পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-২
Tithee Sarker
“না,ওর এখন ফোন দরকার নেই।”
রক্তিমের গম্ভীর আওয়াজে অবাক হলো সবাই।শক্তির মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেলো।এই লোক কোনোদিন তাকে শান্তি দেবে না।নিজের মনেই বলে শক্তি।
“কেনো?এখনই তো ওর ফোন দরকার। ” অবাক হয়ে বলে রক্তিমের বাবা।
“হ্যা,এখন তো ও কলেজে যাবে। একটা ফোনের তো প্রয়োজন।ধর, ও কলেজে গেলো আর আমারা ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারলাম ন,তখন কেমন হবে?আজ হোক কাল হোক ফোন তো একটা দিতেই হতো।”রক্তিমকে অনেকটা উপদেশের মতো বলে জয়া।
কিন্তু রক্তিম তো রক্তিমই।চড়া আওয়াজে বলে,
” আমাকে এতো বোঝাতে এসো না।আমি জানি কার কখন কি দরকার। আমি যখন বলছি লাগবে না তো লাগবে না।”
আর এইদিকে শক্তি কাচুমাচু করছে।রিদ্ধির কানে ফিসফিসিয়ে বলছে,
“ও রিদ্ধি দি,তোমার ভাইকে কিছু তো বলো।লক্ষী নিজে হেঁটে আমার কাছে আসছে আর তাকে তোমার ভাই দরজার বাইরে থেকেই খেদিয়ে দিচ্ছে। ”
রিদ্ধিই এই বাড়ির একমাত্র মানুষ যার কথা রক্তিম শোনে।তবুও কি পুরোটা না যতটুকু তার মনের সাথে মিলবে ততটুকুই।
“আরে একটা ফোনই তো দিচ্ছে ডায়মন্ড সেট তো আর দিচ্ছে না।এমন করছিস কেনো?”
“চাইলে দিতে বল ডায়মন্ড সেট কিন্তু ফোনটা দেয়া যাবেনা।”
রিদ্ধি বুঝে গেলো রক্তিমকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যাবেনা।ও যা বলছে তাই হবে।এখন রীতিমতো আফসোস হচ্ছে ওর শক্তির জন্য।
কিন্তু এবার বেকে বসলেন রক্তিমের বাবা।তিনি কঠিন গলায় বললেন,
“তো তুমিই কিছু সমাধান বের করে দাও।কেননা শক্তি এবার কলেজে ভর্তি হবে মেসে-হোস্টেলে থাকবে ওর সাথে যোগাযোগ করবো কি করে আমরা?”
“হোস্টেলে থাকবে মানে?ও বাড়িতে থেকে কলেজে পড়বে।হোস্টেলে যাবে কেনো?”
পীযূষ বাবু এবার অধৈর্য হয়ে পরেন।তিনি বললেন,
“তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা রক্তিম। ওকে আমি জেলা সদরের ভালো কলেজে ভর্তি করবো।ও বাড়ি থেকে ক্লাস কি করে করবে?”
“না,শহরে নয়,এখানকার লোকাল কলেজেই ভর্তি হবে ও।শহরে গিয়ে ও ঠিক থাকতে পারবে আরও সাথে দেবে নাকি ফোন!”
রক্তিমের এই কথায় সবাই বোকা বনে গেলো।ওর মা বাবা কিছু না বুঝলেও,রিদ্ধি আর শক্তি ঠিকই বুঝে গেলো যে রক্তিম কি বোঝাতে চাইছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই শক্তি বলে,
“থাক না বাবু, আমি এখানকার কলেজেই পড়ব।আর সত্যিসত্যিই তো আমার এখন ফোনের কোনে প্রয়োজন নেই। ”
মুখে এই কথা বললেও শক্তির মনে যে কতটা প্রচ্ছন মনোবেদনা ছিলো তা শুধু রিদ্ধিই বুঝতে পারলো।কিন্তু তারও এখানে কিছু করার নেই।
জয়া তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
“কিরে,, তোরা রসমালাই খাবি না?কত কস্ট করে বানালাম আমি!” (কিছুটা মুখ ফুলিয়ে)
সবাই বুঝতে পারলো জয়া প্রসঙ্গটা পাল্টাতে এই কথা বললো।
“হ্যা,মামনী চলো।” জয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে শক্তি।
জয়া সবাইকে বাটিতে করে রসমালাই পরিবেশন করে কিন্তু যেনো আজ এই প্রিয় খাবার টাও শক্তির কাছে ভালো লাগছে না।কোনো রকমে দুটো মুখে দিয়েই বলে,
“আমি আর খাবো না মামনী। ”
“সেকি কথা!খাবিনা কেনো?”
“না,আসলে স্কুল থেকে আসার পথে সবার সাথে কাচা আম খেয়েছিলাম তো তাই দাঁত টকে আছে। এক কাজ করি,, এটা ফ্রিজে রেখে দেই,ঠান্ডা হলে পরে খাবো।”
এই বলে শক্তি হনহন করে নিজের রুমে চলে এলো।আজ রক্তিমও ওকে কিছু বললো না,যেতে দিলো অন্যদিন হলে দেখা যেতো যে রক্তিম সামনে বসিয়ে পুরোটা খাবার শেষ করাচ্ছে।
আর এইদিকে জয়া ছেলের হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল,
“কিরে বাবাই,তোর হাতে কি হয়েছে?”
রক্তিম শান্ত গলায় বলে, “কিছু হয়নি।”
“কিছু হয়নি মানে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে,আর তুই বলিস কিছু হয়নি।” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে জয়া।
“বললাম তো কিছু হয়নি।”
এই বলে রক্তিমও বাড়ির বাইরে চলে যায়।
জয়া জিগ্যেসু চোখে রিদ্ধির দিকে তাকায়।কারণ সবাই জানে রক্তিমের কি হয়েছে না হয়েছে তার ইনফরমেশন কিছু হলেও রিদ্ধির কাছে পাওয়া যাবে।
রিদ্ধি আড় চোখে বলে,
“আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি কিছু জানি না।”
বলে সেও উপরে চলে গেলো।
“কিরে ভর সন্ধ্যা বেলা ছাঁদে কি পেত্নীর ডলা খেতে এসেছিস নাকি?”
রিদ্ধির এই কথায় চমকে পেছনে তাকায় শক্তি। সন্ধ্যা যে হয়ে গেছে তা এতোক্ষণ সে খেয়ালই করেনি।তার চোখ ছিলো বাড়ির পাশের শিমুল গাছটার দিকে। যদিও এখন ফুল ফোটার সময় নয়।তবুও এই পাতা ঝরা গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগে।তার মনে হয় গাছটাও যেন তারই মতো অসহায়। বছরে শুধু কিছু সময় ফুলে পরিপূর্ণ আর বাকি বছর নিঃস্ব।।।।
যার বাবা মা নেই সে তো নিঃস্বই।যদিও মামনী,বাবু তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।কিন্তু তার জীবনের মেইন ভিলেন হলো রক্তিম।
“কিরে কোথায় হারিয়ে আছিস?নিচে চল।”
“আচ্ছা রিদ্ধি দি,আমার এই নামটা কে রেখেছে বলো তো?”
“কিসের মাঝে কি!এই কথা কেনো জিগ্যেস করিস এখন তুই।”
“কারণ, আমার নাম শক্তি না দূর্বলতা রাখার দরকার ছিলো। দেখো না তোমার ভাই আমার উপর কেমন অত্যাচার করে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে শক্তি।
শক্তির এই কথা শুনে রীতিমতো বেআক্কেল হয়ে যায় রিদ্ধি। হাসতে হাসতে বলে,
“এটা জোস ছিলো,আমার ভাই তো উপর অত্যাচার করে?”
“তা নয়তো কি?আমাকে দেখতেই পারে না।সামনে পরলে মনে হয় যেনো গিলে ফেলবে আমায়।একটা অসহ্য মানুষ। ”
এবার রিদ্ধি একটু গম্ভীর ভাবে বলে,
“সবার মন কিন্তু একরকম নয়,শক্তি। হয়তো ও তোকে পছন্দ করে কিন্তু বোঝাতে পারেনা।”
“আর পছন্দ! আমার এতো পছন্দের দরকার নাই গা।দেখলা না,ফোনটাও নিতে দিলো না আর কলেজে ভর্তির বেলায়ও কেমন করলো।”মুখ ফুলিয়ে বলে শক্তি।
” শোন শক্তি, কোনো মানুষের বাইরেটা দেখে মানুষকে বিচার করিস না।এই যেমন মাত্র জিগ্যেস করলি তোর নামের পেছনের কাহিনী কি,তবে শোন,তুইও কিন্তু অনেক সাহসী একটা মেয়ে। ”
রিদ্ধির এই কথা শুনে শক্তি বিষ্ময়ের সপ্ত আসমান থেকে পড়লো।নিজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে,
“আমি!সাহসী! ”
“শোন,তোর যখন জন্ম হলো তখন আমি আর রক্তিম দুজনেই ছোট। তোর জন্মের খবর শুনে আমরা সবাই গেলাম হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। কারণ তোর জন্মের পাঁচ ঘন্টা পরও নাকি তুই কোনো সাড়াশব্দ করিস নি।আঙ্কেলের তো অবস্থা খারাপ আর আন্টির কথা তো তোকে বলতে হবে না।তুই হয়েছিলি বিকেল তিনটায়। আমরা বসে ছিলাম রাত দশটা পর্যন্ত তবুও তোর জ্ঞান আসেনা।সবাই খুব ভয় পাচ্ছিলো।ডাক্তারও বলে দিয়েছেন আর কোনো আশা নেই।সব ব্যবস্থা করে ফেলতে।তুই বুঝতে পারছিস সবার কি অবস্থা! আন্টিকে তো সামলে রাখাই দায় হয়ে যাচ্ছিলো।”
“কি বলছো গো!আমি মরা হইছিলাম!”
“ধুর,,,পরে শোন না,সবাই তো ভাবছে এবার সব করে ফেলবে, মানে বুঝতে পারছিস তো কিসের কথা বলছি?ঠিক তখনই তুই কেঁদে উঠলি।তোর ওই কান্নার শব্দ আমাদের জানে জান এনে দিয়েছিলো।”
“আমার সাথে এতো কিছু হয়ে গেছে আমি জানিই না।কিন্তু এর সাথে নাম আর সাহসের কি সম্পর্ক? ”
“আছে,তুই তো আমাদের ফাইটার গার্ল।তাই আঙ্কেল তোর নাম রেখছিলো শক্তি। ”
রিদ্ধির কথা গুলো শক্তি মনোযোগ দিয়ে শুনছে।রিদ্ধি আবার বলে,
“তুইও কিন্তু সাহসী।নিজেকে চিনতে শেখ।নিজের ভেতরটাকে আর সাথে আশেপাশের মানুষদের কেউ।তুই রক্তিমকে ভয় পাস বলেই ও তোর সাথে এমন করে।কিন্তু তুই যদি সহজ ভাবে ওর সাথে মিশিশ তো বুঝতে পারবি ও কেমন।এতো বছরেও তুই ওকে চিনতেই পারলি না।”
রিদ্ধির শেষের কথায় হেসে দিলো শক্তি। মনে মনে বলে,
“সহজভাবে কথা বলতে গেলে রক্তিম বলবে,থাপ্পড় খাবি নাকি ছাদ থেকে ফেলে দেবো।”
(চলবে)