মেঘে_ঢাকা_আকাশ #পর্ব-১২

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-১২
#আমিনুর রহমান।

স্পৃহার কান্না থেমে গেলেও অবনির কান্না থামে না৷ সে অনবরত কাঁদতে থাকে। মানুষ তাঁর আপনজনকে হারিয়ে কতটা আঘাত পেতে পারে সেটা অবনিকে দেখে আমি উপলব্ধি করছি। অবনির মায়ের জন্য অবনির কান্নাটা শোভা পায়। সে একজন খারাপ মানুষ ছিল এটা জানার পরেও অবনি তাঁর জন্য চোখের জল ফেলছে। আমারও তো এমন একদিন আসবে যেদিন বাবা মায়ের মৃত্যুতে কাঁদতে হবে। তারা বেঁচে থাকতে আমি তাদের থেকে দূরে দূরে থাকছি,যদিও তারাও আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করেনি খুব একটা। তবে ছেলে হিসেবে বাবা মায়ের প্রতি আমারও একটা দায়িত্ব আছে। পৃথিবীতে সব বাবারা তো আর এক হয় না। আমার বাবাও হয়তো একটু আলাদা। তাই আমার সাথে এমন করেছে। অবনি যদি তাঁর মায়ের সবকিছু জানার পরেও মৃত্যুর আগে তাঁর পাশে থেকে সেবা যত্ন করতে পারে একজন আদর্শ সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে পারে। তাহলে আমি কেন পারব না শেষ বয়সে আমার বাবা মায়ের পাশে থাকতে? সত্যি বলতে অবনিকে দেখে নিজের বাবা মাকে অনেকটা মিস করেছি। এমনটা আগে করিনি। কিন্তু আজ মনে হল আমার মাও হয়তো আমার জন্য কাঁদে। যেমনটা অবনির মা মরার আগে অবনির জন্য কেঁদেছিল।

দুইদিন অবনির ওখানে থাকলাম আমরা। তারপর চলে আসলাম। অবনি এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে সে আমার আর স্পৃহাকে সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেনি একটাবারের জন্যেও। অথচ আমি ভেবেছিলাম আমাকে আর স্পৃহাকে এভাবে একসাথে দেখে অবনি অনেক প্রশ্ন করবে,অনেক কিছু জানতে চাইবে। কিন্তু তেমন কিছুই জানতে চাইলো না অবনি। তার মানে কি অবনির ইমোশন গুলো তাঁর মায়ের জন্য ছিল,আমার জন্য ছিল না? সে তাঁর মায়ের জন্য আমার কাছে ফোন দিয়ে কান্না করতো। অনেকদিন আগে আমাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল এমন তো না যে আমাকে ভালোবেসেছিল। এতদিনে নিশ্চয়ই ভালোবাসার মতো কাউকে খুঁজে নিয়েছে অবনি। আমিও এটাই চেয়েছি। আমি চাইনি সে আবার আমাকে ভালোবাসুক। আগে হয়তো তাঁর ভালোবাসাটা আমি ফিরিয়ে দিতে পারতাম না কিন্তু এখন তাকে গ্রহন করার মতো অবস্থায় আমি নেই। কাজেই অবনি যদি নিজের সুখের জন্য কাউকে খুঁজে নিয়ে থাকে তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। কারণ আমিও চাই মেয়েটা তাঁর একাকিত্ব দূরে করে কষ্টের জীবনের অবসান ঘটিয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকুক।

কিছুদিন পরের কথা,
হঠাৎ করেই একদিন জানতে পারি বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। যখন খবরটা শুনতে পেলাম তখন রাত আটটার মতো বাজে। আমি তখন স্পৃহার সাথে খাবার খাচ্ছিলাম। খবরটা শোনার পরে আমার কোন কিছুই মনে ছিল না। তিনি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন,নিজের মেয়ের জামাই বাড়ির সবার সামনে আমাকে সন্তান বলে অস্বীকার করেছিলেন। কাউকে বলেননি যে তাঁর একটা ছেলে আছে। এসব কিছুই কেন জানি মনে করতে পারলাম না আমি। শুধু তখন একটা কথায় মনে হল, হাসপাতালে যে মানুষটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সে মানুষটা আমার বাবা,মানুষটা আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। আমি খাবার টেবিল থেকে উঠেই একটা দৌড় মারলাম। যেভাবেই হোক যে করেই হোক আমাকে হাসপাতালে পৌছাতে হবে। স্পৃহা আমার এমন অদ্ভুত ব্যবহারে অনেকটা সারপ্রাইজড হল,আমার কাছে জানতে চাইল কি হয়েছে। আমি তাকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। এক ঘন্টার মধযে কিভাবে কি করে আমি হাসপাতালে পৌছালাম জানি না,তবে পৌছালাম। হয়তো বাবা নামের ভালোবাসার শক্তিটাই আমাকে অলৌকিক ভাবে পৌছে দিয়েছে। আমি হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে দেখলাম আমার মা কাঁদছে। বোনটাও এসেছে। সবাইকে কাঁদতে দেখে আমারও চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। একসময় আমি ভেবেছিলাম এরকম বাবার জন্য আমি কখনো নিজের চোখের জল ফেলব না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজকে না চাইতেও আমাকে আমার বাবার জন্য চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে।

আমার খুব ইচ্ছে করল মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলের নিচে মন ভরে কাঁদি। কতটা দিন মায়ের সাথে কথা বলিনি আমি। আমি কি তাহলে আমার মাকে ভুলে গিয়েছিলাম? মায়ের কান্নাটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি কখনোই আমার মাকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি। যে মানুষটা সবসময় হাসিখুশি থাকতো সেই মানুষটার চোখটা আজ জলে ভরা। এই হাসপাতালে এর আগেও আমি এসেছিলাম রাশেদের কাছে। আমি রাশেদকে খুঁজতে লাগলাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর রাশেদের সাথে দেখা হল। রাশেদ আমার বাবা মাকে চিনত না। আমি বলার পরেই ও চিনতে পারল। ও যখন বলল ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হবে বাবার। তখন আমার ভিতরটা কেপে উঠল,ভয় কাজ করতে লাগল। আমার মনে হল আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মতো খুব খুব কাছের কাউকে হারাতে যাচ্ছি। সেই মানুষটা আমার বাবা। আমি মানসিক ভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়লাম।

বাবার রক্তের গ্রুপ আমার সাথে মিল ছিল। অপারেশন থিয়েটার যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার মা আর বোন জানতেন না যে বাবাকে আমি রক্ত দিচ্ছি। আল্লাহর রহমতে ভালোভাবে অপারেশনটা হয়ে গেলো। যেটা নিয়ে ভয় করেছিলাম সেরকম কিছু হয়নি। বাবা সুস্থ আছেন জেনে ইচ্ছে হল তাঁর সাথে একবার দেখা করে যাই। কিন্তু আমি করলাম না। চুপ করে যেমন এসেছিলাম ঠিক তেমনিভাবেই চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই পেছন থেকে আমার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠল। এই ডাকটা আমার বহুদিনের পরিচিত। এই নামে আমাকে শুধু একজন মানুষই ডাকত। খোকা বলে শুধু আমার মা আমাকে ডাকত। আদর করে মা আমাকে এই নামে ডাকত। শেষ কবে মা আমাকে এই নামে ডেকেছেন আমার মনে নেই। পেছন দিকে তাকাতেই দেখি আমাকে ডাকছে। আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন সন্তানের নেই,কেউ মায়ের ডাক উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। আমিও পারিনি।

মা যখন আমার গালে হাত রেখে বললেন।

“আমাকে ছেড়ে থাকতে বুঝি তোর কষ্ট হয় না? একবারও মনে হয় না তোর মাকে? আমরা না হয় ভুল করেছিলাম কিন্তু তুইতো সবকিছু জানার পরেও আমাদের ছেড়ে থাকছিস। তোর বাবা কেমন মানুষ সেটা তো তুই জানিস। তোর সাথে কিংবা তোর বোনের সাথে কখনো খুব ভালোবাসা নিয়ে কথা বলেনি। ওনি মানুষটাই এমন। নিজের ভালোবাসাটা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না। আমি মানুষটার সাথে অনেক বছর ধরে সংসার করছি৷ আমি জানি মানুষটা কেমন। তোকে যেদিন ফোন করে বাসায় আসতে বলল সেদিন তুই তোর বাবাকে যে কথাগুলো বলছিস সেই কথাগুলো ওনি নিতে পারেননি। অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও তোর সেই কথাগুলো ভুলতে পারেনি। সবসময় নিজেকেই দোষ দিয়েছে। ভেবেছে এমনটা তাঁর প্রাপ্য ছিল কারণ সে তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিল। কিন্তু বিশ্বাস কর ওটা ছাড়া তোর বাবার আর কোনো উপায়ও ছিল না। তোর সাথে কথা বলার পর থেকেই তোর বাবার শরীরটা খারাপ হতে থাকে৷ সেই খারাপটাকে কেন্দ্র করেই আজ তাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। তবে এটার জন্য কখনো নিজেকে দায়ি করবি না৷ ভাগ্যে ছিল তাই এমন হয়েছে।”

আমি মায়ের এতগুলো প্রশ্নের জবাবে কিছুই বললাম না। চুপ করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। কারণ এই পবিত্র মুখটা অনেকদিন হল আমি দেখিনি৷ আজ চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না।

আমি বাবার পাশে যেতেই বাবা আমাকে কাছে টেনে নিলেন৷ বাবা আমার কাছে যদি ক্ষমা চাইতে পারত তাহলে হয়তো সেটাই করত৷ মানুষটা অনেক কঠিন ছিল অন্তত আমার ক্ষেত্রে৷ আজ সেই মানুষটাই পানির মত হয়ে গেছে। আমি আমার বোনের সাথে কথা বললাম না। বাবা মাকে বলে যখন চলে আসব ঠিক তখন বাবা বললেন।

“কোথাও যেতে হবে না তোকে৷ তুই আমাদের সাথেই থাকবি৷ এত এত সয়সম্পত্তি টাকা পয়সা এগুলো কার জন্য? এগুলো দিয়ে আমরা কি করব? এগুলো তো তোর। তখন আমার বোন এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল৷ ভাইয়া থেকে যাও না। আমি ওইদিন তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েও বলতে পারিনি৷ বিশ্বাস করো আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিল তোমাকে এতদিন পর দেখেও কথা বলতে না পেরে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা না করে কি থাকতে পারবে তোমার বোনটাকে?”

আমি কিছু বলি না,আমার বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দেই শুধু। বাবাকে বলি আমি এখনি বাসায় যেতে পারব না। তবে যাব তোমাদেরকে ছেড়ে থাকব না। তবে এই মুহূর্তে আমি তোমাদের সাথে থাকতে পারব না। আমি বাবা মা আর বোনের হাসিমুখটা সাথে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম স্পৃহা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু যখন বাসায় গেলাম তখন দেখলাম সে এখনও জেগে আছে। আমার ওভাবে চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলো। আমি তাকে কিছু বললাম না।

কয়েকদিন পর স্পৃহা একদিন আমাকে বলল হাসানের সাথে সে দেখা করবে। হাসান আসবে কালকে৷ কাল দশটার সময় তাঁর সাথে আমাকে যেতে হবে। আমি সরাসরি না বলে দিলাম। ঠিক তখন স্পৃহা বলল।

“ও এবার পার্কে দেখা করতে চাচ্ছে। এর আগে তো সবসময় রেস্টুরেন্টেই দেখা করেছি। এবার পার্কে কেন বুঝতে পারছি না। তাই আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”

তখন আমি একটু তিরস্কার করেই বললাম।
“প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আমি কেন যাব? যা করতে ইচ্ছে হয় তাই করবেন। এতদিন ধরে প্রেম করেন অথচ বয়ফ্রেন্ডের সাথে পার্কে দেখা করতে এত ভয়? কি করবে বড় জোর? চুমু খাবে,জড়িয়ে ধরবে? যাকে ভালোবাসেন তাঁর সাথে এসব করতে পারবেন না?”

আমি কথাগুলো বলেছিলাম স্পৃহার রিঅ্যাকশনটা দেখার জন্য। সে যে এতটা রিঅ্যাক্ট করবে বুঝতে পারিনি। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল।

“আমাকে আপনি এমন ভাবেন? ভালোবাসি বলেই যে বিয়ের আগে এসব নোংরামি করবো এমন মেয়ে আমি না। আর ওতটা বোকাও না। যদি আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় সেখানে যদি একটা মানুষ নিজেকে সেফ করতে পারে সেই মানুষটা আমি। জীবনে কত ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে,কতজনের সাথে ঘুরেছি কেউ কখনো আমার হাতটা পর্যন্ত ধরতে পারেনি। আর আপনি বলছেন আমি এসব করব?”

আমি তখন আস্তে আস্তে নিজেই নিজেকে বললাম।

“বিয়ে করেও তো কিছু করতে পারেননি।”

তখন স্পৃহা বলল কিছু বললেন? আমি বুঝলাম স্পৃহা আমার কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। আমি বললাম না না কিছু বলিনি।

পরের দিন দশটার সময় স্পৃহার সাথে পার্কে গেলাম তাকে সেফটি দেওয়ার জন্য। জামাই হয়ে নিজের বউকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবার জন্য নিয়ে এসেছি তাও আবার সেফিটও দিতে হবে। অনেক সময় পাড় হয়ে গেলেও হাসান আসল না। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পরেও যখন হাসান আসল না। তখন আমরা দুজন পার্ক থেকে বের হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। তখন ঘটল ঘটনা।

একদল বখাটে ছেলে আমাদের পিছনে লেগেছে। কিছু পথ যাওয়ার পরে রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় আমাদের দাঁড় করালো। দলনেতার বেশে যে ছেলেটা ছিল সে আমাদেরকে বলল।

“তোরা জানোস না এই এড়িয়টা খুব ডেঞ্জারাস? তোরা যে প্রেম করতাছোস। তোগরে বাসায় কি কেউ জানে? বাপ মায়ের নাম্বার দে।”

তখন স্পৃহা ওই ছেলের কথার মাঝে বলল।

“আমরা প্রেমিক প্রেমিকা নাতো। আমরা দুজন স্বামী স্ত্রী।”

তখন তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করল না। একজন বলে উঠল ভাই এদের থেকে কিছু মজা নেওয়া যাক। ওদের দুজনকে চুমু খেতে বলেন। যদি স্বামী স্ত্রী হয় তাহলে এটা করতে সমস্যা হবে না। আরেকজন ওকে ধমক দিয়ে বলল। আরে ব্যাটা চুপ কর। এটা কোন পরীক্ষাই হতে পারে না। গবেষণা করে দেখা গেছে স্বামী স্ত্রীর থেকে প্রেমিক প্রেমিকা বেশি চুমু খায়। কাজেই এটা দিয়ে বুঝা যাবে না যে ওরা স্বামী স্ত্রী। ওদের জন্য অন্য একটা ব্যবস্থা আছে। তবে প্রথমে ওদের দুজনকে চুমু খেতে দেই। দেখি কিরকম পারফর্ম করতে পারো। পরে অন্য কিছু নিয়ে ভাববো।

আমি স্পৃহার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছি। এ নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেও নিজেকে সেফ করতে পারবে। অথচ কয়েকটা বখাটে ছেলের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারল না।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here