হারানো সুর (১১)
সানজিদা ইসলাম সেতু
রিসোর্টের একটা রুমে বসে আছে বৃত্ত, চিত্ত, চিত্রা, মম, বিন্দু, রিধি, বিশ্ব, রাহিম। বৃত্ত ওর চেহারা বদলে যাবার ঘটনা আবার বলে। বিশ্ব আর রাহিম অবাক হয়ে সব শুনছিল। বিন্দু পুতুলের মতো সবার কথা শুনছে, কিছু বলছে না। বৃত্ত উঠে দাড়ায়।
‘এখানে উপস্থিত অনেকেই জানে এবং মানে যে, আমি সাড়ে তিন বছর আগে কক্সবাজারে একজনকে খুন করেছি। এবার আমি বলি হ্যাঁ আমি খুন করেছি। তবে…তবে তার আগে আপনাদের একটা জিনিস দেখাচ্ছি। ‘
বুত্ত রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে প্রজেক্টের অন করে। শুরুতেই স্ক্রিনে অর্পণ সিকদার এর ছবি ভেষে ওঠে।
‘এটা কার ছবি?’
‘এটা তো অর্পণ সিকদার এর ছবি।’
‘ইউ আর রাইট বিশ্ব। এটা অর্পণ সিকদার এর ছবি। এবার আরেকটা ছবি দেখ।’
বৃত্ত এবার স্ক্রিনে মৃণাল আর ছবি দেখায়।
‘এটা কার ছবি?’
‘মৃণাল। যার সঙ্গে মৃত্তিকার বিয়ের কথা হচ্ছে।’
কথা শেষ করে নিজের মুখ চেপে ধরে রিধি। মুখ ফসকে বিন্দুর বিয়ের কথা বলে ফেলেছে। বৃত্তর দিকে তাকিয়ে ও সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। বৃত্ত হাসছে।
‘আপনি হাসছেন?’
‘বিন্দুর হাড়ির সব খবর আমার কাছে আছে। এবার সামনে আগাই।
আমি এবার অর্পন আর মৃণাল এর ছবি কোলাজ করছি।
এবার দেখুন তো এই দুটো ছবির মধ্যে কোনো মিল পান কি না?’
বৃত্তর কথায় সবাই খুব মনোযোগ নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। এবার রাহিম মুখ খোলে।
‘মৃণাল এর মোটা ফ্রেমের চশমা আর মোটা গোঁফ যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে তো..’
‘ইয়েস রাহিম ভাইয়া, আপনি যেটা ভাবছেন সেটাই রাইট। অর্পন সিকদার ই মৃণাল।’
‘তার মানে সেদিন অর্পন মারা যায় নি?’
‘হ্যাঁ। সেদিন আমি ওকে আঘাত ঠিকই করেছিলাম অার ওর ব্লাডও বের হয়েছিল। কিন্তু সেটা ফেক ব্লাড ছিল। আমি ওকে আঘাত করতে পারি এমনটা ভেবেই ও সব প্রিপারেশন নিয়েই এসেছিল।’
বৃত্তর কথায় উপস্থিত সবাই কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পুরো রুমে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে।
বৃত্ত বিন্দুর সামনে হাটু গেড়ে বসে পরে।
‘তোমার কি এখণও মনে হচ্ছে আমি খুনি?’
বিন্দু কিছু না বলে বাইরে চলে যায়। বৃত্তও বিন্দুর পিছনে যায়।
পুল পাড়ে গিয়ে দাড়ায় বিন্দু। পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখে বৃত্ত।
‘আমাকে একা থাকতে দিন প্লিজ।’
‘আমার প্রশ্ন..’
‘প্লিজ।’
‘ওকে।’
বৃত্ত আবার রুমে ফিরে আসে।
‘সরি বৃত্ত, আমরা না জেনেই তোমাকে অনেক বাজে কথা বলেছি।’
‘ইট’স ওকে বিশ্ব, তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এমনটাই করতাম।
কিন্তু আমার বিন্দুকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। ও এখনও কোনো কথা বলছে না।’
‘ওকে একটু সময় দাও, সবটা ঠিক হয়ে যাবে।’
‘হুম।’
এতোক্ষণে মুখ খুরে চিত্ত।
‘সবটা তো হল, কিন্তু মৃণাল ওরফে অর্পণ সিকদার এর কি ব্যবস্থা করবে?’
‘আমি তো ওর জন্য স্পেশাল কিছু প্লান করছি।’
‘ কি করেছ?’
‘…………..……’
‘সর্বনাশ! এ প্লানে আমি নেই।’
‘এই প্লানে সব চেয়ে বড় কাজ তোমার রিধি।’
‘বাঘিনীর খাঁচায় আমায় কেন ঠেলছ? যদি সব তালগোল পাকিয়ে যায়?’
‘বি পজিটিভ রিধি। আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। তুমি শুধু বিন্দুর দিকে খেয়াল রাখ, বাকিটা আমরা বুঝে নেব।’
‘রিধি চিন্তা করিস না, বাড়িতে আমি, ফাইজা আর বীনা তো আছি।’
‘তাহলে বৃত্ত আমরা কাল ঢাকায় ব্যাক ারে ওদিকটা দেখছি।’
‘ওকে ভাইয়া।’
‘তুমি বিন্দুকে নিয়ে কবে ফিরবে?’
‘৫ দিনের ট্যুর। ট্যুর শেষ হোক, আমি ওকে আর রিধিকে বাড়িতে পৌঁছে দেব।’
পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে বিন্দু। কানে বৃত্তর বলা কথা গুলো বাজছে।
‘কি ভাবে নিজেকে, সবসময় ওনার যা মনে হবে তাই করে যাবে? আমার অার অামার ইমোশনের কোনো দাম নেই ওনার কাছে। একটা পুতুলের মতো সবসময় ব্যবহার করে গেছে।
ইচ্ছে হয়েছিল ভালোবাসা অভিনয় করেছিল, ইচ্ছে হয়েছিল বিয়ে করেছিল, ইচ্ছে হয়েছিল চলে গিয়েছিল, আর এখন ইচ্ছে হয়েছে আপন করতে ফিরে এসেছে।
এ পৃথিবীর কারো কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। যার যখন যেমন ইচ্ছে তেমন করে যাচ্ছে আমার সাথে।
সবাই ভুলে গেছে আমি একটা মানুষ, আমারও একটা মন আছে, আমারও কষ্ট হয়।
একদিকে বৃত্ত খেলছে আমাকে নিয়ে, অপরদিকে অর্পণ সিকদার।
কি করব আমি? নাহ এভাবে চলতে পারে না। আমার জীবন আমাকেই ঠিক করতে হবে। না আমার জীবনে বৃত্তর কোনো জায়গা আছে, না অর্পণ সিকদার কোনো জায়গা পাবে।’
পানি থেকে পা তুলে রিসোর্টের ভিতরে যাবার জন্য পা তুলে বিন্দু। কিন্তু পা ভিজে থাকার কারনে পিছলে পড়ে যায়।
বৃত্ত কিছুটা দূর থেকে দেখে বিন্দু পরে গেছে। ও আসতে আসতে বিন্দু হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছে। বৃত্ত যখন পুলে নামে বিন্দু ততক্ষণে তলিয়ে গেছে। এতক্ষণে সবাই পুলসাইডে এসে গেছে। পুলে নামতে নামতে বৃত্ত চিত্তকে বলে পুল সাইজের সব আলো নিভিয়ে দিতে। চিত্রা রুম থেকে চাদর নিয়ে আসে।
পানি থেকে বিন্দুকে তুলে শুয়িয়ে দেয় বৃত্ত। পেট চেপে পানি বের করে নেয়। অজ্ঞান হয়ে যায় ও। চাদরে মুড়িয়ে রুমে নিয়ে যায় ওকে। রিধি বিন্দুর ড্রেস পাল্টে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বিন্দুর জ্ঞান ফিরে আসে। বৃত্ত রুমে আসলে রিধি রুম থেকে বের হয়ে যায়। বৃত্তকে দেখেও বিন্দুর কোনো ভাবান্তর হয় না। বৃত্ত বিন্তুর পাশে বসে ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নেয়। বিন্দু এক ঝটকায় বৃত্তর হাতের মধ্যে থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
‘সবটা জানার পরও তুমি এমন করবে? কথা বলবে না আমার সাথে?’
‘আমি অর্পণ সিকদারকেই বিয়ে করব।’
‘তুমি চাইলেও সেটা করতে পারবে না। তুমি আমার স্ত্রী বিন্দু। আইনত তুমি এটা করতে পারবে না আর আমি এমনটা হতেও দেব না।’
‘তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দিন আমাকে।’
‘তোকে মেরে ফেলবে তাও তোকে ডিভোর্স দেব। এই কথা যদি ২য়বার মুখে আনিস তোর জিব টেনে ছিড়ে নেব।’
‘মেরে ফেলুন আমাকে, অন্তত দিনে দিনে মরে যাওয়ার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়া অনেক ভাল।’
‘আমার অনুমতি ছাড়া তুই মরতে পারবি না।’
‘আপনি আমাকে ডিভোর্স না দিলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব, কেউ আটকাতে পারবে না।’
বৃত্ত নিজের রাগ সামলাতে না পেরে বিন্দুকে চড় মেরে দেয়। বিছানার সাথে লেগে কপাল কেটে যায়, ঠোঁট দিয়ে রক্ত বের হয়।
‘আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই তোমার কাছে? তুমি শুধু নিচের টা নিয়েই আছো, একবারও আমার অবস্থা বুঝার চেষ্টা করলে না। না তুমি তখন আমাকে বুঝতে, না এখন আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছ।
ডিভোর্স চাই তো তোমার, বেশ দেব তোমায় ডিভোর্স। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমার এ কাজের দাম তোমাকে দিতে হবে। এমন একটা দিন আসবে যেদিন তুমি আমাকে চেয়েও পাবে না।’
বৃত্ত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বিন্দু ওখনেই বসে পরে। কাঁদতে কাদতে মাথার চুল টানতে থাকে। চিত্রা আর মম এতোক্ষণ বাহিরে দাড়িয়ে সবটা শুনছিল। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা এই ঘটনা বাকিদের জানায়। সবটা জেনে বিশ্ব আসে বিন্দুর রুমে। বিশ্বকে দেখে বিন্দু চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।
‘সবটা জানি না অামি, যা জানি না তা প্লিজ বল।’
‘তোর কোনো কথাই অামি বুঝতে পারছি না ভাইয়া।’
‘তুই বৃত্তর সাথে এমন করছিস কেন? জানিস ছেলেটা কত কষ্ট পাচ্ছে?’
‘কিছু করার নেই ভাইয়া। আমি বৃত্তকে যা বলছি সবটাই সত্যি।’
‘মৃত্তিকা এখনও সময় আছে, সব সত্যিটা বল।’
‘এখনে সবটাই সত্যি, কোনো মিথ্যে নেই।’
‘এত দিন যা করিনি, আজ অামাকে তুই সেটা করতে বাধ্য করিস না।’
‘জানিস তো ভাইয়া, সবই নিজের মতো সবটা ভেবে রায় দিচ্ছে। তুই কেন বাদ যাবি, তুইও বল।’
‘তোর জীবনে সব চেয়ে প্রিয় জিনিস কি?’
‘আমার পরিবার।’
‘তোকে সেই পরিবারের সকলের অনুরোধ সত্যিটা বল।’
‘কেন জানতে চাইছিস? অামি চাইনা অামার কারনে কেউ কষ্ট পাক।’
‘অনেকেই কষ্ট পাচ্ছে মৃত্তিকা।’
‘বাবা……!’
বিন্দুর বলা কথা শুনে বিশ্ব মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে।
কি হবে এবার? বৃত্ত বিন্দুর সম্পর্ক তো আস্তে আস্তে খাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কি পরিনতি হবে দুজনের? জীবনের হারানো সুর কি কখনো ফিরে আসবে, নাকি সুর বিহীন ভাবে কাটবে ওদের জীবন?
চলবে…