হারানো সুর (৪)
সানজিদা ইসলাম সেতু
‘বস কাজ হয়ে গেছে। পুরো বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা আর বক্স লাগানো শেষ আর কেউ টেরও পায় নি।’
টেবিলের উপর হাজার টাকার নোটের ৩ টা বান্ডিল ছুড়ে দেয় বৃত্ত। লোকটা টাকার বান্ডিল গুলা নিয়ে চলে যায়। ল্যাপটপ এর দিকে মুচকি হেঁসে তাকায় বৃত্ত।
‘এবার থেকে সবসময় তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে।
তোমার যা কাহিনি শুনলাম তাতে তোমার উপর আমার একটুও ভরষা নেই। দুষ্টিমিতো সেরা তুমি।
আমি মনে হয় আজ একটু বেশিই করে ফেলেছি। ফাষ্ট ডেটে কি বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি? ওকে সরি বলতে হবে। ওমন রাগারাগি না করে সবটা বুঝিয়ে বলতে পারতাম।
আর ওরই বা কি দরকার ছিল রিজভীর হাত ধরে ঘোরার?’
না না বৃত্ত, ভুল করছিস তুই। ভাই, বন্ধু বা পরিবারের অনেকেই থাকতেই। বিন্দুতো শুধু আমার, তাই ওকে নিয়ে এতটা ভয় না পেলেও চলে।
খুব শীঘ্রই তোমাকে পারমানেন্ট করে আমার কাছে নিয়ে আসব।’
টাওয়াল টা বিছানায় ছুঁড়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকে। ভাবতে থাকে তখনকার কথা। ওতটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল!
‘আমাকে শর্ত দেয়! এলেম আছে বলতে হবে। নিকুচি করি তোর শর্তের। তোর একটা শর্তও মানব না আমি, দেখি কি করতে পারিস তুই। মৃত্তিকাকে থ্রেড দেয়!
আমাকে চড় মারে ওই হুলো বেড়াল, ওর লেজ কেটে দেব,হুহ।
সাগর পাড়ের যদি কেউ বাবাকে বিকালের ঘটনা বলে দেয়, তাহলে তো বাবা অামাকে আস্ত রাখবে না। হুলোবেড়ালে তোর কপালে শুধু শনি না পুরো সপ্তাহ নাচছে। দেখে নেবে এই মৃত্তিকা তোকে।’
বিন্দুর কথা শুনে বৃত্ত হাসবে নাকি কাদবে তাই বুঝতে পারছে না। বৃত্ত ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারে, বিন্দু মাত্র গোসল করেছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হিসেব বের করে ১ ঘন্টা ধরে বিন্দু গোসল করেছে।
ফোন করে বিন্দুকে… কিন্তু রিসিভ করে না। পরে রিজভীকে ফোন করে।
স্ক্রিনে বৃত্তের নাম দেখে রিজভীর মুখ চুপসে যায়। বৃত্তের কাজে আজ বেশ ভয় পেয়েছে ও। কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে বৃত্তর ঝাড়ি।
‘ফোন ধরতে এতো সময় লাগে?’
‘(চুপ)’
‘ফোনটা বিন্দুকে দাও, এখনি।’
রিজভী বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামে, এক দৌড়ে বিন্দুর রুমে। কিছু না বলে ফোন এগিয়ে দেয়।
‘এটা দিয়া কি করব?’
‘কথা বল, বৃত্ত ভাইয়া।’
বিন্দু ফোনটা হাতে নিয়ে কানের কাছে নেয় …..
‘কি চাই?’
‘তুমি এত সময় নিয়ে সাওয়ার নিয়েছ কেন?’
নিজের ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে বাইরের কারোর হস্তক্ষেপ কোন কালেই পছন্দ ছিল না বিন্দুর।
‘আমি কি করব না করব তা আপনি ঠিক করার কে? আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আপনার ইন্টারফেয়ার আমি এলাউ করব না।’
বৃত্ত কিছু না বলে ফোন রেখে দেয়। বিন্দু ফোনটা রিজভীকে দিয়ে দেয়।
বিন্দুর মনে বৃত্ত নিজের জন্য ভালোবাসার গাছ লাগাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। কিন্তু ও হাল ছাড়েনি।
বিন্দু বৃত্তের থেকে ছুটকারা পাওয়ার জন্য নানা উপায় ভাবতে থাকে কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়।
ভার্সিটির সামনে থেকে প্রায় সময়ই বৃত্ত বিন্দুকে তুলে আনত। কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে বা হাসতে দেখলে বিন্দুকে শাস্তি পেতে হত। এতে বিন্দুর আরো ক্ষোভ বাড়ত। বাড়িতে যে ক্যামেরা লাগানো সেটা বিন্দু বেশ ভালো করেই বুঝতে পারত।
একেক করে দিন গড়াতে থাকে। বিন্দুর মন বৃত্তের প্রতি দূর্বল হতে থাকে। বৃত্ত দূর থেকেও বিন্দুর কেয়ারে একটুকুও ফাক রাখে নি, ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বিন্দুর দূর্বলতা বৃত্ত বুঝতে পারলেও কখনও প্রকাশ করে নি।
‘কি ব্যাপার, মুড অফ নাকি?’
‘না৷ আমার কেন মুড অফ হবে?’
‘তাই নাকি! তা আমাকে মিস করছ বুঝি?’
‘একদমই না। আমি কাউকে মিস করছি না।’
‘তাহলে রুম অন্ধকার করে আছ কেন?’
‘আমার ইচ্ছে। ‘
‘আলো জ্বালাও। ‘
‘না।’
‘বিন্দু.. ‘
‘বিন্দু বিন্দু বলে লাভ নেই, আমি আলো জ্বালাবো না।’
‘বেশ জ্বালিও না, আমিও ফিরব না।’
সাথে সাথে রুমের লাইট জ্বলে ওঠে। ওপাশে মুখ চেপে হাসে বৃত্ত। মনে মনে বলে,
‘যখন এতটাই ভালোবাসো, তখন মুখে স্বীকার করতে অসুবিধা কি? আমারও তো তোমার মুখ থেকে সেই থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড শুনতে ইচ্ছে হয় বল। জানি না তুমি কবে আমার আমার সে ইচ্ছে পূরণ করবে।’
বৃত্ত আর বিন্দুর মেলামেশার কথা দুই পরিবারের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। দুই পরিবারই এতে রুষ্ট। বৃত্তর দাদা ওকে ঢাকায় ডেকে নেয়। বিন্দুর বাবা ওর ফোন কেড়ে নেয় আর বাড়ির বাইরে বেরনো বন্ধ করে দেয়।
এতো সবচেয়ে বেশি লাভ হয় অর্পন সিকদাররের, কক্সবাজারের স্থানীয় নেতা। বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জরিত কিন্তু কেউই জানে না। খুবই চতুরতার সাথে সবার সামনে নিজের ভালো ইমেজ ধরে রেখেছে। তিনি অনেকদিন যাবৎ বিন্দুর পিছনে চরকির মতো ঘুরছে। আর তার সব মেহনতে পানি ঢেলে দেয় বৃত্ত। সে বহুদিন যাবৎ সুযোগ খুঁজছিল, কিভাবে বিন্দু আর বৃত্তকে আলাদা করা যায়। অবশেষে সে সুযোগ পেয়েছে।
‘তোমার কি মনে হয় বৃত্ত, ওই দুটার ব্যাংকারের মেয়েকে আমি এই মজুমদার বাড়ি বৌ করে আনব? অসম্ভব, তোমার এ মনে হওয়াকে ভুলে যাও। একটা কথা ভালো করে বুঝে নাও, ওই মেয়েকে আমি কিছুতেই মানব না।’
‘আমি বিন্দুকে ভালোবাসি দাদু। একটা কথা ভেবে বলত, দাদী বাবা মানে তোমার শ্বশুর কত টাকার মালিক ছিল? আমি যতটা জানি সে প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরি ছিল। তাহলে তুমি যদি একটা দপ্তরির মেয়েকে বিয়ে করতে পারো তবে অামি কেন ব্যাংকারের মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না।’
‘বৃত্ত!! তোমার এত সাহস তুমি আমার মুখের উপর কথা বলছ?’
‘তোমাকে ফ্যাক্ট বোঝাচ্ছি। আরেকটা কথা বিন্দু এবাড়ির বউ না হলেও আমার বউ অবশ্যই হবে। দেখি কে অাটকায়।’
‘তোর থেকে আমি এটা আশা করি নি মৃত্তিকা। তুই আমার মান সম্মান সব শেষ করে দিয়েছি।’
‘বাবা তুমি আমার কথা তো একবার শোনো।’
‘আর কি শোনানোর বাকি রেখেছিস তুই? যখন তখন যেখানে সেখানে তুই এই ছেলেটার সাথে ঘুরে বেরিয়েছিস। আমাদের কথা একবারও ভাবিস নি তুই।
আমি একটা স্বিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘
আহসান সাহেবের কন্ঠ আস্তে আস্তে শক্ত হচ্ছে। বিন্দু খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে, ওর বাবা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা খুবই কঠিন।
‘আমি অর্পনের সাথে বিন্দুর বিয়ের পাকাকথা সেরে এসেছি। আগামী পরশু ওদের বিয়ে হবে। সবাই সে অনুযায়ী প্রিপারেশন নেয়া শুরু কর।’
কথাটা যেন সবার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত এর মতো মনে হয়। বিন্দু কিছু বলতে পারছে না। রোবটের মতো নিজের রুমে চলে যায়। মনে মনে শুধু এটাই বলছে, কালকের মধ্যে যেন বৃত্ত এখানে এসে যায়। ওই অর্পনকে বিয়ে করার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
সিসিটিভি ফুটেজে সবটা দেখেছে বৃত্ত। দেখা মাত্র কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে চায় কিন্তু পারে না। ইখতিয়ার মজুমদার ওকে ঘরবন্দী করে দেয়। ওর রুম থেকে বাইরে বের হবার কোনো উপায় নেই, যতক্ষণ না দরজা খোলা হচ্ছে।
বৃত্ত রিজভীকে ফোন দেয় কিন্তু পায় না। কারণ আহসান সাহেব রিজভীর ফোনও নিয়ে নিয়েছে। বিন্দু আর বৃত্তর সম্পর্কের কথা রিজভী জানা সত্বেও কাউকে না বলায়, যতক্ষণ না বিন্দুর বিয়ের অর্পনের সাথে হচ্ছে ততক্ষণ রিজভী ওর ফোন পাবে না।প্রয়োজন মনে না করায় ও বৃত্তর ফোন নাম্বার মুখস্থ করে নি।
লাল বেনারসি পরানো হয়েছে বিন্দুকে। মনে মধ্যে এখন আশা রেখেছে বৃত্ত আসবে। বিন্দুর হাতের মুঠোয় রেয়েছে ২৮টি স্লিপিং পিল। বৃত্ত আজ না আসলে বিন্দু এগুলোকে আপন করে নেবে বলে ঠিক করেছে।কাজি এসে গেছে , বিন্দুকে কবুল বলতে বলছে। তাও বিন্দু মনে মনে বৃত্তকে ডাকছে।কিন্তু কোথায় বৃত্ত?
চলবে