ভাবী_যখন_বউ পর্ব_০৬,০৭

ভাবী_যখন_বউ
পর্ব_০৬,০৭
Syed_Redwan
পর্ব_০৬

রাতে খাওয়ার পর রুমে চলে আসলাম। এর মাঝে রাইফার সাথে আমার কোন কথাই হয়নি। আমি রুমে ঢুকার ঠিক পরমুহূর্তেই রাইফাও রুমে প্রবেশ করল। আমি যেই বিছানায় শুতে যাবো, ঠিক তখনই রাইফা আমার টি-শার্টটা পিছন থেকে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেয়। আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই আবার ও আমাকে ধরে ফেলে। আমি ঠিকভাবে দাঁড়ানোর আগেই ও আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। বলে,
“অনেক হয়েছে। আমাকে তোমার মেনে নিতেই হবে, হোক আগে কিংবা পরে। শুধু শুধু কেন বিলম্ব করছ?”
“আমার ভাইয়ের খুনীকে আমি নিজের বউ হিসেবে মেনে নিব? হা হা হা!”
“যদি আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমি তোমার ভাইকে খুন করিনি, তবে?”
“তাহলে নিঃশর্তে তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিব, আমার করা প্রতিটা দুর্ব্যবহারের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করব। ভালোবেসে এবং নিজ থেকেই তোমাকে স্ত্রীর অধিকার দিব। কিন্তু আফসোস! সেই দিন হয়তো আসবে না কোনদিনও। কারণ তুমি আমার ভাইকে খুন করেছ, এই সত্যটা তুমি হাজার চাইলেও পরিবর্তন করতে পারবে না। সত্য ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়, বদলানো যায় না।”
“আমাকে জাস্ট কয়েকটা দিন সময় দাও, আমি তোমার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবোই।”
“দিলাম সময়। একমাসের ভিতর পারো কিনা দেখি।”
“আচ্ছা। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না কিন্তু।”
“ঠিক আছে। আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ো না, তাহলেই হবে।”
“আমি তোমার এই শর্ত মানতে পারব কিনা জানি না, তবে তুমি আমাকে কষ্ট দিতে পারবে না কিন্তু এই কথা দিয়ে ফেলেছ তুমি। হি হি!”
এটা বলেই ও ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো। আমিও আর ওর জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।

আজ দুপুরে বেশ অনেকটা সময় ঘুমানোর কারণে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে স্ক্রিন স্লাইড করে দেখি যে রাত দুটো বাজে। হঠাৎ করেই কী মনে করে যেন খাটের পাশে তাকিয়ে দেখি যে রাইফা নেই। আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ি। বাথরুম চেক করে দেখি সেখানেও নেই। রাইফার রুমে বেশ বড় একটা বেলকনি আছে। সেখানে থাকতে পারে হয়তো। এটা মনে করে সেখানে গিয়ে দেখি রাইফা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে বাইরের দিকে তাকিয়ে।

আমি চুপিচুপি ওর পিছনে চলে যাই। ও টের পায় না। ওর শেষের কথাগুলো শুনতে পাই।
“হ্যাঁ দোস্ত, এটার খুবই দরকার আমার। সরাসরি দেখা হলে সবকিছু খুলে বলবো। এখন রাখি, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। রেড উঠে পড়লে আমাকে না পেলে কী না কী ভাববে আবার। রাখলাম।”
ফোনটা কেটে দেয় রাইফা। ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পিছন ঘুরেই বেশ জোরেই আমার বুকের সাথে ধাক্কা খায় কিন্তু আমি ওকে ধরে ফেলি, তাই ও নিচে পড়ে না। মনে হয় যে আমাকে দেখে ও কিছুটা ভয় পেয়েছে। নিশ্চয়ই ও আমাকে এই সময় এখানে আশা করেনি।
“এত রাতে কী করছিলে এখানে?”
“আসলে…..আমার এক বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম।”
“সেটা আমিও শুনে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কার সাথে এবং কী নিয়ে কথা বলছিলে?
“একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম।”
“এত রাতে আবার কেমন জরুরি বিষয় নিয়ে কথা থাকতে পারে শুনি?”
“আসলে এটা আমার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। আমি এতকিছু বলতে পারব না তোমাকে।”

বলেই আমার পাশ কাটিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করতে নেয়। সাথে সাথেই আমি আমার বাম হাত দিয়ে ওর ডান হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসি ওকে আর ডান হাত দিয়ে ওর কোমর বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরি। আমার বাম হাত ওর লম্বা চুলের ভিতর অতি সন্তর্পণে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের হাত মুঠি করে ওর মাথার চুলের এমনকি ওর সম্পূর্ণ মাথা নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসি। ও এতক্ষণ ধরে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আমার এই কাজটা দেখছিল। আমি নিশ্চিত, ও কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি যে আমি এটা করতে পারি। বললাম,
“ভালোয় ভালোয় আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। এতে তোমারই ভালো। নাহলে আমাকে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য সুশীল হবে না।”
“আমি কিছুই বলতে পারব না এখন। ছাড়ো আমাকে!”

মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। সাধারণত মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে, তার উপর রাইফার এমন ঘাড়ত্যাড়ামি আমি সহ্য করতে না পেরে ওর চুলের মুঠি জোরে টানলাম। ও ব্যথায় চিৎকার করে বলে উঠল,
“আহহ্! প্লিজ ছাড়ো আমাকে, আমি বলছি তোমাকে।”
ওর চুলের মুঠিটা হালকা করে দিলাম, ঠিক আগের মতোই। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। তারপর আমার বুকে নিজের মাথা এলিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। আমি বাধা দিলাম না কেন জানি। তখনো আমি বাম হাতে ওর চুলের মুঠি ধরে রেখেছি আর ডান হাত দিয়ে ওর কোমর ধরে রেখেছি। ও বলা শুরু করল,”আমার বান্ধবী নীলার সাথে দেখা করা হয় না বহুদিন। ও একটা দরকারি কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিল, ওর ফোনও বন্ধ ছিল। ও কিছুক্ষণ আগে শহরে এসেই আমাকে কলব্যাক করলো। ওর সাথেই কথা বলেছি বিশ্বাস করো। আর কী কথা হয়েছে, সেটা এখন জানতে চেয়ো না প্লিজ। সেটা সময় হলে এমনিতেই জেনে যাবে।”
“কোন নীলা? জুনায়েদের গার্লফ্রেন্ড?”

আমার কথা শুনে বুক থেকে মাথা তুলে রাইফা চোখ বড় বড় করে তাকালো আমার চোখে। তারপর বলল,
“তুমি কীভাবে জানো যে জুনায়েদ ভাইয়া নীলার বয়ফ্রেন্ড?”
“আমার একজন বেস্টফ্রেন্ডের জিএফকে আমি চিনবো না, এমনটা হয় নাকি?”
“জুনায়েদ ভাইয়া তোমার বেস্টফ্রেন্ড?!”
“হুম। কিন্তু এতে তুমি এতটা উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?”
“এমনি মানে……জানতাম না তো, তাই আরকি! সমস্যা নেই, এখন জেনে নিলাম যে জুনায়েদ ভাইয়া তোমার বেস্টফ্রেন্ড। কিছুদিন পর আশা করি আমার একটা দুলাভাইও হয়ে যাবে হি হি হি।”
“রাত হয়ে গিয়েছে, রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আমাকে কোলে করে নিয়ে যাও রুমে। এমনিতেই তো জড়িয়ে ধরে রেখেছ। একটু কষ্ট করে কোলে করে নিয়ে যাও না গো খাট পর্যন্ত। আমার তোমার কোলে ওঠার খুব ইচ্ছে করছে।”

আমি সাথে সাথেই ওকে ছেড়ে দিলাম। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
“নিজের ভাইয়ের খুনীকে এত আদিখ্যেতা দেখাতে পারব না আমি।” বলেই রুমে এসে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম আমি।

আমি এসে পড়ার পর রাইফা কিছুক্ষণ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দিয়ে রুমে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার নিজেকে আবিষ্কার করলাম গতদিনের মতো রাইফাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়। আজকেও ও আমার আগে ঘুম থেকে জেগে ওঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ রেগে গেলাম আমি। ওর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটা ধাক্কা দিলাম।
“এমন করার মানে কী? এসব করে আমার মন গলাতে পারবে না।”
“আমি আবার কী করলাম, হুম?”
“আমার কাছে এসেছো কেন?”
“ওমা! তুমি নিজেই তো ঘুমের ঘোরে আমাকে জড়িয়ে ধরেছ। আমার ইচ্ছা হয়নি, তাই ছাড়াইনি। তাছাড়া তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ঘুমাতে খুব আরাম হয় আর ভালোও লাগে হি হি।”
“আমাকে বোকা পেয়েছো? রাতে আমার ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় তুমি নিজেই আমাকে কৌশলে তোমাকে জড়িয়ে ধরাও, আর সকালে বলো যে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি, তাই না।?”
“একদম না! তুমি নিজে থেকেই আমাকে জড়িয়ে ধরো ঘুমের মধ্যে। ”

আমার কোলবালিশ নিয়েই ঘুমানোর অভ্যাস নেই, সেখানে এই মেয়েকে ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে ধরার কোন প্রশ্নই আসে না।
“আমি মোটেও তোমাকে জড়িয়ে ধরি না। মিথ্যা বলছো তুমি।”
“তুমি আমাকে জড়িয়ে কেন ধরতে পারো না বলো তো? আমি কি একেবারেই সুন্দরী না? হট আর সেক্সি না আমি? একদম ধবধবে ফর্সা না হলেও যথেষ্ট উজ্জ্বল আমি। আর আমি তো এতদিন এটাই জেনেছি যে, যেকোন পুরুষকে আকৃষ্ট করার যথেষ্ট রূপ আর গুণ আছে আমার। তাহলে কেন তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারো না, বলো? আমাকে তোমার ভালো লাগে না দেখতে, কাছে পেতে, বলো?”(আমার কলার ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল)
“শুধু চেহারা ভালো থাকলেই সবাইকে আকৃষ্ট করা যায় না, এর জন্য একটা সুন্দর মনও থাকা প্রয়োজন, যেটা তোমার মধ্যে নেই। কীভাবে থাকবে, তুমি তো একটা খুনী।”(নিজেকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে)
“আমি মোটেও খুনী না। আর, হ্যাঁ, আমি দেখতে সুন্দর, আমাকে তোমার ভালো লাগে এটা সরাসরিভাবে না হলেও, অন্তত ঘুরিয়েফিরিয়ে স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ। খুব শীঘ্রই আমার মনটাকেও তোমার সুন্দর লাগবে।”
“এই স্বপ্নই দেখতে থাকো জেগে জেগে।”
“এটাই হবে বাস্তবে।”

রাইফা উঠে বাথরুমে চলে গেল। ঘড়িতে দেখি সকাল আটটা বাজে। গতকাল বাড়ির লোকদের ফোন দেওয়া হয়নি। আমি ফোনটা নিয়েই আম্মুর নম্বরে কল দিলাম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরই রিসিভ হলো।
“হ্যালো আম্মু।”
“বল বাবা। কেমন আছিস? সবকিছু ঠিকঠাক তো সেখানে।”
“হুম। তোমাদের ওইখানে কী অবস্থা? সব কাজ ঠিকঠাকমতো হয়েছে তো? আব্বু আর মেঘা কেমন আছে? বাড়ির সকলে কেমন আছে?”
“হুম, সবাই ভালো আছে। আমরা পরশুদিন চলে আসবো ইনশাল্লাহ। নিজের খেয়াল রাখিস বাবা।”
“ভাইয়ার কথা খুব করে মনে পড়ছে আম্মু। ভাইয়া আমাদের কেন ছেড়ে চলে গেল এভাবে?”
“কেউ তো আর চিরকাল বেঁচে থাকার জন্য আসে না পৃথিবীতে। সকলকেই চলে যেতে হবে একদিন। তুই এখন আমাদের একমাত্র ছেলে সন্তান। তুই নিজেই যদি এতটা ভেঙে পড়িস তাহলে আমাদের কী হবে একবারও ভেবে দেখেছিস?” আম্মু নিজেই কান্না করে দিল কথাগুলো বলতে বলতে।

আমার নিজের চোখ দিয়েও ইতিমধ্যে জল গড়িয়ে পড়ছে। শুধু শব্দ করে কান্না করছি না, এইটুকুই। সবার জীবনেই তো উথান পতন আসে, এখন নাহয় আমাদেরই কষ্টের সময়। এসবকিছুকে সহ্য করে আমার নিজেকে এগিয়ে যেতে হবে, সাথে নিজের পরিবারকেও সামলাতে হবে। আমি নিজেই ভেঙে পড়লে সত্যি আমার পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। তাই আমি অতি কষ্টে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করে বললাম,
“না আম্মু, আমি ভেঙে পড়িনি। শুধু ভাইয়ার কথা মনে পড়ছিল আরকি। তোমরা সাবধানে থেকো, আর আব্বু এবং বোনকে দেখে রেখো।”

এমন সময়ই রাইফা বাথরুম থেকে বের হলো। ঠিক তখনই আম্মু বলল,
“বৌমা কোথায় রে? তোর আশেপাশে আছে? থাকলে একটু ফোনটা দে, ওর সাথে কথা বলি।”
“হুম দিচ্ছি।”

রাইফার হাতে ফোনটা দিয়ে আমি বাথরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। বের হয়েও দেখি ও আম্মুর সাথে খুশিমনেই কথা বলছে। আমি ড্রয়িংরুমে গেলাম। সেখানে রাইফার কাজিনরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের হাই-হ্যালো বলে আমি গিয়ে সীমান্তর পাশে বসলাম।
“কী খবর ভাইয়া, না মানে…..দুলাভাই? ধুর! দুলাভাই ডাকায় স্টেবল হতে একটু সময় লাগবে।”
“সমস্যা নেই, সময় নিয়েই দুলাভাই ডাকা আয়ত্তে আনো। আমি নিজেও ভাবিনি তুমি কোনদিন আমার শ্যালক হবে। তো, যে কাজের জন্য এসেছিলাম, তোমার কি কিছুদিন সময় হবে আমার জন্য? মানে একটা খুনের তদন্ত করতে হবে।”
“কী?! খুনের তদন্ত? কার খুন? আর যদি করতেই হয়, তবে আমার সাহায্য কেন চাচ্ছেন? আপনার শ্বশুরমশাই-ই তো আছে যিনি এই কাজের জন্য বেস্ট।”
“উঁহু, কিছু সমস্যার জন্য উনার সাহায্য আমি নিতে পারব না। আমার তোমার সহযোগিতাই লাগবে। আসলে, এটা আমার ভাইয়ের হত্যার তদন্ত। আমি জানি যে এটা অ্যাকসিডেন্টের নামে চালিয়ে দিলেও আসলে এটা একটা খুন।”
“কাকে সন্দেহ করছেন আপনি?”
“ঠিক কাকে সন্দেহ করছি এখন বলবো না। তবে তুমি এমনিতেও আসামি সামনে আসলে জানতে পারবে। এখন বলো, পারবে না আমাকে কিছুদিন সময় দিতে?”
“আসলে হয়েছে কি দুলাভাই, আমার এক ভাগ্নী হয়েছে। তাই আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি কানাডায় আপু-দুলাভাইয়ের কাছে। দুই মাস পর ফিরব। তাই বলছিলাম, ততদিন আপনি অপেক্ষা করেন অথবা অন্য কাউকে বলেন আপনার সাহায্য করতে।”
“তুমি থাকলে সবচেয়ে ভালো হতো।”
“পাসপোর্ট ভিসা সবকিছুই রেডি দুলাভাই। আর কিছুদিন আগে বললেই কিন্তু আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু এখন না গিয়েও উপায় নাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে, কী আর করার। আমার নিজেকেই সবকিছু করতে হবে।”
“এক কাজ করা যায়। আমি দেশে থাকবো না তো কী হয়েছে? আমরা ইন্টারনেটে যোগাযোগ করতে পারি। আপনি এখানে থেকে ক্লু যোগাড় করবেন, আর আমি দূরে থেকে হলেও মিলানোর চেষ্টা করব সবকিছু। নাহলে একমাস পর তো আমি এসেই পড়ছি। কিন্তু আমার মনে হয় আমার দেশে ফেরত আসার আগেই কেইসটা সলভ হয়ে যাবে। কারণ আপনার বড়ভাইয়ের মৃত্যুর কেইস, আপনার সর্বোচ্চ ডেডিকেসন থাকবে এতে আর তার সাথে আমি তো আছিই আপনার সাথে সর্বদা। চিন্তা করবেন না, রিফাত ভাইয়ার খুনীকে আমরা অবশ্যই বের করব এবং তার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”
“হুম, ঠিক আছে।”

সীমান্ত আমার অনেকদিনের পরিচিত এক ছোটভাই। কিন্তু সে যে রাইফার মামাতো ভাই, এটা আমি জানতাম না। আমাদের তিন ব্যাচ জুনিয়র সে। আমি আর ও একই স্কুলে পড়েছি, সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়। ও বর্তমানে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু ও একজন বিশিষ্ট ছদ্মবেশী গোয়েন্দা হিসেবেই আমার কাছে বেশি পরিচিত। কারণ ও ইতিমধ্যে কিছুদিন আগে একদল ড্রাগ ব্যবসায়ীদের ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া ওর সাথে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্কও আছে। আমি জানি যে ওর পক্ষে সত্যি এখন সম্ভব না শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে আমাকে সাহায্য করা, তাই ও করবে না বলেছে। সম্ভব হলে অবশ্যই রাজি হতো। তবে আমারও বিশ্বাস, ও বিদেশে থেকেই আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবে।

সকালের নাস্তা করে আমরা দুপুরের আগেই ঘুরতে বের হলাম। সারাদিন অনেক জায়গায় ঘুরলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম চোখে এসে ভর করলো। রাইফারও খুব ক্লান্ত লাগছে শরীর, কিন্তু এখন যে ওর ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলে চলবে না। ওকে যে অনেককিছুই এখনো করতে হবে।

ওয়াসরুম থেকে মুখে পানি দিয়ে বের হলো সে। তবে রুম থেকে বের হতে গিয়েও ফিরে আসল। আমার ঘুমন্ত মুখের সামনে এসে বসলো। আমার গালে হাত রাখল। তারপর নিজের মুখটা আমার মুখের কাছে এনে আমার কপালে একটা চুমু খেলো। এরপর ওর ঠোঁটজোড়া আমার ঠোঁট পর্যন্ত নামিয়ে এনে আমার ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট মিলালো তবে অনেক সাবধানে, যাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। কিছুক্ষণ পরই আমার মাথার চুলগুলো ঠিক করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে রুম থেকে এবং এরপর বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

“এতকিছু হয়ে গেল আর তুই এখন এসব বলছিস আমাকে? তাই তো বলি, এতদিন আমাদের সকলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে কেন রেখেছিলি।” বেশ অনেকটা উত্তেজনার সাথেই বললো রাইফার বান্ধবী, নীলা।
“আমার কাছে আর কোন উপায়ই ছিল না। তখন এসব ঠিক মনে হয়েছিল তাই করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, রেড কি আমাকে মাফ করবে?” রাইফা বলল।
“জানি না। সেসব কথা পরে। এখন তুই বল, কী করবি? কোন প্ল্যান আছে তোর কাছে?”
“সম্পূর্ণ প্ল্যান নেই, তবে কিছুটা আছে। এজন্যই তো তোর সাহায্য নিতে এসেছি। তুই আর আমি মে একটা সম্পূর্ণ প্ল্যান সাজাই, যাতে আমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারি।”

এরপর তারা দু’জন বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা বলে। শেষে নীলা বলে উঠল,
“ব্যস! হয়েই গেল। এই প্ল্যান মোতাবেক কাজ করলে আর তোর রেদওয়ানের কাছে মাফ চাইতে হবে না। সব এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। শুধু এখন বাকি আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা। কষ্ট হবে, হয়তো আমাদের অনেক কষ্ট হবে এটা করতে, কিন্তু তোকে এটা পারতেই হবে নিজের জন্য, নিজের ভালোবাসাকে কাছে পাওয়ার জন্য।”
“আমি পারব। তুই খালি আমার সাথে থাকিস।”
“সবসময়ই আমি তোর সাথে আছি। তোর বেস্টু কি এমনি এমনি হয়েছি নাকি আমি, হুম?”
“হা হা।”

ঠিক এমন সময়ই রাইফা আর নীলা যেই রেস্টুরেন্টে বসে আছে, সেই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে আমার এক বেস্টফ্রেন্ড জুনায়েদ। ওকে এই সময় এখানে দেখে রাইফা অআাক হওয়ার চেয়ে ভয় বেশি পেয়ে যায়। ও তড়িঘড়ি করে নীলাকে বলে,
“তোর বয়ফ্রেন্ড এখানে কেন?”
“ওকে আমিই আসতে বলেছিলাম এখানে। তোর সাথেও দেখা হয়ে গেল আর ওর সাথেও ডেট হয়ে গেল, এক ঢিলে দুই পাখি মরলো। কতদিন পর দেখা করছি আমরা। দাঁড়া, ওকে ডাকছি। এই জুনায়েদ, জুনায়েদ…..” রাইফা নীলার মুখ চেপে ধরলো আর বলা শুরু করল,
“তোর বয়ফ্রেন্ড আমার হাসবেন্ডের বেস্টফ্রেন্ড। ও এখন এখানে আমাকে দেখতে পেলে রেডকে বলেও দিতে পারে যে আমি তোর সাথে দেখা করতে এখানে এসেছি বা এখানে আসি। আমি কোনভাবেই চাই না ও জানুক আমি কীভাবে এই কাজটা করছি। ও জানতে পারলে আমাকে বাধা দিতে পারে। আমি কোন রিস্ক নিব না। আমি গেলাম, বাকি কথা ফোনে হবে। আমি বের হওয়ার পর ওকে ডাক দে। বায়!”
“আচ্ছা দোস্ত, পরে ফোন দিস, বায়!”

রাইফা কোনরকমে মুখে কাপড় দিয়ে নিজেকে গোপন করেই বের হয়ে আসতে সক্ষম হয় রেস্টুরেন্ট থেকে। রাইফা বাসা থেকে রেস্টুরেন্ট কাছে হওয়ার ও পায়ে হেঁটেই এখানে এসেছে এবং হেঁটে হেঁটেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। তখনও সন্ধ্যা নামতে ঘন্টাখানেক দেরি।

রাইফা বাসার দিকে যাচ্ছে এবং নিজের পরিকল্পনার কথা বারবার ভাবছে। বরাবরের মতো এবারও তার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। সে জানে তার এখন কী করতে হবে।

চলবে

#ভাবী_যখন_বউ
#পর্ব_০৭
#Syed_Redwan

রাইফা কোনরকমে মুখে কাপড় দিয়ে নিজেকে গোপন করেই বের হয়ে আসতে সক্ষম হয় রেস্টুরেন্ট থেকে। রাইফা বাসা থেকে রেস্টুরেন্ট কাছে হওয়ার ও পায়ে হেঁটেই এখানে এসেছে এবং হেঁটে হেঁটেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। তখনও সন্ধ্যা নামতে ঘন্টাখানেক দেরি।

রাইফা বাসার দিকে যাচ্ছে এবং নিজের পরিকল্পনার কথা বারবার ভাবছে। বরাবরের মতো এবারও তার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। সে জানে তার এখন কী করতে হবে।

বাসায় এসে রুমে প্রবেশ করে দেখে যে আমি নেই রুমে। আমি কোথায় যেতে পারি এটাই ভাবছে ও। হয়তো ছাদে গিয়েছি। ও ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় বদলে বের হয়ে এলো। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে আর নিজ মনেই ভাবছে,”কোনদিনও ভাবিনি যে এরকম দিনও একদিন দেখতে হবে। তবে যেহেতু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই গিয়েছি আমি, তাহলে এটাকে যে মোকাবিলা করতেই হবে। এই রাইফা কখনো কোনদিনও কারো কাছে হারতে শিখেনি, এমনকি আমি আমার নিজের ভালোবাসার মানুষ রেদওয়ানের কাছেও কিছুতেই হারবো না। জানু, মন খারাপ করো না প্লিজ, কিন্তু আমি যে তোমার কাছেও হারতে পারব না(একটা শয়তানি হাসি দিয়ে)। তোমাকে তোমার নিজের চ্যালেঞ্জেই হারাচ্ছি আমি, শুধু দেখে যাও। আমাকে কোনভাবেই খুনী তুমি প্রমাণ করতে পারবে না। আর তোমাকে পাওয়ার জন্য একটা কেন, হাজারটা খুনও করার সাহস আমি রাখি হাহা!”

রাইফা কালো সালওয়ার কামিজের সাথে মিলিয়ে ঘন কালো রঙের লিপস্টিক দিল ঠোঁটে। ওর নখগুলোতে আগে থেকেই কালো নেইলপলিশ দেওয়া। চোখে গাঢ় কাজল দেওয়া। ও কিছু একটা ভেবে আরেকটা ডেভিল স্মাইল দিয়ে রুম থেকে বের হলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

ফ্ল্যাট থেকে যেই বের হবে ছাদের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য, তখনই ওর ফুপাতো বোন লিজা ওকে আটকায়। ওদের বাসায় এখন অতিথি বলতে আছে মামাতো ভাই সীমান্ত, ফুপাতো ভাই নিলয়, ফুপাতো বোন লিজা আর খালাতো বোন সুমাইয়া। লিজা বলল,
“কী রে, এই সাজ দিলি কেন? পুরো পেত্নীর মতো লাগছে তোকে দেখতে। দুলাভাই এখন ছাদে আছে সম্ভবত। এই অবস্থায় দুলাভাই তোকে তাও আবার এই ভর সন্ধ্যাবেলায় দেখলে কিন্তু একেবারেই ভয়ের চোটে অজ্ঞান হয়ে যাবে যদি কি না তার সাথে অন্য কেউ থাকে।”
“এজন্যই তো এই ডাইনী মার্কা সাজ দিয়েছি। আচ্ছা আমি যাই রে, পরে বলব কী হলো।”
“All the best! তবে বেশি ভয় দেখাস না, হার্ট ফেল করে অক্কাটক্কা পেয়ে গেলে তুই অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যাবি হা হা হা।”
“আরে না, সেরকম কিছুই করব না। আসলাম।”
বলেই রাইফা ছাদের দিকে পা বাড়ালো।

এইদিকে ছাদে আমি আর সীমান্ত গল্প করছি। এইমাত্র সন্ধ্যা হয়ে অন্ধকার নেমে আসলো।
“এটাই হলো কথা। কিন্তু কীভাবে কী করব বলো তো? কোন ক্লু পাচ্ছি না যেখান থেকে শুরু করা যায় তদন্ত।”
“এটাই চিন্তার বিষয়। দেখেন, কোনকিছুতে যদি বিন্দুমাত্রও সন্দেহ হয় তবে আমাকে বলবেন, সেখান থেকেই শুরু করব। আগামীকাল চলে যাচ্ছি, তবে অনলাইনে আমাদের যোগাযোগ ঠিকই থাকবে।” “অবশ্যই।”
“নিচে যাবেন না? অন্ধকার হয়ে আসলো।”
“একটু পর যাবো। তুমি যাও।”
“ঠিক আছে।”

সীমান্ত নিচে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার পরবর্তী ঢাকা শহরের একটা অংশকে নিজ চোখে অবলোকন করছি। পাঁচতলার উপরে ছাদ। ছাদটা ছোট নয় মোটেই। কয়েক প্রকারের ফুল ও সবজির গাছ আছে এখানে। এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশের আবছা অন্ধকার পরিবেশ দেখতে ভালোই লাগছে। সাথে আছে মনমাতানো ফুরফুরে বাতাস। রাইফাদের বাসাটা খারাপ নয় মোটেই। পাঁচতলা বাড়ির প্রতিটা তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। সবমিলিয়ে আটটা ফ্ল্যাট, এর মধ্যে আমার শ্বশুরমশাই চারটি ফ্ল্যাটের মালিক, বাকি চারটি ফ্ল্যাট ডেভেলপাররা বিক্রি করেছে আলাদা করে। আমার শ্বাশুড়ি একজন গৃহিণী। মোটকথা, রাইফাদের পরিবারটিকে নিঃসন্দেহে একটা অভিজাত পরিবার বলা চলে। এমন একটা পরিবারের মেয়ে হয়েও রাইফা এমন করলো, তাও আবার যেখানে ওর বাবা একজন পুলিশ কমিশনার? নাকি আমি নিজেই ওকে এত সময় যাবত ভুল ভেবে এসেছি?

কিছুক্ষণ আগে সীমান্ত জিজ্ঞেস করল আমি কীসে বা কাকে সন্দেহ করি আমার ভাইয়ের খুনের ঘটনায়। আমি ওকে কীভাবে বলতাম যে আমি ওর নিজের ফুপাতো বোনকেই সন্দেহ করছি? আমাকে অন্য কোনকিছু থেকেই শুরু করতে হবে তদন্ত। কিন্তু কী থেকে শুরু করব? এমন সময়ই খেয়াল করলাম ছাদে কেউ প্রবেশ করল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা মেয়ে।

চারদিকে আবছা অন্ধকার এখন। আমার থেকে কেউ দশ ফুটের দূরত্বে থাকলেও তার চেহারা স্পষ্টভানে দৃশ্যমান হবে না আমার কাছে। আর সেখানে মেয়েটা আমার থেকে প্রায় ২০ ফুট দূরে আর তার উপর ওর মুখের সামনে চুল ছড়ানো; মুখ ঢেকে রেখেছে চুল দিয়ে। আচ্ছা, ও কি আদৌ একজন মানুষ, নাকি অন্যকিছু? আমি ভূতে তেমন বিশ্বাসী নই, কিন্তু কেন জানি এখন অনেক ভয় করছে। তাছাড়া শুনেছিলাম যে ভর সন্ধ্যায়, অর্থাৎ এমন সময়ে অথবা এই সময়ের আশেপাশে নাকি ভূত-প্রেতের উপদ্রব বেড়ে যায় নির্জন জায়গাগুলোতে। তবে কি………

ওই মেয়েলি অবয়বটা ধীর গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি পিছাচ্ছি। ছাদ থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই অন্য কোন, বের হতে হলে এই মেয়েলি অবয়বটাকে ডিঙাতে হবে, যেটা করার সাহস এই মুহূর্তে আমি পাচ্ছি না। আমি ছাদের প্রত্যন্ত রেলিং পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম পিছাতে পিছাতে। কিন্তু ওই অবয়বটার থামার কোন নামই নেই। ও নিজের মতো করে এগিয়েই আসছে আমার কাছে।

ওর মাথা নিচু থাকার এবং মাথার সামনে দিয়ে চুল আঁচড়ে পড়ায় ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল না। এগুতে এগুতে এখন সে আমার থেকে মাত্র ১ ফুট দূরত্বে অবস্থান করছে, ঠিক তখনই ও আচমকাই মুখ তুলে চাইল আমার দিকে। আরে! একে তো রাইফার মতো লাগছে দেখতে! কিন্তু সবকিছু কালো কেন ওর, ওকে ভূতের মতো দেখতে লাগছে কেন? তাহলে কি……

আমার একেবারেই যখন কাছে এসে আমার গালে হাত দিয়ে একটা বিকট অট্টহাসি দিল সে, ঠিক তখনই আমার হুঁশ আসলো। তার মানে ও ভূত না? ও এতক্ষণ আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল? কিন্তু এসব করার অধিকার কে দিয়েছে ওকে? আমি তো এখনও দেইনি ওকে।

এক ধাক্কায় ওকে ছাড়িয়ে নিলাম নিজের কাছ থেকে।
“তোমার সাহস কী করে হয় আমার সাথে এমন করার?😡”
রাইফা হাসতে হাসতেই বলল,
“কেন? ভয় পেয়েছ নাকি হা হা হা!”
ওর হাসিটা অসহ্য লাগছিল আমার কাছে। এমনিতেই ওকে আমি নিজের ভাইয়ের খুনী হিসেবে সর্বপ্রথম সন্দেহ করি, তার উপর ওর এইসব নাটক আমার মেজাজকে চরমভাবে উত্তপ্ত করে দিল। আমি ওকে কষে একটা থাপ্পড় দেওয়ার উদ্দেশ্য নিজের ডান হাত চালালাম।

কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। ও আমার হাত ধরে ফেলল এবং আমি অপ্রস্তুত থাকার সুযোগ নিয়ে আমার হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে গেল। তারপর আমার গলা জড়িয়ে নিজের হাতের লম্বা নখগুলো আমার ঘাড় এবং গলা বরাবর তাক করে হালকা একটু বসিয়ে দিল। এতে করে আমি ব্যথা না পেলেও অনুভব করতে পারলাম যে ওর নখগুলো সত্যি বেশ ভালোই লম্বা, আগে খেয়াল করিনি এই বিষয়টা। ও আরেকটু জোরে চাপ দিলেই আমার গলা এবং ঘাড়ে ওর লম্বা নখগুলো সম্পূর্ণ বসে গিয়ে ভয়ংকরভাবেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। এত দ্রুত এই কাজ করল যে আমি কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম না, কারণ এই মেয়ের উপর আমার একেবারেই বিশ্বাস নেই, একটু নাড়চড়া করলে যদি রাক্ষসীর মতো নখ ঢুকিয়ে দেয় গলায়!

এবার রাইফা নিজের চোখদুটো একটু সরু করে বলতে লাগল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি তার মানে এই না যে তোমার এসব অযৌক্তিক অত্যাচার বারবার মেনে নিব। আমার দোষ থাকলে যা শাস্তি দেওয়ার দাও, আমি মাথা পেতে নিব। কিন্তু অপরাধ যদি আমি না করে থাকি, তাহলে কিন্তু হবে না। ছোট থেকেই সবসময় আমি নিজের ব্যাপারে অনেকটাই আহ্লাদী, আমার গায়ে হাত আমার নিজের আব্বু-আম্মু পর্যন্ত কেউ তুলতো না। সেখানে আমি তোমাকে এতদিন অনেক ছাড় দিয়েছি শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবাসি বলে। তবে এর মানে তো এই নয় যে আমার নিজেরও সহ্যের একটা সীমা থাকবে না।”

আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি যে রাইফার আমার সামনে ভালোমানুষি রূপের আড়ালে এমন একটা ভয়ংকরী রূপও থাকতে পারে। একজন মানুষকে যদি সবসময় ভালো এবং নম্র ভদ্র হিসেবে কেউ চিনে, জানে এবং সেই মানুষটি যদি হুট করেই রূপ বদলে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, তাহলে যেকেউই আৎকে উঠতে বাধ্য, আমিও ব্যতিক্রম হলাম না। রাইফা নিজের মুখটা আমার মুখের আরো কাছে নিয়ে আসলো, যতটা কাছে আনলে শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করা যায়, চোখে চোখ রেখে চোখের ভাষা অনুধাবন করা যায়। ওকে এবার আরো ভালোভাবে দেখলাম, চোখে কালো কাজল, একদম গাঢ় কালো লিপস্টিক, কালো রঙের ইয়ার রিং; শাঁকচুন্নি বলে যদি কিছু থেকে থাকে বাস্তবে, তাহলে ঠিক সেটার মতোই লাগছে ওকে দেখতে। সাথে ওর চোখ দুটো একদম লাল হয়ে আছে মনে হচ্ছে। আমার ভয়ের মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল।

“আমাকে রুমে নিয়ে চলো কোলে করে।”
“আমি?”
“তুমি ছাড়া আর কাকে বলতে পারি এটা বলো তো?”
“আমি পারব না।”
এবার রাইফা তার নখগুলো আরেকটু গাঁথল আমার গলায়, সামান্য একটু লেগেছে মনে হচ্ছে গলায়। আমি চোখ বন্ধ করলাম। কয়েক মুহূর্ত পর আবার ঢিলা করল নিজের নখগুলো আমার গলা থেকে।

“বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে একদমই কষ্ট দিতে চাই না। জানো, আমার এক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছিল চারবছর আগে, যখন আমরা অনার্সে নতুন নতুন ভর্তি হয়েছিলাম। তার হাসবেন্ড আবার মিচকে শয়তান ছিল, অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতো ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও। আমরা বান্ধবী আমাকে এটা বলার পর আমি তাকে এই সমস্যার সর্বশ্রেষ্ঠ সমাধান দেই। জানতে চাও সেটা কী?”
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম যার অর্থ যে আমি চাই সেটা জানতে। ও আবার বলা শুরু করল,
“বর পিটানো! হ্যাঁ, এটাই নিজের বরকে নিজের হাতের মুঠোয় নাচানোর সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। আমার কথা অনুযায়ী সেদিন থেকেই তার হাসবেন্ড তার কথার বাইরে একটু এদিকসেদিক করলেই বা অন্য মেয়েদের দিকে ভুলবশত তাকালেই উড়াধুরা কেলানি দিত। ভদ্রলোক কিছু বলতেও পারতেন না কারণ তার শ্বশুরমশাই হচ্ছেন পুলিশ, আমার বাবার সহকর্মী। শেষে আর কোন উপায় না পেয়ে বেচারা বউয়ের অলিখিত গোলাম হয়ে গেলেন। মাশাল্লাহ আমার সেই বান্ধবীর এখন একদম ফুরফুরে অবস্থা, তাকে দেখে আমার নিজেরও এখন হিংসে হয়, ইশশ্ আমার বরকেও যদি আমি এরকম বানাতে পারতাম! কিছুদিন আগেই তো বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছিলাম, বেচারা দুলাভাই খালি বান্ধবীর দেওয়া অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটামাত্র কাজে সামান্য একটু ভুল করেছিল আর তাতেই কেল্লাফতে! বান্ধবীটা তাকে রুমে নিয়ে গিয়ে দিল একটা খুন্তির বাড়ি😂!”

রাইফার কথা শুনে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। এসব বলছেটা কী ও? ও আমাকে নিজের গোলাম বানাতে চায়? চাইলে যে কিছুই করার নেই আমার, সেটা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। রাইফা আবার বলে উঠল,
“এই শ্রেষ্ট বুদ্ধিদাত্রীর বর হলে তুমি। কিন্তু আমি তোমাকে আমার গোলামও বানাতে চাই না, আর না চাই তোমাকে কষ্ট দিতে। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবেসে আমার সকল ইচ্ছা পূরণ করো। কী হলো, করবে তো ভালোবেসে আমার সবগুলো ইচ্ছে পূরণ? নাকি আমাকে বাধ্য করবে….”
“কী করতে হবে আমার?”
“বললামই তো, আমাকে কোলে করে আমাদের বেডরুম পর্যন্ত নিয়ে চলো।”
“আচ্ছা, কিন্তু কোন শয়তানি করতে পারবে না বলে দিলাম।”
জবাবে রাইফা একটা মুচকি হাসি উপহার দিল আমাকে।

বাধ্য হয়েই ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও সাথে সাথেই গলা জড়িয়ে ধরল। এই প্রথমবার নিজের বোন বাদে কোন মেয়েকে কোলে নিলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে সারা শরীরে শিহরণ জাগলো। ও আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলেও আমি সামনের দিকে তাকিয়েই বাসার দরজা পর্যন্ত নিয়ে আসলাম ওকে।
“এবার নামো কোল থেকে। বাসার মানুষজন দেখলে কী ভাববে?”
“কিছুই ভাববে না। কেউ কিছু ভাবলে আমি দেখে নিব।”

অগত্যা বাধ্য হয়েই দরজায় কড়া নাড়লাম। সীমান্ত এসে দরজা খুলে দিল, আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই আমার শ্বাশুড়িমা বলে উঠলেন,
“কী ব্যাপার বলো তো? আমার মুরব্বিরা আছি না হুম? আমাদের সামনেও এসব করতে হবে নাকি?”
রাইফা বলল,
“আসলে আম্মু, আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি তো তাই তোমাদের জামাই আমাকে নিয়ে আসলো কোলে করে। আমি কত করে বললাম যে এমন করো না, কিন্তু ও আমার কথা শুনলোই না।”
রাইফার এমন কথা শুনে আমার মাথা লজ্জায় কাটা যাচ্ছে। আমি মাথা তুলে তাকাতে পারছি না কারো দিকে। তখন আমার শ্বাশুড়িমা একটু হেসে বললেন,
“ওহ আচ্ছা।”

আমি রাইফাকে রুমে নিয়ে আসার সময় পিছনে না তাকালেও বুঝতে পারলাম যে সকলেই হাসছিল আমাদের দেখে।
রুমে এসে রাইফাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার সময় ও আমার গলার যেই দুটো জায়গায় হালকা একটু নখের আঁচড় দিয়েছিল, সেখানে চুমু খেয়ে বলল,
“আই অ্যাম সো স্যরি জান। আমি তোমাকে কখনোই কষ্ট দিতে চাই না। তুমি শুধু আমার ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছেগুলো পূরণ কইরো, কেমন। আমি কখনো একটুও কষ্ট পেতে দিব না তোমাকে। লাভ ইউ!”

ও আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমি দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে অনবরত মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতে থাকলাম। এতে করে রাগ অনেকটাই প্রশমিত হয়।

রাতে খেতে যাওয়ার সময় সকলেই রাইফাকে নিজের পায়ে হেঁটে আসতে দেখে বলতে লাগলো,
“কী ব্যাপার তোর না পায়ে ব্যথা? তাহলে কীভাবে এত স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছিস?”
“আরে তখন ব্যথা পেয়েছিলাম কিন্তু এখন আর নেই, ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
“তাই? নাকি ব্যাপারটা অন্যকিছু হুম?” রাইফার খালাতো বোন সুমাইয়া চোখ টিপ দিয়ে বলল।
“দেখ ফাজলামো করিস না এগুলো নিয়ে। তুই তো বিয়ে করছিসই কিছুদিন পর, তখন বুঝতে পারবি সবকিছু, হুম।”
রাইফার কথা শুনে সকলে একসাথে হেসে দিল।

খাওয়া হয়ে গেলে আমি তড়িঘড়ি করে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেই। আমার মনে হচ্ছিল যে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় পেলে ও আমাকে জ্বালাতে ছাড়তো না। এছাড়া আমাকে আগামীকাল খুব ভোরে উঠতে হবে ঘুম থেকে। যদিও ভার্সিটি থেকে ভাইয়ের বিয়ের নাম করে দশদিনের ছুটি নিয়েছিলাম বিয়ের তিনদিন আগেই, কিন্তু কে জানতো যে সেটা আমার নিজেরই বিয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে যাবে? তবে আগামীকাল আমাকে খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে কিছু ভাবার জন্য, কিছু করার জন্য।

রাইফা তার কাজিনদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে রুমে এসে দেখে যে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। ও আমার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে একটা কাজে। কাজ বলতে, নীলার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় থাকে ও।

কিছুক্ষণ পর রাইফা আর নীলা মেসেঞ্জারে:
রাইফা: কী!? একসপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে আমাকে? দোস্ত, এটা একটু বেশি হয়ে যায় না?
নীলা: কিছুই করার নাই রে। ভাইয়া দেশেই আসবে পরশুদিন। সব কাজ গোছাতে গোছাতে সাতদিন লেগেই যাবে। কিন্তু চিন্তা করিস না, ভাইয়া লাশটাকে ততদিন মর্গে রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছে তাও আবার সুরক্ষিতভাবেই। কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।
রাইফা: ঠিক তাই হয় যেন। সাতদিনের বেশি একটা দিনও কিন্তু আমি বাড়তি দিব না। তোর ভাইকে চিনা আছে আমার খুব ভালো করেই। বেশি ঘাড়ত্যাড়ামি করলে কিন্তু ভাবীকে বলে দিব সে কোন কোন মেয়ের সাথে টাংকি মারতো বিয়ের আগে, এটা তাকে বলে দিস। ডাক্তার হয়েছে বলেই তার এত ভাব বাড়তে হবে না। আর লাশটার কিন্তু জানাজাও করাতে হবে, বলে দিস তোর ভাইকে।
নীলা: আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। তুই কোন চিন্তা করিস না, আমি সবকিছু ম্যানেজ করে নিব। রাত হয়ে গিয়েছে অনেক দোস্ত, আসি।
রাইফা: বায়!

রাইফা তার ফোনটা বালিশের পাশে রেখে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করল। সবকিছু তার প্ল্যান মোতাবেক হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এভাবে সবকিছু চললেই হয়। এবার আমার দিকে তাকালো সে। আমার ঘুমন্ত মুখ দেখে আনমনেই সে হেসে দিল, যে হাসিটা এক ধরনের তৃপ্তির হাসি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here