শুভ্র_রঙের_প্রেম
পর্বঃ৩৬
লেখিকাঃ#রুবাইদা_হৃদি
মাটি থেকে উঠে আসা ঠান্ডা ভাব সাথে ঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা গুলো অনাবিল শান্তি দিচ্ছে ৷ ঝকঝকে রোদের আলোতে বিন্দু বিন্দু পানি গুলো চিকচিক করে উঠছে৷ জুতো হাতে খালি পায়ে পুরো ক্যাম্পাসের মাঠ জুড়ে আমি ছুটোছুটি করছি ৷ নীতি আর রাহাত ক্রুর চোখে তাকিয়ে আছে ৷ আঁচল ছাড়িয়ে দিয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ ফটাফট আমার একটা ছবি তুলে তোর প্রেমের গুরুর কাছে পাঠিয়ে দে তো! ‘
–‘ পারুম না! আমার ঠ্যাকা লাগছে? ‘
–‘ ফারিহার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর জন্য পায়ে ধরলেও আমার আর ঠ্যাকা লাগবে না ৷ ডিরেক্ট মশলা মিশিয়ে তোর সিঙ্গেল লাইফ পার্মানেন্ট করে দিবো৷ ‘
ও বিরস মুখে মোবাইল বের করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো৷ আমি নীতিকে টেনে নিয়ে রাহাতকে বললাম ওর ছবি ওর নিরামিষ জামাইয়ের কাছে পাঠাতে ৷
আমার কথা শুনে নীতি ক্ষেপে উঠে বলল,
–‘ পাঠাতে হবে না৷ ও থাকুক ওর কাজ নিয়ে৷ ‘
আমি আর রাহাত সুর টেনে বললাম,
–‘ ওওওওও! ‘
নীতি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো৷ আমি ধাক্কা দিয়ে বললাম,
–‘ তোর ও এর সাথে বুঝি ঝগড়াঝাটি হয়েছে? তাই এই ক্ষেপা বাঘিনী রুপ! ‘
–‘ সারাদিন অফিস আর রাতে পড়াশোনা ৷ আমার দিকে নজর দেওয়ার একদম টাইম নেই৷ স্নিগ্ধ ভাইয়াকে দেখ কতো কেয়ার করে তোর! ‘
বট গাছের নিচে ইটের শান বাধানো জায়গায় বসে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘ হ্যাঁ! এইজন্যই তো গত দুইদিন মহাশয়ের কোনো পাত্তাই নেই ৷ ঢাকা এসেই এনজিও তে চলে গেছে ৷ দিনে একবার ফোন দিয়ে ক্লান্ত গলায় গম্ভীর সুরে বলবে,
হৃদি, তুমি খাবার নিয়ে এতো অলসতা কেন করো? রাফিন কিন্তু টাইম টু টাইম খবর দিচ্ছে আমায়৷ কাজ শেষে ফিরতে দেও তোমার হেয়ালি করা ছুটাবো আমি ৷
গত দুইদিন উক্ত কথা বলেই ফোন কেটে দিয়েছে ৷
আমার কথা শুনে নীতি আর রাহাত হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ৷ এর মাঝেই মাধবী এসে বিরস মুখে আমাদের পাশে বসতেই রাহাত ছবি গুলো আমাকে দেখাতে দেখাতে ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–‘ তোর আমের আঁটির মতো মুখ এমন বাকায় রাখছোস কেন? মনে হইতাছে,তোর জামাই কেউ কাইড়া নিয়া গেছে ৷ ‘
রাহাতের কথা শুনে মাধবী কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
–‘ তোর জানিস না? ‘
–‘ কি জানবো?’
–‘ স্নিগ্ধ স্যারের নাকি বিয়ে হয়ে গেছে ৷ আর উনি নাকি আর ভার্সিটিতেও আসবেন না৷ ‘
মাধবীর কথা শুনে নীতি আমার দিকে চোখ মারতেই আমি গম্ভীর চোখে তাকিয়ে হালকা হেসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
–‘ কি বলিস! উনার বিয়েও হয়ে গেলো৷ ইশ!তুই তো প্রেমে পরার আগেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলি মাধবী৷ ‘
নীতি হাসি আটকিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
–‘ উনার বউ নিশ্চয় অনেক সুন্দর হবে তাই না? ‘
মাধবী উৎসাহ নিয়ে বলল,
–‘ তবে আমার ধারেকাছেও যেতে পারবে না ৷ ‘
ওর অতিরিক্ত কনফিডেন্স আমাকে বিরক্ত করে তুলে বরাবর৷ নিজেকে কি ভাবে ও? আমি রেগে কিছু বলার আগে রাহাত বলল,
–‘ হৃদি ও তোর ধারেকাছে যেতে পারবো না? ‘
মাধবী আমার দিকে তাকালো৷ আমি মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ও বলল,
–‘ আমি কি ওর কথা বলেছি না’কি? আজ স্নিগ্ধ স্যার এসেছেন দেখলাম ৷ সামির স্যার বলছিলো উনার বউকে নিয়ে এসেছেন ৷ উঁকিঝুঁকি মেরেও দেখতে পেলাম না৷ একটু পরেই দেখতে পাবো সবাই! তখন দেখা যাবে উনার বউ কেমন৷ ‘
মাধবীর কথা শুনে আমি একলাফে নেমে দাঁড়ালাম৷ অবাক হয়ে বললাম,
–‘ কোথায় আছেন উনি? ‘
–‘ মান্নান স্যারের কক্ষে৷ ‘
–‘ দেখেছিস আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি যে আজ আসবে ৷ ‘ আমি বলেই পাঁ বাড়ালাম৷ রাগ সংযত করার চেষ্টায় আছি৷ একে তো কাজে ব্যাস্ত তার উপর ফোন করেন না আবার আজ আসবেন সেটাও বলেন নি ৷ আমি কিছুদূর যেতেই সামনে তাকিয়ে দেখলাম মান্নান স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন৷ আমি উনাকে দেখেই উলটো দিকে ঘুরে নীতিদের কাছে এসে আবারও চুপিসারে পাঁ উঠিয়ে বসে পরি৷ মাধবী আমাকে দেখে বলল,
–‘ স্নিগ্ধ স্যারের বউকে দেখতে যাচ্ছিলি বুঝি? ‘
–‘ প্রতিদিন দেখছি৷ একটু আগেও দেখলাম৷ তুই দেখবি বুঝি? দেখ দেখ৷ ‘
মাধবী আমার কথার ধরণ বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে৷ আর আমি সামনে থেকে হেটে আসা মানুষটার দিকে ৷
উনি আর মান্নান স্যার আমাদের কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি ভদ্রতার খাতিরে মিষ্টি হেসে সালাম দিলাম৷ সালামের জবাব নিলেও তাকাচ্ছেন না আমার দিকে৷ লজ্জা পাওয়ার দরকার আমার আর আমি’ই দিব্যি হেসে হেসে কথা বলছি আর উনাকে দেখো মাথা নীচু করে রেখেছেম । রাগ আঁকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ এর মাঝেই ,মান্নান স্যার আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
–‘ মা শা আল্লাহ! দুইজনকে খুব ভালো মানিয়েছে৷ আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে৷ ‘
–‘ দোয়া রাখবেন৷ ‘
–‘ অবশ্যই! তোমরা ভালো থাকো সব সময়৷ আর স্নিগ্ধ ফোন দিলে অবশ্যই আসবে ভার্সিটি৷ তোমার জন্য এখনো স্টুডেন্টরা রিকুয়েষ্ট করে৷ ‘
–‘ it’s my pleasure.’
উনারা আমাদের সামনেই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছেন৷ নীতি আর রাহাত পাশে বসে চুপ করে আছে সাথে আমিও৷ কিন্তু মাধবী বিস্ময়ে হা হয়ে আছে ৷ ওর বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন মান্নান স্যার চলে যাওয়ার পর উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে হালকা কেঁশে বললেন,
–‘ কেউ কি আমার সাথে আজ কথা বলবে না, রাহাত? ‘
–‘ আঁকাশে মেঘ জমেছে আজ !আপনার উপর বিদ্যুৎ চমকাবে তাই সাবধান৷ ‘
রাহাতের কথা শুনে ওরা হেসে চলেছে ৷ আমি উপেক্ষা করে বললাম,
–‘ আজ আসবেন জানালেন না কেন? ‘
উনি আমার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে আমার মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন,
–‘ জ্বর এখনো যায় নি এর মাঝেই আবার বৃষ্টির পানি মাথায় পরতে দিয়েছো কেন? ‘
লজ্জায় মিইয়ে আশেপাশে তাকালাম৷ রাহাত নীতি চোখ বন্ধ করে একসাথে বলল,
–‘ আমরা কিছু দেখছি না৷ ‘
বলেই নীতি মাধবীর চোখের উপর একহাত দিয়ে দাঁত বের করে হেসে ঘুরে বসলো৷ আমি হতবাক ওদের কান্ডে।
উনি রুমাল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
–‘ বউকে নিয়ে যাচ্ছি বিচ্ছু বাহিনী৷ পেছন পেছন আসবে না,একদম ৷ ‘
রাহাত চিল্লিয়ে, ‘ ওকে দুলাভাই! ‘ বলতেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন গাড়ির সামনে৷ আমি হাত ছাড়িয়ে অভিমান করে বললাম,
–‘ ফোন করেন নি কেন? ‘
–‘ তখন ফোন করলে আজও কাজ শেষ করে আসতে পারতাম না৷ ‘
আমি গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে জোরে লাগিয়ে দিয়ে বললাম,
–‘ সারাদিন আজ আমার ব্যাক্তিগত মানুষটাকে চাই ৷ যার কাছে শুধু আজকের সময় টা আমার জন্য শুধুমাত্র আমার জন্য শুধুমাত্র আমার জন্যই বরাদ্দ থাকবে৷ ‘
উনি মাথা দুলিয়ে হাসলেন৷ আমার পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে হাতে হাত রেখে বললেন,
‘ ভেজা পাতার কারুকার্যে,তোমাকে খুজে বেড়াই ক্ষণে ক্ষণে
ভাবলে কি করে? তোমায় ছাড়া আছি আমি ভালো? ‘
আমি উনার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে প্রশান্তির শ্বাস নিলাম৷ এতো কোমল আর আদ্র কেন এই লোকটা?
আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি হাসছেন ৷ আমি মাথা উঁচু করে ছোট একটা পরশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে একনাগাড়ে বললাম,
–‘ ভালোবাসি.. ভালোবাসি.. ভালোবাসি৷ ‘
_______________
রোদের মিষ্টি আলোর লুকোচুরি খেলা করছে বারান্দা জুড়ে ৷ ঢালা বর্ষণের মাস! চারদিকে কালো মেঘের আনাগোনা! সেই ফাঁকে দু এক টুকরো রোদের দেখা মিলছে৷ সদ্য ভিজে উঠা কদমের ডালে ডালে ফুল ফুঁটতে আরম্ভ করেছে ৷ হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজে মুখোরিত আবার কখনো বিদ্যুৎ-এর ঝলকানি ৷
দূরে থাকা কদমের গাছটায় থেকে একজোড়া শালিক পাখি কিছুক্ষণ আগে হওয়া বৃষ্টির জন্য ভিজে একদম চুপ চুপে হয়ে একজন আরেক জনের গায়ের সাথে মিশে আছে৷ ভালোবাসা তো প্রত্যেক টা প্রাণীতে বিদ্যমান৷ সেটা পাখি হোক কিংবা মানুষ৷ তবে প্রকাশের ধরণ আলাদা ৷
গত বর্ষায় নবদম্পতির বৃষ্টি ভেজা দিনের কথা মনে হতেই স্নিগ্ধের বুকে মাথা গুজে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতেই উনি একহাতে শক্ত করে ঝাপটে ধরে আমায় ৷
আর কয়টা দিন তারপরেই এক বছর হয়ে যাবে এই মানুষটার সাথে আমার পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনের নাম ৷
স্নিগ্ধ আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,
–‘ এতো দ্রুত সকাল কেন হয়? ‘
আমি হাসলাম৷ প্রত্যেকদিন সকালে এই কথা দিয়েই দিন শুরু করেন উনি৷ আবেশে ল্যাপ্টে কঁপাল ছুঁয়ে আছে অবাধ্য চুল৷ প্রতিদিনের মতো আজও চুল গুলো সরিয়ে গাঢ় চুমু দিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন,
–‘ শুভ্রতায় রাঙা সকাল হোক শুভ্র পরীর ভালোবাসায়৷ শুভ সকাল! ‘
আমি উনাকে জড়িয়ে রেখেই বললাম,
–‘ আজ এনজিও তে যাবেন? ‘
–‘ যদি বলি না৷ ‘
উনার কথা শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম ৷ উনি মাথার নীচে হাত গুজে সন্ধিহান গলায় বললেন,
–‘ সারাদিন রোম্যান্স করার ইচ্ছা আছে বুঝি? ‘
আমি উনার কথা শুনে পাশে থাকা বালিশ ছুড়ে মেরে বললাম,
–‘ ছিঃ! কি সব কথাবার্তা৷ ‘
–‘ তাহলে আর কি! তুমি ভার্সিটি যাও আর আমি এনজিও তে৷ ‘
উনি গম্ভীর মুখে বললেন ৷ আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ আচ্ছা৷ ‘
আমি উঠে নামতে গেলেই একটানে আটকে দিলেন আমায় ৷ আমি টাল সামলাতে না পেরে পরে যাই তার উপর ৷ ব্যথা পাওয়ার মতো শব্দ করে বললেন,
–‘ ভারী হয়ে গেছো বেশী৷ ‘
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,
–‘ ধরে রেখেছেন কেন? ছাড়ুন!’
উনি হাসলেন৷ হাতের বাধন আরো শক্ত করে বললেন,
–‘ তোমার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় নিজেকে হারাতে চাই৷ তোমার নরম হাতটি ধরে হাটতে চাই দূর অজানায়৷ হারিয়ে যেতে চাই অজানা সীমাহীন কোনো রাজ্যে! যাবে কি? ‘
আমি আহ্লাদী কন্ঠে বললাম,
–‘ সত্যি? গত কয়েক মাস ঢাকা টু চট্রগ্রাম যেতে যেতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি ৷ ‘
উনি আলতো ভাবে ঠোঁট ছুইয়ে বললেন,
–‘ এক্সাম শেষ হোক৷ ভালো মার্কস পাও ৷ তারপর! ‘
আমি অসহায় চোখে তাকালাম ৷ এই লোকের সব বিষয়ে পড়াশোনা কে কেন টানা লাগে? আমি সিউর, পড়াশোনার হাত-পা থাকলে ছুটে পালাতো উনার থেকে….
চলবে…..
নোট~ নানা ঝামেলায় গল্পটার পরিচ্ছেদ একটু নড়বড়ে হয়ে গেছে৷ আজ এক্সাম কাল তো কাল আরেক এক্সাম৷ যাই হোক তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে চেয়েছিলাম তবে এইটার আরো কয়েকটা পার্ট যাবে৷