প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা?,শেষ পর্ব
জাহান আরা
কিন্তু পাত্র কে??
সবার পাঞ্জাবির দিকে তাকাতেই একটা পাঞ্জাবি চেনা লাগছে,আমার শাড়ির ডিজাইন আর পাঞ্জাবির ডিজাইন একই রকম।
তাহলে সেই পাত্র।
মুখের দিকে তাকাতেই আমি তাকিয়েই রইলাম।
বস আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম পাত্র তাহলে বস-ই।কিছুই বুঝতেছি না,উনি কোথায় আর আমরা কোথায়,আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে উনি বিয়ে করতে রাজী হবে আমার ভাবনার অতীত ছিলো।
অনু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বসের পাশে বসালো,বস ২ টা রিং বের করে প্রথম টা আমাকে পরালেন,২য় টা অনুকে পরালেন।
তারপর অনুকে কোলে টেনে নিলেন।
আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ পাকা হলো।
আমাদের কারোরই তেমন আত্মীয় স্বজন নেই,তাই বাসাতেই আয়োজন হবে বিয়ের।
রাতে বিছানায় যেতেই আস্তে আস্তে সমস্যা দেখা দিলো,আমার পুরো বিছানা এলোমেলো। বালিশ,তোষক কেটে টুকরো টুকরো করা,পুরো রুমে তুলো উড়ছে।
আমি রুমে যেতেই সেই ঘ্রাণ টা পাচ্ছি।
বুঝতেছি না ওর কি হলো??
আমি শুয়ে পড়লাম,কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই জেগে গেলাম।কেউ যেনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে বারান্দায়।
সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা তীব্র খুব।
ভয়ে ভয়ে বারান্দায় যেতেই দেখি কেউ একজন বসে আছে বারান্দার ফ্লোরে।
তার শরীর থেকে সেই ঘ্রাণ খুব তীব্র ভাবে আসছে।
আমি জানি ও কে,আমি কি ভেবে যেনো তার পাশে গিয়ে বসলাম।তার কান্না আরো বেড়ে গেলো।
আমিঃ কি হয়েছে??
সেঃ তুমি এই বিয়ে করতে পারবে না,তুমি আমার।আমি তোমাকে অনেক বেশী ভালোবাসি।
আমিঃ কিন্তু এ কি করে সম্ভব বলো??
তুমি আমি ২ জন ২ জাতি।আমি মানুষ তুমি জ্বীন,কিভাবে তোমার আমার ভালোবাসা হবে??তুমি কি ভুলে গেছো সেই ছোটো বেলায় আমাদেরকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিলো ২ জন ২ জাতি বলে।
সেঃ আমি জানি না অনিতা,আমি শুধু জানি তুমি আমার।তোমাকে আমার কাছ থেকে যে কেড়ে নিতে চাইবে আমি তাকে বাঁচতে দিবো না।তোমার বস রাফিকে আমি শেষ করে দিবো বিয়ের দিন।বাসর রাতেই তুমি বিধবা হবে অনিতা।
আমিঃ তুমি এরকম কিছুই করবে না।তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু।তোমার থেকে আমার এরকমটা প্রত্যাশিত না।
সেঃ তুমি আমার ভালোবাসা,আমার ভালোবাসার জন্য আমি সব করতে পারি।আমার ভালোবাসা যে কেড়ে নিতে চাইবে আমি প্রতিশোধ নিবোই।
বলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
আমি কি করবো এখন,কাকে বলবো এসব,কে বিশ্বাস করবে আমার এসব কথা??
আমার রাফিকে সব বলতে হবে।তারপর রাফি সিদ্ধান্ত নিবে কি করবে।
পরেরদিন অফিসে যেতেই সবাই আমাকে আলাদা খাতির করা শুরু করলো,আমার আর রাফির বিয়ের কথা সবাই জেনে গেছে।
আমি সোজা রাফির কেবিনে গিয়ে ঢুকলাম।
গিয়ে দেখি রাফি ল্যাপটপে কিছু করছে
আমিঃ আমার কিছু জরুরি কথা আছে আপনার সাথে।
রাফিঃ হ্যাঁ বলো,তার আগে আমার জরুরি কাজ আগে করো।
আমিঃ কি??
রাফিঃ আগে কেবিনের দরজা লক করো।
আমি এই কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম কি বলছে উনি।
আমিঃ কেনো দরজা লক করা লাগবে??
রাফিঃ যা বলছি তা করো আমি তোমার বস,ইটস মাই অর্ডার।
আমি গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
রাফি আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো,আমি পিছিয়ে যেতে লাগলাম।একসময় গিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে গেলাম।রাফি আমার নাকের সাথে নাক মিলিয়ে দাঁড়ালো।ওর নিশ্বাস আমার মুখে পড়ছে।
তারপর নিচে বসে গিয়ে আমাকে পায়েল পড়িয়ে দিলো।
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
রাফিঃ ভয় পেয়েছো তাই না??
তুমি তো ২ দিন পর পার্মানেন্ট ভাবে আমারই হয়ে যাবে,আগেই কোন আক্কেলে আমার বৌ কে আমি অপবিত্র করবো বলো তো মিসেস রাফি মাহবুব ???
আমিঃ আমার কথা বলা হয় নি এখনো।
রাফিঃ আমার কাজ এখনো শেষ হয় নি,এদিকে এসো।
আমি গিয়ে দাড়াতেই রাফি আমাকে ওর চেয়ারে বসিয়ে দিলো,তারপর নিজে পাশে দাড়িয়ে থেকে আমাকে ল্যাপটপে বিভিন্ন শাড়ি,জুয়েলারি দেখাচ্ছে আমার কোনটা পছন্দ বলার জন্য।
তার যে কি উৎসাহ মুখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পারছি।আমি আমার পছন্দগুলো বল্লাম।
তারপর রাফি টেবিলের উপর বসে আমাকে বললো,বলো এবার কি বলবে,তোমার কথা শুনি।
আমি রাফিকে কাল রাতের কথা বললাম।
রাফিঃ কিন্তু সে কে??তোমার সাথে পরিচয় কিভাবে হলো??
আমিঃ শুনো তাহলে।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে একটা কামিনী ফুল গাছ ছিলো।আমি প্রতিদিন ভোরেই ছুটে যেতাম সেখানে ফুল কুড়াতে সবার আগে।তখন থেকেই আমার খুব প্রিয় কামিনী ফুল।
একদিন আমার আগেই অন্যরা এসে ফুল নিয়ে যায়,আমি গিয়ে দেখি গাছতলা শুন্য।কোনো ফুল না পেয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়,চোখে পানি চলে আসে আমার।ঠিক তখুনি আমার চাইতে কিছুটা বড় একটা ছেলেকে দেখতে পাই গাছে বসা।
ছেলেটা আমাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করে আমার কি হয়েছে,ফুলের চিন্তায় আমি এতোই অস্থির ছিলাম যে ও যে একটা সরু ডালে বসে আছে যেখানে বসা প্রায় অসম্ভব ছিলো, তা আমি চিন্তা ও করি নি।
আমি বলে দিলাম ফুলের কথা।
শুনে ছেলেটার কি যে হাসি।
হাসতে হাসতে সে বললো দাড়াও দিচ্ছি।একটা নাড়া দিতেই গাছের সব ফুল পড়ে গেলো।
আমি সব নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
তারপর থেকে কেউই ফুল পায় না,কিন্তু আমি গেলে দেখি অফুরন্ত ফুল ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
আস্তে আস্তে ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় হয়।
সে আমার সব কিছুতে পাশে থাকে,যখন একা থাকি তখন তার সাথে কথা বলি একা একা।বিষয় টা বাবার নজরে আলসে,বাবা মাকে বলে,মা আমাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি মা’কে বলে দিই।
ছেলেটা রাতে আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসতো। কতো রকমের ফল,কিন্তু প্রতিবার কামিনী ফুলের মালা থাকতোই সাথে। আমাদের বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হচ্ছে আমার কাছে বিষয় টা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
বিষয় টা যে অস্বাভাবিক আমার তা মনে হয় না।
বাবা মা পরামর্শ করে এক হুজুরকে আনে,হুজুর কিভাবে যেনো ওরে ১যুগের জন্য বোতল বন্ধী করে দেয়।
তারপর বাবা আমাদেরকে নিয়ে গ্রাম থেকে চলে আসে।
এতোবছর ঠিক ছিলো,কিন্তু ১ যুগ শেষ হওয়ার পর সে মুক্তি পেয়েই চলে আসে।
তারপর তো সবই জানেন আপনি।
রাফিঃ সেই হুজুরের কাছে যাওয়া যায় না আবার??
আমিঃ ও মুক্তি পেয়ে সবার আগে ওই হুজুরকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলেছে।
রাফিঃ ভয় পেও না,আল্লাহ ভরসা। অফিস করা লাগবে না চলো আমরা এক জায়গায় যাই।
আমিঃ আমার কাজ আছে যেতে পারবো না।
রাফিঃ ও ম্যাডাম,আই এম ইউর বস,আফটার ম্যারেজ ইউ উইল বি মাই বস।
তো যতোদিন আমি বস ততোদিন একটু আমার কথা শুনেন,২ পর তো আমি শুনে চলবো আপনার কথা।
আমি আর কিছু না বলে রাফির সাথে বের হয়ে এলাম।
রাফি আমাকে গাড়িতে বসতে বলে কাকে যেনো ফোন দিলো,ফোনে কি বললো জানি না।
কিছুক্ষণ পরেই একটা রেষ্টুরেন্টে গেলো আমাকে নিয়ে,একটু পর দেখি আংকেল ও এলো।
আমি উঠে সালাম দিলাম ওনাকে।
আংকেল আমার থেকে আবার শুনলো তার কথা।
সবাই খাবার খেয়ে নিলাম,আংকেল একটা ঠিকানা দিলো রাফিকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
রাফি আমাকে নিয়ে চললো সেখানে।
আমিঃ আমরা কোথায় যাচ্ছি??
রাফিঃ গেলেই দেখবা কই যাচ্ছি।
আমিঃ কেনো যাচ্ছি??
রাফিঃ আমার বৌ কে কোন জ্বীন ব্যাটা কেড়ে নিতে চায় তার বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছি সুইটহার্ট
আমিঃ আপনি বিয়েটা করিয়েন না।
রাফিঃ আমার হবু বৌ কি ওই জ্বীন ব্যাটার প্রেমে পরছে নাকি??
আমিঃ কি জানি কিন্তু ও আমার কোনো ক্ষতি করে নি,আমার সব বিপদে আমাকে বাঁচিয়েছে।ওর কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না।
রাফিঃ দেখো অনিতা,জীবন এতো সহজ না,আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।যেটা অসম্ভব সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখা বোকামি।
তুমি কি ভাবো যে তুমি ওকে বিয়ে করতে পারবে??
আমিঃ না তা পারব না
রাফিঃ তাহলে আমি যা করছি তা করতে দাও,আমি চাই না আমাদের মাঝে কেউ থাকুক।তোমাকে যেদিন প্রথম দিন অফিসে দেখেছি সবার চাইতে আমার তোমাকে অন্যরকম মনে হয়েছে তোমার সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে,আমি একজন মা পেয়েছি,আমার মায়ের অভাব পূরণ হতে যাচ্ছে এতো দিনে,আমি মন খুলে কাউকে মা বলে ডাকার অধিকার পেতে যাচ্ছি অনিতা,মায়ের কোলে মাথা রেখে কান্না করার সুখ পেতে যাচ্ছি,আমার সেই সুখ তুমি কেড়ে নিও না প্লিজ।
আমি খুব ভালোবাসার কাঙ্গাল।
আমি আমার সব ছেড়ে দিবো সব দিয়ে দিবো তোমাকে তবু আমাকে এতটুকু দান করো।
বলেই রাফি কান্না করতে লাগলো।
আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে আমার কি করা উচিৎ এখন।আমি যা চাইছি তা কখনো সম্ভব হবে না। কিন্তু রাফিকে যদি ও মেরে ফেলে তাহলে আমি কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো।বিয়ে ভাঙতে ও দিবে না রাফি
উফফফফ্ আর পারছি না আমি চাপ নিতে। আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরাঘুরি করছে রাফি।এর মাঝে মা’র কল এলো ২ বার,কি অদ্ভুত মা আমাকে কল দেয় নি আজ আর রাফিকে কল দিয়ে খবর নিয়েছে।
যতবারই মা’র কল এসেছে রাফির মুখ ২০০ ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
মানুষ কতো অল্পতেই খুশী!!
সবার চাহিদা কতো ভিন্ন ভিন্ন!!!
সন্ধ্যা নেমে এলো।
রাফি আমাকে নিয়ে একজন হুজুরের কাছে গেলো,উনি অনেক বড় একজন হুজুর,বাহিরে অনেক লোক বসে আছে।
রাফি আগেই কথা বলে রেখেছিলো বলে আমাদের কে আগে যেতে দেওয়া হলো।
হুজুর আমাকে ওনার সামমে একটা বেঞ্চে বসতে বললো।
একটা পানি ভর্তি গ্লাসের উপর আমার হাত রাখতে বললো,আমার খুব ভয় লাগছিলো,আমি ওর ক্ষতি করতে চাই না।
রাফি আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায়।আমি জানি রাফি কি বলতে চায় আমাকে।
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্লাসে হাত রাখলাম।পুরো ঘর অন্ধকার কোথাও কোনো আলো নাই,পানি ভর্তি গ্লাসটা থেকে শুধু আলো বের হচ্ছে।
হুজুর সেই পানির দিকে তাকিয়ে আমার ছোট বেলা থেকে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে ওর সাথে সব গড়গড় করে বলে গেলো।
আমি অবাক,এমন অনেক কিছু আমার মনে ও নেই কিন্তু উনি বলে গেছেন।
সব দেখার পর হুজুর বললেন,এই জ্বীন বড় ত্যাদড়,একে আটকাতে হবে কৌশলে ।
আমি সহজে ওরে আনতে পারবো না,তবে হ্যাঁ আপনি যদি চেষ্টা করেন তাহলে হয়তো আনতে পারেন এখন,আপনি ডাকলেই সে আসবে।
আমিঃ আমি কিছুতেই চেষ্টা করবো না।আমি চাই না ওর ক্ষতি করুন আপনারা।
হুজুরঃ মা জননী,আপনি এখনো ছোট রয়ে গেছেন,যেই মানুষ টা ২ দিন পর আপনার স্বামী হবে তার প্রতি আপনার ভালোবাসা নেই,দায়িত্ব নেই,যে আপনার কেউ না,তার প্রতি আপনার টান!!
যে আপনাকে বলে গেছে আপনাকে বিধবা করে দিবে তাকে বাঁচাতে চান আপনি??
আপনি আর ও ২ জন ২ সমাজের,কেনো অবুঝ হচ্ছেন আপনি??
আমি কি করবো আমি ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম।
আমি আসলে কি চাই আমি নিজেই জানি না।
আমি চাই না রাফি কে কষ্ট দিতে,ওর মুখে যেই হাসি ফুটে উঠেছে সেই হাসি আমি কেড়ে নিতে চাই না
কিন্তু তাই বলে আমি আমার শৈশবের বন্ধুকে ও হারাতে চাই না ওর তো কোনো দোষ নাই,কেনো ওকে শাস্তি পেতে হবে????
হুজুরঃ বেশ তো,ওকে কিছু করবো না,কিন্তু আপনি কি তাকে মানিয়ে নিতে পারবেন যাতে আপনার স্বামীর ক্ষতি না করে??
আমিঃ না, সে মানবে না।
হুজুরঃ বেশ তাহলে,মানাতে হবে না,আমি ও কিছু করবো না,আপনি আপনার ইচ্ছেমতো চলুন,বাসর রাতে বিধবা হোন আপনি,আপনার স্বামীর প্রান যাক তাও আপনার বন্ধু ভালো থাক
রাফিঃ চলো অনিতা,আমি তাতেও রাজী,তুমি খুশি থাকলেই হলো,আমার আফসোস নাই,মা তো আমি পেয়ে গেছি,মন ভরে মা ডেকে নিয়েছি,এবার মৃত্যুতে ও আমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না।
আমি কি ভেবে রাফিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।
আমিঃ হুজুর আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো,আমার রাফিকে বাঁচান আপনি।
হুজুরঃ আপনারা ২ জনেই বসেন একইসাথে।
আমি আর রাফি বসার পরে হুজুর একটা পিন দিয়ে আমার ১০ আঙুল ফুটা করে দিলো,আমি ব্যথায় কেঁদে দিলাম।
১০ আঙুল থেকে ১০ ফোটা রক্ত নিয়ে ১ টা শিশিতে ভরলেন।
আমার মাথার ১ টা চুল,ওড়নার একপাশ থেকে কিছুটা অংশ ওই শিশিতে রাখলেন।
আমাদের ভয় পেতে নিষেধ করে দিয়ে হুজুর আমাকে বললেন,একটু পরে যা হবে তা আপনারা ২ জনেই দেখবেন।কিন্ত আপনি কোনো নড়াচড়া করবেন না,কোনো কথা বলবেন না।
আপনি কথা বললেই সব পন্ড হয়ে যাবে।
আমিঃ জ্বী ঠিক আছে।
হুজুর একটা মাটির পাত্রে ধূপ পোড়া দিলেন। তারপর কি কি পড়ে যেনো একমুঠ করে ধূপ ওই পাত্রে ফেলতে লাগলেন।কিছুক্ষণ পরেই কতোদূর থেকে সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা আমি পেতে লাগলাম।
সে আসছে,আজকেই হবে তার হয়তো শেষ দিন।
আমার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রইলো না।
কিছুক্ষণ পরেই সে এলো।
আমাকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ।
হুজুরঃ অনিতার প্রান আমার হাতে,তোর খেলা শেষ ।
তুই অনিতাকে পাওয়ার জন্য কতো কিছু করেছিস কিন্তু পেলি না।
সেঃ অনিতার কি হয়েছে অনিতা কথা বলে না কেনো?
হুজুরঃ অনিতা আর কথা বলবে না।
আজকে অনিতার শেষ দিন।ওর কথা ফুরিয়ে গেছে।
সেঃ তোকে আমি বাঁচতে দিবো না অনিতার কিছু হলে।
হুজুরঃ তুই এখানে কিছুই করতে পারবি না,আমার চারপাশ আমি বন্ধ করে রেখেছি।
সেঃআমি জানি সেটা,নয়তো আমি অনিতাকে এখানে একা আসতে দিতাম না,তোর এই জায়গায় আমি প্রবেশ করতে পারছিলাম না অনেক চেষ্টা করেও।
তারপর রাফির দিকে তাকিয়ে বললো,তোকে তো আমি শেষ করে দিবো যদি অনিতার কিছু হয়।(হাহাহা)
হুজুরঃ তার আর দরকার হবে না,অনিতার প্রান আর অল্প সময় আছে তারপর আমি তা নিয়ে নিবো,তুই বল এখন কি করবি??
অনিতা কে বাঁচাবি,নাকি চলে যাবি।
তোর জন্যই চলে যাওয়াই ভালো।
সেঃ আমি অনিতাকে নিয়েই যাবো।আমি সেই ছোট বেলা থেকেই অনিতাকে আমার ভেবে আসছি, সব বিপদে ওর পাশে ছিলাম।
হুজুরঃ তোর হাতে ২ টা উপায় আছে এখন।
১)তুই এখান থেকে প্রান নিয়ে চলে যা,তোর অনিতার প্রান আমি নিয়ে নিবো এখনি।
২) তুই নিজে বন্দী হতে হবে,তার বিনিময়ে অনিতার প্রান আমি মুক্তি দিবো,তুই বল কি করবি??
সেঃ আমি বিশ্বাস করি না,অনিতা কে তুই কিছু করবি না।
হুজুরঃ ঠিক আছে তুই চলে যা শেষ দেখা দেখে যা অনিতাকে।
সেঃ আমাকে অনিতার প্রান দেখা,আমি অনিতার ঘ্রাণ চিনি,ওর রক্তের সাথে আমার ঘ্রাণ মিশে আছে।
হুজুর সেই শিশিটা ওর সামনে ধরলেন।
হুজুরঃ শুঁকে দেখ তো কার ঘ্রাণ।
সে ঘ্রাণ শুঁকে দেখে আমার ঘ্রাণ।
সেঃ আমার অনিতা কে ছেড়ে দে,আমার কি করতে হবে বল।
হুজুরঃ তোকে এই শিশিতে ঢুকতে হবে।
সেঃ আমি রাজি,তার আগে তুই কথা দে,আমাকে বন্দী করার পর অনিতাকে মুক্তি দিবি?
হুজুরঃ আলবৎ দিবো।
সেঃ ঠিক আছে,আমি রাজী।অনিতার দেহে প্রান আসলে অনিতা কে বলে দিস,ওর রুমে আমি বাতাসে আমার কিছু কথা আটকে রেখে এসেছি,ও রুমে গেলে শুনতে পাবে।ওকে অবাক করে দেয়ার জন্যই নিজে না বলে বাতাসে রেখে এসেছি,এখন দেখছি ভালোই করেছি।
আমি কি অনিতাকে শেষ বারের মতো কিছু দিতে পারি?
হুজুরঃ পারিস।
সে এসে আমার চুলে একটা কামিনী ফুলের মালা পরিয়ে দিলো।
সেঃ এই ফুলেই তোমার সাথে পরিচয় এই ফুলেই শেষ। আমি না থাকলেও এই ফুলের মালা পরিয়ো,ভেবে নিও আমি আশেপাশে আছি।
তারপর আস্তে আস্তে সেই শিশিতে ঢুকে গেলো,হুজুর শিশির মুখে ছিপি লাগিয়ে দিলেন,সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা চিরতরে হারিয়ে গেলো।
হুজুরের আখড়ার পাশেই বড় নদী,হুজুর শিশিটা নদীতে ফেলে দিলেন।
আমি রাফিকে ধরে অঝোরে কান্না করছি। এ কেমন ভালোবাসা ছিলো তার,নিজের প্রান দিয়ে আমাকে বাঁচাতে এলো।
রাফিঃ চলো বাসায় চলো,তোমার জন্য কি বলে এসেছে সে।
তাড়াতাড়ি রাফির সাথে বাসায় ফিরে এলাম।
রাফি আর আমি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
তখনি তার কথা শুরু হলো।
সেঃ অনিতা,সেই শৈশবে ফুল কুড়োনোর দিন থেকে তুমি আমার ছিলে,আমি সবসময় তোমাকে আমার ভেবে আসছি।
তোমার জন্য ১২ বছর বন্দী ছিলাম,ভেবেছিলাম বের হয়ে এসেই প্রতিশোধ নিবো,কিন্তু ভালোবাসা বেশী ছিলো তাই পারলাম না।হয়তো ভাবছো জ্বীনের আবার কিসের ভালোবাসা মানুষের প্রতি,কিন্তু কি করবো বলো,হয়ে গেছে যে,ছাড়ার চেষ্টা করি নি কখনো।
আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু আমার জ্বীন সমাজ তোমাকে মেরে ফেলবে,তোমার চাইতে দামী কিছুই নেই আমার কাছে,কিন্তু হিসেব করে দেখলাম তোমার কাছে আমার চাইতে দামী তোমার স্বামী,তোমার বস রাফি,খুব হিংসা হচ্ছিলো,তাই রাফিকে মেরে ফেলতে চেয়েছি। কিন্তু তাতে কি লাভ বলো,তোমাকে তো পাচ্ছি না,এখন যেই স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে তাও আর থাকবে না তখন।
তাই ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম যে তোমাকে তোমার মতো থাকতে দিবো,বিনিময়ে এটুকুই চাইবো,আমাকে তোমার বিপদে তোমার আশেপাশে থাকতে দিও,তোমার সব কিছু পছন্দ করার অধিকার আমাকে দিও,তোমার জন্য আগের মতো পাগলামি করার অধিকার দিও,তোমার স্বামীকে বলে দিও আমি আর কিছুই চাইবো না,বিনিময়ে রাফি তোমাকে পাবে।
তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে তোমার টেবিলে রাখা কামিনী ফুলের মালা গুলো চুলে দিও,আমি আসবো তোমার সামনে,দোয়া করতে তোমার নতুন জীবনের জন্য,আর রাজী না হলে ফেলে দিও,আমি আড়াল থেকে তোমার পাশে থাকবো কখনো তোমার সামনে আসবো না।
আমি ছুটে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে মালাগুলো পরে নিলাম,কিন্তু সে আর আসে না।
সে আর আসে না কেনো,কি করলাম আমি এটা,মিথ্যা বলে ওর জীবন শেষ করে দিলাম।
আমি রাফির দিকে তাকিয়ে আছি
রাফি তক্ষুনি হুজুর কে ফোন দিলো।
রাফিঃ হুজুর,সেই শিশিটা কি পাওয়া যাবে,ওকে মুক্তি দিতে হবে হুজুর।
হুজুরঃ তা তো এখন সম্ভব না,আমি সেটা নদীতে ফেলে দিছি,নদীর ঢেউ কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে সেটা।
রাফি ফোন কেটে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো,আমি তার দেওয়া কালো শাড়ি টা পরে মাথায় কামিনী ফুলের মালা দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে কি আসবে আবার???
আমার মন খারাপ তো সে সবার আগে টের পায়,আজ কি আসবে সে???
বারান্দায় রাখা ব্লেডের সাথে আমার হাত কেটে ফেললাম রাগে।
একটু পর আমি সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা পেতে লাগলাম।
কিন্তু এই ঘ্রাণ কিসের???
আমার রক্তে সাথে মিশে থাকা তার ঘ্রাণ নাকি সে আসছে সেই ঘ্রাণ ।
ঘ্রাণ আরো তীব্র হচ্ছে,তবে কি সে আসছে!!!!
(সমাপ্ত)