প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা সিজন 2,পর্বঃ ০১

প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা সিজন 2,পর্বঃ ০১
জাহান আরা

রাফির বৌ’কে দেখেই হাসান চমকে উঠে, এই কি মেয়ে নাকি অপ্সরা??
একটা মেয়ে এতো রূপবতী হতে পারে হাসানের ধারণা তে ছিলো না।
অপলকভাবে হাসান অনিতার দিকে তাকিয়ে রইলো, এই মেয়েটাকেই লাগবে তার। অনেকদিন নতুন কারো দেহের স্বাদ পাওয়া হয় নি। হাসানের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা পশুটা জেগে উঠে অনিতাকে দেখেই।

আজ রাফির আর আমার বিয়ে,কিন্ত কেনো জানি আমি এখনো তাকে ভুলতে পারছি না।সে তো আমার ক্ষতি করে নি,আমার জন্য নিজের প্রান বাজি রেখেছে,আজ কোথাও সে??

বিদায় বেলা এগিয়ে এলো কেনো জানি আমার সব কিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
কখন যেনো বিদায় নিয়ে চলে এলাম টের ও পেলাম না।সবাই নাকি কান্না করে বিদায়ের সময় অথচ আমার তখন কান্না ও পেলো না।

বাসর ঘরে ঢুকে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পুরো ঘর কামিনী ফুল দিয়ে সাজানো, এ যে আমার ভিতরের আগুন আরো বেশী বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো,সে কোথায় আজ,তাকে কি আর একবার ফিরে পাবো না আমি???
বুকের ভিতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস কান্না হয়ে বের হয়ে এলো।

বাসর ঘরে ঢুকেই রাফি দেখে অনিতা অঝোরে কান্না করছে,রাফি জানে অনিতা কেনো কান্না করছে,রাফির খুব হিংসে হতে লাগলো।
অনিতা রাফির বৌ,অনিতার সব কান্না হাসির কারন রাফি হবে কেনো সে অন্য কারো জন্য কান্না করছে।

হঠাৎ করেই অনিতা পাগলের মতো শুরু করে,ঘরে সাজানো কামিনী ফুলের সবগুলো মালা ছিড়ে ফেলে।

রাফি মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে,খুব শখ করে অনিতার জন্য বাসর সাজিয়েছে রাফি কামিনী ফুল দিয়ে ভেবেছিলো অনিতা খুশি হবে,রাফি বুঝতে পারে নি এই ফুল যে অনিতার ভিতরের আগুন আরো বাড়িয়ে দিবে।।।আজ থেকে কামিনী ফুল অনিতার জীবনে নিষিদ্ধ বলে অপ্রকাশিত ঘোষণা দিলো রাফি।

এগিয়ে গিয়ে অনিতার কাঁধে হাত রাখলো।অনিতাকে নিজের বুকে টেনে নিলো,শক্ত করে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরলো অনিতাকে,যেনো ভয় খুব হারিয়ে ফেলার,যেনো একটু আলগা হলেই হারিয়ে যাবে অনিতা,ছিনিয়ে নিবে কেউ।
কি অজানা আশংকা রাফির বুকের ভিতর বাসা বাঁধে তা শুধু রাফি জানে,রাফি কি পারবে অনিতা কে তার মতো করে ভালোবাসতে,এভাবে আগলে রাখতে তার মতো করে??

রুমের লাইট অফ করে রাফি অনিতা কে বিছানায় শুইয়ে দিলো,আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো অনিতা কে,যেনো পণ করেছে সে আদর দিয়ে অনিতার বুকের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস দূর করে দিবে সে।

কিন্তু বিধিবাম হলে যা হয়,রাফি যতোই অনিতার সাথে ঘনিষ্ঠ হয় অনিতার থেকে কোনো সাড়া পায় না।

রাফির মন খারাপ হয়ে যায়,নিজের বিয়ে করা বৌয়ের মনের ভিতর যখন অন্য কারো চিন্তা চলে,অন্য কারো জন্য চোখের পানি পড়ে তখন তা কারোরই সহ্য হয় না
অনিতার আগ্রহ না পেয়ে রাফি সরে যায় অনিতার উপর থেকে। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।




রাফি রাগ করে আমার কাছ থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি নিজের মনকে নিজে খুব শাসন করছি,কিন্তু পারছি না বুঝাতে।
একবার যদি জানতে পারতাম সে ভালো আছে আমি আর কিছু চাইতাম না,কোনো কষ্ট থাকতো না আমার।

কি করবো আমার কান্নাতে রাফির মন খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারছি।
না এভাবে চলবে না এখন রাফি আমার স্বামী, আমার ভিতর টা পুড়ে গেলে ও রাফিকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
সংসার জিনিস টা কি আমি জানি না, তবে আমার কাছে এখন মনে হয়,”সংসার মানে হচ্ছে নাট্যমঞ্চ, যেখানে যতো সুন্দর অভিনয় করতে পারবো ততই সবাইকে ভালো রাখতে পারবো। ”
এই মুহূর্ত থেকেই না হয় শুরু হোক আমার অভিনয় জগতের সূচনা।

উঠে গিয়ে রাফিকে জড়িয়ে ধরলাম।
আমাকে বুকে টেনে নিয়ে রাফি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি জানি আমার যেমন কষ্ট হচ্ছে তার জন্য রাফির ও সেই কষ্ট টা হচ্ছে আমার জন্য। এ যে কি জ্বালা তা তো আমি বুঝি।

আমিঃ এখন কি আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই রাত পার করবেন স্যার???

রাফিঃ উহু,কোনো স্যার না। আজ থেকে,রাফি।
কি করবো বলো বৌ তো কোনো রেসপন্স করে না।

আমিঃ ঠিক আছে তাহলে বারান্দায় থাকেন যাচ্ছি আমি।

তখনি রাফি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
আস্তে আস্তে আমাকে আদর দিতে লাগলো,আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।
রাফির দেহ আমার দেহের সাথে মিশে গেছে,আদিম উল্লাসে মেতে উঠেছি ২ জন,কি এক অদ্ভুত সুখ!!
পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে আলাদা। এ যে স্বর্গীয় সুখ!!
পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা ২ জন।

কিছুক্ষণ পর ২ জনেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি,রাফি আমার বুকে শুয়ে পড়ে।
আমি রাফিকে জড়িয়ে রেখে ভাবছি,এই গল্পটা তো অন্যরকম হতে পারতো।

তখনি যেনো আমি কোথাও থেকে তার ঘ্রাণ পেতে লাগলাম সেই মিষ্টি ঘ্রাণ, কিন্তু এই কিভাবে সম্ভব!!!

বুঝতে পারলাম আমার মনের ভুল হচ্ছে।
আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।

ভোরে উঠেই গোসল করে রাফিকে তুলে দিলাম, রাফি আর বাবা মসজিদে গেলো আমি নামাজ পড়ে কিচেনে।
রাহেলা খালা ও জেগে উঠেছে,আজ থেকে আমাকে এই ছন্নছাড়া পরিবারকে ঘুচিয়ে নিতে হবে যে।

খালাকে তরকারি কাটতে বলে আমিই রান্না করলাম,আগে থেকেই আমার রান্নার অভ্যাস আছে, বাবা আর রাফি নামাজের পর মর্নিং ওয়াক করে বাড়ি ফিরতেই তাদের নাশতা দিলাম।

বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে,বাবা কান্না থামিয়ে নাশতা খেতে লাগলো কি অদ্ভুত আমি যেনো তখন আমার বাবাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
বাবা বেঁচে থাকতে আমি কোনো কিছু রান্না করলে যেমনই হতো বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে খেতেন।
ঠিক এখন যেভাবে আমার শ্বশুর খাচ্ছে। আমার ও কান্না এসে গেলো।

বাবাঃ কিরে মা,তুই কাঁদছিস কেনো?

আমিঃ আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে বাবা।

বাবাঃ দূর বোকা,আমি তো তোর বাবা,কাদবি না তুই।
আমার অন্ধকার ঘরে তুই যে আলোর প্রদীপ মা,তুই কাঁদলে সেই প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে যায় যে।

অফিসের সময় হয়ে গেলো, রাফি রুমে এসে আমাকে রেডি হতে বললো।

আমিঃ আমি কই যাবো??

রাফিঃ অফিসে যাবে।

আমিঃ মানে কি,আমি কেনো অফিসে যাবো এখন আর??

রাফিঃ ম্যাডাম আপনি কি রিজাইন দিছেন??
নাকি আপনাকে আমি বরখাস্ত করছি,কোনো অযুহাত চলবে না, অফিসের এই ৬ ঘন্টা তোমাকে না দেখতে পেলে আমি থাকতে পারবো না বৌ,আসো না প্লিজ।

আমিঃ সবাই কি বলবে যাও,আমি তোমার সাথে যাবো না।

রাফিঃ ঠিক আছে ম্যাডাম,আপনি আপনার গাড়িতে যান,আমি না হয় আমার গাড়িতে যাবো।

আমিঃ আমি রিকশায় যাবো।

রাফিঃ না তা হবে না।

আমিঃ প্লিজ আজকের জন্য দাও,কাল থেকে তোমার সাথে গাড়িতে যাবো, প্লিজ, প্লিজ

রাফিঃ দিতে পারি ১ শর্তে।

আমিঃ কি বলো??

রাফিঃ আমাকে এখন ১০ টা চুমু দিতে হবে।

আমিঃ যাও নির্লজ্জ একটা।

রাফিঃ আপনার শাড়ী আমি পছন্দ করে রেখে দিছি বিছানায়, পরে নেন।

এই কথা শুনেই আবার আমার মন খারাপ হয়ে গেলো, এভাবে তো সে আমার জন্য শাড়ী পছন্দ করে রাখতো, আজকে কে করছে কার কাজ!!!

রাফিঃ কি হলো??

আমিঃ না কিছু না।

রুমে গিয়ে নীল শাড়িটি পরে নিলাম আমি জানি আজকে রাফি নীল পাঞ্জাবি পরবে।

বের হয়ে আসতেই দেখি সত্যি সে নীল পাঞ্জাবি পরে আছে,কি যে সুন্দর লাগছে রাফিকে!!!

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

রাফিঃ ও ম্যাডাম,এখনই তাকিয়ে থাকবেন নাকি অফিসে যাবেন,আপনার জন্য রিকশা এসে দাঁড়িয়ে আছে, আজকেই কিন্তু শেষ সুযোগ আপনার মনে রাখিয়েন,বিকেলে ফিরবেন আমার সাথে গাড়িতে করে।

আমিঃ ঠিক আছে বস।

বলেই হেসে রিকশায় উঠে গেলাম।
রিকশা চলতে শুরু করে।

বাসার গলি থেকে বের হতে গিয়েই একটা মাইক্রোর সাথে রিকশা ধাক্কা খায়।
আমি রিকশা থেকে পড়ে যাই।

মাইক্রো থেকে হাসান সাহেব বের হয়ে আসে,আমার কাছে বার বার মাফ চায় সরি বলে।

আমিঃ জ্বী ঠিক আছে সমস্যা নাই, আপনি যান।

হাসানঃ না না ভাবী,চলেন আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

আমিঃ না আমি রিকশায় যাবো।

হাসানঃ প্লিজ ভাবী,না করিয়েন না প্লিজ,আসুন আমার সাথে

আমিঃ জ্বী না,আমি রিকশায় যাবো।

হাসানঃ আচ্ছা ঠিক আছে যান তাহলে,আপনার কপালের ডান পাশে কেটে গেছে,এই নেন রুমাল দিয়ে রক্ত মুছে নেন।

হাসান সাহেব আমার দিকে রুমাল বাড়িয়ে দিলো।

আমিঃ কিছু হবে না আমি অফিসে গেলে মুছে নিবো।

হাসানঃ আরে ভাবী নেন তো,রুমাল দিয়ে মুছে নেন,রাফি দেখলে রেগে যাবে পরে।

আমি হাত বাড়িয়ে রুমাল টা নিলাম।

হাসানঃ আপনার নাকের পাশে রক্ত লেগে আছে ভাবী,মুছে নেন,রুমাল টা নাকের কাছে নিতেই আমার কেমন যেনো মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব হচ্ছে, না এটা তার ঘ্রাণ না,এই ঘ্রাণ টা অন্যরকম।
কিসের এটা,ভাবতে গিয়েই আমার চোখ ঝাপ্সা হয়ে এলো, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।




অনিতা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই হাসান লাফ দিয়ে উঠে অনিতা কে ধরে ফেলে,কোলে করে অনিতাকে শুইয়ে দেয় পেছনের সিটে,কাল অনিতাকে দেখার পর থেকে হাসানের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছে এখানে,আজ রাফির সাথে আসলেও প্ল্যান করে রেখেছিলো হাসান অনিতাকে উঠিয়ে নেওয়ার,ভাগ্য প্রসন্ন হলে যা হয়,সুযোগ পেয়ে গেছে একা ছিলো অনিতা।




রাফি অফিসে পৌঁছে চটপট করতে থাকে,অনিতা আসছে না কেনো এখনো??
রাফির আর ভাল্লাগছে না,এতোক্ষণ দেরি হচ্ছে কেনো অনিতার??
পরক্ষণেই ভাবলো হয়তো জ্যামে আটকা পড়েছে।
আরো ৩০ মিনিট পার হয়ে গেলো, এবার আর রাফি বসে থাকতে পারছে না।

অফিস থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় গেলো, দারোয়ান কে পাঠিয়ে দিলো রিকশাওয়ালা কে খুঁজে আনতে,অনিতা কোথায়??

কিছুক্ষণ পরেই সেই রিকশাওয়ালা কে নিয়ে এলো দারোয়ান

রাফিঃ আপনার রিকশায় আমার স্ত্রী ছিলো আপনি নিশ্চয় জানেন,সে কোথায় গিয়েছে??

রিকসাওয়ালাঃ স্যার, আপামনি রে নিয়া গলি থাইকা বাইর অওনের সময় একটা মাইক্রো বাসের লগে ধাক্কা লাগে আমার রিকশার, আপামনি পইড়া যায়,মাইক্রো থাইকা এক সাব বাইর অইয়া আহে,হেই সাবে দেখলাম আপামনিরে ভাবী কইয়া কথা কয়,আমি স্যার তহন রিকশার কাছে ছিলাম বাকি কথা হুনি নাই,কিছুক্ষণ পরে দেহি ওই সাব আপামনিরে একখান রুমাল দেয়,আপামনি নিতে চায় না,হেয় জানি তহন কি একটা কয়,আপামনি তারপর রুমাল দিয়া মুখ মুছতে নেয়,তারপরই মাথা ঘুইরা পইরা যায়,তখনি ওই সাব ধইরা ফালায়,তারপর গাড়িতে উঠাইয়া আমারে কইলো আপনারে ফোন দিবো,আপামনিরে হাসপাতালে নিবো।

এরপর স্যার আমি আর কিছু জানি না।

রাফির খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো, কে নিতে পারে এভাবে অনিতাকে??

হঠাৎ করেই রাফির মনে পড়ে আফজাল সাহেবের কথা,আফজাল সাহেব কে অনিতার জন্য চাকরি ছাড়তে হয়েছিলো, হতেও পারে আফজাল সাহেব অনিতাকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তুলে নিয়ে গেছে।
রিকসাওয়ালা মামা কে সাথে নিয়েই আফজালদের বাসায় যায়।

কলিং বেল বাজতেই আফজাল দরজা খুলে দেয়,দেখে বাহিরে রাফি আর সাথে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে।

রাফিঃ মামা,এই লোক??

মামাঃ না স্যার,হেয় আরেক লোক ছিলো।

আফজাল সাহেব কে কিছু না বলে আবার চলে আসে সেখান থেকে।

ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না রাফি,অনিতা কে অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেছে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here