শ্যামাবতী,পর্ব: ৪

শ্যামাবতী,পর্ব: ৪

সকাল হতেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছি। আজ নিয়ম অনুসারে আমি মামার বাড়িতে যাব। যেহেতু আমার নিজের বাড়ি নেই সেহেতু মামার বাড়িটাই আপাতত আমার বাপের বাড়ি। বেশ খুশি খুশি লাগছে। যদিও নিয়ম অনুসারে বর বউ দু’জনকেই যেতে হয় কিন্তু আমি একাই যাবো। রাহাত যাবেন না কারণ তার ছুটি নেই। গোছগাছ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখি রাহাত অফিসের জন্য তৈরি হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই বলে উঠলো,

-‘আসার পথে নিজের এসএসসি সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কাগজপত্র নিয়ে আসবে। আমাকে যেন সেকেন্ড বার মনে করিয়ে দিতে না হয়।’

আমার সার্টিফিকেট দিয়েই লোকটা কি করবে? বুঝতে পারলাম না তাই কিছুটা অবাক সুরে কোশ্চেন করেই ফেললাম-
-‘আমার সার্টিফিকেট কাগজপত্র দিয়ে আপনি কি করবেন?’

আমার প্রশ্ন শুনে যেন রাহাত প্রচন্ড রেগে গেলেন। আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

-‘বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি পড়াশোনা লাটে তুলে ফেলছো? পড়াশোনা করতে হবে না? শুনো মেয়ে আমার বউ হতে হলে সামান্য এসএসসি পাস করে বসে থাকলে হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সারা জীবন তোমাকে আমি বয়ে বেড়াতে পারব না বুঝলে?’

যদিও তার কথার আমি কিছুই বুঝিনি তবুও ধমক খেয়ে ভয়ে দ্রুত উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম যে হ্যা আমি বুঝেছি। আমার মাথা নাড়ানো দেখে সে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন,

-‘হুম গুড গার্ল!’

অতঃপর সে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সে বের হতেই আমি বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল জাহান্নামের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। বাপরে বাপ কি ভয়ানক লোক! সেটা বড় কথা না বড় কথা হচ্ছে লোকটা আমাকে পড়াশোনা করাবে। যাক এতদিনে একটা ভালো কথা বলল। ইসসস খুব খুশি খুশি লাগছে আমার।

——————

একদিন পর মামা বাড়িতে এসে মনে হচ্ছে কত যুগ পর এসেছি। মামীকে দেখা মাত্রই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। মামিও আলতো হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এই মানুষটি যে আমাকে এত ভালবাসে সেটা আমাকে কখনো বুঝতেই দেয় নি। আমার বিয়েটা না হয়ে গেলে তো আমি কখনো জানতেই পারতাম না।
আজ এক দিন হয়ে গেল আমি মামার বাড়িতে এসেছি। এই মুহূর্তে আমার শাশুড়ি বেশ কয়েকবার কল করেছিলেন। কিন্তু আমার বরটা এখন পর্যন্ত একবারও কল করেন নি। কিছুটা অভিমান হল। মনের কোথাও একটা আমি লোকটাকে অনুভব করতে পারি। তার ফোনের অপেক্ষা করতে করতে এই দিনটা চলে গেল তবু কোন কল আসলো না। অবশেষে আবার ফিরে যাওয়ার দিন চলে এল। ভেবেছিলাম আমায় নিতে হয়তো তিনি আসবেন কিন্তু না তিনি আসেননি। আমার শাশুড়ি মা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। আমার শশুর বেচে নেই। তিনি গত দু’বছর আগে মারা গেছেন। আমার ভাগ্যে শশুরের ভালোবাসা ছিল না। না পেলাম বাবার ভালোবাসা আর নামলাম বাবার সমতুল্য শশুরের ভালোবাসা। যাওয়ার আগে অবশ্য মনে করে আমার সার্টিফিকেট সহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছিলাম।

কেটে গেছে ছয়টি মাস। রাহাত আমাকে একটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা গড়ে না উঠলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমার পড়াশোনা নিয়ে রাহাত খুবই সিরিয়াস। রাহাত আমাকে সব সময় বলেন আমাকে অনেক বড় হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, অনেক ভাল রেজাল্ট করতে হবে। তার কথা রাখার জন্য আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করি। বেশিরভাগ সময়ই বই নিয়ে কাটিয়ে দেই।
এভাবে দেখতে দেখতে কেটে যায় পুরো দুটো বছর। আমার এইচএসসি পরীক্ষা টা শেষ হয়ে যায় এর মধ্যে। জিপিএ 5 পেয়েছি। সবাই খুব খুশী হয়েছিল বিশেষ করে রাহাত। আর রাহাতের খুশি দেখে খুশি হয়েছিলাম আমি। এডমিশনের প্রস্তুতি নিলেও এডমিশন টা আর দিয়ে হয়ে ওঠেনি। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম অনেক। যে কারণে স্থান হয় একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে।
বর্তমানে রাহাত আর আমার সম্পর্কটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। সময় তো কম হলো না এবার নিজেদের সম্পর্ক গুছিয়ে নেওয়ার পালা। রাহাত আর আমার ভেতরের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে অনেকটা প্রনয়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। আজকাল তার বুকে মাথা না রাখলেই ঘুমাতে পারিনা। সে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে তার মিষ্টি কন্ঠে ‘শ্যামাবতী’ ডাক না শুনলে ঘুম ভাঙ্গে না। ভার্সিটিতে বসে ক্লাস বাদ দিয়ে আনমনে তাকে নিয়ে ভাবতে থাকি। বিয়ের কতটা দিন কেটে গেলো আর আমি এখন নতুন নতুন প্রেমের জোয়ারে ভাসছি। রাহাত ও যেন আজকাল আমায় চোখে হারায়। তার কেয়ার, ছোট ছোট শাসন, কিছু আবদার এসব প্রমাণ করে সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। এইতো কিছুদিন আগের কথা। আমি তখন রান্নাঘরে রান্না করছিলাম। শনিবার থাকায় রাহাতের ছুটি ছিল সেদিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবদার করেছিল আমি যেন শাড়ি পড়ে আজ তার জন্য খিচুড়ি রান্না করি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

-‘খিচুড়ি রান্না করতে গেলে কি শাড়ি পড়া আবশ্যক?’

-‘না তবে বর চাইলে সেটা আবশ্যক। তুমি এখন সুন্দর করে আসমানী রংয়ের একটা শাড়ি পরবে। দুহাতে সোনার বালা পড়বে, কানের ছোট দুটি সোনার দুল পড়বে, নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল পড়বে, চুলগুলো হাতখোঁপা করবে। তারপর রান্নাঘরে রান্না করতে চলে যাবে। এটা তোমার বরের আবদার। আর বরের আবদার পূরণ করা স্ত্রীর দায়িত্ব। সো ডু ফাস্ট।’

কথাগুলো বলেই সে আবার ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিল। আমিও হালকা হেসে তার কথা মতই সেজে রান্নাঘরে রান্না করতে চলে গেলাম। আমার ননদের বিয়ে হয়ে গেছে বছরখানেক হলো। শাশুড়ি মা গ্রামেই বেশি থাকেন। তার নাকি শহরে আর মন টেকে না। তাই এত বড় বাড়িতে শুধুমাত্র আমরা দুই টোনাটুনি আর একটা কাজের মেয়ে থাকি। গরুর গোশ ভুনা, চিংড়ি মাছ ভুনা, বেগুন ভাজি আর খিচুড়ি এটা হচ্ছে আজকের মেনু। এই আইটেমগুলো রাহাতের খুবই পছন্দ। মাঝেমধ্যে তো সে নিজ হাতে রান্না করে আমাকে খাওয়াবে বলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here