শেষ প্রহর,পর্বঃ০১

শেষ প্রহর,পর্বঃ০১
জাহান আরা

রাত বারোটার দিকে মা আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলছে,” তাড়াতাড়ি রেডি হ,তোর বিয়ে একটু পর”

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,কি হচ্ছে এখানে???
আমার বিয়ে মানে কি!!!
ঘুম থেকে উঠলে ২ মিনিট লাগে আমার বুঝতে আমি কে,কোথায় আছি??

আস্তে আস্তে মনে পড়লো আমি আছি এখন আমার খালাতো বোন সুলতানার শ্বশুর বাড়িতে।বিরাট বড়লোক ওনার শ্বশুর বাড়ির মানুষ।
কিন্তু আমার বিয়ে এই মাঝরাতে কেনো???
আর এই বাড়িতে থেকে কেনো হবে বিয়ে,বিয়ে হতে হলে আমাদের বাড়িতে হবে।মা-ই বা এখানে আসলো কখন??
আমি তো মা’কে ঘুমানোর আগে দেখি নি এই বাড়ি।

আর সবচাইতে বড় কথা,কার সাথে আমার বিয়ে???
আমাকে কেউ দেখতে আসে নি,কোনো কথাবার্তা নেই,হুট করেই বিয়ে কেনো???

চোখ থেকে এখনো ঘুমের রেশ কাটে নি।মাথা খানিকটা এলোমেলো লাগছে আমার।কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না।পায়ে খুব ব্যথা করছে কেটে যাওয়া জায়গা টা।

বাহিরে পূর্ণ চাঁদের আলোয় সব আলোকিত,মৃদু বাতাস,কি সুন্দর প্রকৃতি!!!
অথচ আমার মনের ভিতর কিসের ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমি জানি শুধু,মেয়ে হয়ে জন্মালাম বলে এই প্রথম খুব আফসোস হচ্ছে আমার।

এই পর্যন্ত লিখে চন্দ্র ডায়েরি বন্ধ করলো।জীবনের বিশেষ দিনগুলোতে সে ডায়েরি লেখে,তবে মনে মনে সেটা।

একটু পর সুলতানা রুমে এলো,সুলতানা চন্দ্রর খালাতো বোন,বড় খালার মেয়ে।
বড় খালার সচ্ছল পরিবার,খালু সরকারি চাকরিজীবী।একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
আর চন্দ্ররা???
চন্দ্রর বাবা নেই,দুই বোন।
মা আছেন শুধু।বাবা ছাড়া একটা পরিবার যেভাবে চলার ঠিক সেভাবেই চলে।চন্দ্র আর অনিতা দুজনেই টিউশনি করে,মা একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে এটা যে সুলতানা,চন্দ্র,অনিতা দেখতে একইরকম।
যে কেউ দেখলেই বলবে ওরা ৩ বোন।হয়তো মা খালা একই রকম দেখতে হওয়াতে ওরা এমন।

সুলতানা বিয়ের শাড়ি,ব্লাউজ,গহনা এনে চন্দ্রকে পরতে বললেন।
কিন্তু চন্দ্র নড়াচড়া করছে না।

সুলতানা কি ভেবে চন্দ্রর পাশে এসে বসেন।চন্দ্রর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,মন খারাপ করিস না,আমি তোর খারাপ জায়গায় বিয়ে দিবো না।

আপার কথা শুনে চন্দ্র দ্বিতীয় বারের মতো চমকায়।তারমানে তার এই বিয়ের ব্যবস্থা আপা করেছে,কিন্তু কেনো???

ব্যক্তিগতভাবে চন্দ্র সুলতানা আপা কে অপছন্দ করে,কিন্তু কি একটা অজানা কারণে সুলতানা ওদের দুই বোন কে প্রচুর ভালোবাসে।তবে চন্দ্রর মা’কে খুব অপছন্দ করে।মা’র সাথে আপার ক্যাটক্যাটে কথা চন্দ্রর সহ্য হয় না,এটাও হয়তো সুলতানা কে অপছন্দ করার একটা কারণ। বড়লোক বাড়ির বৌ,সচ্ছল পরিবারের মেয়ে হলে হয়তো মানুষ সুলতানা আপার মতোই দেমাগি হয়।

কিন্তু চন্দ্র আর অনিতার সাথে অন্যরকম। হয়তো নিজের বোন নেই বলে ওদের সাথে মিশতে চায়

অনিতা যদিও সুলতানার সাথে সহজে মিশতে পারে চন্দ্র পারে না।

চন্দ্রর এখন ও কিছুই মাথায় ঢুকছে না।তাই আপাকে জিজ্ঞেস করলো,”কার সাথে আমার বিয়ে??”

“বিয়ের সময় জানতে পারবি কার সাথে বিয়ে।এখন এগুলো পরে নে।”

“আপা,আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না,আমি মাত্র অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি আপা,এখন বিয়ে মানে মা’র উপর কতো চাপ,মেহমান,আত্মীয় স্বজন।
আমার পড়ালেখা ও বন্ধ হয়ে যাবে,আমি পড়ালেখা করতে চাই,মা’য়ের জন্য কিছু করতে চাই আপা।”

“তোকে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।চুপচাপ রেডি হ,নাকি তোর পছন্দের কেউ আছে???”

“আমরা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে,আমাদের পছন্দের মানুষ থাকাটা বিলাসিতা। সেসবের বালাই আমার নেই আপা।”

“তবে রেডি হ,পাত্র অপেক্ষা করছে তোর জন্য। ”

কি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে চন্দ্র সে নিজেও জানে না। অথচ বিয়ে নিয়ে তারও কতো স্বপ্ন ছিলো।লেখাপড়া করবে,বড় হবে,জার্মানি তে পড়তে যাওয়ার খুব শখ ছিলো চন্দ্রর।নিজে চাকরি করবে,তারপর মধ্যবিত্ত একজন মানুষ কে বিয়ে করবে।
অবশ্য নিজের বিয়ের আগে অনিতা কে বিয়ে দিবে।
অনিতার বিয়ে খুব ধুমধামে দিবো,যাতে ওর মনে কোনো আফসোস না থাকে যে বাবা থাকলে তার বিয়ে ধুমধামে দিতো।

একজীবনে সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হবার না।চন্দ্রর কপালে কি রেখেছে আল্লাহ তা চন্দ্র জানতো না। বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
স্বপ্নগুলো সব বুকের ভিতর চাপা পড়ে যাচ্ছে,পা বাড়াচ্ছে চন্দ্র এক অন্ধকার জীবনের দিকে।

নিষাদ স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে জানালার গ্রীল খোলার চেষ্টা করছে,যে করেই হোক তাকে পালাতে হবে।আজ তার বিয়ে,অথচ সে এই বিয়ে করতে চাচ্ছে না।তার ভালোবাসার মানুষ আছে,সে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।
মা,বাবা,ভাই,ভাবী সবাইকে বলা শেষ কেউ তার কথা শুনছে না।সবার এক কথা,সুস্মিতা ভালো মেয়ে না।

অথচ নিষাদ জানে সুস্মিতা তাকে কতো বেশী ভালোবাসে। সুস্মিতা কে ছাড়া অন্য কাউকে নিষাদ ভাবতেই পারে না।

সব স্ক্রু খোলা শেষ এবার তিনতলার পানির পাইপ বেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার পালা,গ্রীল সরিয়ে বাহিরে নামতে যাবে,তাকিয়ে দেখে জানালার নিচে বড় ভাই নিশান দাঁড়িয়ে আছে।

নিশান এখানে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিবে তা নিষাদের ধারণা তে ছিলো না।

নিচ থেকে নিশানের গলা শোনা যায়।

“যতোই চেষ্টা করিস নিষাদ,পালাতে পারবি না,তোর ভাবী টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে,বুঝছিস নিষাদ,তোর ভাবীর সব কাজ পূর্বপরিকল্পিত।কিভাবে কিভাবে যেনো সব বুঝে যায়,সিক্সথ সেন্স খুব ভালো মেয়েটার,আমার আবার কোনো সেন্সই নাই,আই লাইক হার”

নিষাদের মেজাজ আরওখারাপ হয়ে যায় ভাইয়ের এসব ফালতু বকাবকি শুনে, মাথার রগ রাগে দপদপ করছে।একটা উপায় নেই তার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। নিজের গালে নিজের থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে তার।কেনো সন্ধ্যায় এমন একটা বোকামি করে ফেললো সে।

সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে সবাই টিভি দেখছে,ভাবীর খালাতো বোন চন্দ্র সবার জন্য ঝালমুড়ি মাখিয়ে এনেছে।ভাবীর প্রেগন্যান্সির পর চন্দ্রকে ভাবী নিয়ে আসে তার দেখাশোনা করার জন্য।
কথার ফাঁকে ফাঁকে ভাবী সুস্মিতার কথা তুললো,নিষাদকে বারবার বুঝালো সুস্মিতার সাথে আমাদের যায় না নিষাদ,সুস্মিতা একজন মডেল,বাবা মা’র পছন্দ না,আমাদের ও না।তুমি ওর আশা ছেড়ে দাও।লেখাপড়া শেষ এবার কোম্পানি দেখাশোনা করো বাবার বয়স হয়েছে।

আমি এসব পারবো না ভাবী,ভাইয়াকে বলো আর যাতে আমেরিকা না যায়,ভাইয়া সব দেখাশোনা করবে,আর সুস্মিতার ব্যাপারে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আমি সুস্মিতা কে ছাড়তে পারবো না কিছুতেই।

তোমার ওকে ছাড়তে হবে নিষাদ,এটা আমদের পরিবারের মান সম্মানের প্রশ্ন,বাবা মায়ের ওকে পছন্দ না।

ভাবীর কথা শুনে নিষাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো,চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে,ভাঙা কাঁচের একটা টুকরো গিয়ে চন্দ্রের পায়ে বিঁধে। মুহুর্তেই রক্তাক্ত হয়ে যায় ড্রয়িং রুমের কার্পেট।

যেনো কিছুই হয় নি,কোনো ব্যথা পায় নি,এরকমভাবে শান্ত হয়ে চন্দ্র দাঁড়িয়ে থাকে।
চন্দ্রর পা কেটে গেছে দেখে সুলতানা চিৎকার করে উঠে,সুলতানার দুচোখ জলে ভরে যায়।
নিষাদ কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যায়।

চন্দ্র সুলতানা কে শান্ত করে টান দিয়ে পা থেকে ভাঙা কাঁচ টেনে বের করে আনে।সুলতানা তাকিয়ে দেখছে কতো অবলীলায় চন্দ্র এই কাজ করছে যেনো কোনো সমস্যাই না এটা।

সুলতানার বুকের ভিতর কেমন হুহু করে উঠে,চন্দ্র কেনো এতো কঠিন,কেনো তার কোনো আবেগ নেই,অনুভূতি নেই,অভাব কি মানুষকে এভাবে বদলে দেয়??
আবেগশূন্য করে দেয়???

নিষাদ কে কয়েকটা কথা শুনানোর জন্য সুলতানা নিষাদের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
নিষাদের রুমের বাহিরে এসেই শুনতে পায় নিষাদ ফোনে কথা বলছে কারো সাথে।

অন্যায় জেনেও সুলতানা আড়ি পেতে শুনে।

“আমি যা বলছি তাই হবে সুস্মিতা,আমার বাড়ির লোক পাগল হয়ে গেছে,ওরা কিছুতেই চায় না আমাদের বিয়ে হোক।”

—————

“আমি রিস্ক নিতে চাই না,জীবনে বিয়ে একবারই,সেটা আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে করতে পারবো না।”

—————

“কাল সকালে রেডি হয়ে থেকো,আমরা পালাবো সুস্মিতা,আমি আর দেরি করতে চাই না।একবার বিয়ে করে ফেললে তখন আর কেউ মেনে না নিয়ে পারবে না,হয়তো দেরি হবে,দুয়েক বছর আমাদের দূরে রাখবে,এরকম ১০ বছর পায়ের উপর পা তুলে খাওয়ার মতো টাকা আমার একাউন্টে আছে।”

এটুকু শুনেই সুলতানা সরে আসে। নিচে নেমে একটা দুটো তালা নিয়ে আবার তিনতলায় আসে,নিষাদের দরজার বাহির থেকে তালা লাগিয়ে দেয়।
চন্দ্র কে ছাড়া কাউকে সে এ বাড়ির দ্বিতীয় বৌ
হতে দিবে না।

১২ টার দিকে নিশান কল দিয়ে নিষাদকে বলে রেডি হতে, আজকে রাতেই তার বিয়ে হবে।নিষাদ তখনই বুঝে যায় তার কথা কেউ শুনে ফেলেছে।

রুমের সব কিছু নিষাদ ভেঙে ফেললো রাগের মাথায়।সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।নিষাদ নিজেও জানে না কার সাথে ওর বিয়ে হবে।নিজেকে খুব অসহায় লাগছে,কয়েকবার কল দিয়েছে সুস্মিতা কে,কিন্তু ওর ফোন বন্ধ।বন্ধুদের কল দিয়েছে কিন্তু কেউই ওকে সাহায্য করতে চায় না,সুস্মিতা কে ওর বন্ধুমহলে কেউ পছন্দ করে না।

সবার ধারণা এরকম কেনো নিষাদ বুঝতে পারে না।মডেল হলেই কি একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায়??
কাউকে সে বুঝাতে পারে নি।

সুলতানা জোর করে চন্দ্রকে সাজিয়ে দিলো,চন্দ্র কেমন বিরস মুখে বসে আছে।অথচ চন্দ্রের রূপ চন্দ্রের মতো।সুলতানা নিজেও কম রূপবতী না।চন্দ্রর ভালোর জন্যই সুলতানা এরকম করছে।অনিতা বসে আছে চন্দ্রর পাশে,অনিতার খুব কান্না পাচ্ছে,বোনকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই অনিতার বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। চন্দ্র কে ছেড়ে থাকা তার জন্য খুব কঠিন।

নিশান,নিশানের বাবা তোজাম্মেল চৌধুরী নিষাদের রুমে যায়।তালা খুলে নিষাদকে নিয়ে নিচে আসে।চুপচাপ পাঞ্জাবি পরে নিষাদ নিচতলায় আসে।পকেটে ওয়ালেট আর ফোন নিতে ভুলে না।
নিচতলায় এতো মানুষ দেখে নিষাদ অবাক হয়ে যায়,এতো মেহমান কখন এলো,বাহিরে ক্যাটারিং সার্ভিস ও আছে,রান্নাবান্না হচ্ছে।নিষাদ বুঝতেই পারে নি এতো আয়োজন হচ্ছে তার বিয়ের।নিষাদের কোনো দিকেই খেয়াল নেই কে কি বলছে তাকে,সে সুযোগ খুঁজতে থাকে পালানোর।

আচমকা নিষাদ পালানোর সুযোগ পেয়ে যায়,পকেটে হাত দিয়ে দেখে সব আছে কি-না। সুযোগ বুঝে এক দৌড় দেয় বাসা থেকে গেটের দিকে।কেউ টের পায় না পাত্র পালিয়ে যাচ্ছে যে……….

চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here