নেশাক্ত_তোর_শহর
পর্ব:: ০৭,০৮
ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৭
ব্র্যাক সিটে বসে আছে আয়াত তৃষ্ণা। আয়াত বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু একটা মনে হতেই ধীরে ধীরে সেটে গেল তৃষ্ণার দিকে। দৃষ্টি পূর্বের মতোই বাইরে আছে। শুধু নিজের সিট থেকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে তৃষ্ণা কিংবা সামনে বসে থাকা আরোহী আর ড্রাইভার কিছু বুঝতে না পারে।
তৃষ্ণার শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো পাশে। আয়াতকে নিজের খুব কাছে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিশ্চুপ হয়ে আরেকটু জানালার দিকে সেটে গেল। আয়াতের দিকে আর না ঘুরে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্বের ন্যায় তৃষ্ণার শরীর ঘেঁষে বসলো। সিটে রাখা তৃষ্ণার হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। শিউরে উঠলো তৃষ্ণা। বুকের ভেতরের ধুক পুকানী ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তিন ফুট দ্রুতে থাকা যে কেউ আওয়াজ শুনতে সক্ষম হবে। আয়াত সেই শব্দের তোয়াক্কা করলো না। বরংচ নিজের মাথাটা তৃষ্ণার কাঁধে রেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো।
স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। কোমরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠছে। তখন পাত্তা না দেওয়াতে এখন প্রচুর ব্যাথা করছে। সবটা বোধগম্য হতেই নিঃশব্দে হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকালো। আর জায়গা বাকি নেই। হাত ঝাড়া মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো..
— “আয় আমার কোলে এসে বস। সরি, আমার কোলে কেন বসবেন? একটা কাজ করুন হাতির কোলে গন্ডার বসুক। জীবনে কখনো তো দেখেন নি, এবার দেখে নিন”।
তৃষ্ণার বিরক্তিকর কন্ঠে সামনে বসে থাকা আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো পেছনে। সাথে সাথে তৃষ্ণার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল আয়াত। হাই তোলার ভঙ্গি করে মাথা চুলকে বলল..
— “দেখতে পারছিস পার্সোনাল সময় কাটাচ্ছি আর তুই তার বেঘড়া না দেওয়া পর্যন্ত থামবি না”।
সিটের উপর শরীরের সমস্ত ভড় দিয়ে আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে বলল..
— “এটা তোর বেডরুম নয় ব্রো। তাই পার্সোনাল সময়টা কন্সিনটেশন করিস না”।
লজ্জা পেল তৃষ্ণা। দুহাতে মুখ গুঁজে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার আগ পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে তেমন আর কোনো কথা হলো না।
.
আনমনে ক্যাম্পাসের ভেতরে দিয়ে হেঁটে চলেছে তৃষ্ণা। উদ্দেশ্য সোজা ক্লাসরুমে যাওয়া আর ক্লাস শেষে বাড়ি পৌছানো। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার ফলস্রুতি স্বরুপ অপরিচিত লোকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। কিছুদিন থেকে হুটহাট পড়ে যাওয়া একটা অভ্যসে দাঁড়িয়েছে তৃষ্ণার। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো।” কে রে” সম্পূর্ণ করতে পারলো না। চোখের অগোছালো পলকগুলো থেমে গেল। হারিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো তাজা হতে লাগল। তার সামনে রিজভী আর তিশা দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল তৃষ্ণা।দুজনকে পাশাপাশি কতোটা সুন্দর লাগছে। আচ্ছা যদি তিশার জায়গায় তৃষ্ণা থাকলো। তাহলে কি এতোটা সুন্দর লাগত। কথাগুলো ভেবেই জিভ কিটলো তৃষ্ণা। কিসব ভাবছে সে। এখন তৃষ্ণার উপর একমাত্র আয়াতের অধিকার। তার ভাবনা জুড়ে শুধু আয়াত থাকবে, রিজভী নামের কেউ না। ধরা গলায় মলিন হেসে বলল..
— “কেমন আছিস আপু। আমাদের ছোট পুচকু কেমন আছে রে। আর রিজভী.. মাই মিন ভাইয়া। আমার বোন এতো শুকিয়ে গেছে কেন? একটু কেয়ার টেয়ার তো করতে হবে।
আর তুই এই অবস্থায় বাইরে বেরিয়েছিস কেন? যা বাড়িতে যা আর হ্যা পুচকুর যত্ন নে,
মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল তৃষ্ণা। নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না। তবুও দূর্বল প্রমান করতে চায় না। অন্তত নিজের জন্য। ক্যাম্পাসের মাঝে বসে পড়লো সে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ভেবে আয়াতকে ফোন করলো।প্রথমবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হলো।
আয়াতকে কিছু বলতে না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তৃষ্ণা। ভড়কে গেল আয়াত। একটু আগেও মেয়েটাকে স্বাভাবিক দেখেছিল। সামান্য সময়ের ব্যবধানে কি এমন হলো। বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে সংযত করে আশ্বাসের কন্ঠে বলল..
— “পিয়াসু, এই পিয়াসু। কি হয়েছে তোমার পিয়াসু পাখি। আমাকে বলো”।
কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..
— “আয়াত ..! তুমি কোথায়? প্লীজ আমার কাছে এসো”।
— “চিন্তা করো না। আমি এখুনি আসছি। তুমি লাইন কেটে না”।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল আয়াত। আজকে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। মিটিং ক্যান্সেল করে দিলো।
অবশেষে এসে পৌঁছালো ভার্সিটির সামনে। ড্রাইভার আসে পাশে না থাকায় নিজেই ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে চলে এসেছে। যেন ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। প্রতিটা সময় ফোনে হ্যালো হ্যালো করে শান্তনা দিয়েছে। গাড়ি থামতেই ভার্সিটির ভেতরে ছুটল। তৃষ্ণার ক্লাস জিজ্ঞাসা করার আগেই চোখ গেল ক্যাম্পাসের ভিড় করা মানুষের মাঝে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তৃষ্ণা হাঁটু ভাঁজ করে নাক টেনে কাঁদছে। লাইন কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। চোখ বন্ধ করে শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তৃষ্ণার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হচ্ছিল তৃষ্ণাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
মুখ তুলে গালে হাত রেখে বলল..
— “এই পিয়াসু কাঁদছ কেন? চোখ তুলে দেখ, আমি এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। কি হয়েছে বলো আমাকে”।
চোখের সামনে আয়াতকে দেখে সময় অবিলম্ব না করে ঝাপিয়ে পড়ল চিবুকে। চাঁপা কান্না থামিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পিঠে হাত রাখলো আয়াত। জিজ্ঞাসু সুরে বলল..
— “কি হয়েছে পিয়াসু বলো আমাকে”?
চোখ তুলে আয়াতের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। যে-চোখে তার জন্য লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। তাকে শান্ত করার অদম্য ইচ্ছা। সেই ছেলেটাকে কিভাবে বলবে অন্য একটা ছেলের দেওয়া ধোঁকার জন্য এভাবে কাঁদছে। আচ্ছা আদোও কি সে এমন স্বার্থহীন ভালোবাসার যোগ্য। মাথা নিচু করে করুন সুরে বলল..
— “আসলে আমার ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। তাই এমন করেছি..
চোখ গরম করে তাকালো আয়াত। ইতিমধ্যে ভার্সিটি জুড়ে আয়াত তৃষ্ণার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দুহাতে বাহু ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল…
— “তোমার ধারণা আছে, আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ক্যান্সেল করে এসেছি। তাও তোমার এইসব ন্যাকামীর জন্য।
আর আপনাদের কোনো ক্লাস নেই, এখানে দাড়িয়ে ফালতু ন্যাকামো দেখছেন। আ’ম আয়াত রিদুয়ান। তৃষ্ণার হাসবেন্ড। এখন যান এখান থেকে”।
ধীরে ধীরে ভিড় জমানো ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করলো। সাথে সাথে ভেতরে ভয় জমতে শুরু করল তৃষ্ণার। কিন্তু আয়াত কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না। উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। খসে পড়া ব্যাগটা পূর্ণরায় কাঁধে ঝুলিয়ে আয়াতের পিছু পিছু ছুটল তৃষ্ণা। আয়াত যে তার উপর রাগ করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সত্যি কথাগুলো শুনলে হয়তো কষ্ট পেত, তারচেয়ে রেগে আছে এতেই ডের ভালো।
.
দু’জনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রিজভী -তিশা। বোনের কথা শুনে থামাতে এসেছিলো তিশা। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে বোনকে ধরার আগেই পাশ কাটিয়ে অন্য একটি ছেলে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গেল। প্রথমে ছেলেটির বিহেব বুঝতে ব্যর্থ হলেও পরে যখন হাসবেন্ড শুনেছে তখন চমকে উঠেছে। তার জানামতে তৃষ্ণা রিজভীকে ভালোবাসে। সামান্য কিছুদিনের তফাৎ এ কিভাবে এটা সম্ভব। মুঠোফোন থেকে তাহসানের নাম্বারে ফোন করল।
_____________________
— “এইযে শুনছেন? এভাবে মুখ ফুলিয়ে আছেন কেন? বলছি তো আ’ম সরি। প্লীজ এভাবে রাগ করে থাকবেন না। এই দেখুন আমি কান ধরছি”।(কানে ধরে তৃষ্ণা)
লুকিং গ্লাসে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আয়াত। এই নিয়ে ১৩ বার সরি বলছে কিন্তু আয়াত ফিরেও তাকায় নি। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই এক অদ্ভুত জাদু আছে। যতই চেষ্টা করছে কথা না বলতে ততই দূর্বল হয়ে পড়ছে।
ফোনটা বের করে কানে ধরা অবস্থায় একটা পিক তুলে নিলো। আকস্মিক ঘটা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল না তৃষ্ণা। কান ছেড়ে আয়াতের ফোন নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ ব্রেক করতে সামনে ঝুঁকে গেল তৃষ্ণা। সামনে তাকিয়ে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত গাড়ির চাবি নিয়ে, সিট বেল্ট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল..
— “আজ সারাদিন পার্কে ঘুড়বো আর বাদাম খাবো। যদি কেউ যেতে চায়। তাহলে যেতে পারে। আমার কোনোরুপ সমস্যা নেই”।
(চলবে)
#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৮
— “ঐ গন্ডরের বাচ্চা গন্ডার বললাম তো সরি। এবারও রাগ করে থাকবেন। আপনি জানেন, আমি একটবার হ্যালো বললে, সব ছেলেটা পাগল হয়ে যায়। দেখবেন”?
আয়াত তৃষ্ণার কথা এক কানে দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল। গা ছাড়ানো ভাব নিয়ে বাদামের লালচে খোসা গুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। সামান্য খোঁসা তৃষ্ণার মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ খুলে আয়াতের দিকে তাকাতেই মেজাজ বিগড়ে গেল তার।
— “আপনার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না”!
আর কিছু বলার আগেই আয়াত তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল..
— “প্রথমত গন্ডারের বাচ্চা অলওয়েজ গন্ডারই হয়, সিংহ নয়। আর দ্বিতীয়ত আমি সবসময় তোমার সাথে ছিলাম না। তাই তুমি হ্যালো বললে ছেলেরা পাগল হয়ে পাগলা গারদে যায় নাকি অন্য কোথায়, সেটা আমি কিভাবে জানবো।
তোমার ভয়েজ এতোটাই খারাপ যে, ছেলেদের হ্যালো বললেই পাগল হয়ে যায়। তুমি আবার তা গর্ব করে বলছ? হাউ ফানি”।
গভীরভাবে কিছুক্ষণ ভাবলো তৃষ্ণা। কথার মাঝে ফাঁক রাখলে যা হয় আরকি।” ওয়েট” বলে উঠে গেল তৃষ্ণা। আয়াতের সামনে ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে পড়লো। বাদাম খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এক্সজেকলি কি করছে তৃষ্ণা।
মাথার ঘোমটা ফেলে পায়ের উপরে পা তুলে ভাব নিয়ে বসলো তৃষ্ণা। চোখের দৃষ্টি মোহনীয় করে সামান্য দূরত্বের ছেলেটার দিকে তাকালো। ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দিল। চুলে কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে ছেলেটাকে চোখ টিপ মারলো। দুগালে হাত রেখে ইশারায় কথা বলছে।
তৃষ্ণার কান্ড দেখে পরপর ঢেকুর তুললো আয়াত। কিছুতেই কমছে না, যতোই তৃষ্ণার দিকে তাকাচ্ছে ততোই ঢেকুর বেড়েই চলেছে। বেঞ্চিতে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে দুই ঢোক খেয়ে সামনে তাকালো।
তৃষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে, দেখে মাথা গরম হয়ে গেল আয়াতের। বোতলটা দূরে ছুঁয়ে ফেলে এগিয়ে গেল তৃষ্ণার দিকে। শরীর থেকে ওরনাটা টান দিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিল।
থেমে গেল তৃষ্ণা। ওরনাটা ধরার আগেই আয়াতের হাতে চলে গেল। দুহাতে শরীর ঢেকে মাথা নিচু করে নিল। আয়াতের চোখের তাকানোর মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছেনা। আয়াত পকেট থেকে ফোন বের করে বলল..
— “ওরনাটার সাথে তোমার নোংরা বিহেব যাচ্ছে না। তাই খুলে নিলাম। এবার যেটা করছিলে সেটা কান্টিনিউড করো। আমি ভিডিও করছি”।
তৃষ্ণাকে শান্ত দেখে আবার বলল..
— “বুঝতে পারছি, আমার সামনে সমস্যা হচ্ছে। ঠিক আছে তারচেয়ে বরং আমি চলে যাই আর তুমি কান্টিনিউড করো”।
শিস বাজাতে বাজাতে আয়াত চলে গেল। আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল তৃষ্ণা।পার্কের সবাই বাজে দৃষ্টিতে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। বড্ড অভিমান জন্মালো তার উপর। কিভাবে পারল এমন পরিস্থিতিতে ফেলে চলে যেতে।
মিনিট দুয়েক পর কেউ একজন ওরনা পেঁচিয়ে দিলো তৃষ্ণা শরীরে। দুহাতে ওরনার ফাঁক দিয়ে কোমড় জড়িয়ে গলায় গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। চমকে উঠলো তৃষ্ণা। সে ভালো করেই জানে আয়াত এসেছে। আয়াতের অস্তিত্ব উপলব্ধি করে তাকে চিনতে হয়না। উষ্ণ স্পর্শগুলো জানান দেয় আয়াতের উপস্থিতি।
.
— “কি হলো, বাড়িতে যাবে না না-কি এভাবেই থাকবে”।(নিজের দিকে ফিরিয়ে আয়াত)
— “আসলে হাতি পড়ে গিয়েছিল তাই কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে। হাঁটতে পারবে না। কোলে নিতে হবে”।
বলেই হাতজোড় বাড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো তৃষ্ণা। আয়াতও হেসে তৃষ্ণাকে কোলে তুলে নিলো। এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যে দিকে।
__________________________
হাসি আনন্দের মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। ধীরে ধীরে তৃষ্ণার মনে অজান্তেই আয়াত জায়গা করে নিয়েছে। প্রায়ই আগের সেই কেয়ারিং আয়াতকে মিস করে তৃষ্ণা। কারণ আয়াত আর আগে মতো নেই। তৃষ্ণার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। সে চায়না তার কেয়ারিং এ তৃষ্ণা অস্বস্তিতে পড়ুক। প্রথমে তৃষ্ণার অতীত সম্পর্কে কিছু না জানলেও পরবর্তী তার মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনেছে। তাই তৃষ্ণাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে কাজের চাপে নিজের যত্ন নিতে পারে না। ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে অফিসে যাচ্ছে আর মাঝরাত করে বাড়ি ফিরছে। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় গাড়িতে অবস্থান করা সময় টুকু আর রাতে ঘুমন্ত তৃষ্ণার মুখটা মন ভরে দেখে আয়াত।
রাতের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে আবার মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাত নয়টার কাটা অতিক্রম করার আগেই জনশূন্য হয়ে পড়েছে শহর। রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলও অনেকটা কমে গেছে।
বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে আয়াত। ব্যাগটা সোফায় রেখে সুট খুলে রাখল। বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টির দিনে ঘুম ভালো হয় বিদায় সন্ধ্যা রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভেজা শরীর নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালে পেছন থেকে ঢেকে উঠল মনিকা..
— “আয়াত খাবারটা নিয়ে যা। নিচে আর আসতে হবেনা। দুজনে একসাথে খেয়ে নিস”।
পেছনে ঘুরে খাবার হাতে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো আয়াত..
— “মা! তৃষ্ণা খায়নি”।
— “জানি না মেয়েটার কি হয়েছে। সকালে সামান্য খেয়ে ভার্সিটিতে গেছে। দুপুরে আর খায়নি”।
বাক্য উচ্চারণ না করে খাবার নিয়ে উপরে চলে এলো আয়াত। অন্ধকারে গ্ৰাস করে আছে আয়াতের রুমটা। জানালা দরজা খোলা বিধায় বৃষ্টির পানিতে রুমের অনেকটা অংশ ভিজে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানিতে সবকিছু দিনের মতো আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। যেই ঝলকানিতে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা আয়াত দেখতে পারছে। যেই মুখের দিকে তাকিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না আয়াত।
খাবারটা টেবিলের উপর রেখে দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। ভেজা জামা কাপড়সহ ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে শান্তভাবে বলে গেল..
— “তৃষ্ণা খাবারটা খেয়ে আবার ঘুমাও। নাহলে অসুস্থ হয়ে যাবে”।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। আগের ভঙ্গিতেই তৃষ্ণা শুয়ে আছে। আলো জ্বালাতেই গোপনীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নজরে এলো আয়াতের। মেয়েটার এমন বিহেবের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলো না সে।
এগিয়ে গিয়ে তৃষ্ণার পায়ের কাছে বসে পড়লো। বাঙ্কেটের ভেতর থেকে পা বের করে কোলের উপর রাখলো। ধীরে ধীরে টিপে দিতে লাগল।
অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে ফিরে তাকালো তৃষ্ণা। মাথার ঘোমটা টেনে করতলের উপর ভর করে ধীরে ধীরে উঠে বসলো তৃষ্ণা। সময় নষ্ট না করে তৃষ্ণার পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। অতঃপর খাবার মেখে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিলো।
খেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু আয়াতের হাতে খাওয়ার সুযোগটা ছাড়তে চাইছে না। বড় করে হা করলো। আয়াত খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে বলল..
— “তৃষ্ণা আমি হয়তো জানি না এইসব দিনগুলো কেমন হয়। কিন্তু এইটুকু তো জানি, এই সময়ে স্বাভাবিক দিনের তুলনায় খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর হতে হবে। পাশাপাশি নিজের যত্ন নিতে হবে। কিন্তু তুমি দিন দিন কেমন আলসে হয়ে যাচ্ছ”।
তৃষ্ণা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়াতের কোলে উঠে বসলো। শক্ত করে আয়াতের গলা বেষ্টিত করে কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু শব্দে বলল..
— “আমি আলসে হয়ে গেছি তাতে কি? আমার আয়াত তো আছে, আমার জন্য! সে নাহয় তার পিয়াসু পাখির যত্ন নেবে”।
প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল আয়াতের মুখে। প্রথমবার আয়াতকে নিজের বলে দাবি করছে তৃষ্ণা। নিজেকে আয়াতের পিয়াসু পাখি বলে সম্বোধন করছে।
বাম হাত থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে তৃষ্ণার গালে হাত রাখলো। কিছু একটা ভেবে কপালের এপিঠ ওপিঠ ছুঁয়ে দিল। না জ্বর আসে নি।
.
ল্যাপটপের মৃদু আলোয় আয়াতের ক্লান্তিময় মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারছে তৃষ্ণা। কতো গুলো এই মুখটার বদলে ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থেকেছে তার হিসেব নেই। কিছুক্ষণের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মুখ খুললো তৃষ্ণা।
— “শুনছেন”?
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আয়াত। পূর্ণরায় ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বলল –“হয়”
— “বলছিলাম, আপনাকে আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে। প্রতিদিনই তো রাত জেগে কাজ করেন আজ ঘুমিয়ে পড়ুন”।
আয়াত কিছুক্ষণ ভেবে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল..
— “ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়বো। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে”।
(চলবে)