পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-৩
tithee Sarker
প্রায় মধ্যরাত।বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর গ্রামের বাড়ি হওয়ায় আশেপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই।শুধু দূরের জঙ্গল থেকে কিছুক্ষণ পর পর শেয়াল আর বুনো কুকুরের ডাক ভেসে আসছে।
দরজা ঠেলে শক্তির রুমে প্রবেশ করে কেউ।শক্তি আর রুশা তখন ঘুমে কাদা।
আগন্তুক এসে শক্তির মাথার কাছটায় বসে।শক্তির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বিরবির করতে থাকে,
“আমি সরি!রক্তিম ইস ভেরি সরি।আমি তোকে এই ভাবে আঘাত করতে চাইনি।কিন্তু কি করি বল!ওই ছেলেটা কিভাবে তোর দিকে তাকাচ্ছিলো।কিন্তু আমি ওকেও ছেড়ে দিইনি,বাঁকা হেসে বলে রক্তিম।
ওর এমন অবস্থা করেছি যে অন্তত একমাস বিছানায় পড়ে থাকবে।”
এই বলে রক্তিম শক্তির হাত দুটো নিজের গালে ঘসতে থাকে এবং আরো কি সব বিরবির করতে থাকে ।রক্তিমকে এখন দেখাচ্ছে একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের মতো।
ঘুমের মাঝেই শক্তি অনুভব করে যে কেউ তার পাশে বসে আছে। আর শুধু বসেই আছে তা নয় রীতিমতো তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।সে ঘুম থেকে উঠে বসে কিন্তু কাউকেই রুমে দেখতে পায় না।তবে কি এটা তার মনের ভুল ছিলো!না,এটাকে সে ভুল বলে মানতে পারছে না।সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তার সাথে কেউ ছিলো এমনকি হাতে তার স্পর্শও পেয়েছে। এসব ভেবে আবার সে শুয়ে পরে কিন্তু তা চিন্তা দূর হয়না।
এদিকে দরজার আড়াল থেকে সবটাই লক্ষ করে রক্তিম আর ভাবে,”বাব্বাহ্,পিচ্চু তো এখন চালাক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বড় হ পিচ্চু, আ’ম ওয়েটিং ফ’ ইউ।
সকালবেলা জয়ার ডাকে ঘুম থেকে উঠে শক্তি। কিন্তু রাতের বিষয়টা এখনও তার মাথায় ঘুরছে।হাই দিতে দিতে নিচে নামে শক্তি মনে হচ্ছে যেন এখনো তার ঘুম কাটেনি।নিচে এসেই সামনে পায় রিদ্ধিকে।ও গয়লা মাসির কাছ থেকে দুধ রাখছে।শক্তি উপর থেকেই ঠিক করে এসেছে যে রিদ্ধির কাছে আজ রাতের ঘটনার কথা জিগ্যেস করবে।অবশ্য মামনীকে জিগ্যেস করলে বেশি ভালো হতো কিন্তু সে তো লজ্জায় মামনীকে কিছু বলতেই পারবে না।
“রিদ্ধি দি শোনো না।”
“বলে ফেল,শুনছি।”
“জানো,কাল রাতে মনে হলো কেউ আমার রুমে এসেছিলো।আমি স্পষ্ট তার আওয়াজ শুনেছি।”
“রুশা মনে হয় ওয়াশরুমে গেছিলো। সেটাই শুনেছিস তুই।নয়তো তোর রুমে আর কে যাবে।”
“বাহ্ রে,আমার নামে আবার কি কথা হচ্ছে, আমি আবার কি করলাম?”পাশ থেকে বলে রুশা।
রিদ্ধি ভ্রূ কুঁচকে জিগ্যেস করে,” কাল রাতে উঠেছিলি নিশ্চয়ই। ”
“আমি কখন উঠলাম আবার!আমি তো এক ঘুমেই রাত পার করে দিয়েছি।” অবাক হয়ে বলে রুশা।
শক্তি রিদ্ধির গায়ের সাথে একটু চেপে আস্তে আস্তে বলে,”না গো, ওটা রুশা ছিলো না।রুশার আওয়াজ আমি চিনি।ওটা অন্য কেউ ছিলো। তাছাড়া শুধু কাল রাতেই নয় এর আগেও আমি অনেক বার টের পেয়েছি যে রুমে কেউ তো আসেই।
শক্তির এই কথা শুনে টনক নড়ে রিদ্ধির।এখন ও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ঘটনাটা কি ঘটেছিলো। কিন্তু সে শক্তিকে কি করে বলবে এই কথা।মিনিটের মধ্যেই রিদ্ধির মাথায় একটা দুষ্ট আইডিয়া খেলে গেলো।ও নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করে বলে,
“শক্তি, তোকে তো এতো দিন একটা কথা বলাই হয়নি।আমাদের দাদুর আত্মা প্রতিদিন রাতে এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।নিজের নাতি-নাতনীদের দেখতে আসেন উনি।”
“তোমাদের আবার দাদু কোথা থেকে এলো।”
“ওই বেদ্দোপ মেয়ে, আমার বাবা কি কলা গাছ ফেটে বের হইসে নাকি?আমার দাদুকে তুই দেখিস নাই। তুই এই বাড়িতে আসার অনেকদিন আগেই দাদু স্বর্গবাসী হয়েছেন।কিন্তু তার আত্মা এখনও এই বাড়িতে ঘুরাঘুরি করে। ”
এবার রীতিমতো ভয় পায় শক্তি। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
“কিন্তু তোমার দাদু আমার কাছে কেনো আসছিলো? ”
শক্তির এমন মুখ দেখে হাসি পায় রিদ্ধির। তবুও হাসিকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে বলে,
“হয়তো উনি তোরে রুশা ভেবে ধরেছিলেন।আবার দেখ,বাবা তো তোকে নিজের মেয়েই মনে করেন সেই হিসেবে দাদুও হয়তো নিজের নাতনি ভেবেই তোর কাছে এসেছিলেন।”
——————————————–
বাড়ির সামনে বাধানো বকুল তলায় বসে আছে শক্তি আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড পিয়া।এখান থেকে দক্ষিণে তাকালেই চোখে পরে কুলকুল শব্দে বয়ে যাওয়া মহুয়া নদী।রক্তিমের ঠাকুমা নাকি নদী দেখতে খুব ভালোবাসতেন। তাই রক্তিমের দাদু এই বকুল তলা শান দিয়ে বাধিয়ে দিয়েছিলেন যাতে উনি অবসরে বসে নদী দেখতে পারেন।
“সিরিয়াসলি, শক্তি!রিদ্ধি আপু এই কথা বলেছে?”
“হ্যা রে,,আমার তো ভয়েই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”
“ধূর,,,আপু তোর সাথে মজা করেছে হয়তো।তোকে বোকা বানানোর জন্য বলেছে এসব।”
“ও আমাকে বোকা বানাতে যাবে কেনো।আমিই তো এই বিষয়ে জানিয়েছি দিদিকে।আর আমার রুমেই বা কে ঢুকতে যাবে।”
“তাও তো ঠিক।তবুও আমার ‘ডাল ম্যা কুছ কালা লাগতা হ্যা।”আচ্ছা, এবার বল কোন কলেজে আবেদন করবি!”
“আর কোন কলেজ! এখানকার কলেজেই ভর্তি হবো।” বলে শক্তি।
“কেনোরে,,আমি তো ভাবলাম তুই মনে হয় জেলা সদরের কলেজে ভর্তি হবি।”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু আমার জীবনের মেইন ভিলেনকে চিনিস না,ওইটা যেতে দিলে তো।”গোমড়া মুখ করে বলে শক্তি।
” রক্তিম ভাইয়াটা না কি একটা! তবে ভালোই হলো তুই আর আমি একসাথে যেতে পারবো।আর এখন আমার শুধু চিল করবো চিল!”
“এ্যাহ্,কোত্থেকে আসছেন আমার চিলওয়ালী!ওই খবিশটা জানতে পারলে না মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে।আমার লাইফে আর চিল করা হলো না। ”
“সত্যিই ওইবার মেলায় যাওয়া নিয়ে কি কান্ডটাই না করেছিলো।”
ফ্ল্যাশব্যক**
তখন ছিলো শীতকাল। সেদিন শক্তিদের ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিলো।আর রক্তিম, রিদ্ধি কেউই বাড়ি ছিলো না।কারণ তখন তাদের থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলে।কিন্তু রক্তিমের সেদিন বাড়ি ফেরার কথা ছিলো যা কিনা শক্তি ঘুণাক্ষরেও জানতো না।জানলে কি আর সে এই কাজ করে।
শীতকালে প্রতি বছর তাদের গ্রামে বিশাল বড় মেলা হয়।অনেক মানুষ, অনেক দোকানপাট বসে।রক্তিমই তাদের সবাইকে নিয়ে যায় মেলায় কিন্তু সেই বছর রক্তিম, রিদ্ধি কেউ না থাকায় আর মেলায় যাওয়া হয়নি তাদের।
ওইদিন সকাল থেকেই পিয়া ওর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিলো যে আজ তারা দুইজন যাবে মেলায়।শক্তি অনেক বার না করেছিলো।কেননা,রিদ্ধিকে ছাড়া ও কোনোদিন কোথাও যায়নি। এমতাবস্থায় সে মেলায় কি করে যায়!
কিন্তু পিয়া কোনো কথাই শুনতে রাজি নয়।তারও যে যেতে ইচ্ছে করছিলোনা, তা নয়।কোনোদিন একা একা কোথাও যায়নি।যেখানেই গেছে ওখানেই রক্তিমের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হয়েছে।তাই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে তার পিঞ্জরাবদ্ধ মনটা মুক্ত আকাশে ডানা মেলতে চাইলো।অবশেষে শক্তি রাজি হলো যাওয়ার জন্য।
মেলায় অনেক মানুষ থাকলেও খুব ভালো লাগছিলো ওদের।এটা ওটা কিনছিলো।অনেকগুলো ফুচকাও খেয়েছিলো আর নাগরদোলাতেও উঠেছিলো। রক্তিম সাথে থাকলে এসব কখোনোই করতে দিতো না।খুব ভালো সময় কাটছিলো তাদের। ঘোরাঘুরি শেষ করে তারা বসে ছিলো পুতুল নাচ দেখতে।পুতুলনাচ অর্ধেকও হয়নি আর এরই মাঝে যমদূত এসে হাজির।
দশগ্রামের লোকের সামনে দিয়ে তাকে হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিলো। বাড়িতে এনে এমন এক থাপ্পড় দিয়ে ছিলো যে দুদিন পর্যন্ত সে কথা বলতে পারেনি ব্যাথার জোটে।আর ওইদিন সারা রাত তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখছিলো রক্তিম। ওর বাবা হাজার বকাঝকা করেও কিছু করতে পারেনি।
রক্তিমের কথা হলো একটাই ওর কথার অবাধ্য হয়েছো তো শাস্তি পেতেই হবে।
সেদিনের কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্তি। মাঝে মাঝে শক্তির রক্তিমকে পাগল টাগল মনে হয়।নইলে এমন কেউ করতে পারে।
পিয়ার কথায় ওর ভাবনার ঘোর কাটে।
“তবে আমার কি মনে হয় জানিস?রক্তিম ভাইয়া যা করে তা তোর ভালোর জন্যই করে।জানিস,কালকে তো লিমনকে মেরে পুরো হসপিটালে পাঠিয়েছে। ”
“লিমনটা আবার কে!” অবাক হয়ে বলে শক্তি।
“হায় আল্লাহ্,,ভাইয়া আসলে ঠিকই করে তোর সাথে।তুই একটা কি রে!কাল যে ওর সাথে কথা বললি আজ তার নামটাই ভুলে গেলি।” রেগে গিয়ে বলে পিয়া।
“আমি কি ওর নাম জানি নাকি?জীবনে কোনোদিন কথা বলতে দেখেছিস আমাকে ওর সাথে। কাল তো জিজ্ঞেস করলো তাই কথা বললাম।কেনো ওকে কেনো মেরেছে? ও বেচারার কি দোষ? ”
“হ্যা,সবাই তো তোর কাছে বেচারাই।ও নাকি তোর দিকে খারাপ নজরে তাকিয়ে ছিলো। আর সেটা দেখলো কে? একদম রক্তিম ভাইয়া।”
“বিশ্বাস কর দোস্ত, আমি ওর দিকে তাকাইও নাই।কেমনে বুঝবো খারাপ না ভালো নজরে দেখেছে?”
“তো দেখ,এইদিক দিয়ে ভাইয়া তো কাজটা ঠিকই করেছে।”
“কি জানি রে,,,মাঝে মাঝে মনে হয় উনি আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেন,আমার অনেক কেয়ার করেন।আর মাঝে মাঝে মনে হয় উনি আমায় দুচোখ দেখতে পারেন না।”
শক্তি যদি জানতো যে রক্তিম তার জন্য কি অনুভব করে তবে ও আর এই কথা বলতো না।বেচারা রক্তিম। শক্তি ওকে বুঝলোই না।
(চলবে)