আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_১৪,১৫
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_১৪
– কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!
আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। এখনো রক্ত জমাট বাঁধা দাগটা আছে। কামড়ের দাগটা রয়ে যাবে বোধহয়। জামাইরে কি কমু!!! আমার ভবিষ্যত সংসারে এখন থেইকাই আগুন লাগাইয়া দিল। ধুর! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ কইরা দিল। স্ক্রিনের আলো জ্বালাই মেজাজ আরো খারাপ হইল। মাত্র ছয়টা দুই। এত সকালে আরামের ঘুমটা মাটি কইরা দিল। ইচ্ছে করতেসে নিজের চুলগুলো একটা একটা কইরা ছিঁড়ি। না থাক। বহুত ব্যাথা পামু। তাছাড়া বিয়ের পর জামাই বলবো, বেল বৌ, আমার কাছে আসো, তোমার ফুটবল মাঠে একটু ঢুগঢুগি বাজাই। ভাইবা নিজেই ঢোক গিললাম। বেল বৌ হওয়ার শখ নাই। নাহ, মাথা ঠান্ডা করা লাগবো। ফোনটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চইলা আসলাম। মুখে ব্রাশ পুইরা দিয়া ইচ্ছা মতো ঘষতেসি আর রাগগুলো বেচারা ব্রাশের উপর ঝাড়তেসি। মুখ ধোয়া শেষে আয়নায় নিজের দাঁত দেইখা সেই লেভেলের সন্তুষ্ট হই গেলাম। একেবারে হীরার মতো জ্বলতেসে। বেঁচলে বড়লোক হই যামু একদিনে। আমি কল্পনা করলাম, আমার দাঁতগুলা হীরার দামে বেঁচতেসি। আমি দাঁতবিহীন মাড়ি বের কইরা হাইসা হাইসা বলতেসি, হীলাল ডাড লয়ে যান। দাঁতবিহীন আমারে কেমন লাগবো। নিজের অবস্থা ভাইবা নিজেই শিউরে উঠলাম। আল্লাহ গো!!! কি সব ভাবতেসি! ব্রাশের দিকে তাকাই দেখলাম বেচারার অবস্থা করুন। মান ইজ্জত কিচ্ছু রাখি নাই। কালকে মাত্র নতুন বাইর করসি৷ এখন মনে হইতেসে আজকে আরেকটা নামাইতে হবে।
আমি ফ্রেশ হইয়া বাইর হইতেই ম্যাসেজের শব্দ। ফোন খুইলা দেখি ত্রিশটা ম্যাসেজ। বাপ রে…। সিমওয়ালারাও তো এতো ম্যাসেজ দেয় না। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কে এত ম্যাসেজ দিসে। চেনা চেনা লাগতেসে। ম্যাসেজ পইড়া মেজাজ আবার বিগড়াইলো। ব্যাটার সমস্যা কি? কামড়ে আমার ঘাড়ের মাংস তুইলা নিয়া গেসে এখন ম্যাসেজ কইরা কইরা আমার মাথা খাই ফেলতেসে। সে ম্যাসেজ দিসে, জলদি নাস্তা করে নাও। আজকে না টি.সি. আনতে যাবে? সুন্দর করে শালীন হয়ে যাবে। মনে থাকবে? না হলে…
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার।
এই শালা কেমনে জানলো এতকিছু! হায়রে!!! ক্রাশের চিন্তায় আমি বেঁহুশ আসিলাম। এখন দেখি ভ্যাম্পায়ারের চিন্তায় আমি অজ্ঞান হমু। ওয়েট, বেহুঁশ আর অজ্ঞান তো একই জিনিস। ধুর ভাল্লাগে না। কি মুসিবত! সব কেমন হেডফোনের মতো জট পাকাই যাইতেসে। ক্রাশের কারনে এতদিন আধাপাগল আসিলাম। এখন মনে হয় পুরা পাগল হয়ে পাবনা যাওয়ার সময় হইসে।
আমি সাড়ে ছয়টার দিকে মুনতাহাকে ঠেইলা উঠাইলাম। বেচারি ঘুমে ঢুলতেসে। সেভাবেই অত্যাচারীদের মতো ওরে ওয়াশরুমে ঢুকাই দরজা মাইরা দিলাম। আমি ওর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতেসি। মেয়ে তো বেরই হয় না। ব্যাপার কি!!!! বিশ মিনিট হইয়া গেল। বাথরুম করতে গিয়া ঘুমাই পড়ল নাকি!!!! আমি আস্তে কইরা দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। কেউ নাই! দরজাও আটকায় নাই। অদৃশ্য হইয়া গেল নাকি! জোরে দরজা খুলতেই ধুপ কইরা কিছু পড়ার শব্দ। সাথে সাথে, ওরে বাবা গো, কোমরটা গেল মনে হয়… মুনতাহা ফ্লোরে বইসা বইসা ষাঁড়ের মতো চেঁচাইতেসে। আমি তাড়াতাড়ি আইসা কইলাম, তুই কোথা থেকে আসলি!
– আমি কি উবে গেসিলাম নাকি! এখানেই তো ছিলাম। উরে……
– এখানে কই ছিলি? দেখলাম না যে।
– দরজার পেছনে।
– ওখানে কি করতেছিলি?
– হেলান দিয়ে ঘুম তাড়াইতে ছিলাম। কিন্তু কখন ঘুমাই গেসি টের পাই নাই।
আমি হাসমু না কাঁদমু বুঝতে পারতেসি না। মুনতাহা বলল, এমন হ্যাবলার মতো দাঁড়াই থাকবি না তুলবি? আমি ওকে টাইনা তুলতে ও বলল, আজকে মাজাটা মনে হয় গেল। তোর সঙ্গে আর যাওয়া হবে না। তুই আব্বুর সাথে যাস। ওরে বাবা। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হইয়া আসলাম। ও দরজা মাইরা দিল। এই মেয়ে সামনে আমারে কি পরিমান জ্বালাইবো কে জানে! কেউ নাকি ঘোড়ার মতো দাঁড়াই দাঁড়াই ঘুমায়। তাও আবার ওয়াশরুমে! এতদিন আমি সবাইরে জ্বালাইসি এখন এ আমারে জ্বালাইবো। নাহ্, এটা তো হইতে দেওয়া যাবে না। দাঁড়া তোরে আমি টাইনা সোজা করমু। না হইলে আমার নামও গাজরের হালুয়া না। এ্যাঁ…!!!!
.
.
.
.
আমি বের হইয়া দেখলাম সবাই মোটামুটি টেবিলে উপস্থিত। শুধু আমরাই বাকি ছিলাম। আমি বইসা পড়লাম টেবিলে। মিষ্টি খালা আমাকে নাস্তা দিয়ে বলল, মুন কই?
– আসতেসে।
আমি মাত্র মুখে খাবার দিমু তখন মুনতাহা বুইড়া মানুষের মতো কোমরে হাত দিয়া আইসা চেয়ার টেনে বসল। সানজিদা আপু জিগাইল, কি হইসে তোর আবার? আমি রুটি আলুর ঝোলে চুবাইতে চুবাইতে কইলাম, ওয়াশরুমে ঘুমাইতে গিয়া পইড়া গেসে।
– ছোঁয়া……
– এসব কি মুন?
– আরে আব্বু, ও দুষ্টুমি করছে।
ও আমারে গলায় চাকু চালানোর ভঙ্গি করে বুঝাইল, কিল ইউ। আমিও ভেংচি কাইটা কইলাম, বিলাই ইউ। আমাদের কান্ড দেখে মিষ্টি খালা বলল, আসতে না আসতে চুলাচুলি শুরু করবি নাকি? মুন, আজকে স্কুলে যাবি না? ও কোমরে হাত দিয়ে বলল, আম্মু, সেই লেভেলের ব্যাথা পাইসি। আজকে না যাই?
– খালি ফাঁকির বাহানা। ছোঁয়া মা, আজকে তোমার খালুর তোমার সাথে স্কুলে যাবে। টি সি আনতে।
– আচ্ছা।……আমাদের বাসাটা কি করবে কিছু ভেবেছ?
– না। এই ব্যাপারে তুই যা বলবি তাই। আমরা তোর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না।
– বেঁচে দাও।
সবাই আমার দিকে তাকাইলো। আমি কইলাম, কি হইসে? সবাই এভাবে তাকাই আছো কেন? মিষ্টি খালা বলল, সত্যিই বেঁচে দেবো? আমি রুটির টুকরা মুখে পুরে দিয়া বললাম, আমি কি এমনি এমনি বলসি নাকি? আমি জানি তোমরা এতো বড়লোক নও যে এই পরিবার চালানোর সাথে ঐ বাসাটাও চালাইতে পারবা। দরকার কি বোঝা বাড়িয়ে? ঐ বাসাটা বিক্রি করে যা টাকা হবে সেগুলো আমার জন্য খরচ করবা। তাহলে তোমাদের উপর আমার জন্য আসা চাপটা কমবে। আমি তোমাদের উপর বোঝা হতে চাই না। আমি শেষ টুকরা মুখে পুইরা দিয়া উইঠা গেলাম। সবাই চুপচাপ খাইয়া উঠল। আমি রুমে এসে দরজাটা মাইরা পিঠ ঠেকে দাঁড়াইলাম। কিছু পানি নাকের ডগায় জমলো। আমি সামনে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকাই বললাম, সরি আব্বু আম্মু।
সাতটার মধ্যে রেডি হইয়া বের হইলাম। দরজা খুললে আগে চেরি ফলের বাসার দরজা দেখতাম। এখন একটা ফাঁকা উঠান নজরে পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি ক্যাডস পইরা বাইর হই গেলাম। এখান থেকে স্কুল যাইতে একঘন্টা লাগবে। আজকে শেষ। লেট কইরাই গেলাম। কি আর হইবো? বাসা থেকে বাইর হয়ে একটা অটোতে উইঠা গেলাম। খালু ছুটির পর আসবে। আমার সাথেই আসতে চাইছিল। আমিই বলসি আজকে সব ক্লাস করব। শেষদিন বলে কথা। স্যার ম্যাডামদের একটু প্যারা দিয়া আসি। তাই খালু বলেছে ক্লাস শেষ হলে আসবে।
আমি একঘন্টা পরে আইসা পৌঁছাইলাম। দারোয়ান চাচা গেটে আটকাইলো। আমি একটা মলিন হাসি দিলাম। চাচা কইল, এত লেটে ক্যান আসলা?
– আজকে ঢুকতে দেন, চাচা।
– উঁহু।
– এই শেষবার চাচা, আর জ্বালাবো না।
– এই কথা আগেও বলসিলা।
– আগে তো মজা করে বলসি। আজকের পর থেকে আর জ্বালাবো না, চাচা। সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি চাচা। আমি চলে যাবো।
– কই যাবা?
– এখান থেকে দূরে চাচা। আজকে শেষবার দেখতে আসছি। টিসি নিয়ে চলে যাবো চাচা। আর প্যারা দিবো না।
চাচা কিছু বললেন না। মুখ কালো করে সইরা গেলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। চাচাকে কত প্যারা দিসি। একবার আম চুরি করতে আসছিলাম স্কুলে। চাচার হাতে ধরা খাইয়া সে কি দৌঁড়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে গেলাম। সব স্মৃতি গুলা চোখে ভাসতেসে। কেউ নাই মাঠে। সবাই ক্লাসে। আমি মাঠের মাঝে গিয়া দাঁড়াইলাম। চারদিকে একবার চোখ বুলাইলাম। এতদিন বুঝতে পারি নাই ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কাকে বলে। আগে আমার জগত জুড়ে কত মানুষ ছিল আর পুরো পৃথিবীতে আজ অসহায় একা আমি।
আমি ধীরে ধীরে আমাদের ভবনে ঢুকলাম। সিঁড়ির রেলিং ছুঁয়ে উঠতে লাগলাম। দেয়ালগুলো আজ আমার দিকে তাকিয়ে হাহাকার করতেসে। জীবনের একটা ঝড় সবকিছুকে আমার থেকে এক ধাক্কায় সরাইয়া নিয়া গেল। আমি রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ঘন্টা মিস করসি। দ্বিতীয় ঘন্টার স্যার এখনো আসে নাই। কেউ কেউ বারান্দায় দাঁড়াই আছে। রিদিকেও দেখলাম। আমাকে দেইখা ও দৌঁড়ে এসে জড়াই ধরল। আমি দাঁড়াই রইলাম। ও মুখে হাসি টেনে বলল, এত দিন পর আসলি। তোকে কত মিস করসি। সেই যে দেখসি তোকে তারপর আর দেখতে পারি নাই। জানিস আজকে রেজাল্ট দিবে। একটু পরে। আমি ওর দিকে নির্জীব বস্তুর মতো তাকাই আছি। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর এখান থেকে নতুন এক জায়গায় চলে যাবো।
ও আমাকে রুমে নিয়া গেল। আমি বেঞ্চে বসতেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। সবার শুধু আমার জন্য সমবেদনার বন্যা। আমার মোটেও ভালো লাগল না। স্যার চলে এলেন একটু পরে। আমি হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। স্যারের হাতে মার্ক শিট। সবার মাঝে উত্তেজনা ছড়াই পড়ল। আমি শান্ত হইয়া বইসা আছি। স্যার কিছু কথা বইলা রেজাল্ট কার্ড দেওয়া শুরু করলেন। আমার রোল ৮ ছিল। রেজাল্ট কার্ড পাওয়ার পর রিদি বলল, তুই কত হইছিস? দেখি। আমি ওকে রেজাল্ট কার্ডটা দিয়া দিলাম। এটা দিয়া আমি আর কি করমু? ও দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, তুই প্রথম হয়েছিস!!!!! আমি মনে মনে কইলাম, ক্রেডিট আমার না। চেরি ফলের ছিল। রিদি আমার রেজাল্ট কার্ড নিয়া লাফালাফি করতেসে। আমার এটা নিয়া কোনো মাথাব্যাথা নাই। স্যারের ক্লাস শেষে টিফিন টাইম শুরু হতেই আমি নিচে চইলা আসলাম। গিয়া বসলাম দোলনায়। এই দোলনায় কত স্মৃতি জড়াই আছে। আমি দুলতেসি আর স্মৃতিগুলা হাতড়ে বেড়াইতেসি। রিদি এসে বলল, কি হইসে তোর?
– আমি চলে যাবো রিদু।
– কোথায়?
– আজকে টিসি নিতে আসছি।…… চিন্তা করিস না তোর সাথে যোগাযোগ থাকবে।
ওর মুখের দিকে তাকানোর সাহস করলাম না। উইঠা চইলা আসলাম। কখন আবার বাচ্চাদের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কইরা কাইদা দেয়। মেয়েটারে বড্ড আপন লাগে। বেস্টু বলে কথা।
.
.
.
.
টিসি নিয়া বাসায় আসলাম দেড়টার সময়। সোজা ওয়াশরুম। গোসল কইরা বাইর হতেই মুন আমারে রুবিকস কিউব সাইজের একটা মোটা খাতা দিয়া কইল, এটা তোর।
– কি এটা!?
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১৫
#সাহেদা_আক্তার
গোসল কইরা বাইর হতেই মুন আমারে রুবিকস কিউব সাইজের একটা মোটা খাতা দিয়া কইল, এটা তোর।
– কি এটা!?
– ক্লাস রুম ডিটেইলস। শুধু মাত্র তোর জন্য। স্পেশাল। সারাদিন খাইটা তোর জন্য বানাইসি।
আমি টাওয়াল মেইলা দিয়া খুললাম ছোট্ট খাতাটা। বাপরে! এতো মনে হয় সব টিচার আর স্টুডেন্টদের বায়োডাটা। আমি ওরে জিগাইলাম, তুই এত নাড়ি নক্ষত্র জানলি কেমনে?
– আমি মুন, ওকে? পৃথিবীর উপর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করি। বুঝতে হবে।
আমি হাইসা প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাইলাম। হেডিং রোল ১। নাম রোহান। ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত আর আঁতেল পোলা। চোখের চশমা দিয়া অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো সবাইকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। ওরে খাতায় নাম লেখতে দিলে ক্লাসে চলে পিতপতন নীরবতা। তুমি কোন চিপায় মুখ নাড়াইসো কি নাড়াও নাই নামটা খাতায় সিল হইয়া গেছে। তারপর স্যারের হাতে নাম গেলে সেই লেভেলের পিডানি। পড়ার ব্যাপারে বক্তৃতা দিতে তার ক্লান্তি নাই। ঝামেলায় জড়ানো তার কাছে যুদ্ধের সমান। স্যারদের প্রিয় পাত্র। কারো প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নাই একমাত্র বই ছাড়া। আমি মুনরে কইলাম, বাপরে! তোদের রোহান তো সেই লেভেলের পড়ুয়া ছেলে মনে হচ্ছে।
– হুম।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা। রোল ২। নাম রাতুল। ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট পোলা আর ফাজিলের হাড্ডি। খেলাধুলায় সেই। অনেকের ক্রাশ। আমাদের স্কুলের হেডমাষ্টারের ছেলে। অতএব দূরত্ব বজায় রাখা অতীব জরুরি। ঝগড়ায় সেই লেভেলের পটু। তার থেকে দশ হাত দূরে থাকাটাও রেড জোন। তার সুনজরে যে একবার পড়সে সেই দিন আর রক্ষে নাই। আমি খাতাটা বিছানায় রাইখা ওর পাশে শুয়ে কইলাম, তোর স্কুল তো খুব ইন্টারেস্টিং।
– কচু। গেলে বুঝবা। ঠেলার নাম বাবাজি।
আমি খাতাটা শুয়ে শুয়ে উল্টাইতেসি। মুন বলল, শুন, আজকে থেকে তোর ট্রেনিং শুরু।
– কিসের?
– তোর কাকের গলার। বাপরে কি সুর এই কন্ঠে! আমার দুলাভাইয়ের অবস্থা তো টাইট।
– আরে শোন না। আমি তো ঠিক করেই রাখসি আমার জামাই রে বাসর রাতে ডি জে শুনামু।
– তাইলেই সারছে। আম্মার অর্ডার। আজকে স্যার আসলে তোকে নিয়ে যেতে।
আমি কিছু বলার আগেই খাওয়ার ডাক পড়ল। আমরা খেতে চলে গেলাম। মিষ্টি খালাও আমাকে গান শেখার কথা কইলো। কি জ্বালা!
বিকালে স্যার আসলেন। আমারে টাইনা নিয়া গেল মুন। স্যাররে কইল, স্যার আজকে থেকে ও আমার সাথে গান শিখবে। স্যার দেখতে তো বেশ আলাভোলা মনে হইল। ভালো মানুষের মতো হেসে কইল, ও…… ভালো। তাহলে প্রথমে রেওয়াজ দিয়ে শুরু করি। কি বলো? গানে প্রথমে স্বরলিপি জানতে হয়। যেমন: সা…… বলো।
– সা…
– আরেকটু জোরে।
– সা……
– আরেকটু।
– (চিল্লাইয়া) সা………………
আমার সা এর ঠেলায় পুরা ঘর কাঁইপা উঠল। স্যারও বেতের টুল থেকে পইড়া যাইতে লাগলেন। মিষ্টি খালা আর সানজিদা আপু দরজা দিয়া উঁকি মাইরা দেখতে আসলো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। মুন আমার পাশে বইসা মুখ চাইপা হাসতেসে। স্যার কোনোমতে টাল সামলাইয়া কইলেন, ইয়ে মানে… ভালো। তবে সকাল বিকাল প্র্যাক্টিস করতে হবে। আমি মনে মনে কইলাম, আমার কাউয়ার গলা সকাল বিকাল শুনলে আশপাশের বাড়ি ফাঁকা হই যাইবো।
সন্ধ্যায় চা নাস্তা কইরা পড়তে বসলাম। সবাই গল্প করতেসে। আমি রুমে এসে আমার টেবিলে বসলাম। আজকে খালু কিছু টুকটাক নিয়া আসছে বাসা থেকে। মনে হয় খদ্দের পাই গেসে বাসাটা বেঁচার জন্য। আমি একবার আব্বা আম্মার ছবির দিকে তাকাইলাম। তারপর ক্রাশের বোতামটা হাতের মুঠোয় নিলাম। এখনো ওটা গলায় আছে। কেন যেন ভুলতে পারতেসি না। দুইটা মাসে আমারে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচাই ফেলসে। ওর বোকা বোকা চেহারাটা ভাবতে আমার বেশ লাগে। প্রথম দিন আমার I love you শুইনা যেভাবে বেকুবের মতো তাকাইছিল! মনে পড়তেই আমি মুচকি হাসতে লাগলাম। পেছন থেকে মুন কইল, প্রেম করতেছিস নাকি! এমন মুচকি হাসতেছিস? আমি খেয়াল করি নাই ও কখন রুমে আসছে। আমি কইলাম, খালি প্রেম করলে মানুষ হাসে? মাত্র বয়স চৌদ্দ। এখনো আমার প্রেম করবার বয়স হয় নাই। মুন আমার দিকে অবাক হইবার ইমোজির মতো তাকাই কইল, পুরা বিশ্বে এই বয়সের মাইয়ারা বি এফ নিয়া ঘুরে আর তোর এখনো প্রেম করবার বয়স হয় নাই!? আমি ভ্রূ কুঁচকে কইলাম, তুইও করিস নাকি! সে বিজ্ঞের মতো কইল, আমার সাথে যে প্রেম করবে সে এখনো ইহলোকে আসে নাই। প্রেম করার জন্য পটানো লাগে। আমারে পটানো আর দেয়ালে মাথা ফাটানো একই কথা।
– এ্যাঁহ্, ঢঙ। আয়, পড়বি। বড্ড বেশি ফাঁকিবাজ হই গেছিস।
আমি ওরে কোনোমতে কাটাইলাম। কিন্তু ক্রাশের ছবি কিছুতেই মন থেইকা মুছতে পারলাম না। রাতে শুইয়া শুইয়া যখন ক্রাশের কথা চিন্তা করতেসি তখন ফোনে ম্যাসেজ আসলো। আমি দেইখা চোখ মুখ বোঁচা করলাম। এ কে ভাই! আমার পিছু ছাড়ে না ক্যান! আমি নাম্বারটা সেভ করসি ‘ব্যাটা বাটপার’। বেশি সম্মান দিয়া ফেললাম নাকি! যাগ্গে, সে ম্যাসেজ দিসে, ঘুমাই পড়ো। কাল থেকে নতুন স্কুল শুরু। শোনো, কোনো ছেলের দিকে তাকাবে না, কথা বলবে না, মিশবে না। না হলে আসলে তোমাকে বিয়ের পর কি করবো সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবা না। শেষ লাইনটা পইড়া আমার কাশি উইঠা গেল। আমি একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে আবার ফোনটা হাতে নিলাম। আমি গাঞ্জা খাইসি নাকি! ভুলভাল দেখতেসি। একি!!! ঠিকই তো দেখলাম। হায় আল্লাহ!!! ক্রাশ গো, আমারে বাঁচাও। এ কোন ভ্যাম্পায়ারের পাল্লায় পড়লাম!!! মনে হইতেসে আমার সব রক্ত শুইষা কাগজ বানাইয়া তারপর ছাড়বো। দাঁড়া তোরে আমি ব্লক কইরা ছাড়মু। আমি ব্লকের অপশান খুঁইজা নাম্বারটা ব্লক কইরা দিলাম। সাথে সাথে আমার মনটা মুরগীর পালকের মতো হালকা হই গেল। আমি বাতাসে উইড়া গিয়া বিছানায় পড়লাম। তারপরই ঘুম।
সকালে আবার রিংটোন। এবার আমি ফোনটারে আছাড় মারমু। কালকেও সকাল সকাল ঘুম ভাঙাইছে। আজকেও। আমি চোখ কঁচলে ভালো করে দেখলাম। আননোন নাম্বার। ধুর ছাতা। এত আননোন নাম্বার থেইকা ফোন আসে ক্যান! আমি কি কথার দোকান খুলসি নাকি? কালকে ঐ ভ্যাম্পায়াররে ব্লক দিলাম। আজকে আবার কেডা! আবার বাজতেছে। আমি রিসিভ করতেই বেকুব হই গেলাম। তারপর ঢোক গিললাম।
– এখনো ঘুমাচ্ছিলে? কটা বাজে খেয়াল আছে? সেই কখন থেকে ফোন করছি। ধরোনি কেন? ভেবেছ ব্লক করেই আমার থেকে মুক্তি পাবে? পারবে না। অলরেডি বিশটা সিম কিনে রেখেছি তোমার জন্য। কয়টাতে ব্লক করবে? তোমাকে আমি সারাজীবনের মতো আমার জন্য সিল মেরে দিয়েছি। তুমি আর কারো না। সকাল বিকাল আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেবো। আর এমন করলে দেখো কি করি। You will be mine. এখন তাড়াতাড়ি রেডি হও।
ফোনটা কাইটা দিল। আমি মাছের মতো খাবি খাইতেসি আর ফোনটা কানে নিয়া বইসা আছি। আল্লাহ, দড়ি ফালাও আমি উইঠা যাই। আজকেও মনে হয় আরেকটা ব্রাশ নামানো লাগবো।
.
.
.
.
রেডি হয়ে বের হতেই দুইটা সাইকেল চোখে পড়ল উঠানে। একটা পুরানো আরেকটা নতুন। মুনতাহা পুরানোটায় উইঠা বলল, আজকে আমার সাথে যাবি। কাল থেকে নিজে সাইকেল চালাই যাবি।
– আমি পারি নাকি!
– শিখে নিবি। সেই জন্যই আনাইসি। এখন ওঠ দেরি হই যাইতেসে।
ও আমারে সাইকেলের ব্যাক সিটে নিয়া রওনা দিল। আটটা বাজার পনের মিনিট আগে পৌঁছাইলাম। এখানে ক্লাস সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। মুন বলল, তিন তলার মাঝের রুমটা আমাদের ক্লাস। তুই যা আমি আসতেছি। ও সাইকেল পার্ক করতে চইলা গেল। আমি হাঁটা দিলাম। স্কুলটা আমার আগেরটা থেকে ছোট। একটা মাঠের দুইপাশে দুইটা বিল্ডিং। শুনসি একটাতে ফোর থেকে সেভেনের ক্লাস হয়। আর আরেকটাতে এইট থেকে টেন। ক্লাস সিক্স থেকে টেন অবধি দুইটা কইরা সেকশান। খালু নাকি আমাদের একসাথে রাখার জন্য সেকশান এ তে ভর্তি করাইসে। আমি তিনতলায় উঠে মাঝের রুমটাতে ঢুকলাম। গিয়া বসলাম ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম সিটে। সাথে সাথে সবাই আমার দিকে এমন কইরা তাকাইলো যেন মুরগী হইয়া শিয়ালের খাঁচায় ঢুকসি। আমার অস্বস্তি লাগতেসে। মুনটা কেন যে আসতেসে না। হঠাৎ একটা ছেলে রুমে ঢুকে আমার দিকে নাক মুখ কুঁচকে কইল, তুমি এখানে বসছো কেন? আমি কইলাম, কেন কি হইসে?
– এটা আমার সিট।
– নামটা তো দেখি নাই। দেখলে বসতাম না।
– এখন সরো। আমি এখানে বসবো।
– কেন? তুমি তো পরে এসেছো তাহলে এখানে বসবে কেন?
– কারন এটা আমার সিট। নতুন নতুনের মতো থাকো। ঝামেলা করো না। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো। তুমি জানো না আমি কে।
মুন এসে বলল, রাতুল ও বুঝতে পারে নাই। ছোঁয়া ঐ বেঞ্চে চল। আমি মুখে চিনা হাসি দিয়া কইলাম, ও, তুমি রাতুল! তোমার থেকে এটা আশা করি নাই। রাতুল বলল, কেন? আমি উদাস মুখ করে বললাম, আমি শুনছিলাম, তুমি নাকি অনেক দয়ালু। কারো সাথে ঝামেলা করো না। আমি মনে হয় ভুল শুনেছিলাম। মুন চাপা গলায় বলল, ছোঁয়া কি করছিস! রাতুল এদিক ওদিক তাকাল। সবাই আমাদের দিকে তাকাই আছে। হঠাৎ সে কিছু না বলে সুড়সুড় করে ব্যাগ নিয়ে অন্য বেঞ্চে চলে গেল। মুন অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল, এটা তুই কি করলি? আমি শয়তানি হাসি দিয়ে, ঠান্ডা বোমা মারলাম। তুই বুঝবি না। বস সিটে। ও আমার পাশে ব্যাগটা রাখল। একটু পরেই স্যার চইলা আসল। স্যার আমাকে পরিচয় করাই দিলেন। আজ থেকে আমার রোল ৪৩। আজকে প্রথমেই পাইলাম বিজ্ঞান ক্লাস। আমি কালকে অধ্যায়টা পড়ছি। তাই আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। আমি মনোযোগ দিয়ে দুইটা ক্লাস করলাম। আমার মনে হল রাতুল আমার দিকে তাকাই থাকে। ও আমার পাশের সারিতে দুই বেঞ্চ পরে বসছে। আমি পেছনে ফিরতেই দেখি ও স্যারের দিকে তাকাই আছে। কিন্তু কেন যেন মনে হইতেসে ও এতক্ষণ আমার দিকেই তাকাই ছিল।
দশটায় আধা ঘন্টার টিফিন টাইম। আমি আর মুন নিচে নামতে ছিলাম। তখন হঠাৎ সিঁড়িতে আমারে ধাক্কা মাইরা কইল, একপাশে হাঁটতে পারো না? পুরা পথ মেরে রাখসে। বলেই নিচে নেমে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। এ মনে হয় তার ছেঁড়া। দাঁড়া একবার সুযোগ পাইলে সুধে আসলে সব শোধ করমু।
চলবে…