শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ৩৭

শুভ্র_রঙের_প্রেম
পর্বঃ৩৭

লেখিকাঃ#রুবাইদা_হৃদি
রুমের ভেতর আলো নিভানো৷ রাস্তার ধারে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভু নিভু ভাবে আবছা করে তুলেছে চারিপাশ ৷ বেলীফুল থেকে তীব্র সুগন্ধ ভরে উঠেছে ঘরময় ৷ চোখ-মুখ জ্বলছে আমার৷ অতিরিক্ত কান্না করার জন্যই এই পরিণতি ৷ অস্থিরতা গ্রাস করছে ক্ষণে ক্ষণে৷ কান্নার সুর নেই তবে অভিমান গুলো নিগড়ে পড়ছে৷ দেয়াল ঘড়িতে পৌনে বারোটার ঘন্টা বাজতেই আমি নড়েচড়ে বসলাম ৷ ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলছে সেই সাথে হুট হাট হালকা শব্দ ভেসে আসছে৷
দুদিন আগে ভার্সিটির মাঠে তিয়াস আবারও শাড়ির আঁচল ধরেছিলো৷ আমি ঘুরে পর পর দুইটা থাপ্পড় মেরেছিলাম ৷ খুব একটা ঝামেলা না হলেও এতো বড় ঘটনা ঘটবে আমি বুঝতেই পারি নি ৷
.
চারদিকে ভ্যাপসা গরমে হাসফাস অবস্থা৷ খা খা করছে রোদের তীর্যক রশ্মি৷ গরমে ঘেমে উঠা সর্বকুল৷ তিরতির করে একদল বাতাস ছুটে আসলেও মিলিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ ঠান্ডা শীতল করার আগেই ৷ নীতি ক্লাসের মাঝেই বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
–‘ চোখেমুখে পানি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না৷’

–‘ দিয়ে আয় ! ‘

–‘ আমার সাথে তুই ও আয়৷ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা নদীর পাড়ে চলে যাবো! দোস্ত মানা করিস না, প্লীজ৷ ‘
আমি ত্যাক্ত মেজাজে তাকাতেই ও হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসলো ৷ আজ রাহাত আসে নি৷ দূরে দেখলাম জান্নাত মেরুন কালারের জামা পরে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে ৷ আমি নীতিকে ওয়াশরুমের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে জান্নাতের দিকে এগিয়ে যাই৷
–‘ তোমারে বললাম আমারর বিয়া কর‍তে। আর তুমি না’কি অন্যের ট্যাগ লাগায়ছো এক বছর আগেই।’
পেছনে থেকে তিয়াসের কন্ঠের কথা শুনেই আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে৷ টানা দেড় বছর পর ওকে দেখেই আগের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ঘুরে চলে যেতেই আমার আঁচলে টান দিতেই আমি ঘুরে থাপ্পড় মেরে দিতেই ও হেসে উঠে৷ ওর মতো নির্লজ্জ আর বেহায়া পুরো ভার্সিটিতে আর কেউ নেই ৷ মেয়েদের টিজ করা বিভিন্ন অপকর্মের সাথে লিপ্ত থাকার জন্য গত দেড় বছর ধরে পুলিশ ওকে খুজছে৷ এতোদিন পলাতক ছিলো আজ আবার কোথা থেকে আসলো? ভেবে পাচ্ছি না!
হাত-পা কাঁপছে আমার৷ কঁপাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে ঘাম৷ তিয়াস হাসছে ৷ আমি চলে আসতে গেলে ও সামনে দাঁড়িয়ে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
–‘ নরম হাতের চড়! মনের উথাল-পাথাল ঢেউ বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ‘
–‘ সামনে থেকে সরুন৷ ‘
–‘ আচ্ছা গেলাম সরে৷ তবে চড়ের বদলে ফেরত কি দিবো? চুমু নিবে? ‘
বলেই গালে হাত দিয়ে ঘষে গা জ্বালানো হাসি হাসছে ৷ হাসি থামিয়ে আমার হাত ধরতে আসলেই মান্নান স্যারকে আসতে দেখে চলে যায়৷
সেদিনের ঘটনা নীতিকে বলতেই ও স্নিগ্ধকে জানাতে বলল। কিন্তু আমি না জানিয়ে নিজেই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি ৷ তবে আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় নীতিকে বিদায় দিয়ে আমি আর জান্নাত চৌ-রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষায় ছিলাম৷ আর তখন তিয়াস কয়েকজন ছেলের সাথে এসে আমাকে অশ্রাব্য কথাবার্তা বলতে শুরু করে ৷ আশেপাশে মানুষের ভীড় থাকলেও ও তাদের চোখের সামনে থেকেই আমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ৷ আমি ভয় পেয়ে জ্ঞান শূন্য হয়ে পরি৷ শুধু মনে হচ্ছিলো, ওর নোংরা স্পর্শ আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে৷ জান্নাত ঘাবড়ে গিয়ে আশেপাশের সবাইকে হ্যাল্প করার জন্য এগিয়ে আসতে বললেও কেউ কথা আসে নি ৷ আমার এক হাত মুক্ত পেতেই আমি হিজাবের দুটো পিন মাথা থেকে খুলে তিয়াসের হাতে ঢুকিয়ে দিতেই হাতের বাঁধন আলগা হতেই আমি ওকে জোরে ধাক্কা মেরে ছুটে পিছিয়ে গিয়ে জান্নাতের হাত ধরে ভীড়ের মধ্যে দৌড় দেই ৷
সিএনজি পেতেই মিরপুর এসে পরি ৷
জান্নাত বারবার বলছিলো স্নিগ্ধকে ফোন দেওয়ার কথা কিন্তু আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে শুধু ভাবছিলাম তিয়াস আমার হাতে স্পর্শ করেছে ৷ ঢুকরে বারবার কেঁদে উঠছিলাম৷ জান্নাত আমাকে বাসায় পৌছে দিতেই আমি রুমে গিয়ে দরজা লক করে বসে থাকি ৷ আম্মু,রাফিন,দাদুন সবাই বারবার জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দিই নি ৷ সবাই বাধ্য হয়ে স্নিগ্ধকে আসার জন্য কল দিতেই উনি আসলেও আমি দরজা খুলি নি।
কিছুক্ষণ বাদে, নিজেকে সামলিয়ে দরজা খুলে দিতেই উনি কোনো কথা না বলেই হাত ধরে টেনে বাসার নিচে নিয়েই গাড়িতে বসতে বলেন৷ আম্মু বারবার জিজ্ঞেস করছে,’কি হয়েছে! ‘
উনি ভদ্রতা বজায় রেখে বললেন,
–‘ আমার সাথে ছোট একটা বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে তাই রাগ করে আছে৷ ‘
–‘ এতো রাগ কেন তোর? ‘
আম্মু বলতেই উনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ বাসায় পৌছাতে অনেক রাত দেরি হয়ে যাবে আম্মু! আমরা বেরিয়ে যাই এখন৷ ফোন দিয়ে ইচ্ছামত বকে দিবেন আপনার মেয়েকে৷ বড্ড জ্বালায়া আমাকে ৷ ‘
অন্য সব দিন হলে আমি তেতে উঠতাম৷ কিন্তু আজ চুপ করে বসে হাত ঘষে যাচ্ছি বারেবারে৷ সবার থেকে উনি বিদায় নিলেও আমি মুখ ফুঁটে কিছু বললাম না ৷ উনি গাড়িতে উঠেই আমার হাত তার কোলের উপর রেখে গম্ভীর ভাবে শাসিয়ে বললেন,
–‘ চুপ করে বসে থাকো! ‘
আমি হাত টান দিতে গেলেই উনি চোখ গরম করে তাকাতেই আমি চুপ করে বসে থাকি৷
.
বাসায় পৌছে উনি ব্লেজার খুলে ছুড়ে ফেলে বললেন,
–‘ সাহসী হওয়া ভালো তবে সব চেপে গিয়ে অতিরিক্ত সাহসীকতা দেখাতে আমি বলি নি৷ ‘
আমি তবুও জবাব দিলাম না৷ উনি রেগে আমার কাঁধে হাত রেখে চিল্লিয়ে বললেন,
–‘ উত্তর দিচ্ছো না কেন? বোবা তুমি? এই মেয়ে এই! কি ভাবো তুমি নিজেকে? ‘
–‘ আ..আমি জানাতাম আপনাকে! ‘ কেঁপে উঠা কন্ঠে বলতেই উনি আমাকে ছেড়ে সেন্টার টেবিলে লাথি মারতেই তীব্র শব্দের আওয়াজে কেঁপে উঠলাম আমি৷ উনি রাগে নিজের ঘাড়ের পেছনের চুল হাত দিয়ে টেনে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ সব শেষ হওয়ার পর বলতে? তোমার ধার‍ণা আছে,আমি কি পরিমাণে টেনশনে থাকি তোমায় নিয়ে? আর সেই তুমি,গত দুইদিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা আমাকে জানাও নি৷ ‘

–‘ আমি ভাবি নি তিয়াস আবার এমন করবে৷ ‘

–‘ তুমি তো কিছু ভাবোই না ৷ সব ভাবনা তো আমার৷ কাজের চাপ জানো তুমি? সেই চাপ বাদ দিয়ে আমি ভাবি,কী ভাবে তোমাকে সেভ রাখতে পারবো! আমি মরে যাওয়ার আগে যেন তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে মরতে পারি৷ আর তুমি এতো বড় বিপদ উপেক্ষা করে আমাকে না জানিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

–‘ আর এমন হবে না৷ ‘

উনি আমার হাত টেনে ঝাকিয়ে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
–‘ আমার সামনে আসবে না তুমি ৷ কাজ ফেলে ছুটে এসেছি পাগলের মতো। আজ জান্নাত না বললে হয়তো জানতাম’ই না৷ তিয়াসের বিষয় টা আগে জানালে আজকের দিন দেখতে হতো না ৷ প্রত্যেক টা কাজে আমাকে দূরে ইভেন জানানোর প্রয়োজন মনে হয় না তোমার৷ আর আমি’ই পাগল! যে ছুটে ছুটে চলে আসে ৷ ‘
উনি হাত ছেড়ে দিয়েই ধুপধাপ পা ফেলে চলে যেতেই আমি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ি ৷ উপচে আসছে কান্না৷ আমি উঠে উনার কাছে যেতেই উনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
–‘ দূরে থাকতে বলেছি ৷’
অভিমানে কান্নারা হু হু করে আসছে৷ ছুটে বেডরুমে এসেই হাটু মুড়ে বসে কান্না করে যাচ্ছি৷ উনি টেনশন করবেন ভেবেই তো বলি নি ৷ আর উল্টো আমাকেই রাগ দেখাচ্ছেন৷
আমি সকাল হলেই চলে যাবো ৷ যেখানে উনার আমাকে বোঝানোর দরকার সেই জায়গায় আমার সাথেই রাগারাগি করছেন ৷ বড্ড পর হয়ে গেছেন আপনি!
থাকুন আপনি আপনার কাজ নিয়ে ৷ তিয়সের জন্য কথা শোনাচ্ছেন আমাকে৷ ওই হারামীটার জন্য আপনাকে পেলাম আবার ওর জন্যই আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন ৷
আমি নানান কিছু ভেবে এখনো মেঝেতে বসে আছি৷ একটু পর দরজার আওয়াজ হলেও আমি মুখ তুলে তাকাই নি ৷ উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে কাবার্ড থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যেতেই আমি কেঁদে উঠি আবারও ৷ আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছেন না উনি ৷ এই ভেবে অভিমানের পাল্লা ভারী হলো আরো ৷
উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বললেন,
–‘ সারারাত এখানেই বসে পার করার ইচ্ছা আছে না’কি? ‘
–‘ সারারাত কেন কাল সকাল দুপুর রাত এখানেই থাকবো৷ ‘ আমি ফুঁপিয়ে উঠে জবাব দিলাম৷ উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ উঠো! ‘
–‘ দরকার নেই সাহায্যর৷ আপনার কাজ করুন যান৷ আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার৷’
উনি হাটু মুড়ে বসলেন আমার সামনে ৷ মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াতেই আমি পেছনে সরে যাই৷ উনি কঁপালে ভাজ ফেলে বললেন,
–‘ কান্না থামাও৷ আমি মেরেছি তোমায়? ‘

–‘ না তবে আঘাত করেছেন৷ কথার আঘাত আর সেই সাথে দূরে ঠেলে দিয়েছেন ৷ ‘
নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন উনি৷ হঠাৎ করেই আমাকে কোলে উঠিয়ে নিতেই আমি চমকে গলা জড়িয়ে ধরি ৷ একটু আগের কথা মনে হতেই কন্ঠের খাঁদ নামিয়ে বললাম,
–‘ আপনার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন৷ ‘
–‘ তো থাকো দূরে৷ ‘
–‘ নামিয়ে দিন৷ ‘
উনি ওয়াশরুমের ভেতর গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
–‘ আমার বউকে তো দূরে থাকতে বলি নি৷ ‘
আমি উনার কথার আগামাথা না বুঝে বললাম,
–‘ আমি মানে আপনার বউ ৷ আর আপনার বউ মানে আমি৷’
উনি জবাব না দিয়ে হাসলেন৷ আমাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য এইসব বলছেন উনি!
মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে আমার চুলের বেণী খুলে দিচ্ছেন যত্ন করে ৷ খুলতে খুলতে বললেন,
–‘ ছোট একটা ঘটনা থেকে বড় ঘটনার সৃষ্টি হয়৷ আর আমি চাই না সেই ঘটনার বিন্দুমাত্র রেশ তোমার জীবনে পরুক৷ ‘
–‘ আমি সব জানাতাম আপনাকে! ‘
–‘ হুশ! বলতে দেউ আমায়৷ ‘ উনি আমার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বললেন৷ তারপর চুল গুলো খুলে একপাশে সযত্নে রেখে বললেন,
–‘ আমি আমার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস তোমার জন্যই নিচ্ছি ৷ তোমার ছোট একটা আঁচ পরলে আমার বুকে তীব্র কষ্ট হয় ৷ সারাদিন হারানোর ভয় করে৷ কেন করে? ‘
উনি প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বললেন৷ আমি দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম৷ উনি আমার মাথা তার বুকের সাথে চেঁপে ধরে বললেন,
–‘ কারণ আমি তোমাকে চাই৷ নিজের মৃত্যুর শেষ কাটা পর্যন্ত৷ তোমার হাত ধরে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতেও একদম কষ্ট হবে না৷ কিন্তু তোমার কিছু হলে সেটা আমার মৃত্যুর থেকেও বহুগুণ কষ্টে পুড়াবে আমায় ৷ ‘
–‘ আর হবে না এমন৷ তবুও আপনি মৃত্যুর কথা বলবেন না৷’
উনি আমার মাথা উঠিয়ে ঠোঁটে গাঢ় চুমু দিলেন ৷ ঝরণার পানিতে কিঁছু মূহুর্তের ভালোলাগা প্রগাঢ় সাক্ষীতে মিশে যাচ্ছে৷ উনি চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন,
–‘ আমার মৃত্যুর সাধারণ সত্যিটা কল্পনা করতে পারো না তুমি৷ তাহলে ভাবো আমি কেমনে সহ্য করি তোমার কিছু হলে?’
আমি উনার বুকের বাঁ পাশে মাথা রেখে চোখ বোজে রইলাম ৷ উনি আমার মুখ নামিয়ে কাঁধে চুমু দিয়ে বললেন,
–‘ আমি চাই আমার শুভ্র পরী সর্বক্ষণ আমাতেই বিভোর থাক৷ তার আশেপাশে যেন আমি’ই বিরাজ করি৷ সব বিপদ আমার কাছে আসুক তবুও তোমায় যেন ছুতে না পারে…!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here