আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_১২,১৩

আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_১২,১৩
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_১২

কান থেকে ফোন পইড়া ব্যাটারি খুলে ছিটকে পড়ল একজায়গায়। আমি চায়ের মধ্যে বইসা পড়লাম। আন্টি দৌঁড়ে এলেন। রিদিও দৌঁড়ে আইল। জিজ্ঞেস করতেসে কি হইসে। আমি পাথরের মতো বইসা আছি। আমার জগতটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল চোখের সামনে।

এমন সময় কলিং বেল বাজল। রিদি গিয়ে দরজা খুলল। খালু আসছে। আমি তাকাইলাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকাইতে সাহস করতেসে না। আমি আস্তে কইরা উইঠা খালুর কাছে গেলাম। বললাম, আমাকে নিয়ে যাবে? আমি যাবো। চল না খালু। আমাকে নিয়ে চলো। আন্টি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? খালু একটু ইতস্তত করে বললেন, ওর আব্বু আম্মু এক্সিডেন্ট করেছে। ওর আম্মু স্পটডেড। ওর আব্বু আইসিইউতে। যে কোনো মুহূর্তে …… খালুর ফোন এল। কথা বলে আবার সবার দিকে ফিরে বললেন, ওর আব্বুও……

– আমি তৈরী হয়ে নিই, হ্যাঁ? আব্বু আম্মু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি না গেলে আসবে না।

রিদি এসে আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল, ছোঁয়া, তোর আব্বু আম্মু কেউ বেঁচে নেই। একটু কাঁদ। একটু কাঁদ। আমি ওর হাত সরিয়ে বললাম, কে বলেছে আব্বু আম্মু নেই। একটু আগে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। আব্বুটাও দুষ্ট হয়ে গেছে। বলেছে আমার জন্য জিলাপী আনবে। একদম এমন কথা বলবি না। আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।

– ছোঁয়া……

আমি ওর দিকে তাকাতেই ও ভয় পেয়ে সরে গেল। আমার চোখ লাল হয়ে আছে। আমি রুমে চলে এলাম। গোসল করে সুন্দর একটা সাদা জামা পরলাম। মাথাটা বেঁধে বের হয়ে এসে বললাম, চলো খালু। এমনিতে অনেক লেট হয়ে গেছে। আব্বু নিশ্চয়ই আমার উপর অভিমান করে ফেলেছে। আম্মু বকবে। চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি টেনে চললাম খালুকে। উনি আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না, কাঁদতেও পারছেন না। আন্টি খালুর থেকে ঠিকানা নিয়ে নিলেন।
.
.
.
.
আমরা সোয়া দশটায় হাসপাতালে পৌঁছালাম। খালু আমাকে একটা কেবিনের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু, দুলাভাই, মুনতাহা সবাই কাঁদছে। আমি মিষ্টি খালার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে হেসে বললাম, কাঁদছো কেন? আব্বু আম্মু কি তোমাদের বকেছে? মিষ্টি খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। খালা ছেড়ে দিতেই আমি কেবিনে ঢুকলাম। দুইটা বেড। সেখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো মানুষ। একটা আমার আদরের আব্বু আরেকটা আমার দুষ্টু আম্মু। আমি আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, আম্মু, এই আম্মু, উঠো বলছি, না হলে কিন্তু ডিসের লাইন কেটে দিবো। তখন আবার লোক এনে ঠিক করাতে হবে। জানো, আজকে আমার হাত কেটে গেছে, দেখো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুমি মলম লাগিয়ে দেবে না? কি হল উঠো। আব্বু, এই যে, তুমিও উঠছো না? আমি কিন্তু জিলাপির ভাগ দেবো না। বাসায় কিন্তু ফ্রিজে মিষ্টি আছে। আম্মু তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। ওগুলোও দিবো না। ওঠো, ওঠো বলছি। আমি দুই বেডের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। মিষ্টি খালা আমাকে টেনে বের করে আনল। আমি বার বার বলতে লাগলাম, আরে দেখো আব্বু আম্মু উঠবে। আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। খুব দুষ্ট হয়ে গেছে। আরে ছাড়ো আমায়, ছাড়ো। সানজিদা আপু আর মিষ্টি খালা আমাকে ধরে রাখল। আমি খালি বলতে লাগলাম, ছাড়ো আমাকে ছাড়ো। না ছাড়লে কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলে দেবো। তখন ওরা খুব বকুনি দেখে। কি হল ছাড়ো। ওরা আমার কথা শুনল না। ছাড়লো না একটিবারের জন্য।

রাত আটটা। আমি ঝিম ধরে বসে আছি বসার রুমের ফ্লোরে। বিড় বিড় করছি, আমার আব্বু আম্মুকে কোথায় রেখে এলে। নিয়ে এসো। আমার ভালো লাগছে না। আমি বিড়বিড় করেই চলেছি। সবাই বসার রুমে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি খালা মাঝেমধ্যে মুখ চেপে কাঁদছে। খালু আর আঙ্কেল চুপ করে বসে আছেন। আন্টিও কিছু বলছে না। চেরি ফল একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সারাদিনে একফোঁটা কান্না করিনি। সবার চোখে পানি আর আমার চোখে চৈত্রের খরা।

হঠাৎ কেউ বুঝে ওঠার আগেই চেরি ফল সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে এক টানে দাঁড় করালো। তারপরই ঠাস করে সজোরে চড় মারল। সবাই সেই শব্দে চমকে উঠল। আঙ্কেল আন্টি দৌঁড়ে এসে বললেন, এটা তুই কি করলি? আমার মুখে সাথে সাথে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ স্পষ্ট বসে গেল। আমি চেরি ফলের দিকে তাকালাম। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। একবার দুবার তিনবার। গলা ফাঁটিয়ে যতটায় শক্তি ধরল। তারপর ওর বুকে দুই হাত দিয়ে সজোরে মারতে মারতে বললাম, কেনো মারলে আমায়? কেন? কি দোষ আমার? কি দোষ বলো? কি করেছি আমি? যখন তোমাকে আমার জগত বানালাম তখন তোমার জগতে ছিল অন্য কেউ। আমি মেনে নিলাম। সরে এলাম তোমার জীবন থেকে। নিজের জগতটাকে নতুন করে সাজালাম আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমার জগতটাকে মুহূর্তে চুরমার করে দিয়ে পালিয়ে গেছে ওরা। কেন? আমি কেন? আমার সব ভালোবাসাকে কেন কেড়ে নিল এভাবে? কেন আমাকে অসহায় করে দিয়ে সবাইকে চলে যেতে হবে? আমি আর পাগলামি করবো না। বলো আমার আম্মুকে ফিরে আসতে। আমি সবঠিক করে করব। আমি আর আব্বুর লুকিয়ে মিষ্টি খাওয়ার কথা আম্মুকে বলব না। বলো আমার আব্বুকে ফিরে আসতে। কি হল যাও। যাও……

আমি মারতে থাকলাম। ও আমাকে আটকালো না। আমার চোখের পানির বাঁধ ভাঙল। গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর ধারায়। চেরি ফল আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। আজ যে আমার বড়ো আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু কার কাছে যাবো আমি? আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে ও আমাকে ডাকতে লাগল। আমাকে সরিয়ে নিয়ে দেখল আমি জ্ঞান হারিয়েছি।
.
.
.
.
সকালে চোখ মেলে তাকালাম। আমি বিছানায়। হাত নাড়তেই সুঁইয়ের গুঁতো খেলাম। তাকিয়ে দেখি স্যালাইন দেওয়া। শরীরটা দুর্বল লাগছে। আমি আস্তে করে উঠলাম। টান দিয়ে খুলে ফেললাম সুঁই। কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হলো। আমার অনুভূতি নেই। আব্বু আম্মুর সাথে আমার আনন্দ অনুভূতি সব কবরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। পুরো রুম অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে। প্রত্যেকদিন সকালবেলা আম্মু জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিতো। আজ পর্দা সরানোর কেউ নেই। তাই নিজেই ধীর পায়ে গিয়ে পর্দা সরালাম। চোখে আলো পড়তেই হঠাৎ অসহ্য লেগে উঠল। ভাবলাম আবার পর্দা টেনে দেবো কিনা। কেউ একজন এসে দেখে গেল। বুঝলাম মুনতাহা এসেছিল। একটু পরে মিষ্টি খালা এসে বলল, উঠেছিস? ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা বানিয়েছি। খেতে আয়। আমি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দরজা মেরে ঝর্ণা ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর একজন একজন করে ডেকে গেল। একঘন্টা হয়ে গেল। আমি কারো ডাকেই সাড়া দেইনি। চুপ করে বসে আছি ঝর্ণার নিচে। সবাই শুধু পানির শব্দই শুনতে পেল। আমি বের হচ্ছি না দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। তখনই আমি বের হয়ে এলাম রুম থেকে। আমাকে কাগজের মতো সাদা লাগছে। মুনতাহা আমাকে নিয়ে সোফায় বসালো।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। আন্টি, আঙ্কেল আর চেরি ফল আমাকে দেখতে এসেছে। আন্টি আমার পাশে এসে বসে বললেন, এই অবস্থা কেন? পুরা সাদা হয়ে আছে। সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। কপাল ধরে বললেন, কপাল তো বেশ গরম। মনে হয় জ্বর আসবে। একটা কাঁথা নিয়ে এসো। মুনতাহা কাঁথা মুড়ি দিতেই আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম শীতে। মাথা রাখলাম আন্টির কাঁধে। আন্টি বললেন, দেখ, কি জোরে মেরেছিস কালকে। পুরো কালো হয়ে গেছে। মিষ্টি খালা বলল, ও মেরেছে বলে তো পাথর বুক ভেঙে কান্না করেছে। আমার তো এখন ওকে নিয়ে ভয়। আপা দুলাভাইকে খুব ভালোবাসতো মেয়েটা। ওরা চলে যাওয়ায় একদিনে কি যে হাল হল! মিষ্টি খালার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন। আঙ্কেল বললেন, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে থাকলে তো মেয়েটা মরে যাবে। আমি জ্বরের ঘোরে বলতে লাগলাম, আমি আম্মুর কাছে যাবো। আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। তোমরা না আমার কাছে আসবে বলেছিলে। কেন এলে না? এখন আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে চলো। আমার কথাগুলো শুনে পুরো বসার ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
.
.
.
.
– কি বুঝলেন?

– দেখুন, ও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আজ সারাদিনে জ্বর ১০৩ এর নিচে নামেনি। ওষুধ দেওয়ার পর যদি পেসেন্ট রেসপন্স না করে তবে সেটা সমস্যা।

– এখন কি করব ডক্টর? আমাদের তো কিছু মাথায় আসছে না। সদ্য আপা আর দুলাভাই চলে গেছে। বড্ড ভালোবাসতো। নিজেদেরকেই নিজেরা সামলাতে পারছি না। আর ও তো বাচ্চা মেয়ে।

– দেখুন, ওকে বোঝাতে হবে। এভাবে তো স্যালাইন দিয়ে বেশি দিন চলা ঠিক হবে না। আপনারা ওকে বোঝান। ঠিক মতো খাওয়ান। এভাবে করতে থাকলে শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকবে।

– ওকে ডক্টর, আমরা চেষ্টা করব।

মিষ্টি খালা আর খালু ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি। তাকালেই মাথা ঘুরাচ্ছে। ঝিমঝিম করছে। মিষ্টি খালা আমার কাছে একটা পায়েসের বাটি নিয়ে এসে বলল, দেখ ছোঁয়া, তোর না পায়েস পছন্দ? আমি বানিয়ে এনেছি।

– খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবো না।

– সোনা, এমন করে না। আমি অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। একটুও খাবি না?

আমি কয়েক চামুচ খেলাম। বললাম, তেতো। মিষ্টি খালা বলল, একটু তো তেতো লাগবে। জ্বর মুখ তো। আরেকটু খা। তাহলে আর জোর করবো না। আমি আরো সাত আট চামুচ জোর করে খেলাম। সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠল। আমি গড়গড় করে বমি করে বের করে দিলাম পেটে যাওয়া পায়েসটুকু। ক্লান্ত শরীরে বললাম, আর পারছি না। নিয়ে যাও সব আমার চোখের সামনে থেকে। আম্মুকে ডেকে দাও। ডেকে দাও। মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।

চলবে…

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১৩
#সাহেদা_আক্তার

মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।
.
.
.
.
সপ্তাহখানেক হল আমি হাসপাতালে। এখন একটু সুস্থ আছি। খাওয়া দাওয়াও করতে পারছি। তবুও শরীরে জোর পাই না। ডাক্তার আজকে রিলিজ করে দেবে। আমি বসে আছি বেডে। মিষ্টি খালা এসে বলল, আজকে থেকে তুই আমাদের কাছে থাকবি। আমি মাথা নাড়লাম। উনি আবার বললেন, আজকে তাহলে আমাদের সাথে চল।

– আমি বাসায় যাবো একবার।

মিষ্টি খালা আর খালু একে অপরের দিকে তাকাল। খালু বললেন, আগে আমাদের সাথে চলো পরে একদিন না হয় ওখানে যেও।

– আমি দ্বিতীয় বার ওখানে যেতে চাই না।

– বেশ।

দুপুরের দিকে আমাকে নিয়ে বাসায় এলো। আমি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর উঠে বড় একটা লাগেজ বের করলাম। চেইন খুলে আলমারি থেকে জামা কাপড় ঢোকালাম। চেরির শার্টটা নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। তারপর ওটা একটা জামার ভেতর নিয়ে লাগেজে ঢুকালাম। আম্মুর রুম থেকে বাক্সটা এনে নিয়ে নিলাম। ডায়রী আর কিছু টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলাম। তারপর দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির সামনে দাঁড়ালাম। আমার, আব্বুর আর আম্মুর। কি সুন্দর হাসছে! আমি ছবিটা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বিড়বিড় করে বললাম, কেন এত তাড়াতাড়ি তোমাদের মেয়েকে এত বড় দুনিয়ায় ফেলে চলে গেলে? আমি ছবিটা নিজের সামনে ধরে আব্বু আম্মুকে চুমু দিলাম। তারপর লাগেজে রেখে চেইন মেরে দিলাম। রুম থেকে বের হয়ে বললাম, চলো। মিষ্টি খালা জিজ্ঞেস করল, খাবি না?

– উঁহু, একসাথে ওখানে গিয়ে খাবো।

– আচ্ছা।

খালু আমার থেকে লাগেজটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। মিষ্টি খালাকে বললাম, নিচে যাও। আমি আসছি। খালাও চলে গেল। আমি পুরো বাসাটার দিকে তাকালাম। আমার চোখের সামনে সব স্মৃতি ভেসে উঠল। আমি এদিক থেকে ওদিক ছুটছি আর আম্মু পেছন পেছন ছুটছে। আম্মু মেরেছে বলে কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর কাছে ছুটে গেছি। আব্বু আমাকে আদর করে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। প্রথম আঁকতে শিখেছি বলে পুরো বাসার দেয়াল এঁকে নষ্ট করেছি। আম্মু দেখে অনেক বকেছে। আব্বু একটা ছবি তুলেছিল। সেটা এলবামে আছে। হঠাৎ এলবামের কথা মনে পড়ল। আমি খুঁজে নিলাম এলবামটা। তারপর শেষবার তাকিয়ে তালা মারলাম দরজায়। যেতে গিয়ে চেরিফলের দরজার দিকে চোখ পড়ল। কাছে গিয়ে দরজায় হাত রাখলাম। তারপর দরজায় একটা চুমু দিয়ে বললাম, ভালো থেকো নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে। আঙ্কেল আন্টিকে সাবধানে রেখো। অনেক জ্বালিয়েছি। আমি ছিলাম তোমার জীবনে কয়দিনের অতিথি, তাই চলে যাচ্ছি বহুদূরে। আন্টির থেকে অনেক কিছু শিখেছি। থ্যাংক ইউ আন্টি। না বলে যাওয়ার জন্য সরি। আমি নেমে চলে এলাম মিষ্টি খালা আর খালুর কাছে। রওনা দিয়ে দিলাম তাদের বাড়ি।
.
.
.
.
মুনতাহা আর সানজিদা আপু অপেক্ষা করছিল। আমি যেতেই হাসি মুখে আমাকে ঘরে নিয়ে গেল। মুনতাহা আমার সমবয়সী। খালি সারাদিন পটর পটর করে। আমি যেতেই কথার ফুল ঝুঁড়ি নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুরছে। শুধু ওয়াশরুমটাই ছিল একমাত্র ওর থেকে বাঁচার উপায়। খেতে বসেও যখন বকবক শুরু করল আমি বললাম, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না তো। শান্তি মতো খেতে দে। আমার কথায় সবাই বেশ খুশিই হল। কারণ আজকে অনেকদিন পর নিজ ইচ্ছায় খাচ্ছি। খেয়ে গেলাম মুনতাহার রুমে। এখন থেকে ওখানেই থাকবো। আগে সানজিদা আপু থাকতো। এখন বিয়ে হওয়ায় অন্যরুমে শিফট করেছে। আমাকে আলমারিতে জায়গা করে দিয়ে মুনতাহা বলল, এখানে সব কাপড় চোপড় তুলে রাখ। আমি তোকে হেল্প করছি। আমি আর ও মিলে সব তুলে রাখলাম। বাক্সটা রাখতেই ও বলল, এটা কি?

– আমার জন্মদিনের গিফট।

– আমি দেখবো।

আমি খুলতেই ও বলল, ওয়াও!!!!!! কি সুন্দর শাড়ি!!!! কে দিয়েছে? আমি বললাম, জানি না। মনে মনে বললাম, একটা রাক্ষস ভ্যাম্পায়ার। শাড়ির বদলে আমার ঘাড়ে কামড় দিসে। ও সব দেখে রেখে দিল আলমারিতে।

সন্ধ্যায় সবাই আড্ডা দিতে বসল ছাদে। মিষ্টি খালাদের বাড়িটা একতালা। একটু গ্রাম সাইডে। বাড়িটার চারদিকে চারটা রুম আর মাঝে ডায়নিং। রান্নাঘর আলাদা। আমি থাকবো দক্ষিণ পশ্চিম রুমটাতে। সবাই যে যার মতো বকবক করছে। দুলাভাইও আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মুনতাহা খেয়াল করে বলল, কি রে, তারা গুনছিস নাকি?

– উঁহু, দেখছি আর ভাবছি কোনটাকে আব্বু ভাববো আর কোনটাকে আম্মু। আচ্ছা মুন, কোন দুটো উজ্জ্বল তারা আমাদের রুম থেকে দেখা যাবে?

আমার কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল। মুনতাহা কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ওই বেটি, আমি কি করে বলবো। জানো ছোঁয়া না অনেক ভালো গল্প বলতে পারে। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, কে বলল তোকে?

– কে বলবে? আমি বলছি। এখন একটা গল্প শোনা। অনেকদিন শুনি নাই।

– হ্যাঁরে বল না। দেখ ভালো লাগবে হয় তো।

সবাই জোরাজুরি করতে লাগল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলাম।

– আকাশে তো কত মেঘ। কিছু রঙ তুলির ছেটা রঙের মতো, কিছু বা জমাট। সেই জমাট বাঁধা একটা মেঘেই থাকতো ছোট্ট এক দুষ্টু পরী। সে খুব দুষ্টু ছিল। সারাক্ষণ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতো। তার বাবা মা তাকে সামলাতে হিমসিম খেতে হতো। মাঝে মধ্যে খুব শাসন করতো। কিন্তু তবুও তার দুষ্টমি কমলো না। একদিন ওদের জমাট বাঁধা মেঘে প্রচন্ড বজ্রপাত শুরু হল। পরী দেখে খুব ভয় পেল। কিন্তু ওর বাবা মা ওকে সাহস যুগিয়ে বলল, কিচ্ছু হবে না। তুমি ঘরে থাকো। পরী জিজ্ঞেস করল, তোমরা? তারা বলল, আমরা একটু পরেই চলে আসব। ছোট্ট পরী সারাদিন ঘরে বসে অপেক্ষা করল তার মা বাবার জন্য। এদিকে বজ্রপাত থেমে গেল। ছোট্ট পরী বেরিয়ে এল। কিন্তু তার বাবা মাকে খুঁজে পেল না। ওরা হারিয়ে গেল বজ্রপাতের সাথে।

দুই ফোঁটা পানি চোখ থেকে চিবুকে গিয়ে জমলো। সবাই চুপ। চারদিকের ঝিঁঝিঁ পোকার কোলাহল স্পষ্ট হয়ে জেকে বসছে কানে। মিষ্টি খালা বলল, সবাই নিচে চলো। রাত হয়ে যাচ্ছে। সবাই একে একে নিচে চলে এল। মুনতাহা পাটি গুছিয়ে নিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিল।

রাতের খাওয়া শেষে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু আর মুনতাহা লুডু খেলতে বসল। আমাকেও টেনে নিয়ে গেল। আমি মাত্র মুনতাহার গল্পের বই সংগ্রহে হামলা দিতেছিলাম। কি আর করা। বইসা পড়লাম কালো গুটি নিয়া। মুনতাহা বলল, সাফে সাফে খেলবো। আমি আর ছোঁয়া। মিষ্টি খালা ধরল আমাকে। উনি আমাকে ছাড়া কিছুতেই খেলবে না। আমি বললাম, আমার দলে থাকলে হেরে যাবে তো। তবুও আমাকে ছাড়ল না। খেলা শুরু করলাম। দর্শক খালু আর দুলাভাই। শেষ পর্যন্ত আমার কথাই ফললো। হাইরা গেলাম। মুনতাহা বলল, আরেক বার। এবার আমি আর ছোঁয়া। আবার বসলাম খেলতে। আমাদের দুইজনের তুমুল ছক্কা উঠতে লাগল। ছক্কার চোটে আমদের গুটি লাফিয়ে লাফিয়ে পেকে গেল। পথে যত গুটি পাইলাম সব কেটে সাফ। জিতে গেলাম। বেশ মজাও হল। মিষ্টি খালা দুই বার হেরে গিয়া বলল, আজ আর না। শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে। সত্যিই অনেক বাজে। যে যার ঘরে চলে গেল। আমরাও শুয়ে পড়লাম। আমার মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। মুনতাহা বলল, ছোঁয়া, আব্বু বলেছে তোকে ট্রান্সফার করে আমাদের স্কুলে নিয়ে আসবে। খুব মজা হবে তাই না?

– হুম।

– আমরা একসাথে স্কুলে যাবে। একসাথে পড়ব।

– হুম।

ও খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার চোখে ঘুম নেই। আমি তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে। ভাবছি, ইস্ যদি ছাদটা না থাকতো। আকাশের তারাগুলো দেখতে পেতাম। মনে মনে বললাম, আম্মু তুমি আর চিন্তা করো না। আজ থেকে আমি আর দুষ্টুমি করবো না। তোমাদের এই দুষ্টু পরীটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে। হঠাৎ আম্মুর ফোনে ম্যাসেজের শব্দ। আম্মুর ফোনটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। আব্বুরটা এক্সিডেন্টে ভেঙে গেছে৷ ঐ সিমটাও আম্মুর ফোনে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আমি লক খুলে ম্যাসেজটা দেখলাম।

‘ এখনও ঘুমাওনি? জেগে জেগে তারাদের কথা ভাবছো? আর ভাবতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। পালিয়ে যাওয়ার আগে তো তোমার মুখটা দেখতে দিলে না। দাঁড়াও যখন তোমার কাছে ফিরে আসবো তখন আর পালাতে দেবো না। ভালোবাসার শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখবো নিজের কাছে।
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার’

পড়ার সাথে সাথে মেজাজ খারাপ হল। তার ঐ কচু বাইটের জন্য প্রচুর চুলকানি হইসে। সবাই প্রশ্ন করে পাগল বানাই ফেলসে। কোনোমতে সামাল দিসি। তবে একটু ভয়ও হইল। জানল কি করে আমি এখন কি করতেসি, কি ভাবতেসি!? আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেইখা নিলাম। কই, কোথাও কেউ নেই। আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম, যদি সামনে আসো তবে তোমার চৌদ্দ গুষ্টির শরীরের এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট রাখবো না। সব শুষে নেবো। ব্যাটা ভ্যাম্পায়ার। মেজাজ খারাপ করে ফোনটা রাইখা দিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম। আমার ম্যাসেজটা পেয়ে কারো একজনের মুখে হাসি ফুটল।
.
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। এই নিয়ে দশবার রিং টোন বাজছে। কে যে ফোন করতেসে। ধুর বাবা। চোখ বন্ধ করে কোনোমতে হাতিয়ে ফোনটা নিলাম। ব্যাটা এখনও বাইজা বাইজা মাথা তুলি ফেলতেসে। কোনোমতে রিসিভ করে বললাম, হ্যালো৷ কে?

– এখনো ঘুমাচ্ছো। ঘুমন্ত সুন্দরী হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? যে কিস করে উঠাতে হবে।

ধমক খেয়ে আমি চোখ খুলে তাকালাম। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার। আমি আবার বললাম, কে বলছেন আপনি? আপনি হয়ত ভুল নাম্বারে……

– আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি। এখুনি ঘুম থেকে ওঠো না হলে এসে ঘাড়ে আরেকটা কামড় দিবো।

– কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here