শ্যামাবতী,পর্ব: ৬ (অন্তিম পর্ব)
লাবিবা
তারপর কি হলো? তাহি কি রাহাতের সাথে দেখা করতে পেরেছিল? এমন অনেক কোশ্চেন ই থেকে যায় কিন্ত তার কোন উত্তর এই ডাইরির পাতায় দেয়া নেই। অবন্তী ডায়েরিটা বন্ধ করে আরাধনা দিকে ফিরে তাকায়। আরাধনার দুচোখে ও পানি ভরপুর। অবন্তী ও কাঁদছে। অবন্তী ভেবে পাচ্ছেনা কেউ কতটা আবেগ দিয়ে এভাবে নিজের জীবন কাহিনী ডাইরির পাতায় ফুটিয়ে তুলতে পারে। প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা কথা সবই যেন জীবন্ত লেগেছিল অবন্তীর কাছে।অবন্তী মনে মনে বরংবার চাইছে তাহি যেন বেঁচে ফিরে। রাহাতের শ্যামাবতী যেন রাতের বুকে ফিরে আসে। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ করেই অবন্তী আরাধনা দিকে ফিরে তাকাল। কিছুক্ষন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-‘এটা আন্টির ডায়েরি আরাধনা?’
অবন্তীর প্রশ্নে আরাধনা এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আরাধনা এ কান্নাটি অবন্তী সম্মতি হিসেবে ধরে নিল। সে নিজেও কাঁদছে। একহাতে আরাধনাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। কাঁদুক না মেয়েটা! মেয়েটা ঠিক তার মায়ের মতোই হতভাগী হয়েছে। তার মা পায়নি বাবার ভালোবাসা আর সে পায়নি মায়ের ভালোবাসা। সে তো তার মাকে এক পলক দেখার সুযোগ ও পায়নি।
আরাধনা আর অবন্তী বেস্ট ফ্রেন্ড। তারা দুজন এবার অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। দুজন দুজনকে বোনের মতোই ট্রিট করে। অবন্তী খুবই অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে তবে আরাধনা হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতই শ্যামবর্ণের। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছে সে। মায়ের নামের সাথে মিল রেখে তার বাবা তার নাম রেখেছে ‘আরাধনা আহি’। মেয়েটা ঠিক তার মায়ের প্রতিরূপ। মায়ের মতোই কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েছে। আর রাহাত, সে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। মাস দুয়েক হলো হার্টের রোগ দেখা দিয়েছে। বর্তমানে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে সে। তার জীবনে হয়তো খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। খুব শীঘ্রই পাড়ি জমাবে তার প্রিয়তম স্ত্রীর কাছে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে তার নিজের ছোট্ট লাইব্রেরীতে কাটায়। আরাধনার দাদিমা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। বর্তমানে বাবা আর মেয়ের সংসার চলছে। তাহি মারা যাওয়ার পর সে আর বিয়ে করেনি। করবে বা কী ভাবে? তার মনের সমস্ত টা জুড়েতো শুধু তার শ্যামাবতীর বসবাস।
রাহাত তার ছোট্ট লাইব্রেরীতে কাঠের চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি উপন্যাসটি পড়ছিল। এখন মধ্য দুপুর। তার লাইব্রেরীর জানালার পাশে রয়েছে মস্ত এক আম গাছ। গাছের পাতার ফাঁক থেকে ছোট্ট ছোট্ট সূর্যকিরণ জানালা গলিয়ে রুমে ছড়িয়ে পড়ছে। সূর্যের সোনালী আলোতে রুমটা ঝলমল করছে। রাহাত তার হাতে থাকা উপন্যাসটি বন্ধ করে পাশের টেবিলে রেখে দিল। চোখ থেকে পাওয়ারি চশমাটা খুলে খুব সন্তর্পনে তার বুক পকেটে খুঁজে দিল। অতঃপর খুব আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দিল। আজ তার মন ভীষণ ভালো।
অবন্তী আরাধনার সাথে তার বাড়িতে এসেছে। সে মাঝেমধ্যেই আসে এখানে। তবে আজ তার আসার কারণ ভিন্ন। আজ সে এসেছে রাহাত আঙ্কেলের থেকে আন্টির মৃত্যুর কাহিনী টুকু জানতে। বাকিটুকু না জানতে পারলে তার মনের অস্থিরতা কমছে না।
বাড়িতে ঢুকেই আরাধনা সরাসরি লাইব্রেরীতে ঢুকলো। সে জানে তার বাবা এই সময়ে লাইব্রেরীতেই থাকবে। তার সাথে সাথে অবন্তী ও লাইব্রেরীতে পৌঁছালো। আরাধনা একটি চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলো। অল্প শব্দতে রাহাত চোখ মেলে তাকাল। মেয়েকে পাশে হাসিমুখে বসে থাকতে দেখে সে খানিক হাসলো। মেয়ের মাথায় হাত রেখে সযত্নে প্রশ্ন করল,
-‘আজ এত দেরি হল কেন মা? কোন কাজে ব্যস্ত ছিলে নাকি?’
উত্তরে আরাধনা মাথা ডানে-বামে ঘুরিয়ে না বোঝালো। আরাধনার পাশের চেয়ারটিতেই অবন্তী বসেছিল। রাহাত অবন্তীকে দেখতে পেয়েই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
-‘ আরে অবন্তী যে! তোমরা একসাথে আসলে নাকি? অনেকদিন পরে এ বাড়িতে আসলে। তো কেমন আছো ডিয়ার?’
উত্তরে অবন্তী হাসিমুখে বলল,
-‘ আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল। আপনার থেকে কিছু জানার জন্য এসেছিলাম আঙ্কেল। আমি যদি কিছু জানতে চাই আপনি বলবেন তো?’
-‘অবশ্যই ডিয়ার! হোয়াই নট?’
রাহাতের উত্তরে অবন্তী খুশি হলো। সে কোন দেরি না করে সাথে সাথেই প্রশ্ন করল,
-‘আন্টির ব্যাপারে জানতে চাই আঙ্কেল। কিভাবে মারা গেল আন্টি? আসলে ডায়েরিতে পরের কোনো অংশ লেখা ছিল না। আর বাকিটুকু জানতে না পারলে মানসিক শান্তি পাচ্ছিনা।’
অবন্তীর কথা শুনে রাহাত চোখ বন্ধ করে মাথাটা চেয়ারের সাথে এলিয়ে দিল। খানিক হেসে বলল,
-‘তাহলে ডায়েরীটা তোমাদের পড়া হয়ে গেছে তাই তো?’
উত্তরের অবন্তী শুধু মাথা নড়িয়ে হ্যাঁ জানান কিন্তু সেটা রাহাত দেখতে পেল না কেননা তার চোখ বন্ধ ছিল। হয়তো সে অনুমান করে নিয়েছিল উত্তরটা তাই সে নিজে থেকেই সেদিনের কাহিনী তাদেরকে বলে।
সেদিন অপারেশনের আগমুহূর্তে তাহি প্রচন্ড পাগলামী শুরু করে। সে রাহাতের সাথে দেখা না করে অপারেশন থিয়েটারের ঢুকবি না। অন্যদিকে তার ডেলিভারি পেইন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে সেদিন নার্গিস বেগম অর্থাৎ তাহির শাশুড়ি রাতে কল করেন। রাহাত সব জানতে পেরে ছুটে এসেছিল। তাই কোন কথা বলেছিল না শুধু রাহাতের হাত ধরে তার মুখ পানে চেয়ে ছিল। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার শেষ মুহূর্তে তাহি রাহাতের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে বলেছিল,
-‘আমি বেঁচে থাকতে চাই রাহাত। আমি আমার সন্তান আর আপনাকে নিয়ে সংসার করতে চাই। আপনাদের আগলে রাখতে চাই। আমার বাচ্চাটার মুখে বা ডাক শুনতে চাই। আপনাদের খুনসুটি স্বচক্ষে দেখতে চাই। খুব করে চাই বেঁচে থাকতে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি এখান থেকে আর ফিরে আসতে পারবো না। কিন্তু আমি ফিরে আসতে চাই রাহাত। খুব করে চাই ফিরে আসতে। ভালোবাসি আপনাকে অনেক।’
সত্যিই সেদিন তাহি আর ফিরে আসেনি। বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে আনতে পারলেও ডাক্তাররা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। তার সকল চাওয়া অপূর্ণই থেকে গেল। নিজের বাচ্চার মুখটাও দেখার সুযোগ সে পায়নি। এই মেয়েকে আল্লাহ একটা হতভাগী কেন করল? মানুষের ভাগ্য এতটাও খারাপ হয়? চিত্কার করে কেঁদেছিলো রাহাত সেদিন। সে তো তাঁর শ্যামাবতীকে ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে ও পারলনা। কিন্তু তার শ্যামাবতী ঠিকই যাওয়ার আগমুহূর্তে তার অনুভূতি প্রকাশ করে রেখে গেলো।
বিকেলের আজান পড়ে গেছে। অবন্তী নিজের চোখ মুছে আরাধনা কে নিজের বুকে টেনে নিল। আরাধনা কে শান্ত করে দুজন উঠল নামাজ আদায় করে নেওয়ার জন্য। লাইব্রেরী থেকে বের হওয়ার পূর্বে আরাধনা তার ব্যাগ থেকে ডায়েরী টা বের করে তার বাবার হাতে দিলো। অতঃপর ধীর পায়ে রুম থেকে প্রস্থান করল।
বাহাতে চোখের পানি টুকুই বুঝে রাহাত তার হাতে থাকা লাল ডায়েরি টার দিকে তাকালো। ডায়েরীটা কেমন নির্জীব হয়ে গেছে। পৃষ্ঠাগুলো সব লালচে লালচে হয়ে গেছে। এই ২০ টা বছর ধরে রাহাত এই ডায়েরিটিকে আগলে রেখেছে। আরো একবার পাঞ্জাবির হাতা টুকু দিয়ে চোখের পানি মুছে রাহাত। তার দৃষ্টি পরল লাল মলাটের ডায়েরিটি উপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘শ্যামাবতী’ নামটির দিকে। লেখাটির উপর হাত ছুঁয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো রাহাত,
‘শ্যামাবতী! ভালোবাসি। শুনতে পাচ্ছ তুমি? ভালবাসি তোমাকে শ্যামাবতী। খুব ভালোবাসি।’
সমাপ্ত
Odvut rokom valo legeche story ta, khub sundor guchiye lekha hoyeche.
Thank you so much for the story