নেশাক্ত তোর শহর
পর্ব:০১
ইফা আমহৃদ
প্রেগনেন্সির রিপোর্ট দেখে মাথা ঘুরে উঠলো আমার। ফলাফল পজেটিভ।আজ আমার আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠার দিন। আনন্দের বদলে মনে রয়েছে এক রাশ অভিযোগ। প্রিয়জনদের প্রতি হাজারও অভিমান।এমন একটা যন্ত্রনাদায়ক দিন আমাকে আঁখিপাত করতে হবে, জীবনে কোনো দিন কল্পনা করতে পারি নি।ভাগ্য আজ বড়ই অদ্ভুত।নিয়তি আমার সাথে খেলছে।
হাত থেকে খসে পড়লো রিপোর্ট খানা। টানা টানা নয়নজোড়া দিয়ে ঘনঘন পলক ফেলে এগিয়ে গেলাম আপির দিকে। নিজের হাতের বাজে আপির হাত বন্দী করে নিলাম ।আশ্বাসে জরানো মলিন কন্ঠে বললাম..
— “আপি আমি জানি ,, এইসব কিছু মিথ্যা। তুই আর রিজভীর আমার ভালোবাসা পরিক্ষা করতে এমন টা করেছিস? বিশ্বাস কর, আমি রিজুয়ান কে নিজের চেয়েও বড্ড বেশি ভালোবাসি।তাই এইসব কিছু বন্ধ কর । দেখ সবাই এই নাটক সত্যি মনে মনে করেছে। একবার মুখ ফুটে বল সবাইকে ,, দেখবি কেও তোর উপর বিন্দু পরিমাণ রাগ করবে না”।
আপি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। চোখে চোখ রাখার মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছেনা হয়তো। বাঁধন আলগা করে হাত সরিয়ে নিল । তার এমন নত ভঙ্গিতে সবকিছু অগোছালো মনে হচ্ছে আমার। জানান দিচ্ছে সে বিন্দু পরিমাণ মিথ্যা বলছে না ।ধরা গলায় বলল..
— “এতোবড় একটা ব্যাপার নিয়ে কেন তোকে মিথ্যা বলতে যাবো, বল বনু । নিত্যতা আজ তোর সামনে ।আমি সত্যিই রিজভীনের সন্তানের মা হতে চলেছি”।
বোধশক্তি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি । ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে মনটা বিষিয়ে উঠেছে। নিজেকে সংযত করার বৃথা চেষ্টা চালালাম কিছুক্ষণ। কিন্তু বৃথা চেষ্টা বৃথাই রয়ে গেল। অজান্তেই হাতটা আপুর গালে চলে গেল। আমিই হয়তো প্রথম বড় বোনকে নিয়ে রেকর্ড গড়লাম। আপি ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল..
— “শেষে তুইও”!!
হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললাম…
— “চুপ কর তুই । সামান্যতম লজ্জা করছে না ।এতোবড় একটা ঘৃণ্যতম কাজ করে মুখ তুলে কথা বলতে । কি করে পারলি বড় বোন হয়ে ছোট বোনের ভালোবাসার মানুষটির সাথে .. ছিঃ”
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি । দুকদম এগিয়ে রিজভীর শার্টের কলার চেপে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললাম…..
— “ক-কেন?? কেন করলে এটা আমার সাথে । নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিল তোমায় । আর আজ এইভাবে আমার স্বার্থহীন ভালোবাসার মূল্য দিলে।একবার আমার কথা মনে পড়ে নি”।
কান্না করতে করতে রিজভীর বুকে মাথা রাখলাম ।বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। রিজভী দ্বিধা ধন্দ কাটিয়ে হাত রাখলো আমার পিঠে । অপরাধী কন্ঠে বলল…
— “আই এম সরি তৃষ্ণা। আমার কুকর্মের জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে ।আমি সব ঠিক করে দিবো ।আমি আমার সন্তানের অযত্ন করবো না।আর না তোমায় অবহেলা করবো”।
রিজভীর কথা শ্রাবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছালে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলাম তাকে । পরতে পরতে নিজেকে সামলে নিলো সে ।তৃক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম ….
— “লজ্জা করছে না,, এমন কথা বলতে । তুমি এতোটা নিচ , জানলে কখনো এতোটা ভালোবাসতাম না”।
–” তৃষ্ণা এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। যখন যার তার সাথে ঘটতে পারে । আমার সাথেও ঘটেছে ।আমি তো অস্বীকার করছি না।
আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আর না তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে” ।
তর্জনী দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু টুকু ক্লান্ত হাতে মুছে নিলাম। এতোবড় একটা ঘটনা এতো সহজে সমাধান করে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে বললাম..
— “এতোবড় একটা ঘটনা তোমার কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যাপার,, এক্সিডেন্ট । দুদিন পর যখন আমাকে ইউস করা হয়ে যাবে ,, তখন কি বলবে ??
আঙ্কেল- আন্টি আপনাদের ছেলেকে আর তার বাচ্চার মাকে নিয়ে যান” ।
নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না।একপ্রকার ঝড়ের বেগে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। দুহাতে মুখমন্ডল আড়াল করে বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কেঁদে চলেছি ।আজ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের দুজন মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে।
_________________________
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তৃষ্ণা । চোখের দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে আগুনের মাঝে। তিনমাস আগের দিনটাকে কিছুতেই মন থেকে অপনোদন করতে পারছে না।সেদিনের অপ্রত্তাশিত ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা মনে করে অন্তরাত্মা থেকে অফসৃত করতে পারছে না । ডাইরীর শেষ পাতাটা আগুনের মাঝে দিয়ে থামলো সে । ধোঁয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের শিখা নিয়ন্ত্রণে এলো ।আস্তে আস্তে নিভে ডাইরীর পাতাগুলো এক মুঠো ছাইতে রুপান্তরিত হলো।হাত দিয়ে ছাইগুলো মুঠোয় নিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল । চোখ বন্ধ করে শান্তির নিঃশ্বাস নিল সে । ডাইরীটা নিমিত্তে বাইরে কোনো রকম প্রভাব না পড়লেও ভেতরে দহনে প্রজ্বলিত হচ্ছে। কারো পদধ্বনিতে হুস ফিরলো তৃষ্ণার কিন্তু ফিরে দেখলো না। কে এলো-গেল তাতে তৃষ্ণার যায় আসে না। কিছুক্ষণ পর কাশির শব্দে ফিরে চাইলো ।তার স্নেহের বড় ভাই তাহসান রমিজ এসেছে । ধোঁয়াচ্ছন্ন রুমে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বিধায় কাশির সমস্যা হচ্ছে। তট জলদি উঠে জানালা, দরজা খুলে দিল । ইলেকট্রনিক্স সার্কিট প্রেস করে মাথার উপর ঝুলন্ত সিলিং ফ্যান আর বাতি জ্বালিয়ে নিলো । গ্লাসে পানি ঢেলে ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিল । অতঃপর ঝাড়ু এনে রুমের ভেতরটা পরিষ্কার করলো। ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে নয়ন জোড়া বেষ্টিত করে নিল ।
তাহসান রমিজ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন । আলোকিত রুমের অগোছালো অবস্থা দেখে মন কম্পিত হলো। তার কাছে আলোকিত রুমটার চেষ্টা অন্ধকারে বেষ্টিত রুমটাই শ্রেয় ছিল।
আজ থেকে পনেরো বছর সমীপে এক কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে তৃষ্ণার বাবা-মা মারা যায় । তখন থেকে দুই বোনকে বুকে আগলে বড় করেছে তিনি ।কখনো মাতৃত্ব- পিতৃত্বের অভাব বুজতে দেয় নি। বোনদের ইচ্ছেতে বছর চারেক আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন । তিনমাস ধরে এক বোনের জন্য অন্যবোনকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে , তৃষ্ণা একবারও মন খুলে কাঁদে না। বাইরে থেকে মনে হয় সবটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে । সকলের অগোচরে যন্ত্রনাটা আড়াল করে নিয়েছে ।
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন…
— “তৃষ্ণা বনু,, মন খারাপ তোর”??
চোখ তুলে তাকালো তৃষ্ণা। ভাইয়ের কাছ থেকে কখনো কিছু লুকোই নি । বেডের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলো । নিজের মাথাটা ভাইয়ের কাঁধে রেখে মলিন কন্ঠে বলল..
— “ভাইয়া, আমি কারো মায়ায় নিজেকে গভীর ভাবে হারাতে চাই । যে পুরোপুরি আমার । কখনো আমাকে ধোঁকা দিবে না । ভুলতে চাই রিজভীকে ।
এই বাড়িতে যতক্ষন থাকি দম বন্ধ হয়ে আসে আমার” ।
কিছুক্ষণ মৌন্যতা অবলম্বন করলেন তাহসান । তার বাবা মা ছোটবেলায় তৃষ্ণা- রিজভীর বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন । বাবার ইচ্ছেটা পূরন করতে , অনার্স কম্পিলিট করার পর রিজভীর হাতে তৃষ্ণাকে তুলে দিকে চেয়েছিল । কিন্তু তার আগেই তিশা রিজভীর সাথে গভীর সম্পর্কে লিপ্ত হয় । কৌতূহলী কন্ঠে বললেন..
— “কী বলতে চাইছিস তুই” ??
— “আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও” !
— “তোর পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি”?
— “তাকে কি হয়েছে ভাইয়া ।বিয়ের পরেও তো অনেকে পড়াশোনা করছে “।
দুই ভাই – বোনের কথায় ব্যাঘাত ঘটালো তাহসানের বউ শান্তার কথায় । বাইরে থেকে ক্রমাগত তাহসানকে ডেকে চলেছে । বোনকে ঘুমাতে বলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো সে ।
_________________
প্রায় দিন দুয়েক পর মধ্যবয়স্ক এক ভদ্র মহিলা তৃষ্ণাকে দেখতে এলেন । হালকা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পড়ে ঘোমটা টেনে তার সম্মুখে উপস্থিত হলো। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা টেনে মহিলাটির সকল প্রশ্নের জবাব দিলো। তাহসান আর মহিলার কথা বার্তার ধরণ দেখে মনে হলো,, তারা পূর্বের পরিচিত । তবুও মুখ তুলে তাকে দেখলো না। কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো। আসার আগেই ভদ্রমহিলা তৃষ্ণার হাতে ছোট একটা রিং পড়িয়ে দিলো। অতঃপর সেখানে কি হলে সে জানে না ।সেদিনের মতো বিয়ের পাকা পোক্ত করে তিনি চলে গেলেন ।
পরের শুক্রবার ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৃষ্ণার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে । ক-বু-ল শব্দটি উচ্চারণ করতে মিনিট দশেক সময় লেগেছিল । প্রিয় মানুষগুলো কথা খুব মনে পড়ছিল । পুরোটা সময় এক ধ্যানে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল । এই বুঝি তিশা রিজভী এলো বলে । কিন্তু এলো না । আসবে কিভাবে , তারা তো তৃষ্ণার বিয়ের কথা জানে না । জানলেও কি আদোও আসত ।
বিদায়ের আগ পর্যন্ত নিজেকে যথা সম্ভব সামলে নিয়েছে তৃষ্ণা । যতবারই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় , ভেতরে ভেঙ্গে আসে কান্নায় । ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে আসছে তার । ভয়ংকর নিঃস্তব্ধতা এসে গ্ৰাস করলো তৃষ্ণার মন মস্তিষ্ককে। আস্তে আস্তে হেলে পড়লো সে ।
চলবে…
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,, ধন্যবাদ )