‘নিজের কোনো ব্যাপারে যদি কোনো অনিয়ম করেন তাহলে কিন্তু আমি খুব রাগ করব।’
ততক্ষণে সবাই বিন্দুর পাশে এসে জরো হয়।
‘মৃত্তিকা মা, তোর কি হয়েছে?’
‘আমি তোমাকে দেয়া কথা রাখতে পারলাম না বাবা। তোমার সম্মান আমি রাখতে পারলাম না। ক্ষমা করে দিও আমায়।’
‘বিন্দু কি হয়েছে তোমার, প্লিজ বল, বিন্দু।’
বৃত্তর বলা শেষের কথা বিন্দুর কান পর্যন্ত পৌছায় নি। তার আগেই বিন্দুর চোখ বন্ধ হয়ে যায়। উপস্থিত কারোর মাথায় কি আসছিল না যে এখানে হচ্ছে টা কি? বীনা পানি এনে মুখে ছিটানোর পরেও বিন্দুর জ্ঞান না ফেরাতে সবার টনক নড়ে। রাহিম বিন্দুর হাত ধরে ওকে ডাকতে নিলে কি মনে যেন ওর পালস চেক করে। রাহিম ছিটকে সরে যায়।
‘কি হয়েছে রাহিম ভাইয়া? আপনি ওভাবে সরে গেলেন কেন?’
‘মৃত্তিকা, মৃত্তিকা ইজ ডেড।’
এক শ্বাসে কথা শেষ করে রাহিম। রাহিমের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও মজা করছে না। কে কিভাবে রিয়েকশন করবে তা বুঝতে পারছে না।
‘বিন্দু এই বিন্দু, চোখ খোল প্লিজ। রাহিম ভাইয়া যা বলছে তা সব মিথ্যা। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না। সব কিছু মিথ্যে প্রমান করতে চোখ খোল প্লিজ। বিন্দু বিন্দু… ‘

বিয়েতে তৈরী করা পায়েস চিনাবাদাম দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। চিনাবাদামে বিন্দুর এলার্জি আছে। অার এই পায়েস বিন্দু বেখেয়ালে খেয়ে ফেলেছিল, এই এলার্জির কারনে ওর শ্বাসনালী ফুলে যায় আর ওর মৃত্যু হয়। যদি আগে থেকে কেউ এটা বুঝতে পারত তাহলে হয়ত বিন্দুকে বাঁচানো যেত।
বিয়ে বাড়ি শোকে পরিনত হয়েছে। পুলিশ এসে অর্পনকে নিয়ে গেছে। চিত্ত সবাইকে সবটা জানায়। আহসান সাহবে নিজের ভুল সবটা বুঝতে পারে।
যদি এই ঘটনা গুলো আরো কিছুক্ষণ আগে ঘটত তাহলে হয়তো পরিবেশটা সুখের হত।

বৃত্তর বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। মানুষিক ভাবে খুবই বিধ্বস্ত। সারাদিন শুধু বিন্দুর নাম যপে যাচ্ছে। ইখতিয়ার মজুমদার নিজের ভুলে অনুতপ্ত।

সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেটা পেরিয়ে গেলে সব কিছু হাতের বাইরে চলে যায়। ঠিক যেমন বৃত্ত-বিন্দুর ক্ষেত্রে হল। এমনটা তো না হলেও পারত। ছোট, সুন্দর আর ভালোবাসায় জরানো খুব সংসার হতে পারত দুজনের। কিছু মানুষের সময়ের অপব্যবহার এর কারনে দুটো জীবন শেষ হয়ে গেছে।

সুর না থাকলে যেমন গানের সৌন্দর্য থাকে না, ঠিক তেমনি ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ না থাকলে জীবনের সৌন্দর্য থাকে না। বৃত্তর জীবন থেকে দুটোই হারিয়ে গেছে। ওর জীবনের সুর হারিয়ে গেছে। সেই হারানো সুর কোনো দিন ফিরবে না ওর জীবনে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here