প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-৬
#ফাবিহা_নওশীন
||
ভরদুপুর। তেজস্বী সূর্য তার সম্পূর্ণ তেজ যেন উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছে। পুকুর পাড়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে কিন্তু এই বাতাস সূর্যের প্রখরতা কমাতে সফল হচ্ছে না। রুহানিও সূর্যের মতো প্রখর তেজ নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে সূর্যের সাথে পাল্লা দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগেই তায়েফের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ করে এল। এতদিনের বন্ধুত্ব কিন্তু একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং নিজের উপর রাগ লাগছে। যে মেয়েদের অসম্মানের চোখে দেখে সে নিশ্চয়ই মেয়ে বন্ধুদেরও ছাড় দেয় নি। না জানি কতদিন, কতবার কুদৃষ্টি নিয়ে দেখেছে। রুহানির গা ঘিনঘিন করছে।
রুহানি পুকুর পাড়ে পা ভিজিয়ে বসে আছে। তবে এই মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা করা দরকার। পুকুরের এই উত্তপ্ত পানি মাথায় দিলে মাথা ঠান্ডা হওয়ার বদলে গরম হয়ে ফুটবে।
“এই প্রথম মেয়ের মতো আচরণ করলে।”
ফালাক ক্যানে চুমুক দিয়ে বলল।
রুহানি পেছনে ঘুরে ফালাককে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
ফালাক ক্যান দেখিয়ে বলল,
“এভাবে চেয়ে আছো কেন? খাবে না-কি?”
রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হ্যাঁ খাবো তবে তোমাকে। হে আল্লাহ! আমাকে সবর দেও। একে যে কবে আমি মার্ডার করে ফেলি। বিরক্তিকর লোক।”
ফালাক বাকা হেসে বলল,
“আমি খুব টেস্টি। তোমাকে আর কি দোষ দেব সব মেয়েই আমাকে দেখলে পাগল হয়ে যায়। মেয়েদের কাছে আমি আইসক্রিম কিংবা চকলেটের মতো।”
রুহানি চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর নাক ছিটকে বলল,
“হুহ! কি তার চেহারা।”
“তোমার মতো তো আর জংলী না। নিজেকে দেখো। নিজের পোশাক দেখো, চুল দেখো। চুল দেখে মনে হয় বহুকাল চিরুনি পড়ে নি। আর জামা-কাপড়েরও কোন ষ্ট্যাণ্ডার্ড নেই। পুরাই জঙ্গল।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমি জঙ্গল! এটাকে স্টাইল বলে,স্টাইল। যা তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি নিজেই একটা জঙ্গল। জংলি লোকেরা আবার স্টাইল বুঝে না-কি!”
ফালাক রুহানির দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোমার পোশাকে তো ছেলেদের ভাব আছে। আমার পোশাকে কি মেয়েলি ভাব আছে? আমার পোশাক সম্পূর্ণ ছেলেদের স্টাইলের এবং হাই ষ্ট্যাণ্ডার্ড।”
রুহানি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“হ্যাঁ স্টাইল তবে ক্ষেত মার্কা স্টাইল! আসছে ষ্ট্যাণ্ডার্ড দেখাতে!”
রুহানি মুখ ভেংচি কেটে হাঁটা ধরল। কিছুদূর গিয়ে থামল। তারপর পেছনে ঘুরে বলল,
“মিস্টার ফালাক! নেক্সট টাইম আমার সাথে লাগতে আসলে খুলি উড়িয়ে দেব।”
রুহানি হাতের আঙুল দিয়ে পিস্তল সেপ করে দেখাল।
ফালাক একটু হাসল। রুহানির আচরণগুলো অদ্ভুৎ লাগে।
।
এভাবে কেটে গেছে দু-তিন মাস। হাসি-আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়ে দিনগুলো সুন্দর ভাবে কেটে গেছে। রুহানি আগের চেয়ে কিঞ্চিৎ বদলেছে। দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটিতে মেতে থাকলেও আগের মতো ভার্সিটির জুনিয়রদের জ্বালাতন করে না। ওর সব জ্বালাতন আর বিরক্তি ফালাক আর ওর বিপরীত দল ইশার টিম সহ্য করছে। রুহানির দলটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। তায়েফ অনেকবার সরি বলার পরেও রুহানি মাফ করে নি। এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ জমা হয়েছে। আর রুহানিও বলে দিয়েছে তোদের ইচ্ছে হলে ওর সাথে কথা বল যা খুশি কর আমি তো মানা করি নি। আমি ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখব না ব্যস।
এ নিয়ে রুহানির আড়ালে ব্যাপক আলোচনা হয় সেটা রুহানি জানলেও পাত্তা দেয় না।
রনক রুহানিকে পড়ানোর সময় হাসি গল্পের মাধ্যমে কিছু নীতিশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে।
এই যেমন “রুহানি নিজের একটা সুন্দর ব্যক্তিত্ব গঠন করো। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ কারো ভালোবাসা, শ্রদ্ধার যোগ্য নয়। এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলো যাতে আশেপাশের মানুষ তোমার ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়, তোমাকে অনুসরণ করে। যে ব্যক্তিত্বে মিথ্যার কোনো স্থান নেই।”
“রুহানি, সব সময় নিজের আত্মসম্মানে অটল থাকবে। কোনকিছুর বিনিময়ে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিবে না। তাহলে বেঁচে থেকেও মরে যাবে।”
“নিজেকে কখনো কারো নিকট দূর্বলভাবে প্রকাশ করবে না আর না নিজের দূর্বলতা। তাহলে সে তোমার দূর্বলতায় কারণে অকারণে আঘাত করবে।”
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ায় রুহানি ওর নাম দিয়েছে পণ্ডিত। তবে এই নামে রনক যথেষ্ট সন্তুষ্ট।
ফালাক এই তিন মাসে রুহানির হাত থেকে রক্ষা পায় নি। বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করে গেছে। তবে রুহানিকেও ফেরত দিয়েছে।
।
ফালাক লাইব্রেরীতে পড়ায় মগ্ন। রাতে অফিসের ফাইলপত্র নিয়ে বসতে হয়, কাজ করে তাই পড়ার সুযোগ হয় না। যতটুকু সময় পায় পড়া গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
রুহানি চুইংগাম চিবাতে চিবাতে লাইব্রেরীতে ঢুকল। শেলফ থেকে একটা বই নিল। আড়চোখে ফালাককে দেখছে। ধীরে ধীরে হাঁটছে রুহানি। ফালাকের পাশ ঘেঁষে হেঁটে বাইরে চলে গেল।
।
ইশা তায়েফকে নিজের দলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সে খবর নুশা দিল রুহানিকে। তায়েফ জাহান্নামে যাক তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই রুহানির। তবে ইশা যে স্পর্ধা দেখাচ্ছে তাতে বেশ রেগে যায় রুহানি।
ক্যান্টিনে ইশাকে দেখে রাগে গজগজ করছে রুহানি। ইচ্ছে করছে গরম কফি ওর মুখে ঢেলে দিতে।
কিন্তু এতটাও নির্দয় হওয়া যাবে না। এতে উল্টো নিজেই কেস খেয়ে যাবে।
রুহানি ডিমের ঝুড়ি থেকে ডিম নিয়ে ইশার মাথার দিকে ছুড়ে মারে। রুহানিকে দেখে ওর বন্ধুরাও ইশাকে ডিম ছুড়ে মারে। ইশার মাথা ডিম দিয়ে ঢেকে গেছে। মুখের কাছেও গড়িয়ে পড়ছে। ডিমের গন্ধে ইশার বমি চলে আসছে। দু-হাত সরিয়ে নাক ছিটকাচ্ছে। রুহানি ওর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,” ইউ আর লুকিং সো কিউট!”
ইশা পারলে ওকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু এইভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিজেই মারা পড়বে। দ্রুত ওয়াশরুমে দৌড়ে গেল।
রুহানি আর বন্ধুরা বাইরে এসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মন শান্তি হয়েছে।
রুহানি এনাউন্স করল,”গাইস! আমি আজকে সবাইকে চাইনিজ ট্রিট দেব।”
তুরানি বলল,
“আমি চাইনিজ খাব না।”
“ওকে যে যা খাবি তাই খাওয়াব। ক্যাশ, কার্ড সব আছে। আজকে আমি অনেক খুশি। যে যা চাইবি তাই দেব।”
তারপর সবাই ক্লাস মিস দিয়েই এক সাথে বেড়িয়ে গেল।
ফালাক লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। শুভ আর সোহান ওর দিকে এগিয়ে এল কথা বলার জন্য। ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে ক্লাসের দিকে গেল। ওরা বসার পর পেছনে থেকে একজন ফালাকের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল। ফালাক পেছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ, তোমার চুলে চুইংগাম। বাজে ভাবে জড়িয়ে আছে।”
ফালাক চুইংগামের কথা শুনে মাথায় হাত দিতে গিয়েও দিল না। শুভকে বলল,
“দেখতো মাথায় কি?”
সোহান আর শুভ দুজনেই মাথার দিকে তাকাল। চুলে চুইংগাম আঁটকে আছে।
সোহান অসহায় ফেস করে বলল,
“ভাই, সত্যিই চুলে চুইংগাম। কি করে লাগল?”
ফালাক ভাবছে কি করে চুলে চুইংগাম লাগতে পারে কিন্তু কিছুই মাথায় এলো না।
ফালাক দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল। শুভ আর সোহানও ওর পেছনে পেছনে গেল। ফালাক ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় মাথার পেছনটা দেখার চেষ্টা করছে। শুভ আর সোহানের সাহায্যে চুল থেকে চুইংগাম ছাড়াতে সক্ষম হলো।
ফালাক মুখে পানি দিচ্ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। শুভ কি জানি ভেবে আমতা আমতা করে বলল,
“ভাই আমার মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে করেছে।”
ফালাক চমকে শুভর দিকে তাকাল। তারপর চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“রুহানি! যথেষ্ট হয়েছে আজ আর ওকে ছাড়ছি না।”
ফালাক হুড়মুড় করে বের হয়ে গেল। চোখ-মুখ লাল করে হনহন করে হাঁটছে আর রুহানিকে খুঁজছে। কিন্তু রুহানিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।
অতঃপর জানতে পারল রুহানি অনেক আগেই চলে গেছে।
“আজ চলে গেছো তো কি হয়েছে? আসবে তো আবার। তোলা রইল তোমার জন্য।”
রুহানি রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সাথে খাওয়া দাওয়া করছে, এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। সেল্ফি নিচ্ছে। কেউ কেউ ফেসবুকেও আপলোড দিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি, খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল।
কিন্তু বাড়িতে ফিরে ওর চোখ চড়কগাছ। বাড়িতে স্যুট-কোট পরা কয়েকজন লোক এসেছে। তারা কি যেন বলছে ওর মায়ের সাথে। ওর মায়ের বিমর্ষ ফেস দেখে ভালো ঠেকল না বিষয়টা।
রুহানি দ্রুত মায়ের কাছে গেল। ওর মা ওর দিকে তাকাল। রুহানি আতংকিত কন্ঠে বলল,
“উনারা কারা মা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”
রুহানির মা রুহানির হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“তুই কোথায় ছিলি? তোকে কতবার ফোন করেছি হাহ?”
রুহানির মা বলতে বলতে কেঁদে দিল।
রুহানি মায়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কি হয়েছে?”
রুহানির মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সব শেষ হয়ে গেছে রুহানি। সব শেষ। ব্যাংকের লোকজন এসেছে।”
“বাবা কোথায়?”
রুহানির মায়ের কান্নার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। তিনি কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“স্ট্রোক করেছে। হসপিটালে আছে। কাছে থাকার মতো একটা মানুষ নেই। রুহানকে রেখে এসেছি। তোকে ফোন করছি তুই তো ফোন রিসিভই করছিস না। সব শেষ রুহানি। এখন আমি কি করব? কার কাছে যাব? আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না।”
রুহানি মায়ের কথা শুনে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। কিছু সময়ের ব্যবধানে কি হয়ে গেল? কিছুক্ষণ আগেও তো বন্ধুদের সাথে কত হাসি-খুশি ছিল কিন্তু বাড়িতে এত কিছু হয়ে গেছে তার কোন খবরই ওর নেই।
রুহানির মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আর পায়ের নিচেও মাটি নেই। ও অন্য কোন দুনিয়ায় আছে। কোনকিছু ভাবার ক্ষমতাও নেই। শরীরের শক্তি নিস্তেজ হয়ে আসছে। অনুভূতিরা শূন্যে ভাসমান। গভীর ভাবে ভাঙ্গনের শব্দ পাচ্ছে। তিলে তিলে গড়ে তুলা প্রাচুর্যের ভাঙ্গন।
চলবে….!