হারানো সুর (৮)

হারানো সুর (৮)
সানজিদা ইসলাম সেতু

‘বৃত্ত আজ মৃত্তিকার সাথে দেখা করেছিল। কিন্তু বৃত্তর মুখ দেখে মনে হল, ও যা চাইছিল তা হয় নি।’
‘আর কিছু দিন, তার পর মৃত্তিকা বৃত্তকে পুরোপুরি ভুলে যাবে। এখন শুধু সেই সময়েরই অপেক্ষা। তোরা দুজনের উপর কড়া নজর রাখবি।’
‘ওকে ভাই।’
‘তোমার জন্য নিজের সব কিছু বাজিতে রেখেছি মৃত্তিকা। তোমাকে তো আমার হতেই হবে।’

‘মৃত্তিকা কি হয়েছে? কার সাথে কথা বলছিলি আর চিৎকার করছিলি কেন?’
চারপাশে তাকিয়ে দেখে ওর পাশে এর মা অার বীনা বসে আছে, অার কেউ নেই। নিজেকে বিছানায় দেখে অবাক হয়।
‘আমি বিছানায় এলাম কি করে? আমি তো মেঝেতে ছিলাম।’
বীনার কথায় হুস অাসে বিন্দুর,
‘আপু কি ভাবছিস?’
‘হ্যাঁ কি বলছিলে তোমরা?’
‘কি হয়েছে তো? চিৎকার করে কাদছিলি কেন?’
‘হয়ত খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম।’
‘আপু তুই তো আমাদের ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলি।’
‘ভিতু কোথাকার। মা চা খাব।’
‘আমি বানাচ্ছি, তোরা আয়।’

বীনা আর মাহবুবা খাতুন এর সাথেই চলে যায়। বিন্দু ওরনা ঠিক করতে নিলে থমকে যায়। একটা চেনা ঘ্রান ওর নাকে লাগছে।
‘এটা তো ওনার পারফিউম এর ঘ্রান। কিন্তু এটা আমার ওরনায় কি করে? তখন তাহলে কে এসেছিল? বৃত্ত!
আর ভাবতে পারছি না আমি। উনি কি করে বৃত্ত হতে পারে, ওনার চেহারা তো… উফ গলার স্বরটা খেয়াল করলাম না।
আচ্ছা কথা গুলো কি ভাইয়াকে বলব? না থাক বেচারা এমনিতেই চিন্তায় আছে।
যা করার আমাকেই করকে হবে।’

‘আরে তোর হয়েছেটা কি? কিছু না বলে চলে এলি, আর এখন চুপচাপ বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছিস।
আরে কিছু তো বল।’
গভীর শ্বাস নিয়ে বৃত্ত বলতে শুরু করে,
‘একটা ভুল আমাকে আর বিন্দুকে আলাদা করে দিয়েছে।’
‘কিহ!’
‘হুম, সেদিন যদি আমি অর্পণ সিকদারকে না মারতাম তাহলে আজ বিন্দু আমার কাছে থাকত। ভাইয়া বিন্দু আমাকে ভয় পায়, ও মনে করে আমি ওকে মেরে ফেলব। আমি ওকে এতো ভালোবাসি, কি করে ওকে মারতে পারি। যে করেই হোক ওর ভয় ভাঙাতে হবে।’
‘কি করবি?’
‘জানি না।’
‘আমি বলি কি, ওকে ওর মতো ছেড়ে দে। আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।’
চিত্তর কথায় বৃত্ত কিছু না বলে আবার আকাশের দিকে তাকায়। বৃত্তকে একা ছেড়ে দেয়া উচিৎ মনে করে চিত্ত চলে যায়।

‘সরি বিন্দু, আমার জন্য আজ তোমার এ অবস্থা। বিশ্বাস কর আমি কখনোও এমনটা চাই নি। আমি চেয়েছি, তোমাকে নিজের করে পেতে। সেদিন কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না। জানো আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কাউকে মেরেছি, খুন করেছি,খুন!
এতো অপরাধের বোঝা আমি টানকে পারব না। আজ তুমি আমার কাছে থেকেও দূরে। এটা যে কত কষ্টের তা তোমাকে আমি বুঝাতে পারব না। প্লিজ বিন্দু ফিরে এসো আমার কাছে। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। ‘
চোখ মুছে বিন্দুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে উঠতে নিলে বিন্দু বৃত্তর হাত ধরে নেয়।
‘সবসময় এসে চলে যান কেন? একটু থাকুন না।’
ঘুমে আচ্ছন্ন বিন্দুর কথা শুনে মুচকি হাসে বৃত্ত,
‘তুমি আমাকে ভালোবাসো, কোনো কারনে হয়ত স্বীকার করছ না। অপেক্ষায় রইলাম, একদিন স্বীকার করবে আর সেদিন আমার মধ্যে কোনো বাঁধা থাকবে না।’
আস্তে করে নিজের হাত থেকে বিন্দুর হাত ছাড়িয়ে চলে আসে বৃত্ত।
পরেরদিন ভার্সিটিতে বিন্দুর সামনে দাড়ায় বৃত্ত, যদিও বিন্দু ওকে চিনতে পারে নি তবে কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। পরে বৃত্ত নিজেই ওর সামনে থেকে চলে আসে। এর পরে খুবই কম বৃত্ত বিন্দুর সামনে এসেছে। কিন্তু আড়াল থেকে সবসময় খেয়াল রেখেছে।

বিন্দু সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেই গভীর রাতে নিজের অতীতে ডুবে যেত। বৃত্তকে ও কখনো ভুলতে পারে নি, বলতে গেলে ভুলার চেষ্টা করে নি। বিন্দু যেমন বৃত্তকে ভুলে নি তেমনি আজও ওকে ভয় পায়। মনের ভয়টা পুরোপুরি কাটাতে পারে নি। সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে তাও পারে নি।

দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবেসে এতো দিন কাটিয়েছে কিন্তু এ ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পাবে কি-না তা কেউই জানে না। এই ভালোবাসাই দুজনের জীবনের সুর তাল সব কেড়ে নিয়েছে। এক জন তার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য আকুল, তেমনি অন্যজন ভালোবেসেও অন্যজনের কাজ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কি যে আছে দুজনের ভাগ্যে, কে জানে?

[এতো পর্বে যে ঘটনা গুলো ছিল তা ছিল সাড়ে তিন বছর আগে বৃত্ত আর বিন্দুর জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনি। আমরা আবার বর্তমানে ফিরে আসছি। যেখানে রিধি আর বিন্দু রিধিদের বাড়িতে যাবে।]

‘কি কাহিনী বলতো, এই অসময়ে তোদের বাড়িতে সবাই গেল কেন?’
‘চুন্নি, তুই যেখানে আমিও সেখানে। জানব কি করে।’
‘এই রিধি বাইরে এতো জুতো কেন? এগুলো তো বাবা মা ভাইয়া আর বীনার, বাকিগুলো কাদের?’
‘ভিতরে চল, গিয়েই দেখি।’

ভিতরে বাইরের কিছু লোক দেখে রিধি অার বিন্দু রিধির রুমে চলে যায়। ওদের পিছু পিছু বিণাও যায়।
‘আপু এদিকে তো ঘটনা ঘটে ঘ হয়ে গেছে।’
‘মানে?’
‘এ যে আজ যারা এলো তারা তোর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। আর ছেলে তো ভাইয়ার বন্ধু মৃণাল। সম্বন্ধ তো প্রায় পাকা করে ফেলেছে।’
বীনার কথা শুনে বিন্দু বসে পরে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। চোখের সামনে বৃত্ত চেহারা আর ওদের কাবিনের দৃশ্য ভেষে উঠছে। তখনই রুমে মাহবুবা খাতুন আসে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুক কেঁপে ওঠে। মা’কে দেখে বিন্দু ব্যাগ নিয়ে রিধিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বিশ্ব বিন্দুকে আটকাতে গেলে রিধির ভাই রাহিম আটকে দেয়।
[রাহিম কাজিনদের মধ্যে সবার বড়।]
‘এখন ওকে আটকাস না। ওকে ওর মতো ছেড়ে দে। ‘
‘কিন্তু ভাইয়া..’
‘কোনো কিন্তু না বিশ্ব। ওর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোরা ওর সাথে একবারও আলোচনা করেছিস? অামার তো মনে হয় না। ওর জীবনের সিদ্ধান্ত ওকে নিতে দে।’
‘বৃত্ত ওর ঠিকানা জানে।’
‘একটা কথা তোকে বলছি, তোরা যতই চেষ্টা করিস না কেন, মৃত্তিকার বিয়ে অন্য করার সঙ্গে দিতে পারবি না, তার চেয়ে বরং এটা বলি যে বৃত্ত মৃত্তিকার বিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে হতে দেবে না।’
‘তো এখন তুমিই বল, কি করব?’
‘তুই মৃত্তিকার সাথে কথা বল। ওর থেকে জান ও কি চায়। এমনও তো হতে পারে ওর সবটা মনে আছে, ওর অার বৃত্তর কাবিনের কথা।’
‘ওই বৃত্তর জন্য আমার বোন আনেক কষ্ট পেয়েছে। নিজের চোখে আমার কলিজাকে পুড়তে দেখেছি।’
‘দু’পক্ষই কষ্ট পেয়েছে বিশ্ব। আমার কি মনে হয় জানিস, মৃত্তিকা বৃত্তকে ভালোবাসে। আজ ওর চোখে আমি রাগ দেখেছি, তোদের প্রতি রাগ।
আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল, মৃত্তিকা কোনোদিন বৃত্তর ব্যাপারে খারাপ কিছু বলছে? কোনোদিন তোদের মুখে ওর ব্যাপারে খারাপ কথা শুনে চুপ করে থেকেছে?’
‘এমনটা কখনোই হয় নি। কিন্তু ওতো কখনো কিছু বলেনি।’
‘ফাইজা আর তুই বৃত্তর ব্যাপারে ওর সাথে কথা বল।’
‘কিন্তু বাবা?’
‘ মিয়া বিবি রাজি তো কেয়্যা কারেগ্যা কাজি।’
‘তুমি তো বৃত্তের ব্যাপারে সবটা জানো।’
‘বৃত্তের জায়গায় আমি থাকলে এটাই করতাম। নিজের ভালোবাসার মানুষকে যে কেড়ে নিতে চাইবে তাকে ওখানেই শেষ করে দেব।’
‘আমরা তাহলে আজই ওর সাথে কথা বলব।’

নিজের মাথা দেয়ালে ঠেকিয়ে বসে আছে বিন্দু। চোখ দিয়ে পানিও পরছে না। দোটানায় পরে গেছে ও। না পারছে বৃত্তকে মানতে না পারছে ওকে ছাড়া বাঁচতে। দিনদিন বৃত্তকে ওর প্রয়োজন হচ্ছে। বৃত্তকে অনুভব করতে চায় ও। কিন্তু নিজের মনের ভয়কে ওভারকাম করতে পারতে না।
কি করবে ও? বাবার স্বীদ্ধান্ত মেনে নেবে নাকি বৃত্তকে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here