মায়াবিনী মানবী,পর্ব_১২,১৩
হুমাশা_এহতেশাম
পর্ব_১২
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই দরজার সামনে আনবক্স স্মার্টফোন দেখলে যে কোন ব্যক্তিই অবাক হবে।তবে জুইঁর অবাক এতটুকুতেই নয়।তার অবাকের মাত্রা চরম পর্যায়ের হওয়ার কারণ হলো দরজার সামনে থাকা আনবক্স স্মার্টফোন আর তার সাথে থাকা শুভ্র বর্ণের জামদানি শাড়ি, দুমুঠো শুভ্র বর্ণের চুড়ি।এদের মধ্যে থেকে শাড়ির উপর রাখা শিউলি ফুলের মালাটা জুইঁকে তার রূপ প্রদর্শনে ব্যস্ত।
ফুলের ব্যাপারে জুইঁ একটু বেশিই দুর্বল।ধুতরা ফুল থেকে বেলীফুল হোক কিংবা গন্ধরাজ ই হোক না কেন সবই জুইঁর পছন্দের। জুইঁ কখনো কোন ফুলেরই তুলনা করে দেখে নি।
সর্বপ্রথম জুইঁ শিউলি ফুলের মালাটাই ফ্লোর থেকে হাতে তুলে নিল।নাকের অতিকাছে নিয়ে বুক ফুলিয়ে প্রাণ ভরে লম্বা এক দম নিল।সঙ্গে সঙ্গে ই জুইঁর মুখমন্ডলে হাসির ছাপ প্রগাঢ় হতে লাগলো।
পরমুহূর্তে ই জুইঁর বাকি জিনিস গুলোর কথা মনে পড়তেই ফ্লোর থেকে ওগুলো উঠিয়ে নিল।সামনে ই আলআবির দরজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখতে পেল আলআবির দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক। সচারাচর আলআবি বাসায় থাকলে রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করাই থাকে।জুইঁর এ বিষয়ে জানা আছে। তবে সেই সাথে এও জানা আছে যে আলআবি অফিসে বা বাইরে গেলে দরজা চাপিয়ে রেখে যায়।অর্থ্যাৎ এখন যেমন কিঞ্চিৎ ফাঁক করা অবস্থায় আছে। তখনও এরূপ ই থাকে।
আলআবি বাসায় নেই। জুইঁ বুঝতে পেরে ওই জিনিস গুলো সমেত রুমে এসে পড়ে। আলআবি এখন বাসায় থাকলে জুইঁ সরাসরি আলআবির কাছেই যেত।আর শাড়ি,চুড়িগুলো দেখাত।কারণ আলআবি ছাড়া এবাড়িতে এমন কেউ নেই যে এভাবে কারো অগোচরে এসে জুইঁকে এসব দিয়ে যাবে।তার উপর আবার জুইঁ তো আজকে রাতে চলে যাবে।সব মিলিয়ে জুইঁর কেন যেন মনে হচ্ছে আলআবি ই রয়েছে এর পিছনে।সাদা চুড়ি গুলো দেখে জুইঁর বারবার করে মানতে ইচ্ছে করছে এই কাজ টা আলআবিরই যেন হয়।
জুইঁ ভেবে নিয়েছে যদি এগুলো তাকে আলআবি ই দিয়ে থাকে তাহলে সে প্রত্যেকটা জিনিস ই গ্রহন করবে। তবে ফোনটা কোন মতেই সে নিতে পারবে না।
জুইঁর বাবা সোজা বলে দিয়েছে ভার্সিটির আগে কোন ফোন হবে না।তার নিয়াজ ভাইর বেলায়ও এরকমটাই হয়েছিল। জুইঁর নিয়াজ ভাইকে তার বাবা ভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখার পরে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল।বাড়িতে ওই একটা স্মার্টফোন ছাড়া আর কোন স্মার্টফোন নেই। জুইঁর মাকে জুইঁর বাবা নোকিয়ার একটা বাটন ফোন দিয়েছে আর নিজেও নোকিয়ার একটা বাটন ফোন নিয়েছে।এ নিয়ে জুইঁর আক্ষেপের কোন শেষ নেই। কিন্তু তার এই আক্ষেপ শুধু মনে মনে ই।
আলআবি বাসায় নেই বলে আজ সকালে হাটতে যাওয়া হয়নি।জুইঁ ওগুলো টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখ মুছতে মুছতে জুইঁ একপলক টেবিলের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ মুছতে থাকে।হঠাৎ করেই মনে হলো শুভ্ররাঙা চুড়ির মধ্যে শুভ্র রঙের ই কিছু একটা দেখল।জুইঁ টেবিলের আরও নিকটে গিয়ে পরখ করতে ই দেখল চুড়ির সঙ্গে সুতোয় বাঁধা একটা ছোট চারকোণার চিরকুট ফ্যানের বাতাসে নিজেকে দুলিয়ে যাচ্ছে। দুলতে থাকা চিরকুট নিজের গায়ে “#মায়াবিনী_মানবীর জন্য” লেখা জড়িয়ে আছে।
জুইঁ সন্তপর্ণে চিরকুট টা খুলে কয়েকবার লেখাটায় হাত বুলিয়ে নিল।আলআবির বলা সেই-
“#মায়াবিনী_মানবী পাশে থাকলে গার্লফ্রেন্ডের কি দরকার?” কথা টার মানে জুইঁ এখন ভালো করেই বুঝতে পারছে।
জুইঁর মুখের হাসি যেন আজ ফুরচ্ছেই না।জুইঁ হাতে চুড়ি গুলো পড়ে ঘরময় রিনরিনে আওয়াজের মেলা বসিয়ে দিয়েছে।শিউলিফুলের মালা একবার নাকের কাছে নিচ্ছে তো একবার হাতখোপায় গুঁজে দিচ্ছে। শাড়ি টা একবার গায়ে মেলে ধরছে তো একবার মাথায় ঘুমটার ন্যায় দিচ্ছে।
ছোট শিশু যখন তার নতুন কোন খেলনা পেলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বারবার তা নেড়েচেড়ে খেলা করে জুইঁও তেমন করছে।খেলনা পাওয়া শিশু আর জুইঁর মধ্যে এখন তফাত পাওয়া মুশকিল।
সকালে আজ সব নাস্তা জুইঁ নিজ হাতে বানিয়েছে। বায়না ধরেছে দুপুরের খাবার ও জুইঁ নিজ হাতে রান্না করবে।এখন মিসেস পারভীন এর সঙ্গে রান্নার ব্যাপার নিয়েই লড়ে যাচ্ছে জুইঁ। সবশেষে সিরাজ সাহেব ওদের লড়াই দেখে জুইঁ কে বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। মানে জুইঁ দুপুরে রান্না করবে।তবে লিপি জুইঁ কে সাহায্য করবে।
রান্নায় সকলের পছন্দের একটা করে আইটেম থাকবে।সিরাজ সাহেবের একটা, মিসেস পারভীন এর একটা,আলআবির একটা।
জুইঁ মিসেস পারভীনের থেকে জানতে পারে আলআবি সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে।কম্পানি খুব বড় একটা ডিল পেতে চলেছে। তাই কয়েকদিন রেগুলার অফিসে যাবে আলআবি।
দুপুরের লাঞ্চ করে রুমে এসে বসেছে জুইঁ।আলআবির জন্য ড্রাইভারকে দিয়ে লাঞ্চ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জুইঁর হাতে মিসেস পারভীনের ফোন। ফোনের ওপাশে রয়েছে জুইঁর মা।কথা শেষ করে জুইঁ মিসেস পারভীন কে ফোন ফেরত দেয়ার জন্য অগ্রসর হয়েও আবার পিছিয়ে গেল।পুনরায় ডায়াল নাম্বারে গিয়ে সাদুর নাম্বারে কল লাগালো।উদ্দেশ্য মাত্র একটা ই তাহলো জুইঁ যে আজ যশোর আসবে তা জানানো।
সাদুর সাথে কথা বলে জানতে পারে সাদমান ভাইর কথা সাদুর পরিবারে জেনে গিয়েছে। তাই বলে ওকে পরিবার থেকে একটু বকাঝকা শুনতে হয়েছে। বকা খেয়েও সাদু খুশি। কারণ দুই পরিবার ওদের দুজনের বিয়ে নিয়ে আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল।এখন পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সাদমানের পড়াশোনা শেষ হলে কেবল আকদ করিয়ে রাখবে।পরে সাদমান নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে সাদুকে অনুষ্ঠান করে বাড়িতে নিবে।
জুইঁ সাদুকে আলআবির কথা আর বলে না।বলেছে সাদুর জন্য সারপ্রাইজ আছে।আসলে জুইঁ সাদুকে সব সামনা সামনি ই বলতে চায়।আর কাল সকালে তো সাদুর সঙ্গে দেখা ই হচ্ছে।মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধান মাত্র।
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল।আলআবি এখনো বাড়ি আসেনি।আসরের নামাজ পড়ে জুইঁ ড্রয়িংরুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে আর দরজায় চোখ বুলাচ্ছে।মিসেস পারভীন এসে জুইঁকে বলল…
–জুইঁ তোর জামা কাপড় গোছানো সব?
–না। গোছানো হয়নি তো কিছু। (জুইঁ)
মিসেস পারভীন ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন…
–সেকি।আরে যা যা তারাতাড়ি গুছিয়ে নে সব।বাড়ি গিয়ে আবার বলবি এটা আনি নি ওটা আনি নি।গুছানো শুরু কর যা।
জুইঁ ধীর পায়ে রুমে এসে সব গুছাতে লাগলো।সব গুছানোর শেষে কিছু একটা মনে করে শিউলি ফুলের মালাটা নিজের কাছে রেখে শাড়ি,চুড়ি আর ফোনটা হাতে নিয়ে আলআবির রুমে ঢুকে পরলো। রুমে ঢুকে জুইঁ থ হয়ে গেল।রুমে দুপাশে ই বইয়ের বিশাল বড় বড় দুটো সেল্ফ।রুমে মাঝ বরাবর হালকা নীলরঙা চাদর বিছানো বেডে দুটো বালিশ পাশাপাশি রাখা। এই বেডেই বেনজি আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। বেনজিকে ঘুমাতে দেখে কিঞ্চিৎ পরিমাণে হাসলো জুইঁ।বিশাল জানালার ধারের কম্পিউটার টেবিলটার উপর জুইঁ হাতের জিনিসপত্র গুলো রেখে দিল।ধীর পায়ে বেনিজর কাছে গিয়ে আদর করতে গিয়েও থেমে গেল।ভাবলো বেচারার ঘুম টা শুধু শুধু ভেঙে দিয়ে কি লাভ।
জুইঁ আলআবির রুম থেকে বের হয়ে আসতেই কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে গেল।জুইঁর মাথা কারো বুকের বা পাশে গিয়ে ঠেকলো।ব্যক্তিটার গা থেকে ভেসে আসছে পারফিউম আর ঘামের মিশ্রনের একটা গন্ধ।গন্ধ টা সহ্য করার মতো।জুইঁ বুঝতে পারছে এটা আলআবি। সেই সাথে আলআবির শ্বাসক্রিয়া জুইঁকে জানান দিচ্ছে যে আলআবি হাঁপাচ্ছে।এভাবে থাকায় জুইঁর কিছু টা অস্বস্তি হচ্ছে। তাই জুইঁ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
আলআবি জুইঁর সামনে ক্লান্ত মুখে ঘামে ভেজা শার্টে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার চোখ দুটো স্তব্ধ।এই চোখ আজ একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে জুইঁ কে।
জুইঁ আলআবি কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা গলা ঝেড়ে নিল।আলআবির হুঁশ ফিরতেই দ্রুত বলতে লাগলো…
–সরি! সরি!রিয়েলি সরি!আমি ভেবেছিলাম তোমাকে দেখতে পাব না।তার আগেই তুমি চলে যাবে।তোমাকে দেখতে পেয়ে তাই ভুলবশত জড়িয়ে ধরে ফেলেছি।সত্যি সরি!
আলআবির এরূপ অবস্থা দেখে জুইঁ নিঃশব্দে ই হেঁসে কুটি কুটি হতে লাগলো।আলআবি কে উদ্দেশ্য করে বলল…
–ঠিকাছে। আমি কিছু মনে করিনি।এতো সরি বলা লাগবে না।
পরমুহূর্তেই আবার আলআবি কে উদ্দেশ্য করে জুইঁ সন্দিহান হয়ে বলল…
–তা আমাকে না দেখলে কি হতো?মানে আমি চলে গেলে আপনার কি?
আলআবি কাতর কন্ঠে বলে উঠলো…
–তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না আমার কি।
আলআবি এরপর জুইঁর চোখে চোখ রেখে বলল…
–সকালে কিছু ই পাওনি?
জুইঁ বুঝতে পেরে বলল…
–কি পাব?কিছু পাওয়ার কথা ছিল কি
জুইঁর কথায় আলআবি স্পষ্ট দুষ্টুমির আভাস পেল।
আর তখনি আলআবির চোখ পড়ল টেবিলের উপর। আলআবির দেয়া জিনিস গুলো নিজের রুমে ই দেখে আলআবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জুইঁর উপর।তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল…
–এগুলো ফেরত দিতে এসেছ তুমি?
জুইঁ না বোঝার ভাব করে বলল…
–কোন গুলো?
আলআবি দাঁতে দাঁত পিষে বলল…
–আমার দেয়া গিফ্ট তুমি আমাকেই রিটার্ন করছ?সাহস হলো কি করে তোমার?
অবস্থা বেগতিক দেখে জুইঁ হড়বড় করে বলতে লাগলো…
–আমাকে গিফ্ট কোথায় দিলেন আপনি? গিফ্ট কি কেউ এসে দরজার সামনে রেখে যায়?দেখেছেন জীবনে কখনো এমন?আপনাকে ই কেউ দরজার সামনে এসে গিফ্ট রেখে দিয়ে চলে গেলে আপনি তা নিতেন?আমি কেন নিব?
আলআবি জুইঁকে পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর থেকে ওগুলো নিয়ে জুইঁর সামনে ধরে বলল…
–নিন তোতাপাখি! এবার এগুলো গ্রহন করুন।
জুইঁ আলআবির কথায় ফিক করে হেসে দিয়ে বলল…
–আমি এগুলো নিলেও এই ফোনটা নিতে পারবো না।
আলআবি ভ্রুকুচকে বলল…
–কেন?ফোনে কি সমস্যা?
–এটা নিয়ে আমি কি করব?আর বাসায় কি বলবো?বাবা আমাকে ভার্সিটির আগে ফোন দিবে না। (জুইঁ)
–তোমার বাবা কি করবে জানি না।কিন্তু এখন এটা না নিলে আমি যে এত কষ্ট করে ছবি গুলো বাঁধাই করিয়ে আনলাম তা তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দিব। (আলআবি)
–উফ! আপনি কিছু বুঝতে চান না।আমি এই ফোম দিয়ে কি গরুর ঘাস কাটব?(জুইঁ)
–আমার সঙ্গে কথা বলবে। (আলআবি)
হুট করে ই জুইঁ মুখ ফসকে বলে ফেলে…
–কেন আমরা কি প্রেম করছি যে আপনার সঙ্গে কথ বলতে ই হবে।
আলআবি দুষ্টু হেসে বলল…
–এখন করছি না তো কি হয়েছে? তখন করব।
কথা শেষ হতেই আলআবি জুইঁ কে একটা চোখ টিপ মারে।
চলবে………….
#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৩
নারীর ষষ্ঠেন্দ্রীয় নাকি তুমুল প্রখর হয়। তবে সব নারীর বেলায় কি এমন হয়?হয়তো বা হয়।জুইঁর ষষ্ঠেন্দ্রীয়ও আজ কিছু একটা ঠাহর করতে পারছে।কোন ছেলে কখনো এমনি এমনি প্রেম করবে বলবে না। এমনি এমনি একটা মেয়েকে ফোন কিনে দিয়ে বলবে না তার সাথে কথা বলতে হবে।আবার এমনি এমনি ই শাড়ি চুড়ি গিফ্ট করবে না।
তখন আলআবির রুমে আলআবির শেষ কথার পরেই হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে আলআবি জুইঁ কে একটা কথা ও বলতে না দিয়ে ফোনটা জুইঁর হাতে গুঁজে দেয় আর বলে…
–এটা নিয়ে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।কথা বলতে হলে শুধু আমার সাথে ই কথা বলবে আর প্রেম করতে ইচ্ছে হলে সেটাও আমার সাথে ই করবে।
আলআবি তার কথা শেষ করে ই দ্রুতপায়ে বেলকনিতে চলে গেল।আলআবির প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে ই লিপি রুমে প্রবেশ করে। লিপি কে দেখে জুইঁ ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি টেনে আনে। লিপি জুইঁ কে আলআবির রুমে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল…
–জুইঁ একলা একলা কি করো এইহানে।
জুইঁ লিপির প্রশ্নে কিছু টা ঘাবড়ে গেল।আলআবির সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে এটা এবাড়ির সবাই ই জানে।তবে জুইঁ যে কখনো আলআবির রুমের দিকে পা বাড়ায় না সেটাও সকলে জানে।
জুইঁ চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বেনজিকে দেখে বলে উঠলো…
–আসলে চলে যাব তো কিছুক্ষণ পরেই তাই বেনজিকে একটু আদর করে যেতে এসেছি।
লিপির সামনেই বেনজির গায়ে জুইঁ হাত বুলাতে লাগল। এতক্ষণে বেনজিও উঠে গিয়েছে।লিপি জুইঁ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো…
–তোমারে রেডি হইতে কইছে খালায়।তোমার রুমে গিয়া তো তোমারে পাই নাই এদিক দিয়া যাওনের সময়ই তোমারে চোখে পড়ল।এহন তাইলে যাও যাইয়া রেডি হও।
জুইঁ কিছু একটা ভেবে লিপিকে বলল…
–আচ্ছা আপনার কাছে কি কালো রঙের ব্লাউজ হবে?
লিপি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল…
–হ!হ! আছে তো কি করবা?
জুইঁ লাজুক এক হাসি দিয়ে বলল…
–শাড়ি পড়ব।একটু পড়িয়ে দিবেন?
–আইচ্ছা আইচ্ছা দিমুনি। (লিপি)
এরপর ই দুজন আলআবির রুম থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। ওপাশে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা আলআবির তৃপ্ত হাসির সে আর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ সাক্ষী রইল না।
বর্তমানে শুভ্র বর্ণের সেই শাড়ি পড়ে কালো বর্ণের হিজাব পড়তে ব্যস্ত এক রমনী।চোখে তার ঠাঁই পেয়েছে চিকন কাজল রেখা।এছাড়া মুখমন্ডলে নেই কোন সাজসজ্জার সরঞ্জামের ছোঁয়া। এই রমনীই যে জুইঁ তা বোঝা বড় দায়।কারণ এই শাড়ি নাকি ক্ষনিকের মধ্যেই কিশোরী থেকে যুবতীতে পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা বহন করে বেড়ায়।তেমনি জুইঁ কেও এই শাড়ি পরিণত করেছে আজ এক যুবতী রমনীতে।
ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে সময় এখন রাত ৯টা বেজে ৩০ মিনিট। ড্রইংরুমে মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব আর তাদের ছেলে আলআবি অপেক্ষায় আছে জুইঁর।অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চুড়ি পরিহিত হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে সন্তপর্ণে নেমে আসে জুইঁ।এই রমনীকে দেখেই আলআবি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে…
–মাশাল্লাহ!তোতাপাখি আল্লাহ তোমাকে সর্বদাই এমন ভাবে রাখুক।
নিচে নামতেই মিসেস পারভীন জুইঁ আর লিপি একধাপ প্রসংশা করলেন।সকলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে জুইঁর ঠিক পিছনেই আলআবি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি তে ব্যাগপত্র ওঠানো হচ্ছে।
হুট করে জুইঁ টের পায় আলআবি জুইঁর কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগের চেন খুলে কিছু করছে।জুইঁ পিছনে ফিরতেই আলআবি ফিসফিসে আওয়াজে বলে উঠলো…
–চিন্তা করো না কিছু চুরি করছি না।বাড়ি গিয়ে দেখে নিও।আর না দেখলেও চলবে তিনদিন পরতো আমি নিজেই যাচ্ছি যশোর।
জুইঁ পিছনে আলআবির দিকে কিছু টা ঝুঁকে আলআবির ফিসফিসে কন্ঠের ন্যায় ই বলল…
–আবার কি দিয়েছেন। এমনিই টেনশনে বারবার গলা শুকিয়ে আসছে।বাবা যদি একবার জানতে পারে আমার কাছে ফোন আছে তাহলে সেদিনই বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
আলআবি দুষ্টুমি ভরাট করা কন্ঠে বলে উঠলো…
–তাহলে তো ভালই।আমার রুমে গিয়ে বসবাস শুরু করে দিও।আগে থেকেই প্র্যাকটিজ হয়ে যাবে।
জুইঁ আলআবির এ কথার সত্যি ই কোন মানে খুঁজে পেল না।মিসেস পারভীন এর ডাক পরলো তখন।জুইঁ আলআবির পানে চেয়ে স্নিগ্ধতা মাখা এক হাসি ছড়িয়ে দিয়ে আলআবি কে বলল…
–আসি।ভালো থাকবেন। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।
আলআবি সকলের অগোচরে জুইঁর হাত শক্ত করে ধরে বলল…
–সাবধানে যাবে।প্রতিদিন কিন্তু আমার সাথে কথা বলবে।
আলআবি আর কিছু বলল না।জুইঁর হাতটা ছাড়তে মোটেও ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না তার
#মায়াবিনী_মানবীকে ছাড়তে।জুইঁ নিজের হাত টা কিছু টা জোর করে ই ছাড়িয়ে নিল আলআবির থেকে।
নিজেকে জুইঁর এ মুহূর্তে নিশাচর প্রানী বলে অ্যাখায়িত করতে ইচ্ছে করছে। রাতের হাইওয়ে দিয়ে তাদের গাড়ি টা দ্রুতবেগে ছুটে চলছে। গাড়ি তে রয়েছে মোট চারজন মানুষ। জুইঁ, মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব আর ড্রাইভার।জুইঁর পাশে মিসেস পারভীন বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।সামনের সিটে বসা সিরাজ সাহেব এরও একি অবস্থা। জুইঁ হাতে হাত ঘড়ির অভাবে সময় দেখতে পারছে না।মধ্য বয়সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো…
–আঙ্কেল কয়টা বাজে বলতে পারবেন?
গাড়ি চালাতে চালাতে উনি বললেন…
–এই রাত একটার কাছাকাছি হবে।
দুজনের কথায় সিরাজ সাহেব এর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো।তিনি আড়মোড় ভেঙে ড্রাইভার আশরাফুল কে বললেন…
–আশরাফ গাড়ি টা সামনের কোন চায়ের দোকানের সামনে রেখো একটু। তুমি অনেক সময় ড্রাইভ করেছ।একটু চা খেলে ভালো হবে।
আশরাফুল সিরাজ সাহেব এর কথা মতো প্রায় দশ থেকে পনেরো মিনিট পরে একটা ছোট খাটো চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করলো।মিসেস পারভীনেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে।মিসেস পারভীন জুইঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
–জুইঁ নেমে একটু হাটাহাটি কর।চা ও খেতে পারিস।
জুইঁ দ্রুত বলে উঠলো…
–না না। এখন নামবো না।তোমরা যাও।এভাবেই ভালো লাগছে।
মিসেস পারভীন এর সঙ্গে জুইঁ আর গাড়ি থেকে নামেনি।জুইঁ বাদে বাকি তিনজন গাড়ির পাশের চায়ের দোচালা দোকান টায় বসে পড়েছে। জুইঁ আগ্রহ কে দমিয়ে রাখতে না পেরে দ্রুত ব্যাগের চেন খুলে আলআবি কি দিয়েছে তা খুঁজত লাগে।ব্যাগ খুঁজে ছোট একটা ব্যাগ আর টেপরেকর্ডার পেল।ব্যাগটা থেকে একটা সিমকার্ড বেরিয়ে এলো।আলআবির সিমকার্ড দেয়ার উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পেরে আনমনে হেঁসে উঠলো। হাতের টেপরেকর্ডার টা অন করতেই ওপাশ থেকে আলআবির সুদৃঢ় কন্ঠের আভাস পেল। জুইঁ গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো।
“এই রেকর্ড টা আমার মায়াবিনীর জন্য। আশা করি আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষ টাই কথা গুলো শুনছে। আজ তোমাকে আমার মায়াবিনীর গল্প শুনাবো। আমার মায়াবিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আজ থেকে আরও দশদিন আগে।দশ দিনেই যে কারো মায়ায় জড়ানো যায় তা হয়তো আমার মায়াবিনী আমার জীবনে না আসলে বুঝতে ই পারতাম না। তোমাকে একটা সিক্রেট বলি শোন-যেদিন আমি জীবনে প্রথম ড্রিংক করেছিলাম সেদিন ই তোমার সঙ্গে আমার দেখা। আরেকটা সিক্রেট কি জানো?আমি সেদিন মাতাল হলেও পরেরদিন ঠিকই আমার সব কিছু মনে পরে যায়।সকালে টেবিলে নাস্তা করার সময় বুঝতে পারি আমার বাসায় একটা #মায়াবিনী_মানবী এসেছে। তার একটু একটু করে খাবার মুখে দেয়া দেখে মনে হয়েছিল ওই নরম হাতে একদিন আমিও খাবার খাবো।সেদিন তার জন্য আমার জীবনের পুরো দু’বছর এর রুটিন এক নিমিষেই পাল্টে যায়।আমার কাজে আমি নিজেও অবাক ছিলাম।আমার মায়াবিনীকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়।বেনজিকে দেখে যখন ভয়ে শিটিয়ে যেত তখন ভয়ার্ত চেহারার মায়াবিনীকে দেখে প্রতিবারই বিমোহিত হতাম।সেদিন ছাঁদে যখন মায়াবিনীকে বলি আমার চোখে চোখ রাখতে তখন বোকা মেয়েটা মুহূর্তে ই হ্যাঁ বলে দেয়।তখন তার চোখে তাকিয়ে ভয়ংকর এক কান্ড বাঁধিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল। মনে হয়েছিল ওই চোখজোড়ায় নিজের অধর দুটো খুব জোড়ে চেপে ধরি।আমার মায়াবিনী প্রতিবারই যখন কফির মগে চুমুক ফেলত ততবারই মনে হতো একদিন কফির মগের জায়গায় আমার অধর থাকবে।একদিন ওই একই মগে দুজনের চুমুক থাকবে।ধীরে ধীরে #মায়াবিনী_মানবীর মায়া আমাকে তীব্র থেকে তীব্র ভাবে গ্রাস করে ফেলল।মায়াবিনীকে এখনো সামনা সামনি অনেক কথা বলা বাকি।এখনো তার বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়ার প্রস্তাব দেয়া বাকি।তাকে বধুরূপে দেখা এখনো বাকি।এখনো বাসর ঘরে তাকে অপেক্ষা করানো বাকি।এখনো তার সাথে দু’রাকাআত নামাজ পড়া বাকি।রাতভর একই রুমে আবদ্ধ থেকে তার কোলে মাথা রেখে ছোট ছোট পুঁচকোদের গল্প করবো তার সাথে। প্রতিভোরবেলা উঠে তার লজ্জায় রাঙা মুখ টা কে দেখা এখনো বাকি। এখনো তার ভিজে চুলের পানির ঝাপটায় ঘুম ভাঙ্গা বাকি।ইনশাআল্লাহ একদিন এইসব ইচ্ছে ই পূরণ হবে।শুধু জানতে চাই মায়াবিনী করবে কি পূরণ আমার এই বাকি থাকা ইচ্ছে গুলো?”
আসছি তিন দিন পর।তোমাকে পবিত্র রূপে আমার করে নিতে। ভালো থেকো।”
রেকর্ড টা এখানেই শেষ হয়।জুইঁর চোখে পানি ছলছল করছে।রেকর্ডার টা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকে।অনবরত বলতে লাগলো…
–করব।আপনার প্রত্যেকটা ইচ্ছে পূরণ করব। অবশ্যই করব।
হঠাৎ বিকট এক শব্দ এসে জুইঁকে অসহনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি ফেলল।বুকে তার মৃত্যুসম ব্যাথার অনুভূতি অনুভব হলো।
পরের দিন সকালে,
চলবে………….