যে নারীর ভাবনায় এতোদিন অয়নের অবাধ্য মন লিপ্ত ছিলো আজ সেই নারী তার সামনে বসে রয়েছে তার বড় ভায়ের বধু রুপে। কি অপরুপ সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। লাল বেনারসিতে লাল অপ্সরার মতো লাগছে তাকে। নিজের প্রেয়সীকে ভাবীমা বলতে হবে ভাবতেই বুকের বা-পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো অয়নের। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে বিয়ের হল থেকে বেরিয়ে গেলো সে। উদাসীন হয়ে রাস্তার ধারে হেটে চলেছে অয়ন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, আজ সিগারেট টাও যেনো বিষাক্ত জ্বলন্ত ফুলকির মতো লাগছে। বুকের জ্বালা কমানোর পরিবর্তে তা যেনো আরোও দ্বিগুণ করে দিচ্ছে। রাইসার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো চোখের সামনে ভাসছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো অয়নের।
সিকদার ভিলা,
সিকদার পরিবারের বড় ছেলে আবরার সিকদারের বিয়ে আজ। সিকদার ভিলা যেনো বউয়ের মতো সাজানো হয়েছে। আবরারের মা শেফালী বেগমের খুশি দেখে কে। ছেলেটার অবশেষে একটা গতি হলো। এবার যদি কাজমুখো ছেলেটা ঘরমুখো হয়। হবে না কেনো! খুজে খুজে পরীর মতো বউ খুজে এনেছেন। শুধু তাই নয়, ছেলে নিজে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটিকে বিয়ে করতে। ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে রাইসা এবং আবরার। আবরারের দাদীজান মহীমা বেগম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বউমাকে ডেকেই যাচ্ছেন যাতে নাতী আর নাতবউকে বরণ করে ঘরে আনেন। নাসির সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,
– মা এতো ব্যাস্ত হচ্ছো কেনো? শেফালী আছে তো
– কখন থেকে নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছে, শেফালীকে বলো তাড়াতাড়ি।
– হ্যা বলেছি। ও মিষ্টির প্লেট নিয়ে আসছে।
– আচ্ছা অয়ন কোথায়? ওকে তো আমি হলে কোথাও দেখি নি। ওদের সাথেও আসে নি। বড় ভাইয়ের বিয়ে আর ছোট ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই কোনো কথা?
– ওর কথা বলো না মা, আমি সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছি ছেলেটার সাথে। একদিকে আবরার সারাক্ষণ ভাবে পরিবারকে কিভাবে খুশি করা যায়, তাদের কিভাবে সুখ দেওয়া যায়। ছেলেটা কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে। আর অপরদিকে তোমার প্রিয়ন নাতী অয়ন। সারাক্ষণ নিজের দুনিয়াতে থাকে। সে কি না ফটোগ্রাফার হবে। এসবের কোনো ভাত আছে। যাচ্ছে তাই।
নাসির সাহেবের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জ্ঞাত মহীমা বেগম। এতো শুভদিনে অহেতুক রাগারাগির কোনো মানেই হয় না। তাই তিনি তাকে শান্ত করতে বললেন,
– বাচ্চা মানুষ, বয়স ই বা কতো বল
– মা, সাতাশ বছর বয়সে আমার দুটা বাচ্চা ছিলো। আর তোমার নবাবনাতী বাউন্ডেলেপানা করে বেড়াচ্ছে।
– আজ একটা আনন্দের দিন, আজ আমার নাতীর পিন্ডি চটকানো বন্ধ করো। যখন সময় হবে এমনি ই সব ঠিক হয়ে যাবে।
– হাহ
নাসির সাহেব সেখান থেকে উঠে গেলেন। ছোট ছেলের এসব অদ্ভুত কান্ড কারখানায় অতিষ্ঠ তিনি। মহীমা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয়। সারাটা জীবন আবরারের ছায়ার তলে থাকতে থাকতে কবে হারিয়ে যাবে টের ও পাবে না। আবরারের সাফল্য তাকে যেনো ঘোর অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এই অন্ধকার কাটানোর জন্য এক ফালি রোদের বড্ড প্রয়োজন। কবে যে তার জীবনে সেই এক ফালি রোদ টুকু আসবে তার ঠিক নেই।
রাইসাকে আবরারের রুমে নিয়ে গেলেন শেফালী বেগম। ফুলসজ্জিত বিছানায় বসাতে বসাতে বললেন,
– এখন থেকে এই রুমের মালিক তুমি। আমার ছেলের সাথে সাথে এই রুমটাও তোমার। দেখে রেখো। এখন আর সকাল বেলা আমি এই রুম গুছাতে আসবো না কিন্তু
– জ্বী মা
– আমার সোনা বউ মা
বলে তার মাথায় চুমু খেয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন শেফালী বেগম। রুমে কেউ নেই, শুধু আছে রাইসা এবং এক আকাশ সম নীরবতা। এতক্ষণ খুব কষ্টে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছিলো সে। কষ্টগুলো বারবার হামলা করছে। বিয়ের আসরে যখন কাজী সাহেব কবুল বলতে বলছিলো তখন যেনো মনে হচ্ছিলো কেউ গলাটা চেপে ধরে আছে। দম বন্ধ লাগছিলো রাইসার। আরোও কষ্ট হচ্ছিলো যখন অয়ন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। কত স্বাভাবিক ছিলো সে! যেনো কিছুই হয় নি! অবশ্য এটা মন্দ নয়। একজন ছলনাময়ী নারীর প্রতি যত কম অনুভূতি থাকা যায় ততই ভালো। রাইসা অনুভব করলো তার গাল ভিজে আসছে। সে তো ভেবেছিলো সে একটি অনুভূতিহীন জড় বস্তু। যার মনে কোনো অনুভূতির রেশটুকু নেই। তার কোনো কষ্ট নেই। সে শুধু একটি বিনিয়োগের মাধ্যম। কিন্তু এই নোনাজলের স্রোত তাকে মনে করিয়ে দিলো তার মনের ভেতর কোথাও না কোথাও একটি জীবন্ত নারী রয়েছে সে এখনো অয়নকেই ভালোবাসে। হঠাৎ দরজা ঠেলার শব্দ পেলে আতকে উঠে রাইসা। বুক টিপটিপ করছে, চোখের নোনাজল মুছে নিজেকে সামলে নিলো সে। শাড়ির আঁচল খামছে ধরে বসে রইলো রাইসা। দরজা ঠেলে আরবার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। ধীরে রাইসার পাশে বসে সে। আলতো হাতে রাইসার মুখখানা আজলা করে ধরে হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– নিজের প্রেমিকের স্মৃতি মনের কোঠর থেকে মুছে ফেলো। ভুলে যেও না সে এখন তোমার দেবর হয় সম্পর্কে।
আবরারের ঠান্ডা কন্ঠে বলা কথাটা শুনে আরোও যেনো হাত পা জমে যায় রাইসার। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে থাকে আবরারের মুখোপানে। কি মায়াবী একটা মুখ! ফর্সা মুখখানা, খাড়া নাক, চুলগুলো কপালের উপর পড়ে রয়েছে। সবথেকে সুন্দর তার ধূসর বর্ণের চোখ জোড়া। কি মায়া সেই চোখে। অথচ এই মায়াবী মুখের আড়ালে একজন হিংস্র নরপিশাচ আছে তা যেনো অবিশ্বাস্য। নিজের নিয়তিকে চোখ বুঝে মেনে নেয় রাইসা। অভুক্ত সিংহের মতো ঝাপিয়ে পড়ে আবরার তার উপর। নিজের কামনা মিটাতে ব্যাস্ত সে। রাইসার দিকে খেয়াল করার সময় তার নেই। খেয়াল করলে দেখতে পেতো তার চোখ থেকে নোনাপানির রেখা গড়িয়ে পড়ছে, কবে অন্ত হবে এই দুঃসহ যন্ত্রণা_____________
রাত আটটা,
ওভারব্রিজের উপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে অয়ন। নিচে তাকালে দেখা যায় শত শত গাড়ি চলে যাচ্ছে আপন গন্তব্যে। আজ আবহাওয়াটা বেশ ঘুমোট। একটা পাতাও নড়ছে না। কোনো বাতাসের ছিটা ফোটাও নেই। হয়তো একটু পর কালবৈশাখী ঝিড় শুরু হবে। আজকাল আবহাওয়া কিছুই ঠাহোর করা যায় না। অয়ন এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট কখন যে আপনা আপনি জ্বলে ছাই হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। আংগুলের কিছুটাও পুড়ে গেছে। অথচ তার সেই যন্ত্রণার অনুভূতি নেই। সে এক মনে তাকিয়ে রয়েছে রাস্তার পাশের ফুলবিক্রেতা ছোট্ট মেয়েটির দিকে। মেয়েটি হাতে বেলীফুলের মালা নিয়ে জনে জনে বিক্রি করছে। রাইসার বেলীফুলের মালা খুব পছন্দ ছিলো। খুব আবদার করতো মালা কিনে দেবার জন্য। কিন্তু আজ আর সে এই ফুটপাতের মালার জন্য আবদার করবে না। কারণ এখন সে একজন বড় সরকারি অফিসারের বউ। তার এখন আর কোনো বেলীফুলের মালায় মন ভরবে না। অর্থ মানুষের রুপ চেনায়। যেমনটা রাইসার চিনিয়েছে। তাও অয়নের আক্ষেপ থাকতো না যদি রাইসার পাশের ব্যাক্তিটি তার নিজের আপন বড় ভাই না হতো। মানুষ সুখী হতে চায়, রাইসাও সুখ বেঁছে নিয়েছে। কিন্তু আবরার ই কেনো! কেনো রাইসা আবরারকেই বেঁছে নিলো! কথাটা ভাবতেই মনের আগুনের তেজ যেনো আরোও বেড়ে গেলো।
– সুইসাইড করার আর জায়গা পান নি? এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য ওভারব্রীজ ই পেলেন!
কন্ঠটি কানে আসতেই ঘুরে তাকায় অয়ন। পেছনে ফিরলে দেখতে পায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুচকে আপাদমস্তক মেয়েটিকে দেখে নিলো সে। বয়স বিশের কাছাকাছি হবে, শ্যাম বর্নের গোলগাল মুখ; সাদা রঙ্গের কামিজ পড়া, কাধের বা পাশে বেনুনি ঝুলছে। কন্ঠটা বেশ মিষ্টি। তবুও কেনো যেনো বেশ বিরক্ত হলো অয়ন। দৃষ্টি সরিয়ে আবারো রাস্তার দিকে দিলো। অয়নের পাত্তা না পেয়ে আবারো বলে উঠলো মেয়েটি,
– কথা কানে যাচ্ছে না, থেমে পরুন বলছি। নিশ্চয়ই ছ্যাকা ছাইছেন। নয়তো এতো ভালো জামাকাপড় পড়ে এমন দেবদাসের মতো ওভারব্রীজের উপর কেউ বসে থাকে না। শুনুন এসব রোমিওগিরি বাড়ি যেয়ে করুন। আর ওভারব্রীজ থেকে লাফ দিলে কোনো লাভের লাভ কিন্তু হবে না। লাফ দিলেই কোনো না কোনো গাড়ির ছাদে পড়বেন তারপর হাত পা ভেঙ্গে যাবে। সর্বোচ্চ প্যারালাইজড হতে পারেন। অহেতুক কেনো মানুষের সিমপ্যাথী নেবার ট্রাই করছেন?
অয়নের বিরক্তি যেনো বেড়েই গেলো। সহ্যসীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। মেয়েটা বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছে। চুপচাপ সহ্য করাটা যেনো অসম্ভব হয়ে গেছে অয়নের পক্ষে। এবার পেছনে ফিরে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেয়েটির উপর। তারপর ওভারব্রীজের রেলিং থেকে ধুপ করে নেমে পড়লো সে। তীব্র বেগে ছুটে আসলো মেয়েটির দিকে। অয়নের চেহারা দেখে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। মেয়েটির কাছে এসে….……………
চলবে
[আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আপনাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আবারো ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। কেমন লাগলো কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]
#এক_ফালি_রোদ
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি