#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-১৩,১৪
#আমিনুর রহমান
পর্ব-১৩
বখাটে ছেলেগুলো আমার আর স্পৃহার দিকে চেয়ে আমাদের অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করছিল। বুঝতে চাইছিল আসলেই কি আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ নাকি। ওদের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আসলেই আমরা স্বামী স্ত্রী। কারণ আমার আর স্পৃহার দূরত্বটা তখনও কমেনি। এক ছেলে বলে উঠল।
“এরা দুজন স্বামী স্ত্রীও না প্রেমিক প্রেমিকাও না। দেখেন না একজন আরকজন থেকে কতদূরে দাঁড়িয়ে আছে। স্বামী স্ত্রী হলে তো একজন আরেকজনের পাশে খুব কাছাকাছি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকত।”
ওই ছেলের কথাগুলো শুনে মুহূর্তের মধ্যেই স্পৃহা আমার খুব খুব কাছে চলে আসল। আমার এই ছোট্ট জীবনে এতটা কাছে কেউ কখনো আসেনি,কোনদিন না। কতটা কাছে এসেছিল সেটা হয়তো আমি পাঠকদেরকে বুঝাতে পারব না৷ তবে জেনে রাখুন এতটা কাছে এর আগে কেউ কারো কাছে আসেনি। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করবে না কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। স্পৃহা যখন আমার খুব কাছে এসে আমার শরীরের সাথে তাঁর নরম শরীরের স্পর্শ দিয়ে আমার হাত ধরে বলল।
“কে বলেছে আমরা স্বামী স্ত্রী না। ওর সাথে আমার অভিমান হয়েছে তাই এমন করেছি।”
তখন বখাটে ছেলেদের দলপতি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল।
“যেহেতু আপনারা স্বামী স্ত্রী তাহলে আমরা যেটা বলছি ওটা করে ফেলুন। না হলে আমরা ভিন্ন কিছু করতে বাঁধ্য হব। আর সেই ভিন্ন কিছুটা আপনাদের জন্য কখনোই ভালো হবে না৷”
বখাটে ছেলেদের দলপতির কথার জবাবে আমি চুপ করে থাকলেও স্পৃহা চুপ থাকল না। সে যে সাহসী একটা মেয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় লাভ করার ক্ষমতা রাখে সেটা প্রমাণ করার জন্যই হয়তো সে বুক উঁচু করে লোকটার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল।
“এটা কি পাবলিক প্লেসে করার মত কোন জিনিস নাকি৷ এটা হল পারসোনাল জিনিস এটা কেন সবার সামনে করতে হবে?
তখন ছেলেটা বলল।
“এছাড়া আপনাদের উপায়ও নেই। যা করতে বলেছি সেটা করেন তাড়াতাড়ি।”
স্পৃহা যখন বুঝতে পারল এটা করা ছাড়া এখান থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব না তখন সে দেরি না করে আমার অপবিত্র ঠোঁটে তাঁর নরম ঠোঁটটা আলগোছে ছুঁইয়ে দিল। তখন আমার খুব রাগ হল। মনে হল কোনকিছু চেকে দেখার পর যখন সেটা খেতে ইচ্ছে করে তখন যদি সেটা খেতে না পারি তখন যতটা খারাপ লাগে আমারও ঠিক ততটাই খারাপ লাগল। স্পৃহার এক সেকেন্ডের ছোট্ট একটা চুমুতে আমার ভিতর বাহিরে প্রকান্ড এক ভূমিকম্পের সৃষ্টি হলেও সেটা থামানোর জন্য স্পৃহার এক সেকেন্ডের চুমু যথেষ্ট ছিল না। এমন চুমু খাওয়া দেখে বখাটে ছেলেদের দলপতি হাসতে হাসতে বলল।
“হ্যাল হ্যাল ম্যাডাম। এটা কেমন চুমু? এটা যে কেউ যে কাউকে খেতে পারবে। না আছে কোন ফিলিংস,না আছে কোন কেমিস্ট্রি। এটা কোন আদর্শ স্বামী স্ত্রীর চুম্বন হতে পারে না। এক জোড়া আদর্শ স্বামী স্ত্রীর চুম্বন হবে লোহা আর চুম্বকের মতো। লোহা আর চুম্বক যেমন একসাথে করলে কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না,জোর করে টেনে টুনে ছাড়াতে হয়। স্বামী স্ত্রীর চুম্বনও ঠিক সেরকম হবে৷ তারা চুমু খেতেই থাকবে খেতেই থাকবে খেতেই থাকবে। কিন্তু আপনারা তো এক সেকেন্ডও দুজনের ঠোঁট একত্রে রাখেন নাই। কিভাবে নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী দাবি করেন?”
তখন স্পৃহা বলল।
“ভাই আসলে আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তো তাই এমন। আর বিয়েটা দুই পরিবারের সম্মতিতে হয়েছে। প্রেম ট্রেম করার সুযোগ পাইনি। তাই চুমু টুমু খেয়ে প্র্যাকটিস করারও সুযোগ হয়নি আমাদের। তাই ধরতে গেলে এই কিস করাতে আমরা অনেকটা ব্যাকডেটেড। দুজনের একজনও এখনো ঠিকমতো চুমু খেতে পারি না। বাসর ঘরে পর্যন্ত আমরা চুমু খাইনি। বিশ্বাস করেন ভাই,বিশ্বাস না হলে আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। আমি তো একটু চালাক,ওতো আরও বোকা। কত ভিডিও দেখল চুমু খাওয়া নিয়ে কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো আমার বোকা স্বামীটা এখনও চুমু খাওয়া শিখল না। নাটক সিনেমায় যেভাবে একজন আরেকজনের ঠোঁটে চুমু খায় বাস্তবে আসলে তেমনটা হয় না। বাস্তবতা ভিন্ন। নাটক সিনেমায় চুমু খেতে গেলে অমৃতের স্বাদ পাওয়া যায়,কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। বাস্তবে সিগারেটের গন্ধ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।”
স্পৃহার কথাশুনে আমার হাসি আটকে রাখতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। তবুও আটকালাম। এই মেয়ে যে কি দিয়ে তৈরি আজ বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি তো জীবনে কোনদিন সিগারেট মুখে দেইনি। তাহলে স্পৃহা আমার ঠোঁটে সিগারেটের গন্ধ পেল কিভাবে? এটা নিশ্চয়ই বিরোধী দলের চক্রান্ত। কিন্তু আমার তো কোন বিরোধী দলই নাই। কে এই জঘন্য কাজটা করবে? নিশ্চয়ই স্পৃহার চালাকি এটা। আমি যখন এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা করছিলাম ঠিক তখন বখাটে ছেলেদের দলপতি স্পৃহাকে ধমক দিয়ে বলল।
“ফাজলামো করেন আমাদের সাথে? আপনারা দুজন এখন দুজন দুজনকে চুমু খাবেন। ঘড়ি ধরে দু’মিনিট চুম্বন করবেন। না হলে আপনার স্বামীর বদলে অন্য কারো সাথে আপনাকে এই কাজটা করতে হবে।”
পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে স্পৃহা বুঝতে পারল এখন যদি এটা আমরা না করি তাহলে হয়তো সত্যি সত্যিই আমার বদলে অন্য কাউকে তাঁর চুমু খেতে হবে। আমি স্পৃহার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখের পলক ফেলতেই স্পৃহা আমার কাছে এসে আমার ঠোঁটে তাঁর নরম ঠোঁটটা ডুবিয়ে দেয়। আমার তখন মনে হলো আমি কোন অমৃতের স্বাদ নিচ্ছি। এর থেকে মিষ্টি হয়তো জগতে আর কোনকিছু নেই,থাকতে পারে না। স্পৃহার চুম্বনে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আমিও সব লজ্জা অপমান ভয় সংকোচকে পেছনে ফেলে স্পৃহাকে শক্ত করে দুহাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসি। আমিও তাঁর ঠোঁটের ছোঁয়ায় হারিয়ে যায় এক স্বর্গ রাজ্যে৷ পুরো দুই মিনিট পর আমাদের চুম্বন পর্ব শেষ হল। আমার পারফর্মটা ভালো না হলেও স্পৃহার পারফর্মটা বখাটে ছেলেদেরকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে৷ কেউ কেউ মাটিতে পড়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বেঁচে থেকেও মরে গিয়েছে। তারা মেনে নিয়েছে এই মেয়ে কোন সাধারণ মেয়ে না। আমি ভেবেছিলাম পরিচিত কাউকে ফোন করব। কিন্তু যখন দেখলাম স্পৃহাকে কাছে পাওয়ার একটা সুযোগ আছে তাই সেটা হাতছাড়া করতে চাইনি। পরে ওই ছেলেগুলো কাউকে ফোন করা ছাড়াই আমাদেরকে ছেড়ে দেয়।
আমি আর স্পৃহা ঘোরের মধ্যে বাসায় চলে আসলাম। দুইদিন হয়ে যায় আমি গোসল করি না। আমার ঠোঁট ভিজাই না। ঠিকমতো পানিও খাই না। কারণ স্পৃহার চুম্বনের ছোঁয়াটা আমি এত তাড়াতাড়ি ভুলতে চাই না। সেই যে ওইদিন বাসায় আসার পর কাথা গায়ে দিয়ে বিছানায় শুইছি আর উঠার নাম নাই। যতবার অনুভব করি ততবারই স্পৃহার ওই মারাত্মক চুম্বন করার দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। বাসায় আসার পর যখন স্পৃহাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আপনি এত সুন্দর করে চুমু খেতে পারেন জানতাম না৷ জানলে হয়তো নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আপনার কাছ থেকে একটা চুমু খেতাম।”
আমার এমন মজা করাটা স্পৃহা মেনে নিতে পারল না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল।
“আপনি এমন কেন? আপনি ওই ছেলেদেরকে কিছু বললেন না কেন? নিজের পরিচিত কাউকে ফোন করলেই তো পারতেন। তাহলে তো আমাদের এমন অবস্থায় পড়তে হত না।”
আমি তখন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে খুশি মনে বললাম।
“দেখুন আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। ভাগ্য ভালো ছিল আমাদের শুধু চুমু খেতে বলছে। অনেক সময় এমন অবস্থায় দেখা যায় যে দুজনকে ফিজিক্যাল রিলেশনও করতে বলে। সে ক্ষেত্রে আমরা অনেক বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আর ওরা ছিল দশ জন আর আমি একা। দুএকজন না হলে হয় রিস্ক একটা নিতাম। আপনিই বলুন ওত গুলো মানুষের সাথে একা আর কি করতে পারতাম আমি? কিছুই করতে পারতাম না। তাই নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু দেখেছি।”
তখন স্পৃহা একা একা কি যেন বলতে বলতে আমার সামনে থেকে চলে গেল।
স্পৃহা বসে বসে কাঁদছিল নাকি হাসছিল বুঝতে পারছিলাম না। কাছে গিয়ে দেখলাম আসলেই সে কাঁদছে। তবে তাঁর কান্নাটা আমার কাছে রিয়াল মনে হলো না,কেমন যেন ন্যাকা কান্না মনে হল। জোর করে কান্না করছে সে,চোখ দিয়ে পানিও পড়ছে না৷ আমি তাঁর মিথ্যা ফ্যাত কাঁদাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম।
“কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?”
তখন স্পৃহা তাঁর ন্যাকা কান্না করতে করতে বলল।
“আমি হাসানকে কথা দিয়েছিলাম আমি তাকে আমার বিশুদ্ধ আমিটা উপহার দিব। আমার ঠোঁট শুধু তাঁর ঠোঁটেরই স্পর্শ নিবে। কিন্তু আমি তাঁর কথা রাখত পারিনি।”
আমি তখন মনে মনে বললাম।
“বাল তোমার থেকে হাসান আরও অনেক বেশি বিশুদ্ধ। তোমরা সবাই বিশুদ্ধ খালি আমরাই অশুদ্ধ। ”
আমি স্পৃহার কাছে গিয়ে বললাম।
“আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। এটা করলে আপনি আগের মত বিশুদ্ধ হয়ে যাবেন।”
তখন স্পৃহা বলল।
“কি বুদ্ধি? ”
তখন আমি তাঁর আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম।
“ছোটবেলায় যখন ফুটবল খেলে ব্যথা পেতাম। তখন ওই ব্যথার মধ্যেই আবার ব্যথা দিতাম। মানে ফুটবল দিয়ে শর্ট মারতাম ওই ব্যথার ওখানে। ব্যথা অটোমেটিক্যালি ভালো হয়ে যেত৷ ঠিক তেমনি আপনি যেই ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন সেই ঠোঁটে আরেকবার চুমু খাবেন। আমি নিশ্চিত আপনি আগের মতোই পিউর বিশুদ্ধ হয়ে যাবেন।”
আমার কথা শুনে স্পৃহা আমার দিকে আগুন চোখে তাকালো। মনে হলো ওই চোখের আগুনে আমাকে পুড়িয়ে মারবে। অথচ অনেক আগেই আমি তাঁর ওই মায়াবী চোখের ভিতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। বের হওয়ার লোকেশন খুঁজে পাচ্ছি না বলে বের হতে পারছি না। পাঠকরা কেউ লোকেশন খুঁজে পেলে জানাবেন।
সত্যি বলতে আজকাল মানুষকে ভালো বুদ্ধি দিতে নেই। আমাকেই দেখুন না। স্পৃহাকে বিশুদ্ধ হওয়ার এত সুন্দর একটা বুদ্ধি দিলাম আর সে আমার ওপর রাগ করল। এজন্যই আমি কাউকে কখনো ভালো পরামর্শ দেই না।
চলবে……..
#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-১৪
#আমিনুর রহমান
আস্তে আস্তে স্পৃহা ওইদিনটির কথা ভুলতে লাগল একসময় ভুলেও গেল। কিন্তু কেন জানি আমার ভোলা হল না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা খুব সহজেই কোনকিছু করে ফেলতে পারে আবার খুব সহজেই সেটা ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু আমি তেমন না। আমার একটা জিনিস মনে ধরে গেলে সেটা ভুলতে অনেকটা সময় লাগে অনেকটা কষ্ট হয়। স্পৃহা আমার থেকে হয়তো বা আলাদা তাই তাঁর জিনিসটা ভুলতে তেমন কষ্ট হল না। স্পৃহা যে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি কিংবা আমার জন্য তাঁর হৃদয়ে কখনো ভালোবাসার বীজ বপন হয়নি সেটা খুব ভালো করেই আমি বুঝতে পারি। আর হলেও সেটা ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কোন মানুষের প্রতি কি কখনো ক্ষণিকের জন্য নিজের হৃদয় মন্দিরে ভালোবাসার জন্ম নিতে পারে? হয়তো পারে না কিংবা পারে না। স্পৃহা কি আমাকে ক্ষণিকের জন্য ভালোবেসেছিল যার জন্যই ওমন করে আমাকে আদর দিয়েছিল। তাঁর ভালোবাসাটা সবসময় ওই হাসানের জন্য। আমি তাঁর কেউ না। এমনটাই মনে হয়েছে এতদিনে।
হঠাৎ করেই একদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি,বাঁচব না মনে হয় এরকম অবস্থা হয় আমার। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল,গরমের মাঝেও প্রচন্ড শীত অনুভব করছিলাম। তখন স্পৃহা আমার অনেক যত্ন নিয়েছিল। টানা পাঁচদিন আমি বিছানায় পড়েছিলাম। এই পাঁচদিন স্পৃহা সবসময় আমার পাশে ছিল৷ আমার মনে হয়েছে এবার বুঝি স্পৃহা আমাকে ভালোবাসা শুরু করেছে। আমাকে এমন অবস্থায় দেখে তাঁর ভিতরটা কাঁদে। কারো জন্য যদি কারো ভিতরটা কেঁদে উঠে তাহলে কি সে তাকে ভালোবাসে না? আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য স্পৃহা দিনরাত আমার সেবা যত্ন করে। এই কারণেই আমি অনেকবার স্পৃহার অনেকটা কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমার অবস্থা এমন হয়েছিল যে নিজ হাতে পানি খাওয়ার মতো শক্তি টুকুও ছিল না। একসময় মনে হয়েছে আমি আর বাঁচব না৷ কিন্তু স্পৃহা আমাকে মরতে দেয়নি। সামান্য জ্বরও যে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সেটাতে আমার বিশ্বাসে ছিল না কোনদিন। কিন্তু এখন বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। কারণ আমি এই জ্বরের কারণেই মরতে বসে ছিলাম। একবার ভাবলাম বাসায় জানাই আমি খুব অসুস্থ। আবার মনে হলো বাবা মা আমার এমন অবস্থার কথা জানতে পারলে আমার কাছে চলে আসবে। তখন তো তারা স্পৃহাকে দেখে ফেলবে। ভাববে আমি তাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছি। কিংবা কপাল খারাপ থাকলে এটাও ভাবতে পারে আমি মেয়ে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছি,ফুর্তি করে বেড়াচ্ছি। বাবা মা হলেও তো তারা মানুষ। আর মানুষ যা দেখে তাই বিশ্বাস করে অন্তত সত্য মিথ্যা পরখ করার আগ পর্যন্ত কিন্তু ততদিনে নির্দোষ মানুষটাকে ভুক্তভোগী ঠিকই হতে হয়। যেমনটা একবার আমি হয়েছিলাম। কাজেই অবস্থা অনেক খারাপ হলেও আমি বাবা মা কিংবা আমার বোনকে আমার এমন মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার খবরটা জানালাম না।
প্রায় চৌদ্দদিন পর আমি পুরোপুরি সুস্থ হলাম। আমার অসুস্থতা যে স্পৃহা আর আমাকে আগের থেকে অনেকটা ক্লোজ হতে সাহায্য করছে সেটা আমি বুঝতে পারি। একদিন রাতে দেখলাম স্পৃহা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে । আমি খুব স্পষ্ট শুনতে পেলাম সে কাকে যেন বলছে।
“আমি আসলে হাসানকে ভালোবাসি নাকি ওকে ভালোবাসি আমি অনেকটা কনফিউজড। ওর সাথে আমার সময় কাটাতে অনেক ভালো লাগে,ওর সাথে থাকলে আমার মন হয় না আমি খারাপ থাকি। আমি হাসানের সাথে কোথাও একা যেতে সাহস পাই না,ইচ্ছে হয় না। কিন্তু ওর সাথে ঠিকই আমি যেকোন জায়গায় যাওয়ার সাহস পাই। ও যখন আমার পাশে থাকে তখন আমি হাসানকে খুব একটা মনে করতে পারি না৷ কিন্তু হাসানের সাথে থাকলে ঠিকই ওকে আমার মনে পড়ে৷ ও যেদিন আমাকে আর হাসানকে রেখে চলে আসল সেদিন সারাদিন আমি হাসানের সাথে থেকেও ওকে খুব মিস করেছি। মনে হয়েছে ও আমার সাথে থাকলে কতই না ভালো লাগত৷ অথচ হাসান আমাকে সেদিন কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরিয়ে দেখাল আমার মন ভরল না। এতকিছুর পরেও মনে হয় আমি যদি হাসানকে ভালো না বাসি তাহলে আমি প্রতারক হব, বেইমান হব। একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কাউকে ভালোবেসার মতো অপরাধ করেছি আমি। আমার ওর সাথে থাকতে ভালো লাগে ওকে আমি ভালোবাসি কিনা সেটা বুঝতে পারি না৷ এমন কেন হয় আমার সাথে? আমি কেন বুঝতে পারি না? আচ্ছা এমন কি কারো সাথে হয়? একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো প্রতি ভালো লাগা ভালোবাসার সৃষ্টি হয়? এটাতো অন্যায়। আমি কি সেই অন্যায়টাই করছি না? হাসানকে আমি কথা দিয়েছি সবসময় ওর পাশে থাকবো আমি,কখনো ছেড়ে যাব না। আর এখন আমার অন্য একটা মানুষের সাথে থাকতে ভালো লাগে। আমি তো ভালোবাসার মানুষের কাছে কখনোই একজন প্রতারক প্রেমিকা হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আমার ভালোবাসার মানুষের বিশ্বাসটা ধরে রাখতে চাই। হাসান আমাকে অনেক বিশ্বাস করে বলেই একটা ছেলের সাথে একছাদের নিচে এক বাসায় আমাকে থাকতে দিয়েছে। আর আমি কিনা তাঁর বিশ্বাসটাই ভাঙতে শুরু করেছি।”
আমি স্পৃহার মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে এমন কথা শুনে খুব অবাক হলাম না। কারণ এই কয়েকদিনে স্পৃহাকে দেখে বিষয়টা আমি একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। সে আসলে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে৷ ওইদিন হাসান না আসার কারণে আমাদের দুজনকে কি একটা অবস্থায় না পড়তে হয়েছিল। যদিও অবস্থাটা আমার জন্য খারাপ ছিল না৷ আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম এমন কিছু হোক। পরে যখন হাসান স্পৃহাকে বলেছিল তাঁর একটা কাজ ছিল,সে কারণেই আটকে গিয়েছিল তাই আসতে পারেনি তখন স্পৃহা বিষয়টা চেপে গিয়েছিল৷ সে হাসানকে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেনি কেন সে ফোন করে জানায়নি সে আসতে পারবে না। কিন্তু স্পৃহা তেমন কিছু হাসানকে বলেনি। খুব সাধারন ভাবেই নিয়েছে স্পৃহা বিষয়টাকে। অথচ সে হাসানের ওপর অনেক রাগ করতে পারত,অনেক অভিমান করতে পারত। কিন্তু এসবের কোনকিছুই সে করেনি। এসব কি প্রমাণ করে না স্পৃহা আমার প্রতি একটু হলেও দুর্বল? আমি যদি একটু বেশি আশা করি তাহলে হয়তো স্পৃহা আমাকে ভালোও বাসে। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে। আর আমি যদি ভুল না ভাবি তাহলে এই কয়েকটা দিনের ব্যবধানে স্পৃহা নামক সুন্দর মনের মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি স্পৃহার সব কথায় শুনলাম কিন্তু অপর পাশের মানুষটা আসলে কে সেটা আঁচ করতে পারলাম না। অবনি নয়তো? এমন নাতো গোপনে গোপনে আমার বিষয়টা স্পৃহা অবনির সাথে অনেক আগেই শেয়ার করেছে? অবনি ছাড়া সে আর কার সাথে কথা বলবে? আমার জানামতে তো তাঁর এসব কথা বলার মতো অবনি ছাড়া আর কেউ নাই। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। অবনি ছাড়া অন্য কোন বন্ধু কিংবা বান্ধবীর সাথেও কথা বলতে পারে সে। কারণ সুন্দরী মেয়েদের বন্ধু বান্ধবীর অভাব হয় না। তবে স্পৃহার তেমন কোন বন্ধু বান্ধবীকে আমার চোখে পড়েনি কখনো। সে কারণেই হয়তো মনে হলো সে অবনির সাথেই কথা বলছে। আমার অনেক সময় স্পৃহার ওপর অনেক রাগ হয়৷ এত ভালোবাসার পরেও কেন সে আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারে না? আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তা জানে আমার ভালোবাসার মাঝে কোন ফাঁক নেই শুধু স্পৃহা জানে না। আমি তাকে কখনো জানাতেও চাই না। সে যদি আমাকে কখনো সত্যিই ভালোবাসে তাহলে সে আমার ভিতরটাকে উপলব্ধি করবে,আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করবে। আমি তাঁর চোখের জল মুছে দিয়ে তাঁর কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিব। আমি জানি না এমন কোন দিন আমার জীবনে আসবে কি না তবে সত্য এটাই আমি এমন একটা দিনের জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করি। আমি বুঝতে পারি না কেন সে আমাকে রেখে হাসানের কাছে যেতে চায়? আবার যখন আমি নিজেকে স্পৃহার জায়গায় নিয়ে ভাবি তখন মনে হয় স্পৃহার কোন ভুল নেই। কারণ আমার আগে সে হাসানকে ভালোবেসেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হাসান সম্পর্কে সে এখনও অনেক ভালোই জানে,খারাপটা এখনো জানতে পারেনি। তাহলে সে আমাকে রেখে হাসানকে ভালোবাসলে দোষটা কোথায়? আমি তো কোন দোষ দেখি না।
আমার ধারণা ভুল হল না। পরের দিন সকালে পেরিয়ে বিকেলবেলা আমি বুঝতে পারলাম রাতে স্পৃহা অবনির সাথেই কথা বলছিল। যখন এটা জানতে পারলাম তখন একটু ভয় হল আমার। এমন তো না অবনি আমার বিষয়টা অনেক আগে থেকেই জানে। স্পৃহা তাকে অনেক আগেই জানিয়েছে আমার কথা। সেজন্যই কি অবনির মায়ের মৃত্যুর দিন স্পৃহা আর আমাকে একসাথে দেখে খুব একটা সারপ্রাইজড হয়নি অবনি? রাতে স্পৃহাকে যতটা আপসেট দেখছিলাম এখন ততটা মনে হচ্ছে না। অনেকটা স্বতস্ফুর্তই মনে হচ্ছে তাকে। স্পৃহা যখন আমাকে বলল।
“অবনির বিয়ের ঠিক হয়েছে। দুইদিন পর বিয়ে আমাদেরকে যেতে বলেছে। ছেলে ডাক্তার। ওর বাবা চলে যাওয়ার আগে ওর বিয়েটা দিয়ে যেতে চান৷ ওর বাবা চাচ্ছে না অবনি একা একা থেকে একাকিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করুক। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হচ্ছে ওর।”
অবনির বিয়ের কথা শুনে অনেক ভালো লাগল। আমি ভেবেছিলাম সে আমার জন্য এত ফোন করত কিন্তু না সে তাঁর মায়ের জন্য আমাকে এত অনুরোধ করতো। অনেক আগে অবনি আমাকে ভালোবাসতে চাইলেও এখন চায় না। এর থেকে ভালো লাগা আর কি হতে পারে আমার জন্য? আমিও যে চাই মা হারা মেয়েটা কারো ভালোবাসার মন্দিরে দেবি হয়ে বেঁচে থাকুক। অবনি কি তাহলে স্পৃহাকে আমার কথা বলেছে? হয়তো বলেনি কারণ নিজের মায়ের সম্পর্কে তো আর কেউ ইচ্ছে করে কারো কাছে খারাপ কিছু বলতে যাবে না। সবসময় নিজের আপনজনদের অপরাধ গুলো আমরা সবার কাছ থেকে লুকাতে চাই। কাউকে বুঝতে দিতে চাই না তাদের কুকর্ম গুলো। যদিও আমার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়। আমি যখন স্পৃহাকে বললাম।
“আমাদের এই বিয়েতে যাওয়া উচিত হবে না। ওখানে তো আপনার ফ্যামিলির সবাই আসবে। আমাদের ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই আপনি অবনিকে না বলে দিন।”
তখন স্পৃহা কিছুটা লাজুক হেসে বলল।
“আরে নাহ,তেমন কিছু হবে না। অবনি আমার খুব কাছের কেউ না। অনেক দূরের একজন। তবে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই ভালো৷ ও আমার সম্পর্কে সব জানে বাট কখনো আমার বাসায় বলেনি। আর অবনির বাবা বিয়েটা খুব যে অনুষ্ঠান করে দিচ্ছে তাও না। খুব আপনজন ছাড়া কাউকে ইনভাইট করবে না৷ আমার পরিবারের কেউ আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এমনটা হলে অবনি আমাকে বিয়েতে যেতে বলত না। কাজেই আমাদের কোন সমস্যা হবে না। আপনাকেও যেতে হবে আমার সাথে। অবনি আপনাকেও যেতে বলছে।”
চলবে………..