শ্যামাবতী,পর্ব: ৩

শ্যামাবতী,পর্ব: ৩
লাবিবার

আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন দুপুর হয়ে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তো চোখ আমার ছানাবড়া। দুপুর দুটো বাজে! মানে এতক্ষণ আমি ঘুমিয়ে আছি? বাড়ির মানুষগুলো কি ভাবছে আল্লাহই ভাল জানে। আমি সিওর এরা বলবে বউ আমাদের ঘুম কাতুরে, একদম অলস প্রকৃতির এসবই ভাববে। এসব বিড়বিড় করতে করতেই বেড থেকে নেমে ওয়াশ রুমের দিকে গেলাম। কিন্তু ওয়াশরুম ভেতর থেকে বন্ধ, তারমানে ভেতরে কেউ আছে। পানি পড়ার শব্দ আসছে, তখন মনে পরলো হ্যাঁ রাহাত হতে পারে। সে তো সকালে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছিল আর কখন ফিরল আমি কিছুই জানিনা। আমার এখন নিজের উপরই রাগ লাগছে। মনে মনে নিজেকে বেশ কিছু গালি দিয়ে শাসাতে লাগলাম কেন ঘুমাতে গেলাম আমি? একটু না ঘুমালে কি বা হত? মরে তো আর যেতাম না। কিন্তু এখন যে মানুষগুলো আমাকে অলস ভাববে! এ ক্ষতিপূরণ আমি কিভাবে করব? এসবই ভাবছিলাম আর আমার রুমের ভেতর পায়চারি করছিলাম। তখনই ওয়াশ রুমের দরজা খুলে রাহাত বের হয়ে আসলো। পরনে তার সাদা কালো চেকের টাউজার, গায়ে ব্লাক গেঞ্জি। একহাতে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে। অন্যহাতে তার সদ্য গোসল করে ধোয়া কাপড় চোপড়। নাকে বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা গুলো মুক্তোর মতো জ্বলছে। আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। এই লোকের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে আমার চোখ ঝলসে যাবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অন্ধ হওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার হুহ।
রাহাত আমার দিকে একবার তাকিয়ে হেঁটে বারান্দায় চলে গেল। ভাব দেখে বাঁচি না যত্তসব। আমাকে যেন তার চোখেই পড়ে না। হতে পারে আমি তার মত সাদা ইঁদুর না কিন্তু শ্যামলার ভিতরে যথেষ্ঠ রূপবতী আমি। আমার পেছনে অনেক ছেলে লাইন দিয়েছে কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি আর এ বেটা আমাকে মোটে দামই দিচ্ছে না। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে লাগেজ খুলে নিজের পড়ার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে আমিও ঢুকে গেলাম ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

—————-

ড্রইংরুমে সোফার উপর গুটিসুটি হয়ে বসে আছি মাথা নিচু করে। আমার সামনেই বসে আছে যমদূত! মানে রাহাতের দাদি রাজিয়া বেগম। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে চলছেন। আর তার এমন চাহনি দেখে আমার প্রান যায় যায় অবস্থা। আমার শাশুড়ি মা আগেই বলে রেখেছেন এই ঘেটা মহিলা আমাকে যাই জিজ্ঞেস করুক আমি যেন ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিই নয়তো পাটায় পিষে ফেলবে আমাকে। রাজিয়া বেগম এই পরিবারের খুবই সম্মানীয় একজন তা এদের কার্যকলাপেই বুঝতে পারছি। মহিলাটির বয়স সত্তর এর কোঠায় হলেও ঝাঁঝে ভরা।

-‘তোমার মায় মরছে কতদিন হইলো?’

রাজিয়া বেগম সর্তা দিয়ে সুপারি কাটতে কাটতে আমাকে প্রশ্ন করলো। আমি যথাসম্ভব মুখে হাসি রেখে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

-‘প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর হলো।’

-‘তা নাথবউ হুনলাম তোমার বাপে নাকি তোমাগো ছাইড়া চইলা গেছিল? তোমার মার কি চারিত্রিক কোন দোষ টোষ ছিল? এমনে এমনে তো আর ব্যাটা মানুষ তার বউ মাইয়া থুইয়া চইল্লা যায় না।’

দাদি কিছু ঠেস দিয়েই কথাগুলো আমাকে বলল। মায়ের নামে এমন কথা আমি সহ্য করতে পারলাম না। চোখ বেয়ে অনর্গল পানি ঝরতে লাগল। আমার শাশুড়ি মা আমার দিকে অসহায় মুখ করে তাকালো। অতঃপর রাজিয়া বেগম কে কিছুটা অনুরোধের সুরেই বললো,

-‘মা এগুলো না বললেই কি নয়! মেয়েটার সবে বাড়িতে এলো এখনই কি এসব বলার খুব দরকার?’

শাশুড়ি মায়ের কথার পিঠে রাজিয়া বেগম কিছু বলবেন ঠিক তখনই রাহাত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘কি হয়েছে দাদি? আমার বউকে সামনে বসিয়ে জেরা পর্ব চালাচ্ছ নাকি?’

রাহাতের কথাতে দাদি যেন দমে গেল। এ পরিবারে রাহাতকেই শুধু দাদি মেনে চলে। এই একজনই শুধু দাদির উপর কথা বলতে পারে। বাকি কেউ তার উপর আ ও করতে পারে না। তার কথার উপর কেউ কথা বলতে গেলে সে ব্যক্তির সম্মান সে পানির সাথে ধুয়ে দেয়। নিজের সম্মান হারানোর ভয়ে সহজে কেউ তার কথার বিপরীতে যায় না। রাহাতের ক্ষেত্রে শুধু ভিন্ন। রাজিয়া বেগম নিজেই রাহাতকে খুব ভয় পান। সবার সামনে বাঘ হলেও রাহাতের সামনে ভেজাবেড়াল সে। রাহাতকে দেখে আমার শাশুড়ির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাহাতকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই রাহাত আমাকে নিজের রুমে চলে যেতে বলল। আমি এতক্ষন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। রাহাত বলামাত্রই আমি সেখান থেকে আস্তে আস্তে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। মনে মনে হাজার খানি ধন্যবাদ দিলাম রাহাতকে এ সময়ে এসে আমাকে বাঁচিয়ে নেওয়ার জন্য।

আজ পুরো দিন টা নিজের ঘরেই কাটিয়ে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে রাহাতের বিভিন্ন কাজিনরা এসেছিল তাদের সাথে টুকটাক কথা বলেছি। এখন প্রায় নয়টা বাজে কিন্তু রাহাত এখনো ফেরেননি। আজ দিনটা তার ছুটি ছিল। দুপুরে খেয়ে বাইরে বের হয়েছেন এখনো তিনি ফেরেননি। রুমের মধ্যে পায়চারি করে চলছি। সময় মোটে যেতেই চাচ্ছেনা। সময় কাটানোর মতোও কিছু নেই। আমার নিজস্ব কোন ফোন নেই, একটা ফোন থাকলে অন্তত গেম খেলে সময় পার করতে পারতাম। আপার রুমে কোন টিভিও নেই। ড্রইং রুমেই শুধু টিভি কিন্তু নতুন বউ হয়ে ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখাটা বেমানান। তাই আপাতত রুমের ভেতর পায়চারি করে সময় পার করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
দশটা নাগাদ রাহাত ফিরে আসে। রুমে এসে কোন কথা ছাড়াই ছোট একটা ব্যাগ আমার হাতে তুলে দেয়। ব্যাগটা নিয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে জানতে চাই এর ভেতর কি আছে। প্রতিউত্তরে সে আমাকে একটা খুলে দেখার জন্য বলে। ব্যাগটা খুলতেই তার ভেতর একটা মোবাইলের বক্স পাই। তার মানে সে আমার জন্য মোবাইল কিনে নিয়ে এসেছেন। অনেকটা খুশি হই এই ভেবে যে এখন আমার ও একটা ফোন আছে। ফোন হাতে নিয়ে সামনে তাকাই রাহাতকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য কিন্তু ততক্ষণে রাহাত আমার সামনে থেকে ফ্রেস হতে চলে গেছেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here