ভাবী_যখন_বউ
পর্ব_০৮,০৯
Syed_Redwan
পর্ব_০৮
রাইফা তার ফোনটা বালিশের পাশে রেখে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করল। সবকিছু তার প্ল্যান মোতাবেক হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এভাবে সবকিছু চললেই হয়। এবার আমার দিকে তাকালো সে। আমার ঘুমন্ত মুখ দেখে আনমনেই সে হেসে দিল, যে হাসিটা এক ধরনের তৃপ্তির হাসি।
আমার কাছে চেপে এসে শুয়ে পড়ে। এরপর গালে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,”খুব তাড়াতাড়ি, হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়িই হেরে যাচ্ছ তুমি তোমার নিজের চ্যালেঞ্জেই। আমি এখন ভাবছি যে তুমি হেরে যাওয়ার পর কীভাবে নিজের হার স্বীকার করবে আমার কাছে। নিজের শর্ত মোতাবেক কীভাবে আমার কাছে আসবে, এসে ক্ষমা চাইবে। আমার কাছে এসে আত্মসমর্পণ করবে। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে খেয়ে বলব যে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারপর হবে আমাদের বাসর, যেটার জন্য আমি ব্যাকুল তৃষিত কতকাল ধরে। ইশশ্, ভাবতেই সেই লাগছে হি হি হি!”
এরপর ও আমার কপালে, গালে এবং ঠোঁটে প্রতিদিনের মতো চুমু খেয়ে শুয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম ভেঙে গেলে আমি নিজেকে আবার আগের মতো অবস্থায় আবিষ্কার করি; রাইফাকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে আছি আমি। কিন্তু আজ ও আমার আগে ঘুম থেকে উঠেনি, এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে আজ প্রথমবারের মতো ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। একদম নিষ্পাপ মনে হচ্ছে ওকে দেখে। ওর চুলগুলো ওর মুখের সামনে এসে পড়েছে, যেটা ওকে দেখতে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। ওকে এত কাছ থেকে পেয়ে খুব করে ইচ্ছে করছে ওর চুলগুলো সামনে থেকে সরিয়ে পেছনে গুঁজে দিতে, ওর গোলাপি নরম ঠোঁটের পরশ পেতে আমার নিজের ঠোঁটে, ওর মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। এমন নিষ্পাপ দেখতে মেয়েটা আদৌ কি কাউকে খুন করতে পারে? হয়তো পারে। ভালোবাসার নেশা মানুষকে অন্ধও করে দেয়। কিন্তু তারপরও আমার মনের কোন এক জায়গায় জানান দিচ্ছে যে ও খুনী না।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম রাইফার কাছ থেকে, যদিও ওভাবে থাকতেই ইচ্ছে করছিল, মন ওকে ছাড়তে মানা করছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো যে ও তো আমার ভাইয়ের খুনী হলেও হতে পারে, এমনটা হলে আমার ওর কাছে যাওয়াটা একেবারেই যুক্তিহীন। ও ভাইয়ার খুনী হলে তো আমি ওর কাছে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না, বরং নিজ হাতে শাস্তি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এটা মনে আসতেই আমি ওর কাছ থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। বের হয়ে দেখি যে রাইফা এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি ওকে অহেতুক ঘুম থেকে না জাগিয়ে নিজেই গেলাম বেলকনিতে। সকাল ৭:৩০ বাজে এখন ঘড়িতে। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটা ভেবে নিলাম। তার সাথে সামান্য একটু ব্যায়ামও করে নিলাম। খুব করে মনে পড়ছে ভাইয়ার কথা এখন। ভাইয়া জীবিত থাকলে কত আনন্দই না করতে পারতাম আমরা! জীবনটাই অন্যরকম হতো।আমাদের পরিবারটা পূর্ণ থাকতো। ছোট থেকে যে ভাইটা আমার এই পর্যন্ত বড় হওয়া অবধি সাথে ছিল, যার সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল আমার, সেই ভাইটিই আর নেই! এটা দুঃস্বপ্ন হতে পারত, কিন্তু ইহাই এক নির্মম বাস্তবতা! তাকে এভাবে হারানোর শোক চিরটা কাল বহন যে করতেই হবে আমাকে, আমাদের সকলকে।
ভাইয়ের কথা ভাবতেই চোখের কোণ জলে ভিজে গেল। আমি তাড়াতাড়ি হাতের তালু দিয়ে চোখের জল আড়াল করে নিলাম। কী হবে আর অশ্রু বিসর্জন দিয়ে? বরং আমাকে ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে, ভয়ংকর প্রতিশোধ! তুমি চিন্তা করো না ভাইয়া, তোমার খুনীকে আমি শাস্তি দিবোই দিব! এমন শাস্তি দিব, যেটার কথা খুনী হয়তো কোনকালেই ভাবতে পারেনি!
আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। আমি রেগে গেলে প্রায়শই এমনটা হয়ে থাকে। এমন সময়ই আমার কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম। রাইফা।
“কখন উঠেছো ঘুম থেকে?” রাইফা জিজ্ঞেস করল।
“আধঘন্টা আগে হয়তো।”
“ওহ। আসো, নাস্তা দিয়ে দিবে একটু পর।”
“হুম, চলো।”
আজ রাইফার মামাতো ভাই সীমান্ত চলে যাবে কানাডায় তার বোনের কাছে। ওর ফুপাতো ভাইবোন নীলয় আর লিজাও চলে যাবে তাদের বাসায়। শুধু থাকবে ওর খালাতো বোন সুমাইয়া। যারা চলে যাবে, তারা শেষবারের মতো আমার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে নিল। দুপুরের আগেই সকলেই চলে গেল। সীমান্তর ফ্লাইট রাতে। ওর সাথে আমার যোগাযোগ এমনিতেও থাকবে। প্রতিটা পদক্ষেপই আমি নিব ওর সাথে পরামর্শ করে। তবে আমি চিন্তা করছি যে তদন্তের শেষে যদি রাইফা খুনী প্রমাণিত হয়, তখন ও কী করবে? ওর ভাবভঙ্গি কেমন হবে? নিজের ফুপাতো বোন একজন খুনী, এটা জানলে ও কি সহজভাবে এটা নিতে পারবে? প্রশ্নটা রয়েই যায়। তবে খুনী যে-ই হোক না কেন, তাকে আমার শাস্তির হাত থেকে কেউই রেহাই দিতে পারবে না।
আগামীকাল সকালেই আমরা বাসায় ফিরে যাব। কারণ আব্বু-আম্মু আসছে বাড়ি থেকে আগামীকালই। আজ আর তেমন কিছুই হলো না। আগামীকাল রাইফার খালোতো বোন সুমাইয়াও চলে যাবে। শুনলাম কিছুদিন পর ওর নাকি বিয়ে। সেটা খাওয়া গেলে ভালোই হবে। কিন্তু এসবকিছুই আমার ভালো লাগছে না। আমার মাথায় এখন শুধুমাত্র একটা বিষয়ই বিরাজ করছে এবং আমি চাইও যেন শেষ অবধি এটাই বিরাজ করুক- আমার ভাইয়ের খুনীকে সনাক্ত করা এবং তাকে নিজ হাতে শাস্তি দেওয়া।
বাকি সবকিছুই ঠিক থাকলো। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখলেন এবং আমি জানি যে জামাই হিসেবে তাঁরা আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করেছেন। একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছি, রাইফার একজন বড় ভাইও আছে। তিনি অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন। এখন তার পিএইচডির কাজ চলছে সেখানে। এজন্য অনেক ব্যস্ত তিনি বিধায় অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারলেন না তিনি নিজের একমাত্র বোনের বিয়ে অনুষ্ঠানে। তাকে আমি দুই বছর আগে থেকেই চিনি। বলাই আছে, রাইফার সাথে আগে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ও আমাকে ভালোবাসার কথা বললে শুধুমাত্র আমি এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু কখনো ওর সাথে দুর্ব্যবহার করিনি অথবা আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করিনি। এমনকি ভাইয়ার সাথে ওর বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্তও ও আমার একজন ভালো বন্ধুই ছিল। ও আগে কখনোই আমাকে ভালোবাসতে জোর করেনি, শুধু প্রোপোজ করতো, আনি সুন্দরভাবে এই বিষয়টা এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু ভাইয়ার বউ, মানে আমার ভাবী হয়ে আমাদের বাসায় আসার পর থেকেই ওর আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে, আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে শুরু করে যেন ভাইয়া নয়, আমিই তার বিবাহিত স্বামী। আমার উপর অনৈতিকভাবে অবৈধ জোর খাটাতে শুরু করে। আমার সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে, একবার তো সফলও হয় যেটা সকলেই জানে। তার এরূপ ঘৃণ্য আচরণের ফলেই আমি তাকে ঘৃণা করতে শুরু করি, যেটা সম্পূর্ণতা পায় ভাইয়ার বিয়ের দিন ভাইয়ার মৃত্যুর পর। তাকে আমি ভাইয়ার খুনী বলে বিশ্বাসই করে নিই কিছু সময়ের জন্য, এরপরের ঘটনাগুলো কারোরই অজানা নয়।
মূল কথায় আসি। ওর ভাইয়াকে একবার আমার সাথে ও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ভার্সিটির ক্যাম্পাসেই। তার চেহারা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তার নাম শুভ। তিনি অস্ট্রেলিয়াতেই স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে গিয়েছিলেন এবং এখনো সেখানেই আছেন, পিএইচডি করছেন। দু’বছর আগে একবার তিনি দেশে ঘুরতে আসলেই রাইফা তার সাথে আমার পরিচয় করায়। তখন থেকেই তাকে আমি চিনি। কথা হলো, শুনলাম যে তার ভাই নাকি এক-দেড় মাসের মধ্যেই আসছেন দেশে। শুনেছি তিনিও নাকি অস্ট্রেলিয়ায় গোয়েন্দার কাজ করেছেন গুটি কয়েকবার। তার সাহায্য পেলে মন্দ নয়!
সবকিছু ঠিক থাকলেও রাইফার আমার সাথে করা আচরণ একটুও বদলালো না। মেয়েটার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আমার সামনে, অথচ বাহিরে অন্যদের সামনে এত লজ্জা পায় রে বাবা! তিনবছর ধরে ওর সাথে গভীর না হলেও হালকাপাতলা বন্ধুত্ব আমার, কখনো মনে হয়নি যে এই মেয়ে এতভাবে রূপ পাল্টাতে পারে সময়ে সময়ে। কীভাবে যে নিজের আসল রূপ আমার থেকে এই তিনটা বছর লুকিয়ে রেখেছে ও এটা আমার একেবারেই অজানা।
পরেরদিন সকালে আমি আর রাইফা চলে আসি বাসায়। আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দিব, ভালো একটা সিজিপিএ তুলারও ইচ্ছা আছে। তাছাড়া এখন আমি ভার্সিটিতে পড়াই, নিজের জ্ঞানের পরিধিটাকে সবসময় বিস্তর রাখার জন্য হলেও বই পড়তে হবে আমার, তার সাথে একটা কোচিং যেখানে আমি পড়াই, সেটা তো আছেই। তাই আমি বই নিয়ে পড়তে বসে পড়লাম। রাইফাও বলেছে যে ও মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু রাইফাকে দেখে মনে হয় না যে ও এতে ততটা সিরিয়াস, কোনরকমে মনে হয় যে পাশ করে ডিগ্রি নিতে পারলেই ওর স্বস্তি।
আব্বু আম্মু আর মেঘা চলে আসলো দুপুরের একটু পরেই। তাদের দেখে আমার কিছুটা স্বস্তিবোধ হলো মনে। তাদের চেহারা থেকে ভাইয়ার বিরহের শোক কিছুটা হলেও কেটেছে। এটাই তো জগতের নিয়ম। কেউ কারো জন্য থেমে থাকে না জীবনে, জীবন নিজের মতো করেই নিজ বৈশিষ্ট্যে কোন বাধা না মেনেই সময়ের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে, যেভাবে যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে এবং অন্ত্য পর্যন্তও নিজ ছন্দেই ধাবিত হবে।
ভাইয়া তো আমাদের সকলের স্মৃতিতেই থাকবে, থাকবে আমাদের প্রার্থনায়। সে নিজে অশরীরী হয়ে উপস্থিত থাকলেও এটাই বলতো যেন আমরা এগিয়ে যাই জীবনে, মাঝেমধ্যে যেন আমাদের দোয়ায় তাকে স্মরণ করি।
কিছুদিন পরই আমার ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে যায়। রাইফাও মাঝে মধ্যে যায় আমার সাথে ভার্সিটিতে ক্লাস করার নাম করে, তবে ওর আসল উদ্দেশ্য আমি বুঝি, আমার সাথে থাকা, আমাকে চোখে চোখে রাখা আর তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়া। সাথে বাসায় ওর করা দৈনন্দিন অত্যাচার তো আছেই। এখন অবশ্য এগুলো গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে; এখন আর ও আমার কাছে আসলে, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে ওকে থাপ্পড় মারি না কিংবা আঘাত করি বা। তবে ও আমার সাথে একেবারেই ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে কিংবা বলি শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে আমি রুগ্নমূর্তি ধারণ করে ওর থেকে দূরে সরে আসি। তবুও ও বিন্দুমাত্র নিরাশ হয় না এসব করায়।
এই কয়দিনে আমি অনেক করেই চেষ্টা করেছি ভাইয়ের খুনের তদন্ত করার, কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারছি না। ভাইয়ার বন্ধুদের কথা ভাইয়ার সাথে তাদের জানামতে কারোরই কোন শত্রুর্তা ছিল না। তাছাড়া আমিও আমার ভাইকে চিনি, সে কখনো কারো পিছনে লাগার মতো মানুষ ছিল না। এসব সত্য হলে তো এটাই দাঁড়ায় যে রাইফাই ভাইয়ার খুনী। নাহ! আমার কাছে শক্ত কোন প্রমাণ নেই এই ব্যাপারে। আমি আরো গভীরভাবে তদন্ত করতে শুরু করলাম। কাটতে লাগল দিন এভাবেই, কিন্তু আমি তদন্ত করেও এটার কোন সুরাহা করতে পারছি না।
অন্যদিকে সাতদিনের মাথায়ই রাইফা নীলার ভাইকে একপ্রকারের ব্ল্যাকমেইল করেই তার কার্য সাধন করতে থাকে। কিছুদিনের ভিতরেই সে সফল হয়। আমার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট উপকরণ সে সংগ্রহ করে ফেলে। সে এখন খুশি, খুব খুশি! সে আমাকে তার ধারণামতো চ্যালেঞ্জে হারিয়ে ফেলেছেই, খালি আমার কাছে প্রমাণ উপস্থাপন করাটাই বাকি আরকি। সে কাজ শেষে নীলাকে ধন্যবাদ জানায়।
“শেষমেশ আমার ভাইটাকে ভাবীর ভয় দেখিয়ে কাজ সেরেই নিলি, না?” নীলা বলল।
“সাধারণ একটা রিপোর্ট দিতেই তিনদিন লাগালো তোর ভাই। এতদিন লাগে😡!?” রাইফা বলল।
“ছাড় না, কাজটা তো হয়েছেই, তাই না। এখন তুই জয়ী। ট্রিট দিতে ভুলিস না যেন!”
“ট্রিট পাবি, চিন্তা নাই। আরেকটা কথা, ওর লাশটাকে ডিসচার্জ করিয়ে ঠিকমতো জানাজার ব্যবস্থা করে দিতে বলিস তোর ভাইকে।”
“আজকেই সেটা করিয়ে নিব, তুই চিন্তা করিস না।”
“মনে থাকে যেন। এটা কোনভাবে মিস গেলেই তোর ভাই ভাবীর হাতে অক্কা পাবে। জানাজা নিয়ে কোন মজা করছি না দোস্ত, আমি সিরিয়াস।”
“আচ্ছা আমার মা, আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে এটা করাবো। এবার খুশি তো?”
“মনে থাকে যেন।”
“থাকবে মনে।”
কাকতালীয়ভাবে সেদিনই আমার মনে পড়ে যায় যে ভাইয়ার একজন মাত্র বেস্টফ্রেন্ড ছিল নাম রিহান; একজনই ছিল যার সাথে ভাইয়ার ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি ছিল। হয়তো তার কাছ থেকে একটু চাপ দিলে কিছু অজানা তথ্য পেলেও পেতে পারি।
তার কাছে গেলাম আমি সেদিনই। রিহান ভাইয়া প্রথমে আমার কাছে কিছু বলতে চাইল না, বলে যে এসব তার বলতে নিষেধ আছে ভাইয়ার। কিন্তু পরে যখন আমি তাকে আরো চাপ দেই, বলি যে আমার সন্দেহ ভাইয়াকে খুন করা হয়েছে, আর আমি সেটারই তদন্ত করছি, তখন রিহান ভাইয়া আর কোন সংকোচ নিজের মধ্যে না রেখে ভাইয়া সম্পর্কে যা যা জানে সবকিছুই বলতে লাগল। কিন্তু ভাইয়া সম্পর্কে একটা তথ্য রিহান ভাইয়ার মুখে শোনার পর আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো!
চলবে
#ভাবী_যখন_বউ
#পর্ব_০৯
#Syed_Redwan
কাকতালীয়ভাবে সেদিনই আমার মনে পড়ে যায় যে ভাইয়ার একজন মাত্র বেস্টফ্রেন্ড ছিল নাম রিহান; একজনই ছিল যার সাথে ভাইয়ার ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি ছিল। হয়তো তার কাছ থেকে একটু চাপ দিলে কিছু অজানা তথ্য পেলেও পেতে পারি।
তার কাছে গেলাম আমি সেদিনই। রিহান ভাইয়া প্রথমে আমার কাছে কিছু বলতে চাইল না, বলে যে এসব তার বলতে নিষেধ আছে ভাইয়ার। কিন্তু পরে যখন আমি তাকে আরো চাপ দেই, বলি যে আমার সন্দেহ ভাইয়াকে খুন করা হয়েছে, আর আমি সেটারই তদন্ত করছি, তখন রিহান ভাইয়া আর কোন সংকোচ নিজের মধ্যে না রেখে ভাইয়া সম্পর্কে যা যা জানে সবকিছুই বলতে লাগল। কিন্তু ভাইয়া সম্পর্কে একটা তথ্য রিহান ভাইয়ার মুখে শোনার পর আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো!
এটা কী শুনলাম আমি! এটা কীভাবে সম্ভব? আমার ভাইয়া একটা মেয়েকে পছন্দ করতো আজ থেকে এক বছর আগে থেকেই। এটা আমি একেবারেই জানতাম তো না-ই, এমনটা যে হতে পারে, সেটা কল্পনাও করতে পারি না। আর একমাস আগে থেকে নাকি মেয়েটার সাথে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয় ভাইয়ার। কিন্তু কীভাবে? একমাস আগে তো ভাইয়া আর রাইফার বিয়ে হয়। তাহলে ওই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে কীভাবে ভাইয়া জড়ালো? ভাইয়া তো বলেছিল যে সে রাইফাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। যদিও রাইফা ভাইয়াকে ব্যবহার করেছিল আমাকে পাওয়ার জন্য, কিন্তু ভাইয়া তো আমার মনে হয় রাইফাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছিল। তাহলে একইসাথে রাইফাকে বউ করে রেখে বাহিরে আরেক মেয়ের সাথে পরকীয়ার সম্পর্কে কীভাবে ভাইয়া জড়ালো? না! রাইফা যাই করুক না কেন, আমি আমার ভাইকে চিনি। আমার ভাইয়া আমার থেকে কোনকিছু লুকোলেও কোনদিনও সে পরকীয়ার মতো জঘন্য কাজ কিছুতেই করতে পারে না। তাহলে ঘটনাটা কী? রিহান ভাইয়া কি আদৌ সত্য বলছে? যদি সে সত্যি কথা বলে থাকে, তাহলে এই হিসাব যে কিছুতেই মিলাতে পারছি না।
রিহান ভাইয়াকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি যা বলছেন, সেটা কীভাবে সম্ভব? ভাইয়া রাইফাকে মানে যে বর্তমানে আমার স্ত্রী, তাকে বিয়ে করেছিল একমাস আগে, তাহলে কীভাবে আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারে সে?”
রিহান ভাইয়া বলল,
“কী বলছ তুমি? রিফাত আবার কবে বিয়ে করলো? আমাদের কাউকে তো কোনকিছুই জানায়নি?”
“এটাই সত্যি। ভাইয়া মারা যায় তার সাথে রাইফার বিয়ের আগের রাতেই। আব্বু আম্মুর রাইফাকে খুব ভালো লেগে যায় এই একমাসেই, তাই ভাইয়ার মৃত্যুর সময়ও আমারই রাইফাকে বিয়ে করতে হয়।”
“এসবকিছুর কিচ্ছুটি জানতাম না আমি। আমি কেন, আমাদের বন্ধুমহলের কেউই জানতো না। রিফাত কীভাবে এতকিছু আমার কাছ থেকে গোপন করে গেল?”
“এসবকিছুর সমাধানই আমি করার চেষ্টা করছি। আচ্ছা বলেন তো, ভাইয়া যেই মেয়ের সাথে প্রেম করতো আপনার জানামতে, সেই মেয়ের নামটা কী একটু বলতে পারবেন?”
“উমমম…. ওহ হ্যাঁ, ওর নাম হচ্ছে স্নিগ্ধা।”
স্নিগ্ধা। নামটা অল্প অল্প পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যেন শুনেছি মনে হচ্ছে নামটা। তবে আমার ভ্রমও হতে পারে।
“ও কোথায় থাকে বা ওর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন কি?”
“ওর ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। শুধু এতটুকু জানি, ও তোমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে, তোমাদেরই ব্যাচের।”
“ওহ! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এসব জানানোর জন্য। দেখি কতটুকু করতে পারি।”
“ধন্যবাদ জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল। ওকে কেউ খুন করে থাকলে অবশ্যই খুনীর শাস্তি আমি কামনা করছি। ওর খুনীকে কোনভাবেই ছাড়বে না তুমি। আমার কোন সাহায্য লাগলে বলবে অবশ্যই। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই সাহায্য করব।”
“জ্বি অবশ্যই। আরেকটা কথা ভাইয়া। রাইফার সাথে যে ভাইয়ার বিয়ে হয়েছিল, সেটা যেন কেউ না জানে। সকলেই জানে যে রাইফার একমাত্র স্বামী আমিই। এটাই সবাই চিরকাল জানবে। আমি বাধ্য হয়ে আপনাকে এটা বলে ফেলেছি। প্লিজ কাউকে বলিয়েন না এটা।”
“বলব না। চিন্তা করো না।”
আমি বাসায় চলে আসলাম। আমি যা ভেবেছিলাম, তার সবকিছুই ছিল ভুল! সবকিছুর হিসাব ওলটপালট মনে হচ্ছে আমার কাছে। এখন মনে হচ্ছে যে একেবারে গোড়া থেকেই সবকিছুর তদন্ত করতে হবে, মানে রাইফার সাথে ভাইয়ার বিয়ের আগে থেকে। এমনটা হলে আর সীমান্তর সাহায্য নেওয়া যাবে না। কারণ, সীমান্তও জানে না যে ভাইয়া আর রাইফার আগে বিয়ে হয়েছিল। এদের কাউকে, মানে দুই পরিবারের হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত কাউকে জানানো বারণ এই বিষয়টা। যা করার আমার নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু আমি সীমান্তর সাহায্য নিয়েও বেশিদূর এগুতে পারলাম না। এখন সীমান্তকে ছাড়া আমার কাজ করতে হবে, তার উপর সবকিছুর হিসাব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কীভাবে পারব আমি ভাইয়ার খুনের রহস্যের সমাধান করে খুনীকে ধরতে?
রাতে ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এসব। ঠিক এমন সময়ই রাইফা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে ওর দিকে তাকাই। দেখলাম যে ও অনেক ভালো করেই সাজুগুজু করেছে। কিন্তু কখন আর কীভাবে করলো? নিশ্চয়ই মেঘার রুম থেকে মেঘার সাহায্য নিয়ে সেজে এসেছে। কিন্তু কীসের জন্য? আমাকে পাওয়ার জন্য? কিন্তু আমি যে ও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারব না।
ও ওয়ারড্রব থেকে কিছু জিনিস বের করলো। দেখে মনে হচ্ছে যেন এগুলো কিছু ডকুমেন্টস। তারপর আমার কাছে এসে বসলো।
“আগে তোমাকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দেই। মনে আছে তো, তুমি কী বলেছিলে? আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে, স্ত্রীর অধিকার দিবে? মনে আছে কিনা বলো আগে। নিজের মুখে এখন আবার স্বীকার করো। তারপর বাকি কথায় আসছি।”
“হুম, মনে আছে। কিন্তু এসব এখন বলছো কেন?”
“কারণ আমি এখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো, তাই আগেভাগে শর্তের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।”
আমি অবাক হলাম কিছুটা ওর কথা শুনে। বললাম,
“ঠিক আছে। এবার করো তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ।”
রাইফা একটু শান্ত হয়ে বলল,
“আমার কথা তোমার কাছে এখন কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তবুও শুনতে হবে তোমাকে পুরোটাই ধৈর্য্য সহকারে। আমি তোমাকে আমার প্রতিটা কথার প্রমাণ দিব চিন্তা করো না। খালি আমাকে মাঝখানে আটকাবে না।”
“ঠিক আছে। বলতে থাকো।”
কিছুটা থেমে রাইফা আবার বলতে শুরু করলো।
“তোমার ভাইয়ার সাথে আমার কোনদিনও বিয়ে হয়নি। সহজ বাংলায়, রিফাত ভাইয়া আর আমি দু’জনে কখনোই স্বামী-স্ত্রী ছিলাম না।”
রাইফার এই কথাটা শোনামাত্র আমার মাথায় সমগ্র আকাশ যেন ভেঙে পড়লো। আমি যা শুনছি তা ঠিক শুনছি তো? নাকি এটা নিছক একটা স্বপ্ন? সেটা যাচাই করতে আমি নিজের হাতে বেশ কয়েকবার চিমটি কাটি। তারপরও আমার এই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা কীভাবে হতে পারে? রাইফা আমাকে এমন করতে দেখে আমার হাত দু’টো নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“শান্ত হও। যা যা আমি বলছি সবই সত্য। আমি বলেছিলাম না, এসব অসম্ভব মনে হতে পারে তোমার কাছে? কিন্তু এটাই চূড়ান্ত সত্য। শান্ত হও, আমি সবটাই বলছি তোমাকে।”
অনেক কষ্টে নিজেকে আমি শান্ত করলাম। যদিও আমার ভিতরটা একেবারেই অশান্ত ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার আর তোমার আর ভাইয়ার যে বিয়ে হয়নি, এটা আমি বিশ্বাস করবো কেন? সেদিন না তোমরা বিয়ে করে আসলে?”
রাইফা বলল,
“এটা দেখো।” বলেই আমার হাতে তাদের কাবিননামাটা দিল। বাইরে থেকে এটা কাবিননামা মনে হলেও এটার আবরণ খুলে দেখতে পারি যে এটা কোন কাবিননামাই না। উল্টাপাল্টা জিনিস লিখা এটাতে। এমনভাবে ওইসব আজাইরা কথা লিখা যে বাইরে থেকে দেখতে এটা একদম যথার্থ একটা কাবিননামার মতোই লাগে। এটা দেখে আমি অবাকের আরেক সীমানায় পৌঁছে গেলাম। তার মানে রাইফা যেটা বলেছে সেটা সত্য? ভাইয়া আর রাইফার সত্যি সত্যি কোন বিয়ে হয়নি? হ্যাঁ, এটাই তো সত্য বলে প্রমাণিত হলো এইমাত্র।
আমি একটু দম নিলাম। রাইফার উপর থেকে অর্ধেক রাগ সাথে সাথেই কমে গেল। এখন আর ওকে আমার অসহ্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমার মাথায় এখন অজস্র প্রশ্ন গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি আর ভাইয়া যদি একে অপরকে ভালোবাসে না থাকো, তোমাদের যদি বিয়ে বাস্তবে না হয়ে থাকে, তাহলে এতসব করার মানে কী?”
রাইফা বলল,
“আস্তে, সবকিছুই জানতে পারবে তুমি। আজকে আমার যে তোমাকে সবকিছু জানানোর দিন, নিজেকে তোমার কাছে নির্দোষ প্রমাণ করে তোমাকে সারাজীবনের জন্য একেবারেই করে পাওয়ার দিন। একটু ধৈর্য্য ধরো, আমি সবকিছু বলছি।”
রাইফা এবার কিছুটা শান্ত হয়ে তারপর নিজের ফোনে একটা মেয়ের ছবি দেখালো। মেয়েটাকে তো আমি চিনি। রাইফার সাথে প্রায়ই দেখতাম। রাইফার বেস্টফ্রেন্ড হয়তো। রাইফা বলতে লাগল,
“এই মেয়েটাকে নিশ্চয় চিনো? আমার সাথেই তো দেখেছ বেশ অনেকবার।”
আমি মাথা নাড়ালাম, মানে আমি চিনতে পেরেছি ওকে।
রাইফা আবার বলল,
“এই মেয়েটাকে তোমার ভাইয়া ভালোবাসত। জানতে চাও তার নাম কী?”
“কী?”
“ওর নাম স্নিগ্ধা।”
স্নিগ্ধা! এই নামটা আমি রাইফার মুখ থেকে শুনার পর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে আমার বেগ পেতে হলো না। তার মানে রিহান ভাইয়ার বলা প্রতিটা কথাই সত্য। তবে এখনও আমাকে জানতে হবে অনেককিছুই। আমি বললাম,
“তাহলে এমন করার মানেটা কী? কেন তাহলে বিয়ে করলে তোমরা? কেন দু’জন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসাথে রাতের পর রাত কাটালে একই রুমের ভিতর?”
“শান্ত হও। সব বলছি তো আমি। স্নিগ্ধাকে তোমার ভাই ভালোবাসতো, তাও প্রায় এক বছর আগে থেকেই। অনেকবার প্রোপোজও করেছিল স্নিগ্ধাকে রিফাত ভাইয়া, কিন্তু স্নিগ্ধা রাজি হতো না। আসলে স্নিগ্ধা মেয়েটা ছিল খুবই দুর্ভাগী। ছোটবেলায় ওর মা-কে ওর বাবা ফেলে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে দূরে চলে যায় সংসার পাতাতে। ওর মা একা ওকে অনেক কষ্ট করে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়ে নিজেও মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। বেচারি মেয়েটার কোন আপন মানুষের কাছেই আশ্রয় হয়নি জানো। ওর চাচারা কিংবা মামারা কেউ-ই ওর দায়িত্ব নেয়নি। ও জীবনে অনেক সংগ্রাম করে, এতিমখানায় মানবেতর জীবনযাপন করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জায়গায় জায়গায় দৌঁড়ে প্রাইভেট পড়িয়ে এতদূর আসতে পেরেছিল, চান্স পেয়েছিল আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার। সেখান থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়। ওর জীবনের কাহিনী শুনে আমি ওর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। কখন যে একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড হয়ে উঠি, বুঝতেই পারি না।”
এতটুকু বলে রাইফা একটু বিরতি নিল। এরপর আবার বলা শুরু করল,
“আজ থেকে আনুমানিক এক বছর আগে স্নিগ্ধাকে তোমার ভাই আমার সাথে দেখে রাস্তায়। তখনই তার স্নিগ্ধাকে ভালো লেগে যায়। নানাভাবে স্নিগ্ধার কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করে, ওকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ও কোন ছেলেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারতো না। এজন্য ওর একটা ছেলে বন্ধু পর্যন্ত ছিল না কখনো। ও ঠিক করেছিল যে ও জীবনে কোনদিন বিয়েই করবে না এই ভয়ে যে যদি ওর বিয়ে করা বর ওর বাবার মতো হয়, ওকে ফেলে অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে ভেগে যায়। এজন্যই ও কোনমতেই রিফাত ভাইয়ার প্রোপোজাল গ্রহণ করেনি। এভাবেই প্রায় একবছরের কাছাকাছি সময় রিফাত ভাইয়া নষ্ট করে ওর পিছনে।”
আমি ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম। আস্তে আস্তে যে রহস্যের জটগুলো খুলছে সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারছি। বললাম,
“তারপর?”
“তারপর আর কোন উপায় না পেয়ে আমার শরণাপন্ন হয় রিফাত ভাইয়া। তিনি ততদিনে জেনে গিয়েছিলেন যে আমি স্নিগ্ধার বেস্টফ্রেন্ড। তাই আমার কাছে সাহায্য চান তিনি। ততদিনে অবশ্য রিফাত ভাইয়াও বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কতটা চাই তোমাকে। আমাকে তোমার দিকে বারবার তাকিয়ে থাকতে দেখে, তোমার কাছাকাছি ঘেঁষতে দেখে খুব সহজেই এটা বুঝতে পেরেছিলেন তিমি। ”
ওর কথাগুলো আমার কাছে মনে হচ্ছে কোন সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! এগুলোই আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা।
“এরপর?”
“আমি একটা সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনা করি তার সাথে। আমাদের দু’জনেরই একই সমস্যা ছিল; আমাদের ভালোবাসার মানুষটি আমাদের বুঝতে চাইছিল না। তাই আমি এমন একটা প্ল্যান করি যেটাতে রিফাত ভাইয়া আর আমি দু’জনেই লাভবান হবো। আমরা মিথ্যা বিয়ের নাটক করার জন্য মনস্থির করি একমাসের জন্য। ”
“কিন্তু এতে তোমাদের লাভ কীভাবে হতো? ভাইয়াই বা কীভাবে স্নিগ্ধাকে পেত আর তুমিই বা কীভাবে আমাকে পেতে? তখন তো আমি জানতাম যে তুমি আমার ভাবী। নিশ্চয়ই তুমি এটা জানো যে আমি কিছুতেই আমার ভাবীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতাম না, কোনভাবেই কারো সাথে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়াবো না। এটার প্রমাণ তুমি সেদিন আমাকে কিস করার পরই পেয়েছিলে। কী থাপ্পড়টা খেয়েছিলে মনে নেই?”
“আহা, এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন তুমি হুম? আমি তো শেষ করিনি এখনো। শুনো, তোমার ভাই আমার শর্তে রাজি হওয়ার পর আমি স্নিগ্ধার হাতেপায়ে ধরে বুঝাই যে সব ছেলে এক হয় না। তাদের মধ্যেও তো অনেকে ভালো আছে। যেমন, আমার বাবাই তো কতো ভালো। আরো অনেক ভালো ছেলের নিদর্শন আছে। আমার এমন অনুরোধ শুনে ও রাজি হয় রিফাত ভাইয়ার প্রস্তাবে। তবে সে একমাস তার সাথে প্রেম করে তাকে পরীক্ষা করে দেখবে, আর আমি এই একমাসে আমি তোমার পরিবারের লোকজন মানে বাবা-মা আর আমার ননদের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করে ফেলবো। তার সাথে মাঝেমধ্যে তোমার সাথে টুকিটাকি ফষ্টিনষ্টি করা তো আছেই🙈। আসলে, সেদিন রাতে তুমি একেবারেই পাতলা একটা শার্ট পড়ে ছিলে, আর আমারও তোমাকে দেখে নেশা ধরে গিয়েছিল। তাই আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। যাই বলো না কেন, সেদিনের অনুভূতিটা কোনদিনও ভুলার মতো নয়😘।”
আমার অগোচরে এতকিছু হয়ে গেল তারপরও আমি কিচ্ছুটি টের পাইনি। নিজেকে এই মুহূর্তে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বোকা মনে হচ্ছে। কিন্তু এখনো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি আছে।
“একমাস না-হয় এভাবে কাটালে। তারপর? তারপর কী করার প্ল্যান ছিল তোমাদের?”
“হুম, বলছি। প্ল্যান ছিল একমাস শেষ হলে আমার আর তোমার ভাইয়ের যেদিন বিয়ে হওয়ার কথা, সেদিন তোমার ভাই বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে বিয়ে করবে। আর যেহেতু আমার ততদিনে বাবা-মা আর মেঘার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠতা হয়ে যাবে, তাই আমিও বলবো যে আমিও এই বাড়ি ছাড়া আর অন্য কোথাও বিয়ে করতে পারব না। করলে এই বাড়িতেই করব তার সাথে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিতাম। আর এই বাড়িতে যেহেতু অবশিষ্ট ছেলে তুমিই আছো, তো ব্যস! তোমার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতেন এমনিতেও বাবা-মা। তুমি কোনদিনও নিজের পরিবারের সিদ্ধান্তের উপর টু শব্দটিও করতে না তাই আমার আর তোমার বিয়ে হয়ে যেত, আমি তোমাকে পেয়ে যেতাম। অন্যদিকে রিফাত ভাইয়াও স্নিগ্ধাকে পেত। কিছুদিন পর এমনিতেই স্নিগ্ধাকেসহ রিফাত ভাইয়াকে আমাদের পরিবার মেনে নিত। স্নিগ্ধা খুব ভালো একটা মেয়ে, তাকে দেখেই ভালো লাগতো আর তার সাথে রিফাত ভাইয়া কেমন ছিলেন সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না, পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় সদস্যই ছিলেন। তাই তখন সবকিছু জোড়া লেগে যেত, সব ঠিক হতো। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!”
আমি নিশ্চুপ রইলাম।
“আর সবচেয়ে বড় কথা যে আমি আর রিফাত ভাইয়া যে এই মিথ্যা বিয়ের অভিনয় করেছি, সেটা আমরা দুই পরিবারের হাতেগোনা কতিপয় লোকজন ব্যতীত কেউ জানে না; রিফাত ভাইয়ার কোন বন্ধু কিংবা আমার কোন বান্ধবীও না। স্নিগ্ধাও না।”
মোটামুটি সবকিছুই আমার কাছে পরিস্কার। রাইফা যে খুনী নয়, সেটাও আমি এখন বিশ্বাস করি। কারণ ওর কথার সাথে রিহান ভাইয়ার কথাগুলো সম্পূর্ণ জোড়া লেগে যায়। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, স্নিগ্ধার কী হলো?
“আচ্ছা, তোমার সব কথাই মানলাম। কিন্তু স্নিগ্ধা কোথায় এখন? ওকে তো একবারের জন্যও দেখিনি পরে আর?”
“আসলে…….She’s dead!” বলেই চোখের পানি ছেড়ে দিল রাইফা।
“কী! কী বলছ তুমি?”
“ঠিক কথাই বলছি আমি। সেদিন রোড অ্যাকসিডেন্টে তোমার ভাই একাই মারা যায়নি। তার সাথে স্নিগ্ধাও মারা গিয়েছিল।” বলেই হেঁচকি দিয়ে কাঁদতে লাগল রাইফা।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার কথা শুনে আমি নিজের উপর থেকেই ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলছি, সেখানে ও আবার কান্না শুরু করল। আমি নিজের দু’হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। আমার হাতের স্পর্শ পেয়েই ওর কান্না থেমে গেল। আমার দিকে বেদনাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। কেন জানি ওর এই দৃষ্টিটার সাথে তাল মিলিয়ে তাকানোর সাহস হচ্ছে না আমার। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কেঁদো না প্লিজ।”
রাইফা বলল,
“হুম। আসলে ও আমার কাছে বেস্টফ্রেন্ডের চেয়েও বেশিকিছু ছিল। তাই নিজের চোখের পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।”
“সমস্যা নেই।”
“হুম।”
“আচ্ছা, তুমি আর ভাইয়া অবিবাহিত অবস্থায় একসাথে একই রুমে থাকতে, কিন্তু কীভাবে?”
“হা হা! তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমার ভাইয়া কেমন ছিলেন? নিশ্চয়ই তার প্রতি তোমার এতটুকু আস্থা আছে যে তিনি তার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের হবু স্ত্রীর সাথে কোনভাবেই অসভ্যতা করতেন না? রিফাত ভাইয়া আর আমার সম্পর্ক ছিল একদম ভাই-বোনের মতো। প্রতি রাতে আমি হাজারবার মানা করা সত্ত্বেও তিনি আমাকে খাটে বিছানা পেতে নিজে ফ্লোরে শুইতেন ঘুমানোর জন্য।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
রাইফা এবার একটা কাগজ এনে আমার কাছে দিল।
“এটা দেখো। রিফাত ভাইয়া আর স্নিগ্ধার কাবিননামা। এটা অ্যাকসিডেন্টের জায়গা থেকে পাওয়া গিয়েছিল স্নিগ্ধার কাছে। আমি অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি।”
আমি কিছুই বললাম না। আমি জানি যে রাইফা এখন সব সত্য কথা বলছে। আমি খালি চিন্তা করছি যে এতদিন রাইফাকে অবিশ্বাস করে এখন আমি ওর সামনে কীভাবে মুখ দেখাবো?
রাইফা আবার বলল,
“নিশ্চয়ই এটা ভাবছো যে রিফাত ভাইয়ার স্নিগ্ধাকে বিয়ে করার কথা ছিল আমাদের বিয়ের দিনই, তাহলে কীভাবে এই কাবিননামা পেলাম তাদের? কীভাবে তারা নির্ধারণ করা তারিখের আগেই বিবাহিত হয়ে গেল, তাই না?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
“আসলে পুরো একমাস রিফাত ভাইয়ার সাথে প্রেম করে তাকে যাচাই করার কথা স্নিগ্ধার থাকলেও সে মাত্র পনের-বিশদিনের মাথায়ই ভাইয়ার উপর একেবারে ফিদা হয়ে যায়। ভাইয়া এই কয়দিনেই স্নিগ্ধাকে এত এত ভালোবাসা দেয় যে স্নিগ্ধার পুরুষজাতির প্রতি থাকা বিদ্যমান ধারণা সম্পূর্ণভাবেই বদলে যায়। ও মরিয়া হয়ে ওঠে আগেভাগেই রিফাত ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য। শেষমেশ ওর পাগলামির কাছে হার মেনে রিফাত ভাইয়া আমাদের গায়ে হলুদের দিনই ওকে বিয়ে করে রাতের দিকে। মনে পড়ে, ভাইয়া সে রাতে কয়েক ঘন্টার জন্য বাইরে গিয়েছিল? তখন গিয়েছিল স্নিগ্ধাকে বিয়ে করতে। সাক্ষী এবং অন্যান্য ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল তার।”
“ওহ।”
কিছুক্ষণ নিরবতার পর রাইফা বলল,
“তুমি কি আমার গায়ে হলুদের ছবিতে খেয়াল করেছিলে যে আমাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল?”
“হুম।”
“কারণটা জানো কি?”
“হয়তো। তাও, তুমিই বলো।”
“কারণটা হচ্ছো শুধুমাত্র তুমি। তুৃমি থাকলে কত ভালো হতো। তুমি আমাকে, আমি তোমাকে হলুদ মাখাতাম। ধুর! সবকিছু আমার ভুলের জন্যই হয়েছিল। আমি যদি তোমাকে লিপকিস করার লোভটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম…..”
“থাক।”
কিছুক্ষণ পর রাইফা আবার তড়িঘড়ি করে আরেকটা কাগজ দেখালো। দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা মেডিকেল রিপোর্ট। আমি বললাম,
“এটা আবার কী?”
“দেখো।”
সেটা পড়ার পর যতটুকু বুঝতে পারলাম তা হলো, মৃত্যুর আগে স্নিগ্ধার সাথে ভাইয়ার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এটা বের করা হয়েছে। কিন্তু ভাইয়ার ডিএনএ স্যাম্পল পেলো কোথা থেকে? তার লাশ তো দাফন করা হয়ে গিয়েছিল, কোন টেস্টের জন্য রাখা হয়নি। আমি কিছু বলার আগেই রাইফা বলতে শুরু করল,
“আমার বিয়ের আগেরদিনই স্নিগ্ধা আর রিফাত ভাইয়া বিকেলের দিকে একে অপরের সাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কোয়ালিটি টাইম পাস করার সিদ্ধান্ত নেয় একটা নামকরা হোটেলে। তারা যে স্বামী-স্ত্রী, এটা প্রমাণের জন্য তারা নিজেদের সাথে কাবিননামাটা রেখেছিল। যাতে করে তাদের পুলিশ বেআইনি কাজের ছুতোয় ধরতে না পারে হোটেল রেইড দিয়ে। তখনই হয়তো তারা ভালোবাসার সাগরে ডুব দিয়ে একে অপরের অস্তিত্বে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মানে, তাদের মধ্যে শারীরিক মিলন হয়েছিল আরকি। এরপরই তারা যখন হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে আসছিল, তখন অ্যাকসিডেন্ট হয় তাদের দু’জনের। রিফাত ভাইয়ার পরিবার আছে, তাই তার লাশের ব্যবস্থা করার কোন ত্রুটি থাকতো না। কিন্তু তিন কুলে স্নিগ্ধার কেউ-ই নেই খোঁজ নেওয়ার। ও নিজেদের পরিবারের কারো সাথেই আর সম্পর্ক রাখেনি, তাই তার লাশ হয়ে যায় বেওয়ারিশ। কিন্তু আমি অনেক কষ্টে বলে কয়ে তার লাশটাকে মর্গে রাখার ব্যবস্থা করি কিছুদিনের জন্য। আমার বান্ধবী নীলাকে চিনো না? ওর ভাইয়া দেশের বাইরে থাকায় ততদিন অপেক্ষা করি। শেষে সে চলে এলে এইসব টেস্ট করাই, আর সেগুলোর রিপোর্ট তো তোমাকে দেখালামই। এরপর আজ ওর লাশের জানাজা হয়ে দাফন হলো। আরেকটা কথা। তোমার ভাইয়ের ডিএনএ স্যাম্পল যেটা ব্যবহার করে টেস্ট করা হয়, সেটা ছিল তার মাথার চুল। আমি তার লাশ বাসায় আনার পরপরই ভবিষ্যতে এমনটা হবে চিন্তা করে নিজের মাথা খাটিয়ে লুকিয়ে এই সেম্পল সংগ্রহ করে রাখি ভাইয়ার মৃতদেহের মাথা থেকে। ব্যস! এটা ব্যবহার করে ডিএনএ টেস্ট করেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে স্নিগ্ধার সাথে রিফাত ভাইয়ার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল আর কাবিননামা এটা প্রমাণ করে যে তার সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে হয়েছিল। উপরন্তু এটা তো প্রমাণ করেই দিয়েছি যে আমার আর রিফাত ভাইয়ার বিয়ে হয়নি।”
আমি নিশ্চুপ হয়ে আছি। রাইফা বলতে লাগল,
“আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগ ছিল যে আমি তোমার ভাইকে খুন করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি এখন খুব ভালোভাবেই প্রমাণ করে দিলাম যে আমার তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার ভাইকে খুন করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। আমার স্বামী শুধুমাত্র তুমিই ছিলে, তুমিই আছো, এবং তুমিই থাকবে। আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি কোনকালেই ছিল না। ওহ হ্যাঁ।”
বলেই রাইফা রুমের বাইরে চলে গেল।
আমি কোনকিছু ভাবার মতো অবস্থায়ও নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাইফা রুমে আসলো আরেকটা কাগজ নিয়ে। আমার হাতে দিয়ে বলল,
“এটা পড়ো। তোমার পড়ার জন্য ভাইয়া রেখে গিয়েছিল। যদিও আমাদের বাসর রাতেই এটা তোমাকে সর্বপ্রথম দিতে বলেছিল সে, কিন্তু তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল।”
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম,
ভাই,
রাইফা যা যা বলবে এখন তোকে, সব সত্যি। আমি আলাদা করে কিছুই আর বলবো না তোকে। আমার উপর রাগ করিস না যেন। রাইফা, মানে তোর বউয়ের কাছ থেকেই সবকিছু জেনে নে। আমরা যা যা করেছি, সবকিছু সকলের ভালোর কথা চিন্তা করেই করেছি। আর কথা বাড়ালাম না, তুই কিন্তু আবার রাগের বশে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস না। রাইফা মেয়েটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে, সেটা তুই অন্ধ বলে দেখতে না পারলেও আমি খুব ভালোভাবেই সেটা বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই। তাই ওকে মোটেও স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করবি না আজ বলে দিলাম। খুব শিগগিরই বাসায় আসবো তোর নতুন ভাবীকে নিয়ে। শুভ বাসররাত!
এতটুকুই লিখা কাগজে। কিন্তু আফসোস! ভাইয়ার সাথে আর দেখা হলো না, আর না হলো আসল ভাবীর সাথে। আমি এটা পড়ার পর রাইফার দিকে তাকাতেই ও বলল,
“জানি যে তোমার মনে এখন প্রশ্ন জাগছে যে আমি কেন আগে এটা তোমাকে দেখিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করিনি। আসলে আমি সব ঘটনা তার সাথে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ একসাথে করলাম তোমার সামনে। এটাই যদি দেখাতাম শুধু তোমাকে আগে তাহলে বাকি ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা চাইতে তুমি, যেটা আমি তোমাকে তখন হয়তো দেখাতে পারতাম না। কিন্তু এখন সব ঘটনার সাথে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দলিল পর্যন্ত তোমার সামনে উপস্থাপন করেছি। এবার বলো, আমি নির্দোষ?”
আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে অত্যন্ত শান্ত এবং বিনয়ী গলায় রাইফাকে বললাম,
“হুম, তুমি নির্দোষ। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও তোমাকে ভুল বুঝার জন্য এতদিন এবং তার সাথে তোমার গায়ে হাত তুলবার জন্য, তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করার জন্য।”
এই বলে যেই ওর পা ধরে ক্ষমা চাইতে যাব, ঠিক তখনই ও আমার হাত আটকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কী করছ তুমি? নিজের বউয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হয় নাকি হুম? আমি মোটেও রেগে নেই তোমার উপর। বরং তোমার ভাইয়ার প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ। আসলেই, তোমার মতো ভাই-ই পাওয়া উচিত একজন ছেলের।”
আমি ততক্ষণে কেঁদে দিয়েছি। আমার আরেকটু কাছে এসে রাইফা আমার চোখের জল মুছে দিল। তারপর আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে আচমকাই আমাকে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে আমার উপর এসে উঠলো। তারপর আমার সারা মুখে চুমু খেতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম যে আজকের এই ঘটনাটা বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাই ওকে তাৎক্ষণিক আস্তে করে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বললাম,
“আমি তোমাকে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এসবের জন্য আমার কিছুদিন সময় লাগবে।”
“কিন্তু এমন তো কথা ছিল না। কথা ছিল যে আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করলেই স্ত্রীর অধিকার দিবে আমাকে তুমি।”
“প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো, আমি এমন মানসিক অবস্থায় এখন নেই। আমার ভাইয়ের খুনীকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে। আমার মন বলছে, অন্য কেউ আমার ভাই আর স্নিগ্ধা ভাবীকে খুন করেছে। তাদের আমি ধরার আগ পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই। আমি অন্য কিছুতে তার আগে মনোনিবেশ করতেও চাই না। তাই প্লিজ, আমাকে জোর করো না।”
এটা বলেই আমি বাইরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম।
রাইফা কিছুক্ষণ আমার দিকে দুঃখিত নয়নে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই ওর মুখে একটা অদ্ভুত, পৈশাচিক হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কে জানে, এই হাসির অন্তরালে কী লুকিয়ে আছে।
চলবে