সৃজা
পর্বঃ২৬,২৭
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ২৬
রুম থেকে বেরোতেই সৃজাকে টেনে ধরল নোভা আর নাতাশা।তাদের দুজনেরই বায়না আগে তাদের ড্রেস চুজ করে দিতে হবে।পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো মেজো মামী।তিনি ধমকে উঠলেন
“এই তোরা কি শুরু করেছিস?ছাড় নতুন বউকে।নতুন বউয়ের অনেক কাজ।” কথাগুলো বলে নোভা,নাতাশার হাত ছাড়িয়ে তিনি নিজেই সৃজার হাত ধরে বললেন
“চলো,তোমার ননদিনীর বিয়ে তোমাকেই তো সব করতে হবে।”
সৃজা হতভম্ব হয়ে বলল
“জ্বী,করতে তো হবেই।”
মেজো মামী সৃজাকে টানতে টানতেই বললেন
“এখন তাড়াতাড়ি চল সানিয়া বিয়েতে কি পরবে সেটাই ঠিক করা হয় নাই।সেই সকাল থেকে লোক এসে বসে আছে।নোভাকে দিয়ে ডাক পাঠালাম,তা তুমি নাকি ঘুমাচ্ছো।লোকটাও বসে আছে।”
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে সৃজা খেয়াল করল এক পাশের সোফায় বুবু বসে আছে তার ল্যাপটপ নিয়ে,কিছু টাইপিং করছে হয়তো।তার পাশেই তানভীর ভাইয়া টিউলিপকে কোলে নিয়ে বসে আছে।টিউলিপের হাতে চকলেট।অন্য পাশের সোফায় বিভিন্ন কাপড় মেলে ধরে বসে আছে বেচারা কাপর ব্যবসায়ী।লোকটাকে উদ্দেশ্য করেই মেজো মামী বললেন
“এই যে ভাই শুরু করুন কাজ।বউয়ের ভাবী কাপর পছন্দ করবে।নতুন বউ যেটা পছন্দ করবে সেটাই পরবে আমাদের সানিয়া।” বুবু তার পরিবর্তে কাজে মনোযোগ রেখেই মুচকি হাসি দিলেন।অর্থাৎ তিনিও চায় আমি চুজ করি।একি ঝামেলায় পরলাম!আমার নিজের জিনিসই কখনো আমি চয়েজ করিনি
অনেক ইতস্তত করে বুবুকে আমার সামনে বসালাম
“তুমি এখানেই বসবে।আমি তোমার গায়ে রেখে দেখবো কোনটা সুন্দর।”
সানিয়া চুপচাপ বসে রইল।সৃজা একের পর এক শাড়ি তার উপর রাখছে আর তানভীর দূর থেকে না করছে।শেষে সাদা আর গোলাপির মধ্যে একটা লেহেঙ্গা রাখলাম সাথে সাথেই তানভীর ভাইয়া বলল
“এটাই পারফেক্ট!” সবাই চমকে তাকালো তার দিকে।ভাইয়া ইতি উতি করতে করতে টিউলিপকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।উপস্থিত থাকা কিছু লোক রসিকতা শুরু করল।বুবুও উপরে চলে গেলো।বোঝা গেল না রাগ করেছে নাকি লজ্জা পেয়েছে৷ যাওয়ার আগে বলল
“তোমার যেটা পছন্দ সেটা রাখো।আমার কাজ আছে,আমি যাচ্ছি।”
আমার শাশুড়ীমা বললেন যেটা তানভীর ভাইয়ার পছন্দ সেটাই রাখতে।এরপর বাড়ির সবার জন্যই একটা করে শাড়ি নিলেন আম্মা।তার পক্ষ থেকে তিনি সবাইকে উপহার দিতে চান।আমি পরলাম বিপাকে আমার শাড়ি নিয়ে।আম্মা বললেন
“তোমার যেটা পছন্দ সেটা রাখ।” উফ্ নিজের জন্য শাড়ি চুজ করা তো আরো ঝামেলা।আম্মা আমার জন্য দুইটা শাড়ি নিলেন।বললেন
“এ দুটোর মধ্যে তোমার যেটা পছন্দ সেটাই পরবে আজ।”
ছোট মামানি রসিকতা করেই বললেন
“আপা আমাদের দিল একটা করে আর নিজের বউমাকে ঠিকই দুইটা দিল।এটা কিন্তু ঠিক না।”
আম্মা কিছুটা রাগ করলেন।এই কথা তার পছন্দ হয়নি।তিনি অসন্তোষ মুখেই বললেন
“আমার বউমা আর তোমরা এক না।আমার বউমাকে আমি একটা দেই আর একশোটা দেই এটা আমার ব্যাপার।তাই এরপর আর কখনো এসব মজা করবেনা।আমি এসব পছন্দ করি না।” দেখে মনে হল আবার সেই আগের রূপে ফিরে এসেছেন আম্মা।এ বাড়ির কেউই এখনো পর্যন্ত আমাকে অসম্মান করে কথা বলেনি।উল্টো আশার অধিক ভালোবাসা,স্নেহ দিয়েছে।তাই তাদের প্রতিও আমার এক প্রকার মায়া জন্মেছে।
আমি পরিস্থিতি সামলে বললাম
“আম্মা উপরে চলুন, লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে গয়না ও বাছাই করতে হবে।” আম্মা বললেন
“হ্যা,চলো,তোমার গয়না ও আমার রুমে আছে।”
নিচে কিছু অসন্তুষ্ট মুখ রেখে আমি আম্মার সাথে পা বাড়ালাম।ছেলে,মেয়ে,মা ওনারা সবাই এক,এতো পসেসিভ আমাকে নিয়ে।যদিও মাঝে কিছুদিন আমার উপর রাগ করে ছিলেন আম্মা।মাঝে মাঝে মনে হয়,এত সুন্দর ভাগ্য আমার!!
সানিয়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল তার বিছানার এক কোণে সাফওয়ান বসে আছে।কতদিন পর সাফওয়ান নিজে থেকে তার বুবুর কাছে এলো।ঠিক কতদিন আগে নিজের আদরের ভাইটির সাথে মন খুলে কথা বলেছে তা ও মনে নেই সানিয়ার।টাওয়েলটা রেখে সানিয়াও সাফওয়ানের পাশাপাশি বসল।
কতক্ষণ দুজনই পাশাপাশি চুপচাপ বসে রইল।নিস্তব্ধতাই যেনো তাদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে নিচ্ছে।তাদের যে হাজারো কথা জমে আছে।এতদিন একই বাসায় থাকলেও কাজ ছাড়া যেন কোন কথাই হয়নি তাদের।নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করে হয়ত ভাইকে কষ্ট দিতে চায়নি।আর হয়তো নিজেকে সামলে রাখতে পারলনা সানিয়া।
নীরবতা ঠেলে সানিয়া একসময় আদরের ভাইটির বুকে আশ্রয় নিলো।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সানিয়া।ভাইটিও পরম মমতায় বোনটাকে আগলে নিল।সুখ-দুঃখ মিলিয়েই সানিয়ার চোখের জলে সাফওয়ানের টি-শার্টটা ভেজা শুরু হলো।সাফওয়ানের চোখ থেকেও কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরল।বড্ড ভালোবাসে তার এই বোনটাকে সে।
দরজার পাশে এ দৃশ্য দেখে সৃজার চোখও ছলছল করে উঠল।
____________
বুবুকে তানভীর ভাইয়ার পছন্দের লেহেঙ্গা পরিয়েই সাজানো হল।তাকে সাজানোর সময় কেউ কোন কথা বলল না।বুবু কিছুটা স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও এখনও সবাই তাকে ভয় পায়।
আছরের পর বিয়েটা পরানো হল।তানভীর ভাইয়া যেন বহুপ্রতীক্ষিত আকাশের চাঁদটি হাতে পেল।তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেল।সেদিন বোধহয় তানভীর ভাইয়ার মতো সুখী মানুষ ওই পরিবারে ছিল না।
বুবু কবুল বলার পরই আম্মা অস্ফুট স্বরে কয়েক ফোটা আনন্দ অশ্রু বিসর্জন দিলেন।তার একমাত্র মেয়েটা যে আবার পর হয়ে গেল।নানু ধমক দিয়ে বললেন
“আহ্ কি শুরু করলি সাফিয়া?আমার এত শক্ত মেয়ে হয়ে তুইও কিনা ন্যাকা কান্না করিস।”
“আপনি বুঝবেন না মা,এটা আমার আনন্দের কান্না।” বলেই নানুকে জরিয়ে ধরলেন,নানুও তার মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।
বড় মামী বিয়েতে উপস্থিত ছিলনা।সবার ধারণা ছেলের বিয়েতে মায়ের থাকা লাগেনা তাই নেই।কিন্তু সত্যিটা আমি জানতাম তিনি এক প্রকার রাগ করেই এখানে ছিলেন না।
রাতে সবার খাওয়া শেষে আমি আর ছোট মামী মিলে বুবুকে তানভীর ভাইয়ার রুমে দিয়ে আসলাম।বুবু প্রথমে সংকোচ করছিলেন।তানভীর ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে দেখলাম উনি টিউলিপকে নিয়ে রুমে ঢুকছে।
“করছেন কি ভাইয়া?টিউলিপকে আমার কাছে দিন।আজ রাতে ও আমার সাথে থাকবে।”
তানভীর ভাইয়া নাকচ করলেন।আমি হার মানলাম না।তাদের বহু প্রতিক্ষীত রাতটা নষ্ট হোক আমি চাইনা।অধৈর্য হয়ে টিউলিপকে জিজ্ঞেস করলাম
“আজ পুতুল মাম্মার কাছে থাকবে টিউলিপ তাই না।মাম্মা টিউলিপকে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বলবে।”
ঘুমো ঘুমো চোখেই কথাটা শুনে টিউলিপ বোধহয় খুশি হলো।একপ্রকার ঝাপিয়েই আমার কাছে এসে পরল।তানভীর ভাইয়াও হতভম্ব হয়ে গেল।আজ সারাদিন সে তার সাথে ছিল।এমনকি এডপশন পেপারে সাইন করার পর এক মুহূর্তের জন্য ছাড়েনি তাকে।রক্তের বন্ধন না থাকলেও মায়ার বাঁধনে বেধে রাখবে তার মেয়েকে তবু আর কাছ ছাড়া করবেনা।
টিউলিপকে নিয়ে রুমে আসতে আসতে ১২ঃ৩০টা বেজে গেল।সে আমার কোলেই ঘুমিয়ে গেছে।রুমের দরজা খুলে বুঝতে পারলাম লাইট নিভিয়ে হয়তো সাফওয়ান ঘুমিয়ে গেছে।অন্ধকারেই হাতড়ে লাইটটা জালিয়ে দিলাম।সাফওয়ান অপর পাশ ফিরে ঘুমালো।আমি টিউলিপকে নিয়ে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিলাম।লাগেজ থেকে একটা সুতি থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়িটা বদলে আসলাম।
ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই সাফওয়ান ধপ করে উঠে পরল।আমি চোখগুলো বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম।কিছুটা অবাক হয়ে বললেন
“টিউলিপ এখানে কেন?”
“আস্তে কথা বলুন,টিউলিপ উঠে যাবে।বলছি এক মিনিট,লাইটটা নিভিয়ে আসি।আপনার ফোনের লাইট অন করুন।”
সাফওয়ান ওভাবেই বসে রইল।
“কি হল লাইট অন করুন।আমি দরজা লাগিয়ে আসছি।”
অগত্যা সৃজার কথা সাফওয়ানকে শুনতে হলো।লাইট নিভিয়ে আসতেই সাফওয়ান টিউলিপকে একটু সরিয়ে তার পাশে জায়গা করে দিল।সৃজা বুঝতে পারল,মনে মনে তার হাসি পাচ্ছে।কিন্তু মুখটা গম্ভীর করে বলল
“আমি ওইপাশে ঘুমাচ্ছি টিউলিপ পরে যেতে পারে।”
এবার সাফওয়ান সৃজার হাত ধরে তার কাছে এনে জোর করে নিজের পাশেই শোয়ালো।পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“আমাদের এতটুকু জায়গাতেই হয়ে যাবে টিউলিপ পরবেনা।”কিছুক্ষণ ছটফট করে সৃজা বলল
“মাঝরাতে কি শুরু করেছেন আপনি?”
“কি শুরু করেছি মানে?সেক্**তো এলার্জি হয় তোমার। একটু জড়িয়ে ধরে শুবো সেই পথও বন্ধ করতে চাও তুমি।” সৃজা আর কিছু বললনা।কথা বলা মানেই প্রশ্রয় পাবে,তার থেকে এভাবেই ঘুমিয়ে পরি।
সৃজার চোখে ঘুম হানা দিলেও সাফওয়ানের চোখে ঘুম নেই।তার বউটা তাকে বোঝেনা কেন?এখনও রাগ করে থাকলে হবে!এই যে সাফওয়ান আজ সৃজার সাথে মিলিয়ে কালো কালার পাঞ্জাবী পরেছে সেটা কি একবারো খেয়াল করেছে।কালো শাড়িটায় তার বউকে পরির মতো লাগছিল,পুরো অনুষ্ঠান জুরে চোখই সরাতে পারেনি সাফওয়ান,সে কি খেয়াল করেছে।না কিছুই খেয়াল করেনি।খেয়াল করলে এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারতনা।সেও তো মানুষ।দোষ গুণ মিলিয়েই তো মানুষ তৈরি নাকি?সে না হয় ভুল করেছে তাতো অনেক আগের কথা।আর তো সে ভুল করবেনা।তাহলে তার পাশে শোয়া,তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ রমনি এটা বোঝে না কেন?
কিছুক্ষণ পর সাফওয়ান ফ্ল্যাশলাইট জালিয়ে সৃজার মুখের দিকে তাকাল।ঘুমিয়ে গেছে চোখ বন্ধ।এখনতো বন্ধ চোখে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছেকে না দমিয়ে সৃজার চোখে চুমু খেল।তারপর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতেই সৃজা মুখ খুললো।
“ঘুমিয়ে পরুন অনেক রাত হয়েছে।” সাফওয়ান চকিত ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অফ করে আবার আগের মতো শুয়ে পরল।
সৃজা এ পাশ ফিরে সাফওয়ানের চুলে হাত রাখল।আস্তে আস্তে তা টেনে দিল।
“হুম,ঘুমান এবার।উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না,এখানে একটা বাচ্চা আছে মনে রাখবেন।”
সাফওয়ান চোখ বুজেই পরম আবেশে অস্ফুটস্বরে বলল
“হুম।”মাথাটা আরেকটু নিচে নামিয়ে সুৃজার বুকে রাখল,পরক্ষনে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সৃজাকে।
চলবে…..
#সৃজা
পর্বঃ২৭
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
ভোরের আলো চোখে পরতে চোখ খুলল সৃজা।সামনে তাকাতেই দেখতে পেল টিউলিপ চোখ গোলগোল করে তার মামা আর মামীর দিকে তাকিয়ে আছে।সৃজা কিয়ৎক্ষণ বোঝার চেষ্টা করল টিউলিপের মনোভাব।পরক্ষণেই হরবরিয়ে উঠে সাফওয়ানের শক্ত বাধন ছাড়িয়ে নিল।সাফওয়ান ও ততক্ষণে উঠে পরেছে।মুদিত নয়নেই বুঝতে পারল কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সাফওয়ান।যা দেখে সৃজা যারপরনাই বিরক্ত হল।সব এই লোকটার জন্য হয়েছে।কি দরকার ছিল জড়িয়ে ধরে শোয়ার।একটা রাত নিজেকে সামলাতে পারলনা।সৃজা ঘুম জড়ানো গলা পরিষ্কার করে টিউলিপকে বলল
“টিউলিপ কখন উঠেছে।মাম্মাকে ডাকেনি কেন?”
টিউলিপ সহসা উত্তর দিল
“তোমাকে যখন মামা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল তখন।” সৃজা লজ্জায় পরে গেল।কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল
“সেটা তো ভুল করে ধরেছে।বুঝতে পারেনি না তোমার মামা।টিউলিপ সোনা তো জানে একজন ভুল করলে সেটা অন্যজনকে বলতে হয় না তাই না?তাই টিউলিপ এটা কাউকে বলবেনা।হুম?”
“আমি জানিতো,ঠিক আছে কাউকে বলবোনা।”
“ইয়ে, টিউলিপ গুড গার্ল।এখন চল ফ্রেশ হবে।”
“আমি মাম্মার কাছে যাবো।”
“ঠিক আছে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে যাবো সোনা।”
সাফওয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই টিউলিপ সাবধান করে দিল এভাবে ভুল করে পুতুল মাম্মাকে কষ্ট না দিতে।সৃজাতো মনে মনে হেসে কুটিকুটি।সাফওয়ান অবুঝের মতো হ্যা বোঝালো।
সৃজার পড়ার চাপটা রয়েই গেছে।তাছাড়া অনেকদিন হল গ্রামে আছে।ঢাকা যাওয়া দরকার নাহলে পিছিয়ে পরবে।সাফওয়ানেরও অফিসে কাজের চাপ প্রচুর।কর্মচারীর উপর ভার দিয়ে বেশিদিন থাকা যায়না।গোলমাল কিছুনা কিছু হবেই।তার উপর সানিয়ার কাজও এখন থেকে সাফওয়ানকে সামলাতে হবে।তাই আজ বিকেলেই ঢাকা চলে যাবে তারা।তবে রেখে যাবে টিউলিপ আর তার মাকে।নতুন জীবন শুরু হবে তাদের।তারাও বেশিদিন এখানে থাকবেনা চট্টগ্রাম চলে যাবে।
সাফওয়ান আর ইমরান চৌধুরী গাড়িতে বসে আছে প্রায় আধ-ঘন্টা।তারা দুজনেই এখন বিরক্ত।বউ শাশুড়ী দুজনেই বিদায় নিতে দেরি করছে।সাফওয়ান অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসল।বাসায় পা রাখতেই দেখল সৃজাকে জড়িয়ে ধরে নোভা আর নাতাশা কান্না করছে।অপরদিকে সাফিয়া চৌধুরী টিউলিপকে কোলে নিয়ে বসে আছে নানুর পাশে।সে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলল
“মম এটা কি শুরু করলে, যেতে হবে তো।প্লিজ তাড়াতাড়ি করো।” সৃজার কাছে গিয়ে নোভা আর নাতাশাকে ধমক দিতে চেয়েও দিলনা।বিদায় বেলায় ধমক না দেয়াই শ্রেয়।সে সন্তর্পণে তাদের হাতগুলো সৃজার শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিল।সৃজার মন খারাপ হলেও সে ও যেন এটাই চাইছিল।সবার সাথেই মোটামোটি ভালো সম্পর্ক হয়েছিল এ-কদিনে।সবাইকে ছেড়ে যেতে তারও ভালো লাগছেনা।বিদায় বেলায় বড় মামী আসলেন না।তার রাগটা প্রগাঢ়।জানিনা সব ঠিক হবে কিনা।তবু আশা করতে তো দোষ নেই।
সানিয়া এসে একবার জড়িয়ে ধরল সৃজাকে।শেষবারের মতো আদর করে দিল আদরের ভাইয়ের বউটিকে।
সানিয়ার মধ্যেও এখন একটা বউ বউ ভাব এসে গেছে।টিউলিপের যত্ন এখন সে আর তানভীর মিলে করে।তানভীরের কড়া নির্দেশ তার মেয়েকে সার্ভেন্টের কাছে দেয়া যাবেনা।সানিয়াকে জড়িয়ে ধরে সৃজা কেঁদেই দিল
“এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেনো।চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে আমরা অবশ্যই ঢাকায় যাবো।আর সাফওয়ান যদি তোমার সাথে ঝগড়া করে শুধু আমাকে একবার বলবে।”
সাফওয়ান মনে মনে বলল কাছে ঘেষতে দিলে তো ঝগড়া করবো।কিন্তু বাইরে বলল
“আমি কদিন পর তোদের নিতে আসবো বুবু।টিউলিপের খেয়াল রেখো।সৃজা এবার চল।” একহাতে সৃজাকে ধরে মায়ের সামনে এগিয়ে গেল।হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল
“চলো মম।” সাফিয়া চৌধুরী টিউলিপকে শেষবারের মতো আদর করে তানভীরের কোলে দিল।তার কলিজার টুকরা আজ থেকে আর নানু বলে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করবেনা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।তবুও নিজেকে শক্ত করে বলল
“নানু আবার আসবো,আমার নানুটা দুষ্টমি করবেনা ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে, কেমন?”
টিউলিপ মাথা নাড়ালো। ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে তানভীরকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিল।সৃজা আর সেখানে দাড়াতে পারলনা।টিউলিপের কপালে একটা গাঢ় চুম্বন একে দ্রূত পায়ে গাড়িতে গিয়ে বসল।তার চোখ ছলছল।যেকোনো মুহূর্তে অশ্রর কণা গড়িয়ে পরবে।শাড়ির আচল দিয়ে সন্তর্পণে তা মুছে নিল।শ্বশুরবাড়িতে আসার পর এই বাচ্চাটার সাথে তার আত্মার বন্ধন গড়ে উঠেছে।সৃজা এখনও মাতৃত্বের স্বাদ না পেলেও টিউলিপকে দিয়ে বুঝেছে মাতৃত্ব কাকে বলে।
সাফওয়ান এসে সৃজার পাশে বসল।সৃজা আর সাফওয়ান এক গাড়িতে অন্য গাড়িতে সৃজার শাশুড়ী আর শ্বশুর।সাফওয়ান একটু কাছ ঘেঁষে সৃজার হাতটা শক্ত করে ধরল।সৃজা চাইলেও তা ছাড়াতে পারবেনা।আজ সৃজার সে ইচ্ছেও নেই।উল্টো সাফওয়ানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পুরো জার্নি কমপ্লিট করল সৃজা।সাফওয়ান কথা বলতে চাইলেও পারলনা।তাই কাজেই মনোযোগ দিল।মাঝে মাঝে সৃজার দিকে তাকিয়ে কপালে কয়েকবার চুমুও খেল।তবে সৃজা তা টের পেল না।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই সৃজা স্টাডি রুমে চলে গেল।অগত্যা সাফওয়ানও অফিসের কাজে মনোযোগ দিল।প্রচুর কাজ জমে আছে।তার এখন মনে হচ্ছে কাজের চাপই তার প্রধান শত্রু।কোথায় রাতের বেলা বউকে কাছে টেনে আদর করবে তা না নিজে বসে আছে গাদা গাদা ফাইল নিয়ে আর সৃজা স্টাডি রুমে।
সৃজা কিছুতেই পড়ায় মন দিতে পারছেনা।এখন তার মন বিক্ষিপ্ত। নানা ধরনের চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।তার মন বলছে সাফওয়ান যা করছে সৃজাকে ভালোবেসেই করছে আর সচেতন মস্তিষ্ক বলছে এসব তাকে কাছে রাখার জন্য করছে।তাছাড়া টিউলিপের জন্যও খারাপ লাগছে।বইগুলো নেড়েচেড়ে আগের জায়গায় রেখে দিল।তারপর ধীর পায়ে সাফওয়ানের রুমের দিকে পা বাড়াল।দরজার সামনে দাড়িয়ে রইল কতক্ষণ।সাফওয়ানের মনোযোগ তার কোলে রাখা ফাইলটায়।আরেক হাতে জলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা দেখে নাক কুচকে ফেলল সৃজা।সরাসরি না বললেও নিজের কাজ দ্বারা কতবার বুঝিয়েছে সে সিগারেট পছন্দ করেনা।তারপরও সিগারেট ধরবেই ধরবে।
সৃজার সন্দিহান দৃষ্টির মাঝেই সাফওয়ান ফাইলে হাত রেখে বলল
“রুমে আসুন মিসেস।আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”
সৃজা চোখগুলো ছোট করে ফেলল।বলল
“আমি কি আপনার ঘুম আটকে রেখেছি নাকি?ঘুমান আপনি আমি যাই।”বলেই পেছন ঘুরল।সাফওয়ান তড়িৎ গতিতে এসে সৃজার হাত ধরল।ফিসফিস করে বলল
” গতকালকের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিবেন।তারপর যেখানে ইচ্ছ সেখানে যেয়ো।নাও আই অনলি নিড ইউ।”
সৃজার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।সেতো এটাই চাইছিল সাফওয়ান তাকে আটকাক।তবে এখন শুনতে ইচ্ছে করছেনা কেন সাফওয়ানের কথা।
সৃজার মৌনতা লক্ষ করে সাফওয়ান কোলে তুলে নিল তাকে।তারপর দরজাটা লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল।সৃজার দিকে তাকাতেই বুঝল ওর মন খারাপ।দুহাতের আজলায় সৃজার মুখটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“টিউলিপকে মিস করছো?”
“হুম,আচ্ছা ওকি আমাদের ভুলে যাবে?”
“উহু আমাকে ভুলে গেলেও ওর পুতুল মাম্মাকে ভুলবেনা।”
……………..
“আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় বলোতো?”
সৃজা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাফওয়ানের দিকে।সাফওয়ান কিছুটা থেমে বলল
“আমরাও টিউলিপের মতো কাউকে আনার প্ল্যান করি চল।” সৃজা কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝল সে কি বলতে চায়।
“বেশি কথা বলছেন কেন?এই আপনার না ঘুম পেয়েছে ঘুমান।নাহলে আমি চলে যাই।” সাফওয়ান বুঝতে পারল সৃজা কথা ঘুরাচ্ছে।
ঘুমানোর জন্য সৃজার বুকে মাথা রাখতেই বলল
“আপনি সেভ করেন না কেন?দাড়ির খোচা লাগে।ব্যথা পাই তো।”
সাফওয়ান চকিত সৃজার দিকে তাকাল।সৃজা চিন্তিত মুখে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।সৃজাকে বলল
“তুমি বসো,আমি পাঁচ মিনিটেই এসে পরবো।”
সৃজা বসেই রইল।সাফওয়ান প্রায় আধা ঘন্টা পর বেরোলো।এসে দেখল তাকে ঘুম পাড়ানোর মানুষ নিজেই বসে বসে ঘুমিয়ে পরেছে।কাছে এসে বালিসটা ঠিক করে সৃজাকে শুইয়ে দিল।সৃজার ওড়নাটা পাশে খুলে রাখল।
সকালে আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই সৃজা খেয়াল করল সে সাফওয়ানের রুমে আছে।আর সাফওয়ানের দুই পা এবং হাত সবই সৃজাকে আকড়ে ধরে আছে।
চলবে…..