অপর প্রান্তে,পর্ব-০১

গল্পঃ অপর প্রান্তে,পর্ব-০১
লেখাঃ হাবিবুর রহমান হাবিব

চুরি করার পর নিবির বড় ব্যাগটা কাধে নিয়ে জানালা দিয়ে বের হওয়ার সময় রুমের একপাশ থেকে একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেল-“আমাকে সঙ্গে নিয়ে নামুন।”

নিবির ভীষনভাবে হকচকিয়ে উঠলো। এখন সময় ভোর চারটার কাছাকাছি। এতো প্লানিং করে চৌধুরি বাড়িতে চুরি করা সেরে শেষমেষ এভাবে কারো চোখে ধরা পড়তে হবে তা একদমই প্রত্যাশা করেনি নিবির। কিন্তু ওর কাছে এখন মেয়েটার বলা কথাটা সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে। মেয়েটা ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার চেচামেচি না করে উলটো একি বললো! এই মূহুর্তে কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছে না নিবির। স্থির হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। হাতে থাকা টর্চলাইটটা মেয়েটার দিকে ফিরিয়ে দেখলো মেয়েটা খাটে বসে ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। ওর জানা মতে মেয়েটা চৌধুরী সাহেবের বড় মেয়ে।

মেয়েটা আবার বললো,
–আমাকে নিচে নামিয়ে না দিলে কিন্তু এখনই চিৎকার চেচামেচি শুরু করবো। তখন কিন্তু আপনার কপালে গনধোলাই কনফার্ম।

নিবির জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এখন কি করা উচিত কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না । মেয়েটা বললো,
–কি হলো! কিছু বলছেন না কেন? আমাকে শুধু নিচে নামিয়ে দিলেই হবে। আপনি কি মই এনেছেন?

–আ…আমিতো মই আনি নি।

–তাহলে আপনি কিভাবে দোতালায় আসলেন জানালা দিয়ে!?

— বড় পাইপটা বেয়ে উঠেছি।

–ও মা! তাই নাকি! কিন্তু আমিতো পাইপ বাইতে পারি না। তাহলে আমি কিভাবে নামবো?

–আপনাকে পাইপ বেয়ে নামতে হবে কেন!? আপনি তো দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই পারেন।

–দরজার চাবি তারা লুকিয়ে রেখেছে।

–মানে…!

–এতোকিছু আপনার জানতে হবে না। আপনি যেভাবেই হোক আমাকে নিচে নামান। নইলে কিন্তু আপনার খবর আছে।

–আপনি তো আমাকে মহা বিপদে ফেললেন দেখছি… আচ্ছা এক কাজ করুন। আপনি আমার পিঠে উঠুন, আমি পাইপ বেয়ে নামি। এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না আমি।

–বলেন কি!?…আমাকে কাধে নিয়ে নামতে পারবেন আপনি?

–আশা করি পারবো। এখন জলদি ডিসিশন নিন। আমাকে এখনই বের হতে হবে। প্লিজ আর সময় নষ্ট করবেন না।

নিবির জানালার পাশে পিঠ পেতে বসলো। মেয়েটা আস্তে আস্তে হেটে নিবিরের পিঠে উঠলো। মেয়েটা আবিরের সমবয়সী প্রায়। তাই ওজন সামলে পাইপ বেয়ে নামতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে নিবিরকে। একদিকে মেয়েটার ওজন অন্যদিকে একহাতে ঝোলানো বড় ব্যাগটার ওজন। মেয়েটার সারাশরীর কাপছে আর নিবিরের গলা খুব শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে। গলার চাপে নিবিরের দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। এদিকে মোটা পাইপটাও নড়ছে। ভেঙে পড়বে নাতো? আতংকে নিবিরের মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।

কোনোমতে হিমসিম খেয়ে মেয়েটাকে নিয়ে নিচে নামতে পারলো নিবির। কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিবির হাটা শুরু করলো। খেয়াল করলো মেয়েটাও ওর পিছে পিছে হাটছে। নিবির হাটা থামিয়ে বললো,

–আপনি আমার পিছন পিছন কেন আসছেন!? আমাকে যদি পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে চান তাহলে এখনই বলুন। আমি তাহলে কাধের ব্যাগটা আপনাকে দিয়ে দিব। আপনার বাসার সব জিনিস-পত্র, টাকা-গয়না এটাতেই আছে। শুধু শুধু নিজের সময় নষ্ট করবেন না আর আমাকেও বিপদে ফেলবেন না প্লিজ।

— আপনাকে ধরিয়ে দিতে চাইলে আগেই ধরিয়ে দিতে পারতাম। আপনি শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছেন কেন?

–আমি কথা বাড়াচ্ছি!? আপনি কেন আমার পিছে পিছে আসছেন? আর বাসা থেকেই বা কেন পালালেন? কারন কি?

–(বিরক্ত ভাবে) আপনি দেখি খুব বেশি কথা বলেন! এতো কেন জানতে ইচ্ছা করছে আপনার? আপনার কিছু যায় আসে নাকি?

–আমার কিছু যায় আসে না। শুধু এটুকু জানতে চাচ্ছি আপনি আমার পিছে পিছে কেন আসছেন?

মেয়েটা কিছুক্ষন চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপ থেকে বললো,
–আমি বলতে চাইছি যে… এখন আপনার কাছে নিশ্চয়ই আমার ল্যাপটপটা আছে। আপনি শুধু আমাকে ল্যাপটপটা আর দশ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় হন।

–এ কেমন কথা! এতো কষ্ট করে চুরি করা ল্যাপটপ আর টাকা আপনাকে কেন দিব আমি!?

–এখন যদি চিৎকার চেচামেচি শুরু করি তাহলে কিন্তু আপনার আম ছালা দুটোই যাবে। ভালোয় ভালোয় বলছি ল্যাপটপ আর টাকাটা দিন। আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। এমনিতেই আপনি আমাদের বাসার জিনিসপত্র চুরি করেছেন, তার উপর এমন আলগা ভাব কেন দেখাচ্ছেন যেন সেগুলো আপনার!?

–মহা বিপদে পড়লাম তো! টাকা চুরি করে পেয়েছি মাত্র একুশ হাজার, এতো কম টাকা এর আগে কখনও কারো বাসায় চুরি করে পাইনি। আর আপনি কিনা বলছেন সেখান থেকে দশ হাজার দিতে! অন্যদিকে গয়নাগাতিও তেমন একটা পাইনি। ব্যাগ ভর্তি শুধু ঘড়ি আর ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতি। সেগুলোর মধ্যে শুধু আপনার ল্যাপটপই অনেক দামি মনে হয়েছে, অ্যাপলের ল্যাপটপ বলে কথা। সেটাও দিয়ে দিতে বলছেন! তাহলে আমার এতো রিক্স নিয়ে চুরি করে লাভটা হলো কি!?

–ওরে বাবারে! কথার কি সাইজ! চুরি করার পরেও আপনার মুখে এতো বড়বড় কথা আসে কিভাবে!? ভালোয় ভালোয় বলছি ল্যাপটপ আর টাকাটা দিন, নইলে কিন্তু আপনার কপালে শনি আছে।

–টাকাটা না হয় দিলাম আপনাকে। ল্যাপটপটা না দিলে হয় না?

–ওটাই তো মেইন জিনিস যেটা লাগবে আমার। ওটা দিয়েই তো ফ্রিল্যান্সিং করে রোজগার করি আমি। ওটা ছাড়া কিভাবে কি!… আচ্ছা শুনুন, এটাই ফাইনাল ডিল- আপনি শুধু আমাকে ল্যাপটপটা দিন। টাকা দেয়া লাগবে না। আমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কোনো গার্লস হোস্টেলে উঠতে পারবো। কিন্তু একটা ভালোমানের ল্যাপটপ কেনার মতো টাকা এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই। তাই যেভাবেই হোক আমার ঐ ল্যাপটপটা লাগবেই। তাই শেষবারের মতো বলছি ল্যাপটপটা দিন, নইলে কিন্তু খবর আছে আপনার।

— এ কেমন কথা! এতো দামি ল্যাপটপ আমি কিভাবে দিয়ে দিই। আপনি তো জুলুম করছেন আমার সাথে।

–কি!? একি শুনলাম আমি! চোর হয়ে আপনি এতো বড় কথা কিভাবে বলতে পারলেন। আমার জিনিস চুরি করে বলছেন আমিই জুলুম করছি। দেখুন, আমার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর কথা বাড়ালে কিন্তু আপনার পরিনতি একদমই ভালো হবে না।

–আপনি একবার আমার দিকটাও বোঝার চেষ্টা করুন। এতো দামি ল্যাপটপ আমি কিভাবে হাতছাড়া করতে পারি! প্লিজ, ল্যাপটপটা বাদে অন্যকিছু চান।

–(প্রচন্ড রাগে) আপনি কিন্তু… আচ্ছা শেষবারের মতো বলছি, আমি ল্যাপটপটা শুধু একমাসের জন্য নিয়ে আপনাকে ফেরত দিয়ে দিব। আপনি আপনার ঠিকানাটা বলুন সময় মতো পৌছে দেবো।

–এ কি বলছেন আপনি! আপনাকে চিনিনা জানিনা, অথচ ল্যাপটপ দিয়ে ফেরত পাবার আশায় বসে থাকবো! এ কি করে হয়!… আচ্ছা শুনুন, প্লিজ রাগ করা থামান, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আমার বাসায় আমার মা আর ছোট বোন থাকে। আমি থাকি বন্ধুর মেসে। আপনি এক কাজ করুন, আমার বাসায় উঠে যান। এতে আপনার বাড়িভাড়াও লাগবে না, আর ল্যাপটপের সমস্যাও সল্ভ। শর্ত একটাই, আপনার খাওয়া-দাওয়ার খরচ আপনাকেই দিতে হবে। আমার ছোটবোন সবসময় ল্যাপটপটা চোখে চোখে রাখবে। আপনি কি রাজি?

— আপনার কি মাথা ঠিক আছে!? আমি এতো রাতে আপনার সাথে আপনার বাসা পর্যন্ত যাবো এটা আপনি ভাবলেন কি করে! আমাকে বোকা পেয়েছেন!? আপনি যদি কোনো নির্জন জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়ে…

–(বিরক্ত গলায়) দেখুন, আপনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। চোর বলে আপনি আমাকে বারবার অপমান করেই যাচ্ছেন। চুরি করেছি বলেই আপনার কি মনে হয় আমি ওরকম কেউ!… আচ্ছা শুনুন, আমার বাসা বাজারের সামনেই। এখান থেকে সেপর্যন্ত পুরো রাস্তা জুরে বাসাবাড়ি ভরা। সুতরাং, যেকোনো সময় আপনি চিৎকার চেচামেচি করে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারেন। প্লিজ , একটু বোঝার চেষ্টা করুন। বেহায়াপনা করার মতো মানুষ আমি না, আর এই যুগে বেহায়াপনা করে ফাঁসিতে ঝোলার শখও নেই আমার।

মেয়েটা কিছুক্ষন আড় চোখে তাকিয়ে থাকলো নিবিরের দিকে। এরপর মেয়েটা বললো,
–(গম্ভীর গলায়)আচ্ছা ঠিক আছে, কি আর করার। চলুন। আমার থেকে দশ হাত দূরত্ব রেখে হাটবেন।

নিবির হাটা শূরু করলো। মেয়েটা ওর পিছে পিছে হাটছে।ওদের মাঝে দূরত্ব দশ হাত না হলেও তিন চার হাত তো হবেই। একসময় একটা ওয়াল-টিনসেট বাড়ির সামনে এসে থেমে নিবির দরজা ধাক্কিয়ে বললো –“সোমা, দরজা খোল”। নিবিরের বোন সোমা এসে দরজাটা খুলে নিবিরের পিছনে মেয়েটাকে দেখে উদ্ধিগ্ন কন্ঠে বললো,”উনি কে?” নিবির বললো,”চৌধুরি সাহেবের বড় মেয়ে।”

সোমা অবাক চোখে মেয়েটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে নিবির বললো,
–ভূত দেখলি নাকি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? যা, ওনাকে ভেতরে নিয়ে যা। আজ থেকে একমাস উনি আমাদের বাসায় থাকবেন। ধরে নে উনি আমাদের বাসার ভাড়াটিয়া। এখন আর কোনো প্রশ্ন করিস না? সব ব্যাখ্যা পরে দেবো।

নিবির ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করে মেয়েটার দিকে বাড়ালো। মেয়েটা কঠিন মুখ করে ল্যাপটপটা হাতে নিলো। নিবির সোমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–ওনার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না। সেটার খরচ উনি নিজেই সামলামে। উনি যা ইচ্ছা তাই করুক কিন্তু খেয়াল রাখবি উনি যেন কখনো ল্যাপটপ নিয়ে বাসা থেকে না বের হয়। ঐ ল্যাপটপটার উপর সবসময় কড়া নজর রাখবি। বুঝেছিস?

সোমা মুখ ভেংচি দিয়ে মেয়েটার দিকে এগোলো। মেয়েটা নিবিরের কথা শুনে অনেকটা রাগী মুখে তাকিয়ে আছে। সোমা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরে ভিতরের রুমে যেতে লাগলো। নিবির সোমার উদ্দেশ্যে বললো,

— দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যা। আজকের মিশন কম্পিট। এখন আমি চললাম।
—————-
সোমা মেয়েটাকে নিয়ে ওর রুমে নিয়ে এলো। সোমা বললো,

–আপনি কি সত্যিই চৌধুরী সাহেবের বড় মেয়ে? ভাইয়ার সাথে কেন এসেছেন জানতে পারি?

মেয়েটা কোনো কথা বললো না। সোমা বললো,
–আপনি মনে হয় এখন ক্লান্ত। কথা না বলতে চাইলে সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করবো না। আপনি তাহলে আজ থেকে এই রুমেই ঘুমাবেন। আমি পাশের রুমে ঘুমাই, মায়ের সাথে। মা কিছুদিন ধরে বেশ অসুস্থ, তাই ওনার সাথেই ঘুমাচ্ছি কিছুদিন যাবত। আমি মশারিটা টানিয়ে দিচ্ছি, কিছু লাগলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।

মশারি টানানোর পর সোমা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–ল্যাপটপটা কি রাতে আপনার কাছেই থাকবে নাকি আমি রাখবো?

মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। সোমা আর কিছু না বলে মেইন দরজায় তালা লাগিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো। মেয়েটা পাশের টেবিলে ল্যাপটপটা রেখে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। চোখ মেলে ভাবছে,’ কাজটা কি ঠিক করলাম? একটা চোরের বাসায় এসে উঠতে হলো শেষমেষ! হায়রে কপাল! এখন কি করা যায়? এ বাসায় একমাস টিকে থাকা আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। যেভাবেই হোক ল্যাপটপটা নিয়ে এখান থেকে বের হতে হবে। সকাল হোক, দেখা যাক কি করা যায়।’
———-
নিবির বন্ধুর মেসে এসে তাস খেলছে। কিন্তু খেলায় তেমন মন বসছে না। মাথায় ঐ মেয়েটার চিন্তা ঘুরঘুর করছে। ভাবছে, ‘মেয়েটা কেন ওর বাসা থেকে পালালো? ওকে বাসায় উঠিয়ে বোকামি করিনি তো?আমার বাসার আশেপাশের লোকজন কি বলবে ওকে দেখলে? মেয়ের ব্যাপারে তাদেরকে কি বলবো? বাসায় যদি পুলিশ আসে তাহলে!? খাল কেটে কুমির আনলাম নাতো!? মেয়েটা তো বাসা পালানোর ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চায় না। কি করা যায় এখন? এখনো তো মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানা হলো না আমার, এমনকি নামটাও না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here