এক_ফালি_রোদ ২য়_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
২য়_পর্ব

অয়নের বিরক্তি যেনো বেড়েই গেলো। সহ্যসীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। মেয়েটা বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছে। চুপচাপ সহ্য করাটা যেনো অসম্ভব হয়ে গেছে অয়নের পক্ষে। এবার পেছনে ফিরে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেয়েটির উপর। তারপর ওভারব্রীজের রেলিং থেকে ধুপ করে নেমে পড়লো সে। তীব্র বেগে ছুটে আসলো মেয়েটির দিকে। অয়নের চেহারা দেখে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। মেয়েটির কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– কি সমস্যা? প্যান প্যান করছেন কেনো? আমি কি আপনাকে বলেছি আমি সুইসাইড করছি?
– না..…না বলেন নি। কিন্তু আ..আপনি ওখানে ওভাবে বসে ছিলেন কেনো?
– আমার ইচ্ছা, আমি ওখানে বসবো না রাস্তায় বসবো সেটা আমার ইচ্ছে। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে নাচবো দরকার পরলে। আপনার কি? শুনি? আপনি আমাকে চিনেন? নাকি আমি আপনাকে চিনি? আর যদি আমি সুইসাইড ও করি তাহলেও আপনার কি?

ক্ষুদ্ধ কন্ঠে অয়ন কথাগুলো বললো। মেজাজ তার অত্যধিক গরম। এখানে মেয়েটির বদলে কোনো পুরুষ থাকলে হয়তো মেরেই বসতো। এখন মেয়েটি মিনমিনিয়ে বললো,
– আপনার গার্লফ্রেন্ডের আজ বিয়ে ছিলো তাই না?

মেয়েটির অস্বাভাবিক প্রশ্নে হতচকিত হয় অয়ন। অয়ন ভ্রু কুচকে সরু দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি ছোট হলেও তার মানুষকে অনুধাবন করবার ক্ষমতা আশ্চর্যজনক৷ হয়তো আন্দাজে সে ঢিল ছুড়েছে কিন্তু এটাই তো সত্যি। মেয়েটি খানিকটা ভীত দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঠান্ডা গলায় নিচু স্বরে অয়ন বললো,
– মানুষের মন সব সময় ভালো থাকে না। তাই অচেনা মানুষের জীবনে ইন্টারফেয়ার করতে হয় না।
– আমি কি ইন্টারফেয়ার করেছি নাকি! আমার মনে হলো তাই বলছি।
– কেনো মনে হলো?
– তাতো জানি না। তবে আমাকে আপনি খামোখা বকেছেন সরি বলেন।
– কিহ?
– হ্যা সরি বলেন। আমি তো খারাপ কিছু বলি নি। মানুষের জীবনে এমন অনেক কিছুই হয় যা তারা মেনে নিতে পারে না। তাই বলে উপন্যাসের দেবদাস কিংবা হিমু সেজে রাস্তার ঘুরে বেড়ানোটা মোটেই যুক্তিসংগত নয়। আর যদি পড়ে যেতেন তখন?
– পড়ি নি তো আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
– দূর্ঘটনার মা বাপ আছে? আর আপনি যেভাবে ঝুকে বসেছিলেন, একটা ধাক্কাই যথেষ্ট আপনাকে ফেলে দিতে।
– আপনি একটু বেশি ই ভাবছেন। যাক আমি নেমে গেছি তো হ্যাপি? আর সরি আমি চিৎকার করেছি এন্ড থ্যাংক্স অচেনা হয়েও আমার জন্য এতোটা চিন্তা করেছেন। আমাকে মাফ করেন এবং নিজের কাজে যান

কথাটা বলে হাটা দিলো অয়ন। মেয়েটার সাথে কথা বাড়াতে ভালো লাগছে না। আবার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। তাই মেয়েটাকে উপেক্ষা করে হাটাটাই যৌক্তিক মনে হলো। ভেবেছিলো মেয়েটি হয়তো তার পিছু ছেড়ে দিবে। কিন্তু কিসের কি! সে অয়নের পাশ দিয়ে হাটা শুরু করলো। প্রথমে অয়ন খেয়াল না করলেও পরে সেটা বুঝতে পেরে থেমে যায়। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
– কি হয়েছে? পাশে পাশে চলছো কেনো?
– রাস্তাটা কি আপনার? আমি ওদিকেই যাবো। তাই হাটছি।
– ওহ তাই? বেশ যান।
– আপনি বাসায় যাবেন না?
– না যাবো না কোনো সমস্যা? প্রব্লেম কি আপনার? আপনার ভয় হচ্ছে না? আমি মানুষটা খারাপ ও হতে পারি৷
– যে মানুষ হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট সহ্য করে, সে অন্তত অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। আর আপনি তো মনে হয় তাজা তাজা ছ্যাকা খাইছেন
– এই থিসিস কি তোমার নিজের।
– একদম
– এমন হলে সাইকো কিলারের জন্ম হতো না।
– তার মানে আপনি এখন সাইকোকিলার হয়ে যাবেন? কিন্তু আমাকে মেরে আপনার কি লাভ হবে? আমি তো এত বড়লোক নই, অনাথ। সামান্য টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনা চালাই।
– তুমি খুন ইরিটেটিং একটা মেয়ে তা কি তুমি জানো?
– জানি, এখন হয়তো আপনার আমাকে ইরেটেটিং লাগছে। কিন্তু আমি অন্তত রাত আটটায় ওভারব্রিজের উপর বসে দুঃখবিলাস করছি না। জীবনটা একটাই বাঁচুন। প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া ব্যাতীত জীবনে অনেক সমস্যা থাকে। আর যে যাবার সে তো চলেই গেছে। তাকে নিয়ে চিন্তা করে কি কোনো লাভ আছে। সে হয়তো তার জীবনে সুখী আছে। কিন্তু বিনিময়ে আপনি রাস্তায় রাস্তায় টাক খাচ্ছেন, বাসায় যান
– সে আমার বড় ভাইয়ের ওয়াইফ। বাসায় গেলেও তার চেহারা চব্বিশ ঘন্টা আমাকে দেখতে হবে। উপদেশ দেওয়াটা অনেক সহজ। যার কষ্ট সেই বুঝে।

টিটকারির স্বরে কথাগুলো বলেই হাটা আরম্ভ করে অয়ন। মেয়েটি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন পেছনে ঘুরে তাকালো না, ইচ্ছে হলো না। দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকে যাবে আজ। বাসায় গেলেই বুকের নিভা আগুণটা আবার জ্বলে উঠবে। তবে অচেনা মেয়েটির একটি কথা যৌক্তিক ছিলো। সে তো ঠিকই সুখী আছে। পাছে অয়নের জীবনটা আধারে ঢেকে আছে, এই আধার কি আদৌ কাটবে!!
_______________________________________________________________________________________________

বারান্দায় সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে আবরার। দৃষ্টি তার বাহিরের দিকে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে এসে ঠেকেছে। সারা ঘর অন্ধকার। বাহিরের ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘরে আছড়ে পড়ছে বিধায় আলোছায়ার এক অসাধারণ খেলা সৃষ্টি হয়েছে। এই আবছা আলোতে রাইসার নিথর শরীরটি দেখা যাচ্ছে। অচেতন হয়ে ক্লান্ত শরীরটা পড়ে রয়েছে। পৈশাচিক অত্যাচার চলেছে এই শরীরটার উপর৷ ঘাড় কাত করে একবার সেদিকে দেখে নিলো আবরার। রাইসা তখন ও ঘুমে বিভর। রাইসার শরীরের ক্ষতগুলো দেখে গা টা শিউরে উঠলো আবরারের। এতোটা অমানুষ কিভাবে হয়ে গেলো। সে তো ভেবেছিলো রাইসাকে সময় দিবে। কিন্তু আজ কেনো যেনো কিছুতেই রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না সে। আজ যখন রাইসার সামনে অয়ন এসে দাঁড়িয়েছিলো অজান্তেই তার গাল ভিজে এসেছিলো। রাইসার মনের কোঠরে এখনো অয়নের নাম জ্বলজ্বল করছে। যা একেবারেই সহ্য হয় নি আবরারের। তবে হিতে বিপরীতটা ঘটলো, এখন হয়তো রাইসার মনের দরজা তার জন্য একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। এই দূরত্বটা শুধু বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে। আচ্ছা কখনো যদি একেবারেই হারিয়ে ফেলে সে রাইসাকে? চিন্তাটা মাথায় আসতেই শিউরে উঠে আবরার। না না এ কি ভাবছে, মনে মনে বলতে থাকে,
” যা আমার তা আমারই থাকবে। রাইসা আমার বিবাহিত বউ, এখন চাইলেও সে কোথাও হারাতে পারবে না। পারবে না”

আবরার বারান্দা থেকে রুমে ফিরে গেলো। রাইসাকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। তার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে চোখ বুঝলো সে। তার রাইসা, তার কাছেই আছে। কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারবে না। কখনো না

সকাল ৭টা,
সূর্যের তীর্যক রশ্নি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রাইসার। গতরাতে কখন অচেতন হয়ে পড়েছিলো তার খেয়াল নেই। চোখ খুলতেই নিজেকে আবরারের বেষ্টনীতে পেলো। আবরার তখনো ঘুমে মগ্ন। অবাক চোখে কিছুক্ষণ আবরারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো রাইসা। কি শান্ত লাগছে তাকে! ফর্সা চেহারা তাকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িটা যেনো বেশ মানানসই, খাড়া নাক, টানা টানা চোখের পাঁপড়ি, চুলগুলো কপালের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। কি সুন্দর ঘুমের মাঝে বিভর। মুখে কোনো রাগ নেই, নেই কোনো হিংস্রতা। হঠাৎ গত রাতের স্মৃতি মনে আসতে ঘৃণায় মন বিষিয়ে আসলো রাইসার। কোনো মতে নিজের তার বাহুর বেষ্টনী থেকে ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো রাইসা। ঝরণা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়ালো। নিজের শরীরের উপর যেনো ঘৃণা জন্মে গেছে। এই নোংরা শরীরটা নিয়ে অয়নের সামনে কি করে দাঁড়াবে সে! ঘষে ঘষে আবরারের স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছিলো সে। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছিলো না। শেষমেশ সেখানেই বসে পড়ে সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু সেটা পারছে না। মাথাটা চেপে ধরে কতক্ষণ ঝরণার নিচে বসে রইলো তার মনে নেই। মরে যেতে পারলে হয়তো এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো।

আধাঘন্টা পর বাথরুম থেকে বের হলো রাইসা। চোখ জোড়া ফুলে রয়েছে তার। নাকটা লাল হয়ে আছে। ভেজা চুল মুছে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। যুদ্ধ তো মাত্র শুরু। অয়নের মুখোমুখি হওয়া যে এখনো বাকি। আয়নার ভেতর থেকে আবরারকে একবার দেখে নিলো। এখনো ঘুমে কাঁদা সে। এখনই সময়, অয়নের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। কাল রাতে বাসায় দেখে নি তাকে। এখনো এসেছে কি না জানে না। তবুও তাকে অয়নের একটা খোঁজ নিতেই হবে। চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ঘর থেকে বের হতেই…………..

চলবে

[পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here