শেষ_প্রহর,পর্বঃ ০২,০৩

শেষ_প্রহর,পর্বঃ ০২,০৩
জাহান আরা
পর্বঃ ০২

সুলতানা চন্দ্রকে নিয়ে নিচে নেমে আসে।সুলতানা আর চন্দ্রর পিছন পিছন আসছে অনিতা।উপস্থিত সবাই তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো একজন অন্যজনের কার্বন কপি।কি অদ্ভুত মিল তিনজনের চেহারায়।

সুলতানার মা সুরাইয়া বেগম,চন্দ্রর মা শায়লা আর সুলতানার শাশুড়ী নাসিমা বেগম বসে বসে কথা বলছেন।শায়লা বেগমের দম আটকে আসছে,এভাবে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে কখনোই ভাবেন নি তিনি,আর এতো বিরাট বড়লোকের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো।কার ভাগ্য কোথায় লিখা আছে কেউ জানে না।

নিচে এসেই সুলতানা জিজ্ঞেস করে,”নিষাদ এখনো আসে নি,এখনো রেডি হওয়া হয় নি ওর?”

নিষাদের নাম শুনে চন্দ্রর আত্মারাম বের হবার জোগাড়। শেষমেশ নিষাদের সাথে আপা ওর বিয়ে ঠিক করেছে,যে কি-না ভালোবাসে সুস্মিতা নামের একটা মেয়েকে।

আপা কিভাবে এই কাজ করলো আমার সাথে?
কিছুতেই ভেবে পায় না চন্দ্র।

বাহিরে থেকে একজন পুলিশ অফিসার নিষাদকে নিয়ে ভিতরে আসে।
ভাবী যে বাড়িতে পুলিশ গার্ডের ব্যবস্থা করেছে নিষাদের ভাবনা তে ও ছিলো না।

নিষাদ কে দেখে সুলতানা মুচকি হাসে।

নিশান এগিয়ে গিয়ে নিষাদ কে বলছে,”বলেছিলাম না তোর ভাবীর সব কাজ গুছানো,সি ইজ ভেরি স্মার্ট,আই লাইক হার”
নিষাদ হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লো।

চন্দ্রর পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এখনো, কেনো নিষাদের সাথেই তার বিয়ে!

অনিতার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে চন্দ্র,একটু পরে তার কুরবানি হয়ে যাবে,স্বেচ্ছায় তাকে মেনে নিতে হবে সব।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে লাগলো। চন্দ্রকে কবুল বলতে বলা হচ্ছে,চন্দ্র ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখতে পারছে না সে।চোখের সামনে সব আবছা লাগছে,তার মাথায় ঢুকছে না কিছু।
কবুল বলার মুহূর্ত কেনো এতো কঠিন!
চন্দ্রর জানা নেই।

নিষাদ মনে মনে দোয়া করছে যাতে চন্দ্র কবুল না বলে,চন্দ্রর দিক থেকে যাতে ভেঙে যায় বিয়েটা।
কোনো মতে যেনো চন্দ্র কবুল না বলে।

সুলতানার ধাক্কায় হুশ এলো চন্দ্রর,অস্ফুটস্বরে কবুল বললো।

নিষাদের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো সাথে সাথে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবুল বলতে হলো তার।এক মুহূর্তে তারা সামাজিক নিয়মে একে অন্যের হয়ে গেলো অথচ মন থেকে তাদের যোজন যোজন দূরত্ব।প্রতিদিনই বিয়ে হয়,কিন্তু মনের সাথে মনের বিয়ে ক’জনার হয়??
তবুও বেঁচে থাকে মানুষ অদেখা এক সমাজকে ভয় করে।

নিষাদ কবুল বলার সাথে সাথে সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিশান হাজার চেষ্টা করছে কিন্তু সুলতানা কে থামাতে পারছে না।সুলতানার কান্নার কারন কেউ জানে না,সুলতানার মা আর চন্দ্রর মা ও কি ভেবে যেনো চোখ মুছছেন।
বিয়ে হওয়ায় কান্নার কথা ছিলো চন্দ্রের,সেখানে সুলতানার এমন কান্না দেখে তার ও কান্না থেমে গেছে,নিষাদ এতোক্ষণ সুলতানার উপর যে রাগ নিয়ে ছিলো মুহূর্তে সেটা উধাও হয়ে গেলো।

কি এমন কষ্ট হচ্ছে সুলতানার?

নিশান সুলতানা কে মানানোর জন্য সব করছে কিন্তু সুলতানা থামছে না।

“সুলতানা,আমাকে বলো কি হয়েছে তোমার,কেনো এতো কাঁদছো???
আচ্ছা,এটা বলো কি করলে তোমার কান্না বন্ধ হবে??”

“তুমি আগামীকালের টিকিট কাটো,আমি তোমার সাথে আগামীকাল-ই ইউএসএ চলে যাবো,এটাই আমার শেষ কথা। ”

সুলতানার এরকম কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে,হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কেউ বুঝতে পারছে না।
সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে নিষাদ,ভাবীকে ছেড়ে তার থাকার অভ্যাস নেই,ভাবী তার বোনের মতো।তার কখন কি দরকার সেটা সে নিজেও জানতো না,ভাবী সব ঠিকঠাক করে দিতো।
সুলতানা রুমে চলে গেলো,মেহমানরা যারা থাকার তারা তাদের রুমে চলে গেলো।

নিষাদ আর চন্দ্রকে ওদের রুমে এনে দিয়ে গেছে নিষাদের বন্ধু রা।যাবার সময় বলে গেছে,ভয় পাস না,আমরা আশেপাশে আছি,কোনো টিপস দরকার হলে কল দিস আমাদের,প্রয়োজনীয় সব কিছু তোর টেবিলে রাখা আছে”

বলেই হাসা শুরু করলো সবাই,লজ্জায় চন্দ্রর ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যেতে।
নিষাদ চোখ বড় করতেই সবাই চলে গেলো নিচের দিকে।

এতোক্ষণ সবার সামনে থাকায় নিষাদ সুস্মিতা কে কল দিতে পারে নি। নিষাদের প্ল্যান এখনো আছে পালিয়ে যাওয়ার। আগামীকাল পালিয়ে যাবে,তারপর চন্দ্রকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।

নিষাদের সব প্ল্যান ভেঙে দিবে সুস্মিতা তা নিষাদ ভাবতে ও পারে নি।
চন্দ্র রুমে এসে শাড়ি খুলে সুতি একটা শাড়ি পরে নিলো।নিষাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,সুস্মিতার টেক্সট পড়ছে।

“নিষাদ,আমার এখন ক্যারিয়ারের শুরু,আমি এই মুহূর্তে তোমার সাথে পালিয়ে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার এখানে শেষ করে দিতে পারবো না,আমাকে মাফ করে দিও,আমি অনেক বড় মডেল হতে চাই,ভালোবাসা,প্রেম জীবনে অনেক আসবে মডেল হতে পারলে,তোমার মতো হাজার হাজার নিষাদ এসে পায়ে লুটিয়ে পড়বে,কিন্তু এখন ক্যারিয়ার শেষ করে দিলে জীবনে কিছুই পাবো না।আমাকে আর কল দিও না,বিয়ে করে নিও তাতেই ভালো”

সুস্মিতার এই মেসেজে নিষাদের পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেলো। নিষাদ চোখে অন্ধকার দেখছে হঠাৎ করেই। কিছুতেই ভাবতে পারছে না সুস্মিতা এরকম করতে পারে। এভাবে তার বিশ্বাস ভেঙে দিবে তা তার ভাবনাতে কখনো ছিলো না।
নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিষাদের,জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষের মতো লাগছে।এতো কষ্ট কেনো জীবনে?
বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে আসছে,নিশ্বাস ফেলতে পারছে না নিষাদ,চোখে ও দেখছে না।কোনোরকমে নিজেকে টেনে এনে সোফায় উপুড় হয়ে শুতে গেলো,সোফায় শুতেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে তার।

নিষাদ এসে চন্দ্রর গায়ের উপর পড়তেই চন্দ্র চিৎকার করে উঠে।চন্দ্রর চিৎকার শুনে নিষাদ চন্দ্রর মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে।

নিষাদের বন্ধুরা সবাই রুমের বাহিরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো,চন্দ্রর চিৎকার শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো।
একজন বাহির থেকে বলে উঠলো,”বন্ধু ফার্স্ট টাইম,একটু সাবধানে করতে হবে সব কিছু”

চন্দ্র লজ্জায় লাল হয়ে গেলো,নিষাদ কথা বলার শক্তি ও পাচ্ছে না।ক্লান্তিতে,অবসাদে তার শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। তারপর ই নিষাদ জ্ঞান হারালো।

বাহির থেকে নিষাদের বন্ধুরা ডেকে বলছে,”বন্ধু কাজের সাথে সাথে আমাদের সাথে একটু কথাবার্তা চালিয়ে যা”
বলেই বাহিরে আবার হাসির রোল পড়ে গেলো।

নিচ থেকে সবাই শুনছে হাসাহাসি উপরে হাসাহাসি হচ্ছে,৩ তলা পুরো টা নিষাদ আর ওর বন্ধুদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন নিষাদের বাবা,নিষাদের বাবার মনটা ভালো হয়ে গেলো,বন্ধুরা হাসাহাসি করছে তারমানে নিষাদ ও খুশী আছে।

চন্দ্র নিষাদের এরকম ব্যবহার নিতে পারছে না। চাপা গলায় বললো,”আমার উপর থেকে উঠুন,আমি ব্যথা পাচ্ছি”

বাহির থেকে নিষাদের বন্ধুরা আবার ডেকে বললো,”ভাবী ফার্স্ট টাইম এরকম হবেই,ঠিক হয়ে যাবে,একটু সামলে নিন,হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় নিষাদকে আমরা ট্রেনিং দিতে পারি নি”

চন্দ্র করুণ চোখে নিষাদের দিকে চাইলো,নিষাদের বন্ধুদের জন্য কোনো কথা-ই বলা যাচ্ছে না।
ওদিকে নিষাদ ও নড়াচড়া করছে না,গায়ের উপর সেই যে পড়েছে,চন্দ্র নিষাদ কে সরাতে পারছে না কিছুতেই।

বাহির থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,”ভাবী কথাবার্তা যা বলার ইশারা,ইঙ্গিতে বলে নিন আজকের রাত,ওরা আপনাদের রুমে মাইক্রোফোন লাগিয়েছে সব শোনার জন্য”

অন্যরা সবাই কথা বলা লোকটার উপর রেগে গেলো বলে দেয়াতে,বাহিরে রাগারাগি,হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে।

চন্দ্র ভেবে পাচ্ছে না এখন তার কি করা উচিৎ?

কথা বললে বাহির থেকে ওরা সব শুনতেছে,কথা না বললে আবার নিষাদকে সরাতে পারবে না,রাত দুটো বেজে গেছে,ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে চন্দ্রর।

শাড়ি বদলে সোফায় এসে শুয়েছিলো চন্দ্র,নিষাদের বিছানায় শোবে না বলে,নিষাদ ও যে সোফায় এসেই পড়বে সেটা কে জানতো!

একসময় চন্দ্রও ঘুমিয়ে পড়লো।

সুরাইয়া বেগম আর শায়লা বেগম এক রুমে শুয়েছে,কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।কোনো এক অজানা কারণে দুজনেই কেঁদে যাচ্ছে।
শায়লা বেগম কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।তার বুক ছিঁড়ে যেনো কেউ তার কলিজা নিয়ে গেছে।
জীবনে তো কতো কিছুই হারালেন তিনি,তবু কেনো এখনো হারানোর ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলছে তা-ই ভেবে পাচ্ছেন না।

সুরাইয়া বেগম রুমের এপাশ ওপাশ করছেন।তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না।কেনো মেয়ে চলে যাবে তাকে ছেড়ে,মেয়ের এতো অভিমান কেনো?
জেনেও তিনি অবুঝের মতো কাঁদছেন।মেয়েকে ছেড়ে থাকা তার জন্য অনেক কষ্টের তা তো মেয়ে জানে তবু কেনো এতো অভিমান। তিনি তার আদর ভালোবাসা দিয়ে কি মেয়ের অভিমান দূর করতে পারেন নি আজও!!!

সুলতানা নিশান কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। নিশান সুলতানার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।মেয়েটাকে তার কাছে আজও ছোট বাচ্চার মতো লাগে।
সবার সামনে কি রাগী একটা মানুষ,যা বলে তাই করে,ভাঙবে তবু মচকাবে না,সেই মেয়েটাই একা হলে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।
কি নিষ্পাপ একটা মুখ,শান্ত দিঘির মতো চোখ,যেনো একটু বাতাস এলেই চোখের জল চলে আসবে!

এই মেয়েটার জীবনে ও কতো কষ্ট আছে,তা নিশান জানে শুধু। অথচ অন্য কেউ দেখলে বুঝবেই না সেটা।নিজের প্রাণের বিনিময়ে যদি পারতেন তার বৌ টাকে খুশী করতে।

সুলতানা নিরবতা ভেঙে কথা বললো,”আমার বাবুটার যদি আমার মতো কপাল হয় নিশান?”

“ছিঃ কি বলছো এসব,কিছু হবে না পাগলী।”

“আমার মন কু ডাকছে নিশান,আমি জানি আমার বাবুর কপাল আমার মতো হবে,জানো তবু আজকে আমি স্বস্তি পাচ্ছি,চন্দ্র আছে বলে”

“এখন কথা বাদ দিয়ে ঘুমাও লক্ষ্মী মেয়ের মতো,আমি জড়িয়ে ধরে রাখছি”

সুলতানা কথা না বাড়িয়ে নিশান কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে। তার শরীর খুব ক্লান্ত ছিলো।
নিশান টের পায় ঘুমের মাঝেই সুলতানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

আশ্চর্য হয় নিশান,সুলতানার কষ্টে তার বুকের ভিতর তোলপাড় করে,যদিও আশ্চর্য হওয়ার কথা না,এটা সুলতানার পুরোনো অভ্যাস,তবুও এতোদিনেও নিশান এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত হতে পারে নি,প্রতিবার সুলতানার কান্নার সাথে তার ও বুক কেঁপে উঠে। ইচ্ছে করে তখন সুলতানা কে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে তার।

ঘুম ভাঙে সকালে নিষাদের,রুমে লাইট অন করা,চোখ মেলতেই দেখতে পায় সে চন্দ্রর বুকের উপর শুয়ে আছে। চন্দ্রর শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে,বুকের উপর থেকে নিচে শাড়ি পড়ে আছে।

চলবে???

#শেষ_প্রহর
পর্বঃ০৩
জাহান আরা

নিষাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চন্দ্রর দিকে,তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হচ্ছে এই মেয়ে এক সময় তার কেউ ছিলো না অথচ আজ মেনে না নিলেও সামাজিক রীতিমতো সে তার বৌ,তার সব দায়িত্ব এখন থেকে নিতে হবে তাকে,তার হাসি কান্না আনন্দ বেদনা সব কিছুর খেয়াল তাকে রাখতে হবে।

অথচ গল্পটা অন্যরকম হবার কথা ছিলো,এই অচেনা মেয়েটার জায়গায় আজ সুস্মিতার থাকার কথা ছিলো।আজ তাদের বাসর রাত ছিলো,এই রাতে সুস্মিতার গহীন সমুদ্রে ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতো সে,অথচ তার রাত কেটেছে ঘুমিয়ে।

বুকের ভিতর তোলপাড় থামে নি,মন কিছুতেই মানছে না সুস্মিতার এই বদলে যাওয়া।
এজন্যই কি ভাবী বলেছিলো সুস্মিতা আমাদের লেভেলের না?

এজন্যই কি বলেছিলো সুস্মিতার সাথে আমাদের যায় না?

না আর ভাবতে পারছে না নিষাদ,বুকের ভিতর একটা তীব্র ব্যথা তাকে ব্যথিত করছে। কে নিভিয়ে দিবে বুকের এই আগুন?

এই মেয়েটা!!!
কি আছে এই মেয়ের মাঝে এমন যা সুস্মিতার নেই,চন্দ্রকে দেখার কাজে মনোযোগ দিলো নিষাদ এবার।এতোদিন ধরে এই বাড়িতে আছে অথচ নিষাদ কখনো ভালো করে দেখেই নি চন্দ্রকে,মনে হয় ৫ মাসে ৫-৬ বারের বেশি দেখা হয় নি চন্দ্রর সাথে,তাও সে ছিলো ফোনে ব্যস্ত সুস্মিতা কে টেক্সট করায় আর চন্দ্র ছিলো ভাবীর সাথে।

কোঁকড়া চুল,মুখে দুটো তিল বাম চোখের নিচে একটা আর থুতনিতে একটা,নাকে একটা সাদা পাথরের নাকফুল,ঠোঁটে কোনো লিপস্টিক নেই তাও কেমন হালকা লালচে লাগছে।
নিষাদের দৃষ্টি নিচের দিকে নেমে আসে,এক পর্যায়ে দৃষ্টি এসে থামে চন্দ্রর ব্লাউজের গলার পাশ দিয়ে বের হয়ে থাকা নেভী ব্লু কালারের ব্রার স্ট্র‍্যাপে,অন্যায় হচ্ছে মনে হতেই নিষাদ চোখ সরিয়ে নেয় সেখান থেকে,তাকাতে তাকাতে আবার চোখ পড়ে চন্দ্রর বুকের উপর।

ফর্সা একটা শরীর,শাড়ি নিচে পড়ে যাওয়ায় দেখা যাচ্ছে শরীরের কামনীয় একটা অংশ,অথচ নিষাদের ভালো লাগছে না।
মাথার ভিতর টা কেমন ভোঁতা হয়ে আছে।

আলগোছে চন্দ্রর উপর থেকে সরে গিয়ে চন্দ্রর গায়ের উপর ফ্লোরে লুটিয়ে থাকা শাড়ি তুলে দেয়।

রুম থেকে বের হয়ে বাগানে চলে যায়।

নিশান রাতেই টিকিট কেটে রেখেছে,সুলতানার শারীরিক এই কন্ডিশনে কিছুতেই সে সুলতানা কে হার্ট করতে চায় না।
সকাল ১০ টার ফ্লাইট তাদের,সুলতানা সকালে উঠে লাগেজ ঘুছিয়ে ফেলেছে।
মাজেদা খালা সকালের নাশতা বানিয়ে টেবিল সাজাচ্ছেন
সুলতানা যায় নিষাদ আর চন্দ্র কে ডাকতে।
গিয়ে দেখে নিষাদ রুমে নেই,চন্দ্র সোফায় শুয়ে আছে।

ওদের মাঝে যে কিছু হয় নি সুলতানা তা বুঝে যায়।তার মন খারাপ হয় না তাতে মোটেও,দুজনের জন্য আগে দুজনের ভালোবাসা জন্মাক,ওদের দুজনকে সে স্পেস দিতেই তো সে চলে যাচ্ছে।

সুলতানা বেশ ভালো করেই জানে সে না থাকলে নিষাদ সব কিছুতেই দ্বিধায় পড়বে,তার সব কিছু সুলতানা করে দিতো,কখন কি পরবে,কি খাবে,কি ইচ্ছে করছে,কখন ব্লাক কফি,কখন কোল্ড কফি,কখন দুধ চা,কখন আদা চা,কখন ঔষধ,সব কিছুতেই সে সুলতানার উপর নির্ভর।

সুলতানা না থাকলে তাকে চন্দ্রর উপর নির্ভর হতে হবে,চন্দ্র ও সে না থাকলে একা হয়ে যাবে,সময় কাটানোর জন্য হলেও সে নিষাদের প্রিয় অপ্রিয় ব্যাপারে মাথা ঘামাবে।

অনিতার একটা ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারলেই সুলতানার দায়িত্ব শেষ হতো।

সুলতানা গিয়ে চন্দ্রর কপালে হাত রাখে।চন্দ্র জেগে উঠে। সুলতানা কে রুমে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে যায়।

“হাত মুখ ধুয়ে আয় খেতে,নাকি খাবার ঘরে পাঠাবো তোদের জন্য? ”

“না আপা,আমি আসছি।”

সুলতানা চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে,কোনো এক অজানা কারণে চন্দ্র তাকে পছন্দ করে না সুলতানা তা বুঝে ভালো করে। চন্দ্রর এই স্বভাবের জন্যই সুলতানা চন্দ্রকে এতো ভালোবাসে।

খাবার টেবিলে বাড়ির সবাই বসে আছে। মেহমানদের জন্য খাবার আয়োজন করেছে বাবুর্চিরা,তারা সেখানে খাচ্ছে,নিষাদ বন্ধুদের সাথে সেখানে খাচ্ছে।

চন্দ্র কিছু খাচ্ছে না,আঙুল দিয়ে শুধু নড়াচড়া করছে খাবার।চন্দ্রর মা শায়লা বিষয় টা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন। মেয়েটা কি অসুখী এই বিয়েতে?
এতো বড় বাড়ির বৌ হওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার,তাহলে চন্দ্র এতো মনমরা কেনো?

মেয়ের দিকে তাকিয়ে শায়লা ও খেতে পারছে না,মেয়ের ব্যথা যেনো তাকেও কাবু করে ফেলেছে।

সুলতানা তার রুমে বসে আছে,কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না তার।একটু পর তারা বের হবে।

নিশান নাশতা করে এসে সুলতানা কে রেডি হতে বলে। সুলতানা তাৎক্ষণিক উঠে রেডি হয়ে নেয়।
খানিক পরেই নিচে নেমে আসে তারা।

সুলতানা সত্যি চলে যাচ্ছে???

চন্দ্রর বিশ্বাস হচ্ছে না।

সবার থেকে বিদায় সুলতানা আর নিশান চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর সুরাইয়া বেগম আর শায়লা বেগম ও চলে যায়, মেহমানরা সবাই বিদায় নিয়ে চলে যায়।পুরো বাড়ি খাঁখাঁ করে জনশূন্যতায়।
বাহিরে কড়া রোদ উঠেছে।

চন্দ্র রুমে বসে আছে, এই প্রথম সে সুলতানার অভাব টের পাচ্ছে,ভীষণ একা লাগছে সুলতানা কে ছাড়া। সুলতানা যে তাকে কি ভীষণ ভালোবাসে হঠাৎ করেই চন্দ্র বুঝতে পারছে।

সুলতানা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতো চন্দ্রকে কিছু খেতে ইচ্ছে করে কি-না,চন্দ্র কখনোই হ্যাঁ বলে নি,কিন্তু সুলতানা তবু বুঝে যেতো,ঠিকই ফুডপান্ডাতে অর্ডার করে দিতো।

নিজে কিছু খেতে পারতো না,খাবারের গন্ধে তার বমি পায় বলে,তবুও চন্দ্রকে পাশে বসিয়ে খাওয়াতো।
চন্দ্রর খাওয়া শেষ হলেই বেসিনে ছুটে যেতো বমি করতে।

মাঝেমাঝে চন্দ্র অবাক হয়, কেনো এতো ভালোবাসে সুলতানা তাদের দুই বোন কে!

বিকেলে চন্দ্রর টিউশন আছে,চন্দ্র বুঝতে পারছে না তাকে টিউশন করতে দিবে কি-না।

নিষাদ সকালে বের হয়েছে সুস্মিতার খোঁজে,সুস্মিতা কে কোথাও খুঁজে পায় নি।গুলশানের ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁতে গিয়ে বসে ছিলো ২ ঘন্টা,সুস্মিতার প্রিয় রেস্টুরেন্ট এটা,খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো সকালে কোনো এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে এসেছে সুস্মিতা।
খাবার খেতে খেতে দুজন অনেক হাসাহাসি করেছে,বের হয়ে যাওয়ার সময় লোকটা সুস্মিতার কোমর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেছে।

নিষাদের মাথায় আগুন ধরে যায় এসব শুনে।ভরদুপুরে বাসায় ফেরে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে।একরাতের মধ্যে সুস্মিতা এভাবে বদলে গেলো?
না-কি অনেক আগে থেকেই সুস্মিতার এসব চলেছিলো নিষাদের অগোচরে।
তবে কি ভাবী ই ঠিক ছিলো?

বাসায় ফিরে রকিং চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে নিষাদ,প্রচন্ড মাথা ধরেছে তার।
চন্দ্র সাহস সঞ্চয় করে নিষাদের পাশে এসে দাঁড়ালো।

“আমার টিউশন আছে বিকেল থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত,আমি আজকে ভার্সিটি ও যেতে পারি নি,আমি কি আমার আগের লাইফ লিড করতে পারবো?”

নিষাদের মেজাজ এমনিই খারাপ,চন্দ্রর কথা শুনে আরো খারাপ হয়ে গেলো। এই মেয়ে ভাবছে কি নিজেকে,এই বাড়ির বৌ না-কি সে???

“তুমি আগে যেমন ছিলে তেমনই চলবে,ভাবীর জন্য বিয়ে করেছি তার মানে এই না যে তুমি আমার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা পাবে।আমি মনেপ্রাণে সুস্মিতা কে ভালোবাসি,ভালোবাসবো,আন্ডারস্ট্যান্ড?
তোমার কোনো বিষয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই,তুমি যদি হাজার ছেলের সাথে ও চলাফেরা করো,আমি একটা প্রশ্ন ও করবো না,কজ তুমি আমার কেউ না”

চন্দ্র যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো নিষাদের এই কথা শুনে। সে তার মতো চলতে পারবে এর চাইতে খুশীর কথা আর কি হতে পারে?
চন্দ্র তক্ষুনি রেডি হয়ে বের হয়ে যায়,লাস্ট ক্লাসের টাইম হাতে আছে,ক্লাস মিস দিতে চন্দ্রর কখনো ইচ্ছে করে না।

ক্যাম্পাসে ঢুকতেই চন্দ্র নিশি,রুমি,মিরা,আদিবের দেখা পায়,তাদের ৫ ফ্রেন্ডের জুটি সেই স্কুল লাইফ থেকে।আদিব চন্দ্র কে দেখে রেগে যায়।

“মহারানীর এখন আসার সময় হয়েছে।” (আদিব)

“ওই,সকাল থেকে তোর ফোন কই ছিলো,ঠাডা পড়ছে নি তোর ফোনের উপর? ” (রুমি)

“আরে ভাই,আমাকে তো বলার সুযোগ দিবি,আমি মাইনকার চিপায় ফাঁইসা গেছি” (চন্দ্র)

“তোর অনামিকাতে এটা কিসের রিং চন্দ্র?
ডায়মন্ডের মতো মনে হচ্ছে। ” (নিশি)

“আমার বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল রাতে”

“কি!!!!!”
সবাই একসাথে বলে উঠে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না চন্দ্রর বিয়ে হয়ে গেছে। একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চন্দ্রর দুচোখ ভিজে যায় জলে।

চন্দ্র সব খুলে বলে সবাই কে। শুনে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এটা কেমন বিয়ে?

“তোর বরের ছবি দেখা না দোস্ত ” (নিশি)

“বর! তাও আমার?
ও আমার বর না রে,ও কাগজে কলমে আমার বর,মনেপ্রাণে সে তার ভালোবাসার,আমার অবশ্য আফসোস নেই তাতে,আমাকে আমার মতো লাইফ লিড করতে দিয়েছে এটাই তো অনেক,আমার কাছে ওর ছবি নেই”

চন্দ্র মুখ অন্ধকার করে আছে তা সহ্য হচ্ছে না কারো।

“আচ্ছা চল আমরা ঘুরে আসি কোথাও থেকে,আজ আর ক্লাস করতে হবে না”

আদিব প্রস্তাব দেয়। চন্দ্র ছাড়া সবাই হৈহৈ করে রাজি হয়ে যায়। চন্দ্র যেতে চায় না দেখে টেনে নিয়ে যায় সবাই মিলে।

ধানমন্ডি লেকের দিকে যায় সবাই মিলে। সবাই মিলে হাসাহাসি করছে আদিবের জোকস শুনে,চন্দ্রর মন খারাপ ভাব দূর হয়ে গেছে।

“আদিব,আরেকটা জোকস বল” হাসতে হাসতে মিরা বললো।

“শুন তাহলে

একদিন ঘুম থেকে উঠে এক লোক তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘আজকের সকালটা সুন্দর।’
পরদিনও ঘুম থেকে উঠে ও বললেন, ‘আজকের সকালটা সুন্দর।’
এর পরদিনও একই ঘটনা।

এভাবে এক সপ্তাহ পেরোনোর পর লোকটির স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘প্রতিদিন এই কথা বলার মানে কী?’

লোকটা: সেদিন ঝগড়ার সময় তুমি বলেছিলে, কোনো এক সুন্দর সকালে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”

আরেক দফা হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়।

হাসতে হাসতে লেকে প্রবেশ করে সবাই মিলে।পাশাপাশি দুটো বেঞ্চিতে বসে পড়ে।

“আরেকটা জোকস বল না আদিব” (রুমি)

“স্ত্রী: বলো তো, স্বামী ও গাধার মধ্যে পার্থক্য কী?
স্বামী: স্বামী গাধা হতে পারে। কিন্তু গাধা এত বড় গাধাও নয় যে সে স্বামী হবে!”

আদিবের জোকস শুনে সবাই আবার খিলখিল করে হেসে উঠে।

চন্দ্রর বেঞ্চির পাশের বেঞ্চে বসে নিষাদ তাকিয়ে থাকে তার দিকে।লেকে এসেচিলো সুস্মিতার খোঁজ করতে,প্রায় সময় সুস্মিতা এখানে আসে,কিন্তু এসে দেখে চন্দ্র বসে আছে এক ছেলের সাথে এক বেঞ্চে,আর ৩টা মেয়ে বসে আছে সামনের বেঞ্চে,সবাই খুব হাসাহাসি করছে,হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ছে।

একসময় রুমির নজর যায় নিষাদের দিকে,এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রুমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ছোট একটা লিপস্টিক বের করে লাগাতে থাকে।

“কিরে,তোর আবার কি হলো এখান দিয়ে?” (মিরা)

“দোস্ত,পাশের বেঞ্চে তাকিয়ে দেখা কতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে,যদি কোনোভাবে আমাকে তার ভালো লেগে যায় তার জন্য একটু লিপস্টিক লাগালাম”

রুমির কথা শুনে সবাই হাহা করে হেসে উঠে।

“যতো যা-ই মাখোস তোরা,এই ছেলে যদি কাউকে পছন্দ থাকে তবে চন্দ্রকে করবে পছন্দ,তোদের মতো কাউয়াঠুঁটিরে কোনো ভালো ছেলে পছন্দ করবে না।”

আদিবের কথা শুনে মিরা রেগে যায়। চন্দ্র হাসতে হাসতে আদিবের গায়ে পড়ে। ওদের নিত্যদিনের ঝগড়া এগুলো।

“চন্দ্র,ছেলেটা তোর দিকেই তাকিয়ে আছে,দেখতো তোর চেনা কেউ কি-না”

নিশির কথা শুনে চন্দ্র তাকায় সেদিকে। নিষাদ কে দেখতে পাবে সেটা চন্দ্র ভাবতে পারে নি।নিজের অবাক হওয়ার বিষয় টা গোপন রেখেই বলে,”না তো,আমার চেনা না উনি,আমি এই লোককে চিনি না।”

চন্দ্র কথাটা একটু উঁচু গলায় বলে,নিষাদ স্পষ্ট শুনতে পায়।চন্দ্র এভাবে কেনো বলছে তাকে চিনে না,তবে কি চন্দ্র তার বন্ধুদের বলে নি তার বিয়ে হয়েছে নিষাদের সাথে,না-কি পাশে বসে থাকা ছেলেটার সাথে চন্দ্রর কোনো সম্পর্ক?

যা ইচ্ছে হোক,আমার কি ভেবে নিষাদ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।চন্দ্র তো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে আছে তার ভালোবাসার মানুষ কই আজ?

চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here