আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_২৯ (শেষ পর্ব)
সাহেদা_আক্তার
আকাশ চিনা হাসি দিয়া বলল, সব ফেরত নিবা বুঝি?
– হুম। সুদে আসলে ফেরত নিবো।
সে দাঁত কেলাই বলল, তাহলে আমার কিসগুলা ফেরত দাও। যদি পরিমানে কম পড়ে আমি বলে দেবো। আমি শুইনাই লজ্জায় মিইশা গেলাম। ‘তুমি তুমি …’, কি কইতাম? প্রতি উত্তরে দেওয়ার মতো কিছু রাখল না। একটু পরে সে চোখ নাচাইয়া বলল, এমন জানলে ঐদিন তোমাকে কিস করেই ফেলতাম। তাহলে আজকে সুদে আসলে অন্তত সেই কিসটার বদলে দুই তিনটা ফেরত পাইতাম প্রতিশোধ হিসেবে।
আমি মাথা নিচু কইরা রইলাম। সে আবার আগাইতেই আমি কইলাম, যা বলসি তা শুনবা। চুপচাপ সোফায় গিয়ে শোও। নাইলে আমি আব্বুকে এখানে পাঠিয়ে আম্মুর কাছে চলে যাবো। ও মুখ কালো করে সোফায় চলে গেল। আমি মুচকি হাইসা শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ওকে পাহারা দিতে দিতে কখন যে নিজেই ঘুমাই পড়সি বলতে পারবো না।
.
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই বুকে ভারি কিছু অনুভব করলাম। দেখি চেরি আমার বুকে মাথা রাইখা ঘুমাইতেসে। আরে? আমি কি কোলবালিশ নাকি! সবাই আমারে কোলবালিশ বানায় ক্যান? আমি নড়তেই আকাশ আমার দিকে তাকাইলো। আমি চোখ গরম কইরা তাকাই রইলাম। যখন দেখি তখনই সে জাইগা থাকে। তাইলে ঘুমায়টা কখন? ও পাত্তা না দিয়া আবার আমার বুকে মাথা গুঁজে দিয়া বলল, কি ভাবছো, তুমি বললেই এত সহজে তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো। মোটেই না। এই ছয় বছর অনেক অপেক্ষা করেছি। এখন সব উশুল করে তবে তোমার ছুটি।
আমার জামাটা পেটের কাছ থেকে সইরা গেসিলো। ও ওখানে আঙুল নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে লাগল। আমার তো সেই রকম কাতুকুতু লাগতেসে। তার উপর ওর ছোঁয়ায় আমার অবস্থা টাইট। ও আমাকে এমন ভাবে জাপটে ধরে আছে না পারতেসি নড়াচড়া করতে না পারতেসি স্থির থাকতে। এমন সময় আম্মু এসে বাঁচাই দিল। দরজায় নক করে বলল, আকাশ উঠেছিস? ছোঁয়াকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। সবাই নাস্তার জন্য ওয়েট করছে। আকাশ অনিচ্ছার সত্ত্বেও আমাকে ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হইতে চইলা গেল। আমি হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। তবে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে যে লুক দিল, আমারে কাছে পাইলেই খবর আছে। আমি ঢোক গিললাম।
সারাটা দিন চইলা গেল ব্যস্ততায়। ওদের গুষ্টিতে এত লোক! একের পর এক আমারে দর্শনীয় বস্তুর মতো দেখে যাইতেসে। আমি ভারি কাপড় গয়না পরে থাকতে থাকতে টায়ার্ড। রাতের দিকে পরিবেশটা হালকা হইল। অনেকে আকাশদের বাড়িতে চইলা গেল। আমরা ফ্ল্যাটটে রয়ে গেলাম। আজকে আমি রাতের খাবারে গাজরের হালুয়া তৈরী করলাম। সবাই সেই রকম প্রসংশা করল। ডিনার শেষ করে আমি আম্মুর কাছে গিয়া বললাম, আম্মু, কালকে থেকে তুমি আমাকে রান্নার ট্রেনিং দিবে। আম্মু হাসলেন। আমি আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি বললাম, আজকে না আমার আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে। আমাকে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো কোলে শুলে।
– আমিও তো তোর আম্মু। তাই না?
– হুম। তুমি আমার আরেকটা বেস্ট আম্মু।
– হয়েছে, আর পাম দিতে হবে না। যা রুমে যা। না হলে ছেলে আমার তোকে না দেখে পাগল হয়ে যাবে।
– হোক। জানো আম্মু এতদিন ও আমাকে ফোন করে করে পাগল করে ফেলেছিল। এখন ও হোক পাগল। পাগল হলে ওকে ঘরে বেঁধে রেখে আমি আর তুমি একসাথে সারাদিন গল্প করব।
আমি একটা আচারের বয়াম আইনা আম্মুর সাথে গল্প করার শুরু করলাম। আমি জিগাইলাম, আচ্ছা, আম্মু, আপনাদের বাড়ি থাকতে এই ফ্ল্যাটে কেন আনা হল আমাকে? আম্মু হেসে বললেন, আমার পাগল ছেলেটা চাইছিল তোমার নতুন জীবনটা তোমার বাবা মায়ের ছোঁয়ায় শুরু হোক। তাই বৌভাতটা এখানে করতে চাইছিল। আমি মনে মনে বললাম, তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য আমার চেরি ফল। হয়ত মিথ্যা রাগ দেখিয়ে তোমাকে দূরে রেখেছি। কিন্তু আমি জানি আমি বেশিদিন পারবো না এই দূরত্ব রাখতে। বড্ড ভালোবাসি যে তোমায়। বড্ড বেশি। আমরা দুইজনে আচার খাইতেসি আর জমিয়ে গল্প করতেসি। এর মাঝে আকাশ দুইবার দরজার সামনে চরকি কাইটা গেল। আম্মু একটু পরে হেসে বললেন, যা না মা। ছেলেটা এই নিয়ে দুইবার দেখে গেল।
– না, আম্মু ওর শাস্তি চলছে। ছয় বছরের শাস্তি। আজকে আমি তোমার কাছেই ঘুমাবো। আব্বুকে বলো ওর কাছে যেতে।
আম্মু আমার কোনো কথা শুনলেন না। জোর কইরা আমাকে পাঠাই দিলেন। আমি মুখ কালো করে রুমে ডুকে দেখি ও রুমে নাই। কই গেসে কে জানে। মধ্যরাতের দিকে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। সেই রকমের বৃষ্টি হইতেসে। সাথে বিদ্যুৎ চমকাইতেসে। আমি জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াই বৃষ্টি দেখতেসি। বৃষ্টি হালকা ছিটা গায়ে পড়তেসে। এটা আমার ভালো লাগে। এমন সময় আকাশ এসে পাশে দাঁড়াইলো। আমি বাইরে তাকাই আছি। সে কইল, জানালা বন্ধ করে দাও।
– কেন?
– বিদ্যুত চমকাচ্ছে তো।
আমি ভ্রূ কুঁচকায় কইলাম, ভয় করছে নাকি তোমার? সে বিদ্রুপ করে বলল, আমি আবার ভয় পাই নাকি? তবে আমার আদরের বউটা যদি ভয় পায়। তাই……
– ঢঙ।
হঠাৎ খুব জোরে ঠাডা পড়ল। আমি চমকায় উঠলাম। আকাশ মনে করছিল ওরে জড়াই ধরমু। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে। যখনই এমন বিদ্যুত চমকাইতো আম্মা আব্বার মাঝে শুয়ে চোখ বন্ধ কইরা শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। তাই চোখ বন্ধ কইরা রইলাম। তাকাতেই দেখলাম সে মুখ কালো কইরা আমার দিকে তাকাই আছে। আমি জিগাইলাম, কি হইসে? ও একইভাবে বলল, তুমি সত্যিই ভয় পাও না। আমি আবার বাইরে তাকাই বললাম, না। বেচারা মনে হয় দুঃখ পাইল। তারপর হঠাৎ আমার সামনে বসে আমার পায়ের পাতা ওর নিজের পায়ের উপর রাখল। তারপর একজোড়া নুপুর পরিয়ে দিল। আমি চিনতে পারলাম নুপুর জোড়া। এই নুপুর জোড়া ও আমাকে ছয় বছর আগে বার্থডে গিফট হিসেবে দিয়েছিল।
আমি পা নামিয়ে বললাম, জানালাটা মেরে দাও। আমি যাই। ও খুশিতে গদগদ হয়ে জানালা মেরে দিল। কারেন্ট নাই। ঝড় শুরুর একটু আগেই চইলা গেসে। রুমের দরজাও বন্ধ। পুরা রুম অন্ধকার। বাইরে থেকে যা আলো আসতেসে ওটাতেই সব আবছা দেখা যাইতেসে। আমি মোবাইলটা মাত্র হাতে নিসি লাইট জ্বালানোর জন্য, আকাশ আমাকে পিছন থেকে জড়াই ধরল। আমি কাঁইপা উঠলাম। আমি কইলাম, ছাড়ো বলতেসি। নইলে কামড়াই দিমু। সে আমাকে আরো চাইপা ধইরা কইল, দাও, সমস্যা নাই। কিন্তু আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। কি রোমান্টিক একটা ওয়েদার।
– তোমার রোমান্টিকের খ্যাঁতা পুড়ি। তোমার রোমান্সের জ্বালায় ছয়টা বছর একটু শান্তি পাই নাই।
– সে তুমি যাই বলো। আজকে নো ছাড়া ছাড়ি।
ও আমার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, এখন থেকে তুমি এই নুপুর জোড়া পরে থাকবে। আমি সব সময় তোমার উপস্থিতি টের পেতে চাই, ছোঁয়া। ভালোবাসি ছোঁয়া। আমার থেকেও বেশি। একবার বলো না ভালোবাসি। আমার সুড়সুড়ি লাগতেসে। আমি না নিজেকে ছাড়তে পারতেসি না সে ছাড়তেসে। আমারে আষ্টেপৃষ্টে জড়াই ধরসে। দাঁড়াও, এত ভালোবাসার পরেও তোমার মাফ নাই। ছয় বছরের হিসাব যদি সব সুদে আসলে মিটাই না নিসি তবে আমিও চেরির বউ না। অজান্তে আমার মুখ থেকেই বাইর হয়ে এল, ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি…
.
.
.
.
সাত বছর পর……
পাঁচ বছরের পর্ষী আমাদের রুমে দৌঁড়াই এসে বলল, আম্মু জানো।
– কি?
– পাশের বাসায় না নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে।
আমি নিজের রুমে কাপড় গোছাইতেছিলাম। কাজের সময় এত বকর বকর ভালো লাগে না। কিন্তু কি করা। একটামাত্র আদরের মাইয়া। আমি কইলাম, পুরান ভারাটিয়া গেলে তো নতুন ভারাটিয়া আসবে।
– জানো ওখানে একটা ছেলে আছে।
আমি ভ্রূ কুঁচকায় কইলাম, তো কি হইসে?
– কি কিউট!!!!! মুখগুলা লাল লাল।
আমি ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলাম। রাগার ভান কইরা কইলাম, খবরদার, একদম ওর সাথে মিশবা না। ওর কাছে যাবা। মেয়ে আমার মন খারাপ কইরা চইলা গেল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মেয়ে দেখি আমার পথে হাঁটা ধরতেসে। আমি ওর বাপরে ভালোবাইসা পুরা জীবন বহুত জ্বলসি। এখনো জ্বালায়। আমার মাইয়ারে আর জ্বলতে দিমু না। আমি কাপড় চোপড় গুছাই আলমারিতে রাইখা বারান্দায় আইসা দাঁড়াইলাম। যদিও জ্বালায় অনেক তবুও ভালোবাসার মানুষটারে তো কাছে পাইসি। এটাই বা কম কিসের। সবার কপালে তো তাও জোটে না।
এমন সময় আকাশ আসল। সে দেখল আমি গলার চেইনে ঝুলানো ওর বোতামটা ধরে বারান্দায় দাঁড়াই আছি। ও পাশে দাঁড়াই বলল, কি ভাবছো?
– পুরান কথা মনে পড়ছে।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কইল, আমারও মনে পড়ছে। ঐ সময় এই বোতামটাকে যত আদর করেছো এই সাত বছরে মনে হয় আমারেও তত আদর করো নাই।
আমি ভেংচি কেটে কইলাম, এ্যাঁহ্, ভালোবাসা উপচাই পড়তেসে। বেশি করলে একেবারে উগান্ডায় পাঠাই দিমু। সে হঠাৎ আমারে পেছন থেকে জড়াই ধরে বলল, ওলে আমার দুষ্টু বউটা লে।
– আরে কি করছো, ছাড়ো, পর্ষী চলে আসবে।
হঠাৎ সামনে তাকাই দেখি পর্ষী বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকাই আছে। আমি আকাশকে ঠেইলা সরাই দিলাম। মেয়ে দৌঁড়ে চইলা গেল। আমি আকাশের দিকে রাইগা তাকাইলাম। সে আমার দিকে একটা বোকা হাসি দিল। কিন্তু মেয়ে ছুটে কোনদিকে গেল? গিয়া দেখলাম ও ছাদে গেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে দেখতেসি মেয়ে প্রত্যেক শুক্রবার ছাদে যাওয়ার জন্য বায়না করে। আমি মানা কইরা দেই। এত ছোট মেয়ে একলা ছাদে যাওয়া বিপদ। আমি সারাদিন কাজ করি। ঘর গুছাইতে গুছাইতে দিন চলে যায়, তাই সময় পাই না। আকাশও সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্ত থাকে। আজকে মেয়ে নিজে নিজে চইলা গেল। আমরাও পিছু পিছু গিয়া ছাদে উপস্থিত। গিয়া দুইজনে বেকুবের মতে দাঁড়াই আছি। পর্ষী ওর থেকে বড়ো একটা পিচ্চি পোলারে পেছন থেকে শক্ত করে জড়াই ধরে আছে। ছেলেটা নিজেকে ছাড়াইতে পারতেসে না। আমি ডাক দিলাম, পর্ষী। আমার ডাকে ওকে ছাইড়া দিল পর্ষী। ছেলে দৌঁড়ে মায়ের কাছে চইলা গেল। ছেলের মা আরেকজনের সাথে গল্প করতেসে। এত খেয়াল নাই। আমি পর্ষীর কাছে গিয়া হাঁটু গেড়ে কইলাম, তুমি ওকে জড়াই ধরসো কেন?
– আব্বুও তো তোমাকে জড়াই ধরসে।
আমি পেছন ফিরে রাগী চোখে আকাশের দিকে তাকাইলাম। আকাশ দাঁত কেলাই হাসতেসে। আমি আবার পর্ষীর দিকে তাকাই বললাম, তোমার আব্বু আর ঐ ছেলে কি এক?
– হুম। আব্বু তোমাকে ভালোবাসে আর আমি ঐ ছেলেকে ভালোবাসি।
উত্তর শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খাইলাম। আকাশ উদাস উদাস ভাব কইরা বলল, তোমার মেয়ে বলে কথা। আমি মুখ বাঁকা করে বললাম, শুধু আমার না। আমাদের দুইজনেরই মেয়ে। মনে মনে কইলাম, তবে আমাদের আপগ্রেডেট ভার্সান।
সমাপ্তি ♥