আমি_তোমার_গল্প_হবো,পর্ব:১৭(শেষ পর্ব)
জাহান আরা
আজকের দিনটা প্রলয়ের জীবনের একটা অন্যতম কষ্টের দিন।
প্রলয় বসে আছে জানালার পাশের সোফায়।
প্রথম যেদিন প্রলয় জানতে পেরেছিলো তার ব্রেইন ক্যান্সার,প্রলয়ের তেমন একটা দুঃখবোধ হয় নি।
প্রলয় ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে।ক্যান্সার ধরা খাওয়ার এতোদিন পরেও প্রলয় কাউকে জানায় নি তার অসুস্থতার কথা।
প্রলয় জানে কি ভীষণ কষ্টের দিন সে কাটিয়েছে।মাথা ব্যথায় মাথা যেনো ছিড়ে যেতো প্রলয়ের,প্রলয় রুমের দরজা বন্ধ করে পশুর মতো কাৎরাতো রুমের ভিতর।
মাঝেমাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো।আবার জ্ঞান ফিরে টের পেতো প্রচন্ড মাথা ব্যথা।
সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে প্রলয় কখনো ভাবে নি আত্মহত্যা করার কথা।অথচ আজকে প্রলয়ের কেনো জানি ভীষণ রমমের ইচ্ছে করছে আত্মহত্যা করতে।
প্রলয়ের মাথাভর্তি চুল,এক মাথা চুল নিয়ে প্রলয়ের মধ্যে সবসময় একটা আনন্দ অনুভব হতো।প্রলয়ের মায়ের ভীষণ পছন্দের প্রলয়ের চুল।সময় পেলেই তিনি বাটিতে করে নারিকেল তেল গরম করে আনেন ছেলের মাথায় লাগিয়ে দিতে।
মায়ের এতো পছন্দের চুল পড়ে যাবে থেরাপি দিলে তাই প্রলয় কখনোই রাজী ছিলো না কেমোথেরাপি দিতে।
মা যদি দেখতো তার ছেলে ন্যাড়া হয়ে গেছে তবে মা কি ভীষণ কষ্ট পেতো তা প্রলয় জানে শুধু।
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।বন্যা মারা যাওয়ার পর মায়ের বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ছিলো প্রলয়।
শুধু একথা ভেবেই প্রলয় পারে নি মা’কে জানাতে ক্যান্সারের কথা।কিভাবে বলতো সে মা’কে?
মা যদি জানতো তার ছেলে কিছুদিন পর মারা যাবে,তবে তো মা প্রলয়ের আগেই মরে যেতো শোকে শোকে,মায়ের কষ্টভরা মুখ প্রলয় কিভাবে দেখতো?
কিন্তু কেনো যেনো আজকে বুকের ভিতর এক সূক্ষ্ম ব্যথা প্রলয় কে মদদ দিচ্ছে আত্মহত্যা করতে।
আচ্ছা শবনম এখন কি করছে?
শবনম আর শ্রাবণ কি জেগে আছে?
ওরা নিশ্চয় এখন গল্প করছে দুজনে!
প্রলয় কল্পনায় দেখতে পেলো সে আর শবনম বসে আছে বিছানায়।ফুলে ফুলে বিছানা ভরে আছে,এতো ফুলের মধ্যেও শবনম কে মনে হচ্ছে একমাত্র তাজা গোলাপ।
হঠাৎ করে প্রলয়ের মনে হলো কল্পনাতে নয়,সত্যি সত্যি শবনম আছে এখানে।
ওই-ওই তো বসে আছে শবনম বিছানায়।শবনম যেনো হাসছে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে।
শবনম কি তাকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে?
হ্যাঁ ডাকছে তো।
শবনম ফিরে এসেছে তার কাছে।
আজ প্রলয় শবনম কে সত্যি কথা বলবে,শবনম কে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবে কি ভীষণ ভালোবাসে সে শবনম কে।
আজ সারারাত শবনম কে বুকে এভাবে জড়িয়ে রাখবে প্রলয়।
প্রলয় বসা থেকে উঠতে পারছে না মাথা ব্যথার চোটে।দৃষ্টি যেনো ঘোলাটে হয়ে আসছে।
প্রলয় কিভাবে যাবে শবনমের কাছে?
ওই যে তার শবনম তাকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে। কিভাবে আজও সে শবনম কে ফিরিয়ে দিবে?
ওই তো টেবিলের উপর শবনমের জন্য লিখা একটা চিঠি আছে।
শবনম যদি বিশ্বাস না করে এখন প্রলয়ের কথা তবে এই চিঠি ও দেখাবে প্রলয় তাকে।
প্রলয় জোর করে উঠতে গেলো কিন্তু পারলো না।প্রলয়ের মনে হলো অদৃশ্য কেউ একজন আছে যে চায় না প্রলয় শবনমের কাছে যাক।সে চায় না প্রলয় শবনম কে ভালোবাসি বলুক।
কিন্তু আর কতো প্রলয় শবনম কে ফিরিয়ে দিবে?
মাথাটা কি আজকে ছিড়ে পড়ে যাবে?
এতো তীব্র ব্যথা হচ্ছে কেনো আজকে?
হামাগুড়ি দিয়ে প্রলয় এগিয়ে যেতে লাগলো শবনমের দিকে।
কি আশ্চর্য!
প্রলয় যতোই শবনমের দিকে এগুচ্ছে শবনম যেনো ততই ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে প্রলয়ের কাছে।
প্রলয় দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গেলো জোর করে,শবনম কে আটকাতে হবে,কিন্তু পারলো না।
দাঁড়ানো থেকে ধপ করে পড়ে গেলো ফ্লোরে।
চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রলয় এগিয়ে আসতে লাগলো হামাগুড়ি দিয়ে।
মাথার ভিতর ধপধপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে প্রলয় স্পষ্ট।
এইটুকু পথ হেটে আসলে যেখানে ১০ কদমের বেশি না প্রলয়ের মনে হচ্ছে সেটা যেনো আজ ১০ মাইল দূরত্ব মনে হচ্ছে।
বিছানার কাছে এসে প্রলয় খাটের পায়ার সাথে চোট পেলো। চোখ মেলে তাকালো প্রলয়।
কিন্তু শূন্য বিছানা।
নেই,কোথাও কেউ নেই।শবনম নেই কোথাও।
একেই হয়তো বলে,”শূন্য শয্যা,মিথ্যা স্বপন”
টলমল করতে করতে প্রলয় উঠে দাঁড়ালো,তার পর পরই প্রলয় পড়ে গেলো,প্রচন্ডভাবে আঘাত পেলো একপাশে রাখা কাঁচের টি টেবিলের উপর পড়ে।মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো টেবিলের কাঁচ,স্রোতের মতো গড়িয়ে যেতে লাগলো রক্ত।
ইশশ,মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ জানে না মৃত্যু কতো কাছে!
.
আজকের ভোরটি অন্য দিনের থেকে আলাদা,রাহেলা বানুর আজকে ঘুম ভেঙেছে বন্যা আর বন্যার বাবাকে কে স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন দেখার পর থেকেই রাহেলা বানু অস্থির হয়ে আছেন।বন্যার মৃত্যুর পর কখনো তিনি বন্যাকে স্বপ্ন দেখেন নি।
অথচ আজকে হটাৎ স্বপ্ন দেখলেন বন্যা এসেছে।সাথে বন্যার বাবা।কোথাও একটা ফুল বাগানে তারা বাবা মেয়ে বসে আছেন।
বন্যার মধ্যে অস্থিরতা কিসের যেনো।মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষায় আছে সে।একটু পর দেখলেন প্রলয় গিয়ে হাজির হলো সেখানে।সাথেসাথে বন্যার অস্থিরতা আনন্দে রূপ নিলো।
ঘুম ভাঙ্গলো বন্যাকে ডাকতে ডাকতে তার।
রাহেলা বানু নামাজ পড়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। প্রলয়ের রুমে গিয়ে প্রলয় কে বলতে হবে স্বপ্নের কথা।
মর্জিনা চা বানিয়ে রেখেছে,রাহেলা বানু ঠিক করলেন আজকের চা ছেলে আর মা মিলে বারান্দায় বসে খাবে।
প্রলয়ের রুমের বাহিরে এসে রাহেলা বানু চমকে উঠলেন।
রক্তের ধারায় ভেসে যাচ্ছে সব।
রাহেলা বানু চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন।
.
সকাল হতেই শ্রাবণদের বাসার সবাই প্রলয়দের বাসায় চলে এলো।শবনম বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।কেনো এভাবে এতো সকালে নিয়ে এসেছে শ্রাবণ।
ভিতরে ঢুকে দেখতে পেলেন মানুষের ভীড়। শবনমের বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো।
প্রলয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে,চাদর দিয়ে ঢাকা।
শবনম কি করবে!
কাঁদবে গলা ছেড়ে?
নাকি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে?
আচমকা শবনম শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। শ্রাবণ কি করবে বুঝতে পারছে না।প্রলয় নেই শ্রাবণ এটা ভাবতে পারছে না। সব যেনো একটা মিথ্যে মায়া।একটু পর এই মায়া কেটে যাবে।
শ্রাবণী যেনো পাথর হয়ে গেছে।গলা দিয়ে কান্না আসছে না ওর।নিজের গালে নিজে চড় বসালো,চুল টেনে ধরলো।
কিন্তু কান্না আসছে না তবুও।
আল্লাহকে বললো,”আল্লাহ একটু কাঁদার শক্তি দাও আমাকে।আমি আজকে কাঁদতে চাই,জীবনের সব কান্না আমি আজকে কাঁদতে চাই।”
কি অদ্ভুত ভালোবাসা!
রাহেলা বানু স্বপ্নের ব্যাখ্যা পেলেন।
মর্জিনা এনে শবনমের হাতে প্রলয়ের লিখা চিঠি দিলো।
খামের ওপর লিখা,”আমি তোমার গল্প হবো শবনম”
না শ্রাবণ মোটেও হিংসা করলো না এটা দেখে।শবনমের হাত কাঁপছে।
কেউ কেউ এভাবে গল্প হয়েই থাকে,চলে গিয়ে।
(সমাপ্ত)
প্রলয়ের লিখা চিঠি টা পোস্ট দিবো আগামীকাল।