প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-১৩
#ফাবিহা_নওশীন
||
বিকেল নাগাদ সবাই হোটেলে পৌঁছে গেল। রুহানি গাড়ি থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙ্গে দাঁড়াল। ও একটু জার্নিতেই হাপিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। রুহানি নিজের লাগেজ হাতে নিয়ে বন্ধুদের সাথে হোটেলের গেট পাড় করে চারদিকে চোখ বুলালো। চারদিক নীরব,নিস্তব্ধ, কোলাহল মুক্ত। কোনো হোটেলের পরিবেশ যে এতটা নিরিবিলি হয় তা জানা ছিল না। বিস্তৃত লন, সুইমিং পুল সবটা জুড়ে নীরবতা।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুহানি বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুহানির শান্তি লাগছে। কিন্তু সে শান্তিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। নুশা এসে ওর হাত ধরে টানতে লাগল।
“শুয়ে পড়লি কেন? খেতে যাবি না?”
রুহানি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“একটু রেষ্ট করতে তো দে।”
“রেষ্ট করতে গেলে আর খাবার পাবি না। চল তাড়াতাড়ি। উঠ। খেতে চাইলে এখুনি যেতে হবে।” নুশা জোর করে রুহানিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।
খেয়েদেয়ে একটু আড্ডা দিয়ে রুহানি রুমে ফিরতে চাইলে নুশা আবারও ওর হাত ধরে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।
“তুই কি আমার হাত ছিড়ে ফেলার প্লান করেছিস? আমার হাত ছাড়।”
“নিচে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। গান-বাজনা করছে। আর আমরা রুমে বসে থাকব?”
“আমি একটু রেষ্ট করতে চাই। প্লিজ মাত্র কিছুক্ষণের জন্য।”
“আমরা এখানে রেষ্ট করতে আসি নি। মজা করতে এসেছি।”
নুশা রুহানিকে জোর করে নিয়ে বসিয়ে দিল। সারাটা দিন কাঠফাটা রোদ থাকলেও সন্ধ্যা থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আকাশে একটা তারাও নেই। মেঘে মেঘে ঢেকে আছে পুরো আকাশ। সব মিলিয়ে যেন বৃষ্টির আয়োজন করছে প্রকৃতি।
বিভিন্ন ভাগে ভাগে ক্যাম্প ফায়ার করা হয়েছে। রুহানি ওদের ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের সাথে বসে আছে। ওরা হাসি-আনন্দে মেতে আছে।
গিটার হাতে ফালাক হোটেল থেকে বের হয়েছে। সবার দৃষ্টি ওর দিকে। হটাৎ রুহানির চোখ পড়ল সেদিকে। ফালাক গিটার হাতে হাত দিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে আসছে। শ্যাওলা রঙের টিশার্ট পরেছে, এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে। চোখে -মুখে কিছু একটা ঝলকাচ্ছে। হয়তো কোন কিছু পাওয়ার খুশি।
ফালাককে দেখে ওদের ডিপার্টমেন্টের একজন বলল,
“ভাইয়া গিটার হাতে যে গান পারেন?”
ফালাক মুচকি হেসে বলল,
“না তেমন না, একটু একটু চেষ্টা করি আর কি।”
সবাই অনুরোধ করতে লাগল গানের জন্য। রুহানি নুশার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ওরা এমন শুরু করেছে কেন? গান কি কখনো শুনে নি?”
নুশা রুহানির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“ফ্রিতে যদি একটা গান শুনতে পারি খারাপ কি? তাছাড়া এই সিনিয়র তো কম জ্বালায় নি। আজ যদি গান শোনার উছিলায় কোন বিনোদন ক্রিয়েট হয় তবে জমবে বেশ।”
রুহানি আর কিছু বলল না। ফালাক ওদের অনুরোধে ওদের সাথে বসল। তারপর গিটারে সুর ধরল।
“তুমি চাইলে বৃষ্টি,
মেঘও ছিল রাজি
অপেক্ষা শুধুই বর্ষণের।
মাতাল হাওয়া বইছে
দূরে পাখি গাইছে গান
বৃষ্টি তোমার আহবান।। ”
(বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিন।)
এমন রোমান্টিক ওয়েদারে ফালাকের গাওয়া গান রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সবার মনেই এই মুহুর্তে হালকা প্রেম প্রেম অনুভূতি জাগছে। হারিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায় কিংবা স্বপ্নের রাজ্যে। আর রুহানির এই গান শুনে ঘুম পাচ্ছে। ফালাক গান শেষ করে রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি হাই তুলছে। রুহানিকে হাই তুলতে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
সবাই যখন ফালাকের প্রশংসা করতে ব্যস্ত। তখন রুহানি হাই তোলায় ব্যস্ত।
রুহানি নুশাকে বলল,
“দোস্ত ঘুম পাচ্ছে।”
“এত তাড়াতাড়ি? মাত্র তো সন্ধ্যা।”
“গান শুনে। সব দোষ এই গানের। গান শোনার পর পরই ঘুম পাচ্ছে।” রুহানি ফালাকের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলল।তারপর ফালাকের দিকে চেয়ে দেখে ফালাক ওর দিকেই চেয়ে আছে। ফালাক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি মিন করতে চাইছো?”
রুহানিও উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি কিছুই মিন করছি না।”
“তাহলে বললে কেন আমার গান শুনে ঘুম পাচ্ছে?”
রুহানি ফালাকের কথার উত্তর না দিয়ে নুশাকে বলল,
“আমি তোকে একটা কথা বলেছি। সেই কথা নিয়ে উনি কাড়াকাড়ি করছেন কেন?”
নুশা ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক বলল,
“তোমার সাথে কথা বললেও কথাটার মধ্যে আমি ছিলাম। তাই ঢুকতে বাধ্য হয়েছি। ও আমার গানের ইনসাল্ট করেছে।”
“ইশশ আসছে! যেই গান তার আবার ইনসাল্ট।”
“নুশা তোমার ফ্রেন্ডকে বলো আমার চেয়ে ভালো গান শুনাতে। যদি পারে আর কি। মনে তো হয় না সে যোগ্যতা আছে।”
“নুশা তুই বলে দে, আমি যাকে তাকে গান শুনাই না।”
“পারলে তো শোনাবে।”
নুশা পড়েছে বিপদে। দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে ফেসে গেছে।
“উনি যে কি পারেন তা বুঝাই যায়। গান শুনে মানুষের ঝিমুনি চলে আসবে।”
“আর ইনি তো লাইব্রেরীতে গিয়েও ঘুমায়। সব জায়গায় ঘুমানোর অভ্যাস হলে যা হয়। কুম্ভকর্ণ! এখন আমার গানের দোষ।”
রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নুশা, উনাকে মুখ সামনে কথা বলতে বল।”
নুশা ওদের মাঝখানে থেকে সরে বলল,
“গাইস, ওয়েট। ঝগড়া করবে নিজেরা সরাসরি করো।
আমি বেচারিকে কেন টানছো? নে সরে গেছি। এখন মন মতো ঝগড়া কর। আমি শুনি। দাঁড়া আমি বরং ফোন বের করে রেকর্ডিং করি। যারটা ভালো হবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে এন্ড ডোন্ট ওরি শান্তনা পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে।”(রুহানির দিকে চেয়ে)
রুহানি নুশার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। তারপর বলল,
“আমি যার তার সাথে ঝগড়া করি না।”
তারপর ফালাকের দিকে তাকাল।
ফালাক তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ঝগড়া করা তোমার মতো ঝগড়ুটে মেয়ের কাজ। আমার কাজ নয়।”
রুহানি নিচ থেকে ফোন তুলে হোটেলের ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ফালাকও গিটার হাতে ভেতরে যাচ্ছে।
রুহানি পেছনে ফালাককে দেখে বলল,
“তুমি আমার পেছনে পেছনে আসছো কেন?”
ফালাক টেডি স্মাইল দিয়ে বলল,
“কারণ তুমি আমার সামনে সামনে হাঁটছো। রাস্তা ছাড়ো আগে যাই।”
রুহানি আরো জোরে জোরে হাঁটা শুরু করল। ফালাক ওর পেছনেই রয়ে গেল।
দোতলার সিড়ি পাড় করে তিনতলার সিড়িতে উঠেছে।
ফালাক পেছনে থেকে বলল,
“তোমার মতলব কি?”
রুহানি অবাক হয়ে পেছনে ঘুরে বলল,
“মানে? মতলব! কিসের মতলব?”
ফালাক উপরের দিকে ইশারা করে বলল,
“তিনতলায় তো আমার রুম। তুমি তিনতলায় কেন যাচ্ছো? আমি যতটুকু জানি ভার্সিটি থেকে সব স্টুডেন্টদের জন্য পুরো দুতলা বুক করেছে।”
রুহানির হুশ হলো। ঝগড়া করতে করতে শুধু সিড়ি পাড় করেই যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তার বোধ নেই৷ তিনতলার সিড়িতে চলে গেছে।
রুহানি ফালাকের দিকে একবার তাকাল। ফালাক মুচকি মুচকি হাসছে। এটুকুই যেন রুহানির শরীরে আগুন জ্বালাতে যথেষ্ট। তবুও ভদ্র মেয়ের মতো ফালাকের পাশ কাটিয়ে দু সিড়ি নিচে নেমে ফালাকের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
“তুমি তিনতলায় কি করতে যাচ্ছো? তোমার রুমও তো দোতলায়।”
ফালাক দু সিড়ি নিচে নেমে বাকা হেসে বলল,
“তা দিয়ে তোমার কি? এত খবরদারি কেন করছো? তুমি কি আমার জিএফ?”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে ফালাককে ধাক্কা মারল। ফালাক তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। রুহানি সাথে সাথে দুহাত দিয়ে ফালাককে ধরে ফেলল। রুহানির বুক ঢিপঢিপ করছে। সারা শরীর কাঁপছে। ফালাক নিচে পড়ে ফেলে কি হত? ওর হাত, পা ভেঙে যেত অথবা মাথা ফেটে যেত। তুলকালাম কান্ড বেঁধে যেত। রুহানিও ফেসে যেত। লাইফে আরেকটা সমস্যা এড হত৷ ফালাকেরও ক্ষতি হত।
ফালাক অবাক হয়ে রুহানির ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে আছে। এর আগে কখনো এত ভয় পেতে দেখে নি রুহানিকে। বাদামি চোখগুলো যেন ভয়ে মাখামাখি। ফর্সা কপাল কুচকে আছে, সরু নাক
আরো সরু হয়ে গেছে। রুহানি ফালাকের হাত ছেড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল।
রুহানি কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল,
“সরি, সরি। আমি ঝুকের মাথায় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। এখানে থেকে পড়ে গেলে কি হত সেটা ভাবি নি।”
ফালাক রুহানির ফেস দেখে নিজেও কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল,
“ইট’স ওকে। পড়ে তো যাই নি। তুমিই হেল্প করেছো। এত সরি বলার কিছু নেই। আ’ম অলরাইট।”
রুহানি আর কিছু বলল না। নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রুহানির আচরণ ফালাককে অবাক করছে। এ যেন সেই রুহানি নয়, কোথাও একটা পরিবর্তনের ছোয়া আছে। তবে এই রুহানিকে মন্দ লাগছে না।
ফালাক রুহানির যাওয়া দেখে বলল,
“শোন।”
রুহানি পেছনে ঘুরল। ফালাক রুহানিকে এক পলক দেখে বলল,
“আমি তিনতলায় আগে থেকেই একটা রুম বুক করে রেখেছি। আসলে আমি কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারি না তাই। শুভ রাত্রি।”
রুহানি কিছু না বলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে বাড়িতে ফোন করে কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর আবারও ধাক্কা মারার কথা মনে পড়তেই নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল,
“রুহানি কোথাও না কোথাও তোর আগের ভয়ংকর অভ্যাসগুলো রয়ে গেছে। নয়তো ফালাককে ধাক্কা দিতে পারতি না। অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করা জরুরী, নয়তো বিপদে পড়তে এক মিনিটও লাগবে না।”
পরের দিন সকালে আর ফালাকের সাথে দেখা হয় নি। নুশা ঝগড়ার জন্য বারবার রুহানিকে ক্ষেপাচ্ছে।
“আচ্ছা তুই ফালাক ভাইকে তুমি বলিস কেন?”
“কারণ প্রথম দিন থেকেই বলি। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“কিন্তু উনি তো সিনিয়র। আপনি বলা উচিত।” (টিপ্পনী কেটে)
“আরে রাখ তো, কে যাবে ওকে এত রেস্পেক্ট দিতে? আপনি! হুহ! আমি তুমি বলি আর তুমিই বলব আজীবন।”
নুশা বড় করে হা করে বলল,
“আজীবন! মাই গড! এত দূর!”
রুহানি চোখ ছোট ছোট করে নুশার দিকে তাকাল। নুশা এক দৌড় দিল। রুহানিও ছুটছে ওর পেছনে পেছনে।
চলবে……