সৃজা পর্বঃ২৪,২৫

সৃজা
পর্বঃ২৪,২৫
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ২৪

বাড়ির নিচতলায় হলরুমের মতো জায়গাটায় সবাই বসে আছে।বিশেষ করে নানু ও বসে আছে।তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ।সোফায় জায়গা না হওয়ায় কিছু লোক এক্সট্রা চেয়ার নিয়েও বসেছে।তবে বাচ্চারা নেই এখানে।আশ্চর্যের ব্যাপার সাফওয়ান ও নেই।তানভীর ভাইয়া একপাশে দাড়িয়ে আছে।বড় মামা আমাকে দেখে বললেন

“ওই তো এসেছে বউমা।হ্যা এখন বলো কি বলতে চাও।” ষাটোর্ধ লোকটির চোখ চিকচিক করছে।হয়তো তানভীর ভাইয়ার থেকে আশানুরূপ কিছু শুনতে চাচ্ছে।নীরবতা ভেঙে তানভীর ভাইয়া বললেন

“সব ভেবে দেখলাম আমার বিয়ে করা উচিৎ।…

সবার মুখেই হাসি ফুটলো।বড় মামী কথা কেড়ে নিয়ে বললো

“জানতাম,আমার ছেলে আমার কথা ফেলতেই পারে না।আমি মেয়ে দেখেছি বাবা।তোর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করবি।”

তুলিকে হাক দিয়ে বললেন

“এই তুলি যা আমার ড্রয়ার থেকে ছবিগুলো নিয়ে আয়।”

তানভীর ভাইয়া থমথমে মুখে বললেন

“আমার মেয়ে পছন্দ করা আছে।আর ওকে ছাড়া আমি কাউকে জীবনসঙ্গী করতে পারবোনা।”বড় মামী অবাক হলেন।তার ছেলের মুখে তো কখনো কোনো মেয়ের কথা শুনেননি।তাহলে কার কথা বলছে সে।তারপরও খুশি হলেন,ছেলে বিয়ে করবে এটাই অনেক।

বড় মামা খুশি হয়েছে কিনা বোঝা গেলো না।তবে তিনি জানেন ছেলের জেদ সম্পর্কে যাকে বলবে তার সাথেই বিয়ে হবে।মুখটা গম্ভীর করে বললেন

” মেয়ের নাম বলো আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।তোমার বিয়ের জন্য তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে আটকে আছে।যত তারাতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাই।”

তানভীর ভাইয়া অকপটে বললেন “ইটস সানিয়া।”

হলরুমে ছোট খাটো একটা ভূমিকম্প হলো।সবাই চমকে তার দিকে তাকালো।শুধু নিশ্চুপ ছিলাম আমি আর আমার শ্বশুরমশায়।ইমরান চৌধুরীকে দেখে মনে হলো তিনি জানতেন এমনটাই হবে।

আম্মা চমকালেও তিনি যে খুশি হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে।তার চোখ চকচক করছে।এতোদিন মেয়েটা মায়ের কাছে থাকলেও তার মা তাকে প্রতিটা মুহূর্তে শুধু কঠোর হতে দেখেছে।টিউলিপের বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটার মুখ দেখলেই সাফিয়া বেগমের বুকটা ধ্বক করে উঠতো।বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হতো তার।তানভীরের কথায় তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন এমন ভদ্র,নম্র ছেলেই তো চেয়েছিলেন তিনি।যে সানিয়ার জীবনটা গুছিয়ে দিবে।সাফিয়া বেগম স্বামীকে মৃদু স্বরে বললেন

“একি আমি ঠিক শুনলাম।” ইমরান চৌধুরী স্বাভাবিক মুখেই বললেন

“হ্যা ঠিক শুনেছো।তানভীর আমাকে আগেই এ ব্যাপারে জানিয়েছে।তবে আমার মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না।”

সাফিয়া বেগম যেন উত্তরটা শুনে নিভে গেলেন।মনের মধ্যে যে ক্ষীণ আশার দ্বীপ জলেছিল সেটা নিভু নিভু প্রায়।যদি সানিয়া রাজী না হয়?এরকম হীরের টুকরো ছেলে তো আর পাবেনা।

বড় মামী সহসা কিছু বলতে পারলেন না তবে মিনমিন করে আওড়ালো
“ও তো বিবাহিত বাবা,তার উপর ওর মেয়েও আছে।”

“আমি সব জানি মা।বিয়ের পর টিউলিপ আমার পরিচয় পাবে।”
বড় মামীর মুখটা দেখার মতো।তবে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ। ছেলের জেদের কারণে চুপ করে রয়েছে।বড় মামা বললেন

“তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?এ ব্যাপারে সানিয়ার মত নেয়াও জরুরী।”বড় মামী মামাকে দিকে তাকিয়ে রেগেই বললেন
” একটা বিবাহিত মেয়েকে আমার ছেলের বউ করবে তুমি।”মামা থামিয়ে দিলেন তাকে।বললেন

“তুমি চুপ করো।বিবাহিত বলে কি মেয়েটা মানুষ না?বড় মামী বিরবির করে বললেন বোনের মেয়ের প্রতি বেশিই দরদ।তবে কথাগুলো কেউ শুনতে পেলো না।সকলকে থামিয়ে বড় মামা নানুর দিকে তাকালেন
” আম্মা আপনি বলেন কি করব?আপনার কথাই এখনো এ বাড়ির শেষ কথা।”

নানু কিছুটা ঠিক হয়ে বসলেন।তারপর গলাটা পরিষ্কার করে বললেন
“আমার বড় নাতীকে আমি চিনি সে যা বলে তাই করবে।তবে যা সে সম্মান ক্ষুইয়ে করবে আমি চাই সেটা সম্মানের সাথেই করা হোক।তবে তার আগে আমার নাতনীরও মতামত নেয়া দরকার।কোথায় সে?”

তানভীর ভাইয়া আমাকে ইশারা করলেন বুবুকে নিয়ে আসতে।উত্তেজনায় আমার পা চলছেই না।তাড়াতাড়ি করে বুবুর রুমে গেলাম।হঠাৎ করে রুমে ঢোকায় বুবু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।আজ একটা থ্রি-পিস পরেছে সানিয়া।দেখে মনেই হচ্ছে না সে এক বাচ্চার মা।সৃজা খুশিখুশি মুখে বললো
“নিচে চলো বুবু।তোমাকে ডাকছে।আর একটা অনুরোধ প্লিজ রাজী হয়ে যেও।”সানিয়া বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।
সিঁড়ির মাথায় এসে দাড়াতেই সকলের দৃষ্টি সানিয়ার উপর পরলো।নানু বললেন
” দিদিভাই আমার পাশে এসে বসো।”সানিয়া তার পাশে গিয়ে বসলো।

“আমি যা বলবো ঠিক করে শুনবে তারপর নিজের মত দিবে।তানভীর দাদুভাই তোমাকে বিয়ে করতে চায়।ছেলে হিসেবে সে লাখে একটা।কিন্তু সে শুধু তোমাকেই বিয়ে করবে বলছে।গত চার বছর কম মেয়ে দেখা হয়নি তার জন্য।সে শুধু এড়িয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন তিনি।তারপর আবারো বললেন

“বিয়ের আগে তোমাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম।তানবীর দাদুভাই আমার কাছে আগেই তোমাকে চেয়েছিল।কিন্তু তুমি হুট করে ওর ওপর রাগ করে বিয়েটা করে ফেললে।তাই কিছু করারও ছিল না আমাদের।”

এই কথাগুলো শুনে যেনো মানুষগুলো আরো একবার অবাক হলো।তাইতো সানিয়াকে চায় তানভীর।এবার সবটা পানির মতো পরিষ্কার ঝকঝকে মনে হলো সবার কাছে।

“এবার বলো তোমার কি মত?তুমি চাইলে সময়ও নিতে পারো।”

তানভীর ভাইয়া নানুকে থামিয়ে দিয়ে বললো
“ও কি বলবে।আমি যা বলবো ও তাই করবে।কি রে বল তুই রাজী।শুধু মাথা নাড়ালেই হবে।তাহলেই সবাই বুঝে যাবে।”

তানভীরের সাথে যে সানিয়ার সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তা তার চোখের আকুলতাই প্রকাশ করছে।সে সানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।আর মনে প্রাণে চাইছে রাজী বলে দে।
সানিয়ার মন তখন দোটানায় ভুগছে।এই মানুষটাকে তো সে সত্যিই ভালোবাসে।অভিমান করেই তো কতকিছু হয়ে গেলো।এখন নাহয় তার কথাই সই।তানভীরের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে সানিয়া বললো
“আমি রাজী।আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।তবে কোনো আয়োজন হবে না।”তানভীরের মুখে হাসি ফুটলো।তানভীর ভাই সবার দিকে তাকিয়ে বললেন

” আমি চাই আগামিকালই বিয়েটা হোক।সানিয়ার কথামতো কোনো আয়োজন হবেনা।ও আমার জীবনসঙ্গী হবে এতেই আমি খুশি।”
মেয়ের মুখে ইতিবাচক উত্তর শুনে যেনো সানিয়ার মা এবং বাবা চাঁদ হাতে পেলো।ইমরান চৌধুরী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তানভীর ভাইকে।চোখের কোনটা নিঃশব্দে মুছে উপরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।সাফিয়া চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে গেলেন তার হাতে সময় কম।মেয়ের গয়নাগুলো অন্তত কাউকে দিয়ে আনতে হবে।তিনিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে মেয়ের মাথায় একটা চুমু খেয়ে উপরে চলে গেলেন।

এই আনন্দের মুহূর্তে সৃজা মিষ্টি নিয়ে এলো।বড় মামীর মুখটা শুধু মলিন।আর সবার মুখেই হাসি।সৃজা সেটা খেয়াল করলেও তার মাঝে ক্ষীন আশা আছে সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তীর বিষয় টিউলিপ বাবা ডাকতে পারবে কাউকে।সবাইকে থামিয়ে তানভীর ভাইয়া বললো

“আমি টিউলিপকে এডপ্ট নিবো।এবং কালই সব লিগ্যালি সাইন করবো।আশা করি কারো আপত্তি নেই।আর আপত্তি থাকলেও আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল।”
সানিয়া হয়তো এটা জানত।সে এ ব্যাপারে কিছুই বললো না।সানিয়া জানে সে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পাচ্ছে।তার সব সিদ্ধান্তই চিরকাল বেদবাক্য সানিয়ার জন্য।এই মুহূর্তে সানিয়া খুব করে ভাইটাকে মিস করছে।কোথায় সে?

সৃজার দিকে এগিয়ে গেলো সানিয়া।সৃজা খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরলো।আত্মহারা হয়ে সে বলেই ফেললো
“আমি খুব খুশি বুবু।” সানিয়াও মুচকি হাসি ফেরত দিলো।হয়তো এতোদিনের মেকি খোলস থেকে সে বেরিয়ে আসার রাস্তা পেয়েছে।

“সাফী কোথায়?ওকে দেখছি না কেনো?” সৃজা থতমত হয়ে গেলো।সেটাই তো এই খুশির দিনে তিনি কোথায়।সকালে যে বের হলো আর তো আসেনি।সৃজা আশ্বাস দিয়ে বললো
“তুমি ভেবো না বুবু।তোমার ভাই হয়তো ব্যস্ত আছে।আমার বিশ্বাস উনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।”

সাফওয়ান এলো একেবারে রাতে।বাড়িতে আজ অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করছে।কেমন আনন্দের আমেজ। দেরি না করে নিজের রুমে গেলো সাফওয়ান।সৃজা রুমে নেই।সেদিকে না তাকিয়ে আগে ফ্রেশ হতে গেলো।ফিরে এসেও সৃজাকে দেখল না।রুম থেকে বেরিয়ে এলো।এ রুম ও রুম করে খোজ লাগাল।নোভাদের রুমের সামনে এসেই থমকে গেল।

সৃজা তখন নোভাদের রুমে।দুবোন তাকে ধরেছে কাল কি পরবে তা ঠিক করে দিতে।গত দু ঘন্টা যাবত এটাই হচ্ছে।কাবার্ডের সব জামা কাপর বিছানায় নামানো তারপরও ঠিক করতে পারছেনা কোনটা পরবে।সৃজা অধৈর্য হয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে।এর মধ্যে দরজার দিকে চোখ গেলো।একি সাফওয়ান দাড়িয়ে আছে।কখন এলো উনি।সৃজা উঠে দাড়ালো
“আমি আসছি।তোমরা রাত ভরে ঠিক করো কোনটা পরবে।”
নোভা জাপটে ধরলো সৃজার হাত

“না বউমনি যেয়ো না।আগে জামা চয়েজ করে দাও।নাহলে কাল দেখবে একটা ফকিন্নি মার্কা জামা পরে আছি।”

সৃজা দরজার দিকে ইশারা করল।সেদিকে তাকিয়ে এমনি হাত ছেড়ে দিল নোভা।নাতাশা বললো

“তুমি যাও বউমনি। কালকেও ঠিক করে দিতে পারবে।”

হায় আল্লাহ এই মেয়ে বলে কি।সৃজা বেরিয়ে আসার আগেই সাফওয়ান ওদের ইশারা করে বললো

“নিজেদের জিনিস নিজেরা চয়েজ করবে এরপর থেকে।” সৃজার দিকে তাকিয়ে বললো

“তুমি রুমে চলো।”

নোভা আর নাতাশার মুখটা চুপসে গেলো।তার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

সৃজাও অনুগত স্ত্রীর মতো সাফওয়ানের পিছু পিছু এলো।

চলবে…..

#সৃজা
পর্বঃ২৫
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

দরজাটা শব্দ করে লাগিয়ে দিল সাফওয়ান।সৃজা চমকে তাকালো।আজ সে একটু ভয় পাচ্ছে কিন্তু কেনো?নিজের মনে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পেল না।ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সে।কতক্ষণ এমনিতেই সময় পার করল সেখানে।এই লোকটার প্রতি আবারো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে সে।দূর্বল হলে তো চলবেনা তার।নিজেকে শক্ত করতে হবে।কদিন পর তো সে বিদেশ যাবেই।উপায় না পেয়ে একসময় বেরিয়ে আসল সৃজা।

সাফওয়ান এতক্ষণ সৃজার অপেক্ষাই যেনো করছিল।
দ্রুত নিজেকে সামলে সাফওয়ানের সামনে অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে দাড়ালো সৃজা।সাফওয়ানের অক্ষিগোচর হতে সৃজার দুহাত পেছনে হেলে চেপে ধরল।সৃজা অস্ফুট স্বরে বললো

“কোথায় ছিলেন সারাদিন?হাত ছাড়ুন” সাফওয়ান হাতদুটো না ছেড়ে আরো চেপে ধরলো।

“কেনো সন্দেহ হচ্ছে।”

সৃজা তাচ্ছিল্য করে বলল”হ্যাহ্ সেটাই কি সম্ভব নয়।”

“না সম্ভব নয়।একদম সন্দেহ করবেনা আমায়।আমার ভালোবাসায় কোনো ক্ষাদ নেই।” সৃজাকে নিয়ে ওভাবেই বিছানায় গিয়ে বসল।পেছন থেকে জড়িয়ে বসলো।সৃজার ডানসাইডের কাধেঁ সাফওয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে।

“হুম তো বলুন কোথায় ছিলেন আজ।”

“ঢাকায় গিয়েছিলাম।অফিসে খুব জরুরি একটা কাজ ছিল।বুবুর আজ যাওয়ার কথা ছিল,কিন্তু যায়নি।তাই আমাকেই যেতে হলো।” একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।বদ্ধ ঘরে সেটা স্পষ্ট শোনা গেল।

সৃজা চুপ করে সে নিঃসৃত নিঃশ্বাস অনুভব করল তার ঘাড়ে।নিস্তব্ধতা গলিয়ে সৃজা সাফওয়ানের দুহাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল

“আপনাকে কিছু বলার ছিল।আগে পুরোটা শুনবেন তারপর প্রতিক্রিয়া করবেন।” সাফওয়ান কাঁধ থেকে মাথা তুলে সন্দিহান দৃষ্টিতে সৃজার দিকে তাকালো।

“প্লিজ সৃ আমাকে রাগানোর মতো কোনো কথা বলবেনা।অন্য যেকোনো কথা বলতে পারো তুমি।”সৃজা আশ্বাসের স্বরে বলল

“কথাটা শুনুন আগে তারপর বলবেন।এটা আপনার জানা উচিত।আজ বাড়িতে ছিলেন না বলে জানতে পারেননি।”

“ঠিক আছে বলো।”

“আজ তানভীর ভাইয়া বুবুকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে।”কথাটা বলে সাফওয়ানের দিকে তাকাল।সে চোখগুলো বড় করে সৃজার দিকে তাকিয়ে আছে।

” বুবুও রাজী হয়ে গেছে।বুবুর ইচ্ছানুসারে আগামিকাল ঘরোয়াভাবে ওনাদের বিয়েটা হবে।আপনি ছিলেন না তাই জানতে পারেন নি।বাড়ির বড়রা মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।যদিও আপনার কথা বুবু জিজ্ঞেস করেছে।আমি বলেছি আপনি শুনে খুশি হবেন।”

“তুমি না জেনেই বলে দিলে আমি খুশি হবো?”

“কেনো আপনি খুশি হননি?সৃজার চোখদুটো ছোট হয়ে গেলো।এক দৃষ্টিতে সাফওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।সাফওয়ান কিছুক্ষণ মৌন রইল।হয়তো ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না।সৃজাকে আবার জিজ্ঞেস করল

” সত্যি বুবু রাজী হয়েছে?সে জন্যই আমি আসার সময় দেখলাম নিচে কিসের আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।”

সৃজা হ্যা সূচক মাথা নাড়াল।তৎক্ষনাৎ সাফওয়ান জড়িয়ে ধরল সৃজাকে।
“আমি কিভাবে এই অনুভূতি প্রকাশ করবো সৃ বুঝতে পারছিনা।তবে আমি খুব খুশি।মন থেকে খুশি।”

কিছুক্ষণ থেমে উদাস মনে বলল

“আমিও তো চেয়েছিলাম বুবু নতুন জীবন শুরু করুক।তবে সেটা যে তানভীর ভাইয়ার সাথে সেটা ভাবিনি।তানভীর ভাই পারফেক্ট হাজবেন্ড হবে দেখো।”

” পারফেক্ট বাবাও হবে,তানভীর ভাইয়া টিউলিপকে এডপ্ট করবে বলেছে।”সাফওয়ান তড়িৎ গতিতে সৃজার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো এটা সত্যি।সৃজা হ্যা বললো।

সে আরবার সৃজাকে জড়িয়ে ধরল।সৃজার হাতদুটো ও আলগোছে সাফওয়ানের পিঠে যেয়ে ঠেকল।সাফওয়ান সৃজার সম্মতি পেয়ে আরো হাতের বন্ধন দৃঢ় করল।

” হয়েছে এবার ছাড়ুন।আপনি ভুলে গেছেন আমার শর্ত।”

“রাখ তোমার শর্ত।এসব শর্ত আর মানছিনা আমি।তুমিও আর কোনো শর্ত দিবেনা।”

সৃজা বলতে চাইল কিন্তু বিদেশ তো আমি যাবোই পড়তে তখন কি করবেন।কিন্তু বললো না,এই খুশির মুহূর্তে নাহয় নাই রাগাল মানুষটাকে।সাফওয়ানের স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে।শাড়ি গলিয়ে তার হাত সৃজার উন্মুক্ত কোমর স্পর্শ করল।হয়ত এতোদিন দূরে থেকে নিজেকে আজ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।সৃজা তৎক্ষণাৎ ছটফট শুরু করল।

“তুমি এতো নরম কেনো বলোতো।মনে হয় স্পঞ্জ রসগোল্লার মতো খেয়ে নেই।” সৃজার ছটফটানি বেড়ে গেলো।নিজের মন ও শরীরকে শক্ত করে বলল

“এই ছাড়ুন আমাকে।ছাড়ুন বলছি।এখন কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

“কোনোকিছুই বেশি হচ্ছে না।আমার তোমাকে চাই আজ।” বলেই সৃজার আচলটা সড়াতে চাইল।সৃজা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলো সাফওয়ানের হাতটা।
“আপনি বলেছেন আমার সম্মতি ছাড়া কিছু করবেন না।” সাফওয়ানের চোখের দিকে তাকাল।

সাফওয়ান তাকালো না।সৃজার কথাগুলো তার কাছে অসম্ভব জেদি মনে হচ্ছে।কিন্তু সে আজ তার অর্ধাঙ্গিনীর কথা কানে নিবে না।অনেক হয়েছে শর্ত। নিঃশ্বাসের অস্থিরতা ঠেলেই সাফওয়ান বেপরোয়াভাবে বললো
“কেনো এমন করছো সৃ?প্লিজ হাত সরাও।এই সরাও বলছি প্লিজ।”

“না আপনি ছাড়ুন আমাকে।” সাফওয়ান তবুও ধরে রইল বোঝার চেষ্টা করল সৃজা কি সত্যি না করছে।শেষ চেষ্টা হিসেবে সৃজার গলায় কতগুলো চুমু দিল।পেছনে হাত নিয়ে ব্লাউজের হুক খোলার চেষ্টা করল।সৃজা ছটফট করছে।মুখের কাছে আসতেই সৃজা এক হাতে আচল ধরে আরেক হাতে ঠোঁট চেপে ধরলো।শক্ত হয়ে রয়েছে সে।কোনোভাবেই যেনো নরম করা যাচ্ছে না তাকে।সাফওয়ান ছোটানোর চেষ্টা করল।তার নিঃশ্বাস ক্রমাগত ভারী হচ্ছে।

“উফ্,কি করছো তুমি।হাত সরাও, প্লিজ জান হাত সরাও।”সাফওয়ান হাতটা সরাতে পারল কিন্তু সৃজা ঠোঁট ভিতরে ঢুকিয়ে রেখেছে।সৃজা অটল রইল তার সিদ্ধান্তে।তার নিঃশ্বাসের চঞ্চলতা বাড়ছে কিন্তু কিছুতেই আজ সাফওয়ানের কাছে ধরা দিবেনা।

সাফওয়ান এবার ছেড়ে দিল।নিচে দাড়িয়ে কতক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নিলো।পরপরই পাশে রাখা কাচের জগটা ছুড়ে মারলো।শব্দ করে ভেঙে গেলো সেটা।হনহন করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে।

সৃজা বিছানায় শুয়েই ফুপিয়ে কেঁদে দিল।দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না লুকানোর চেষ্টা করল।ওইভাবেই ঘুমিয়ে পরলো সৃজা।সাফওয়ান নিজেকে শান্ত করে,চোখে মুখে পানি দিয়ে সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো।

বিছানায় সৃজা এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে।সাফওয়ান গিয়ে ব্লাউজের খুলে যাওয়া হুকটা লাগিয়ে দিল।গায়ে চাদর টেনে দিল বুক পর্যন্ত।লাইটটা বন্ধ করে নিজে গিয়ে সোফায় বসল।

টি-টেবিলে দুই পা রেখে সিগারেট ধরাল।সৃজা উল্টোপাশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে।গভীর নিদ্রা তার চোখে।এদিকে তার স্বামী যে নির্ঘুম রাত পাড় করছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।

ঘুমের ঘোরেই সিগারেটের ধোয়ায় সৃজা কেশে উঠল।সাফওয়ান বুঝতে পেরে বাইরে গিয়ে দাড়াল।আজকের জন্য সিগারেটই তার সঙ্গী।কে বলতে পারে হয়তো আগামী পাঁচ বছরও এটাই তাকে নির্ঘুম রাত পাড় করার শক্তি দিবে।সাফওয়ানের বুঝতে বাকি রইল না সৃজা তার সিদ্ধান্তে অটল।যত যাই হোক সে বিদেশে যাবে।এখন নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে তার।

হুট করে সৃজার ঘুম ভেঙে গেল। মাঝরাতে সাফওয়ানকে রুমে না দেখে পুরোনো ভয় তাকে ঝেকে ধরল।সাথে সাথে সে উঠে বসল।মাথাটা ভার হয়ে আছে তবুও নিজেকে সামলে ওয়াশরুম চেক করল,সেখানে নেই।তড়িঘড়ি করে বাইরে বের হলো।

সামনের করিডরেই সাফওয়ান দাড়িয়ে ছিল।সৃজার যেন আশঙ্কা দূর হল।সাফওয়ানের হাতে জলন্ত সিগারেট।কতক্ষণ পরপর তাতে সুখটান দিচ্ছে আর ধোয়াটা বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।সৃজা কতক্ষণ সেখাইনেই দাড়িয়ে রইল।তার মন আজ দোটানায় ভুগছে।

নিঃশব্দে সাফওয়ানের পিছনে গিয়ে দাড়াল।সাফওয়ানের দৃষ্টি ওই পূর্ণ চাঁদটার দিকে।গতকালই হয়তো অমাবস্যা ছিল।অন্ধকার ঠেলে আজ পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছে।তার জীবনটার অন্ধকার কবে দূর হবে।দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেটাই হয়ত ভাবছিল।হঠাৎ করেই সাফওয়ান বলল

“ঘুম ভাঙল কখন।” সৃজা নিজেকে সামলে নিল।এই লোকটা তার উপস্থিতি খুব সহজেই বুঝে ফেলে।তার মানে কি এই লোকটা তাকে সত্যিই ভালোবাসে।

“এই মাত্র।আপনি ঘুমাবেন না?”

“আমাকে নিয়ে না ভাবলেও হবে তোমার।আমি তো দুশ্চরিত্র।এমন স্বামীর পাশে ঘুমালে তো তুমিও কলঙ্কিত হয়ে যাবে।” তার কন্ঠে অভিমানের শ্লেষ।

সৃজা বুঝতে পারল খুব অভিমান হয়েছে তার।গভীর রাতেই তো মানুষের আবেগ প্রগাঢ় হয়।যেমন এখন দিন হলে হয়তো সাফওয়ান কখনোই এই কথাগুলো বলত না। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা তার মনে আজ প্রভাব ফেলছে,তার ভাবনা প্রগাঢ় হচ্ছে।সে ভাবনা থেকেই অতি আবেগীয় কথা প্রকাশ পাচ্ছে এখন।

উপচে পরা কান্নাকে সামলে সাফওয়ানের হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিল সৃজা।চকিত সাফওয়ান সৃজার দিকে তাকাল।চাঁদের আলোয় তাকে আরো বেশি রূপবতী লাগছে।মাঝে মাঝে তার গর্ব হয় সৃজাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে।ভালোবাসে বলেই তো গর্ব হয়।সৃজা যে তার কাছে আছে এটাই অনেক।কিন্তু কাছে থাকলেই তো মাঝে মাঝে আদর করতে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে বুঝাবে কি করে।আজও তো নিজেকে কন্ট্রোল করা দায় হয়ে দাড়িয়েছিল।কিন্তু সৃজা সেটা বুঝলো না,ও যে সৃজাকে ভালোবাসে তার কত প্রমাণই তো দেয় তাহলে মেয়েটা বোঝে না কেন?

এই যে মেয়েটা মাত্রই তার হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়েছে সে তো রাগ করেনি।কেনো রাগ করেনি ভালোবাসে বলেই তো।সাফওয়ানের ভালোবাসা কবে বুঝবে মেয়েটা।সৃজা নীরবতা ঠেলে বলল

“দেখা হয়েছে?এবার ঘুমাবেন চলুন।কাল বাড়িতে অনেক কাজ।” সাফওয়ান তখনও মোহাবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে।সে বোঝার চেষ্টা করছে কে বেশি সুন্দর ওই চাঁদটা নাকি তার একমাত্র বউটা।

সৃজা আলগোছে সাফওয়ানের হাতটা ধরল
“চলুন,আমার মাথা ব্যথা করছে, ঘুমাবো।”মূলত কান্না করার কারণেই হঠাৎ করে মাথা ব্যথা দেখা দিয়েছে।

সাফওয়ান এবার যেনো বুঝতে পারল কথাগুলো। তার বউটার মাথা ব্যথা করছে সে এতক্ষণ বুঝেনি কেন?সাফওয়ান নিজেই সৃজার হাতটা ধরে রুমে ঢুকলো।ঔষধের বক্সটা দেখল,মাথা ব্যথার একটা ট্যাবলেট খুলে সৃজার দিকে এগিয়ে দিল।সৃজা চুপচাপ খেয়ে নিল।যেন সব স্বাভাবিক।

সাফওয়ান গ্লাসটা রেখে লাইটটা নিভিয়ে দিল।ইতস্তত করতে করতে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে সৃজার পাশে গিয়ে শুয়ে পরল।কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করল সে,ঘুম আসছেনা।

সৃজা বুঝতে পারল কিনা জানেনা।তবে একটু পর সৃজা নিজেই সাফওয়ানের বুকে ধরা দিল।সাফওয়ান যেনো মরুভূমির মাঝে বহুকষ্টে এক ফোটা জল পেল।সে ও সৃজাকে সংকোচ ঠেলে নিজ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল।

সকালে নোভার ডাকে ঘুম ভাঙল সাফওয়ানের।সে ডেকেই যাচ্ছে।বাইরে আওয়াজ শুনে সৃজা আরবার আকড়ে ধরল সাফওয়ানকে।তার ঘুম এখনো ভাঙেনি।

ওপাশে নোভা ক্রমাগত বউমনি,বউমনি বলে ডেকে যাচ্ছে।সাফওয়ানের এবার রাগ হলো মনে হচ্ছে দরজাটা ভেঙে ফেলবে।কিছুটা রেগেই বলল

“আমি আসলে কিন্তু ভালো হবে না নোভা।তোর বউমনি আসছে এখন যা।”

ওপাশ থেকে নোভা দ্বিগুণ উৎসাহে বলল
“তাড়াতাড়ি আসতে বলো দাভাই। নিচে সবাই বউমনিকে ডাকছে।”

“ঠিক আছে তুই যা।” চোখ খুলেই সাফওয়ানের কথাগুলো বুঝতে কিছুটা সময় লাগল সৃজার।নিজেকে সামলে বুঝতে পারল নোভা তাকে ডাকতে এসেছিল।ধরফরিয়ে উঠল সে।বাতায়ন দিয়ে আসা ঝলমলে আলোতে বুঝল অনেক বেলা হয়ে গেছে।রাতে মাথা ব্যথা থাকায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।মোবাইলটা চেক করে বুঝতে পারল ৮টা বেজে গেছে।গ্রামে আটটা মানে অনেক বেলা।

তড়িঘড়ি করে চুলগুলো পাশে রাখা ক্লিপটা দিয়ে আটকে নিল।বিছানা থেকে নামতে গিয়েই বুঝতে পারল শাড়ির আচলটা সাফওয়ানের দখলে।সৃজা আচলটা টানার আগেই সাফওয়ান উঠে গেল।ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলল

“মাথা ব্যথা কমেছে?”

সৃজা আলগোছে মাথা নাড়িয়ে বলল
” হুম।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here