সৃজা
পর্বঃ১২,১৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ১২
বিকেল ৫টার দিকে টিউলিপের দাদা-দাদী আসলো।ওনাদের দেখলে মনে হবে নিউ ম্যারিড কাপল।কারণ আসার পর থেকে টিউলিপের দাদা ওর দাদীর হাত একবারের জন্যও ছাড়েনি।কারণটা বোঝা গেলো না।টিউলিপের দাদীর আচরণ দেখে যা বোঝা গেলো উনি খুবই স্ট্রীক্ট মহিলা।নিজের স্বামীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।ইস্ বেচারা।পোশাকেও তার আধুনিকতা রয়েছে।
টিউলিপ তার দাদীর কাছে এসেছে ঠিকই তবে চুপ করে আছে।কিছু বলছে না।তারা ওর কাছে নতুন মানুষ।ওর মনে সংকোচ কাজ করছে।নিজের দাদীও পর হয়ে যায় যদিনা সবসময় যোগাযোগ থাকে।উনারা এতোদিন শুধু ফোনে মাঝে মাঝে টিউলিপকে দেখেছে।কিন্তু আজ সরাসরি দেখে দুজনেই কেঁদে দিবে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ওর দাদী টিউলিপকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করলেন কিছুক্ষণ। যদিও তিনি যথেষ্ট আধুনিক একজন মহিলা। বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে থাকলেও বাংলার সংস্কৃতি অজান্তেই অনুসরণ করে।এটা বোধ হয় সকল বাঙালীর ক্ষেত্রেই এক।
আমিতো নিজের দেশকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাও করি না।হুট করে কবে বোধদয় হলো আমার দেশ আমার মায়ের মতো তাকে ছেড়ে যাবোনা।দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিলো ব্যাপক।যদিও ইচ্ছাটা এখনো আছে।
তাদের একজন মেয়েও আছে সে নাকি রাতে আসবে।এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি কোন বন্ধুর বাসায় গেছে।জানি না সে কেমন হবে।
আমাকে দেখে পাশে বসতে বললেন।আমি সালাম দিলাম।মহিলা খুবই সুন্দরী।মুখের রগটাও ভেসে উঠেছে তার ধবধবে সাদা চামড়ার উপর।আমাকে দেখে বললেন
“বাহ্ বেশ সুন্দরী মেয়ে এনেছেন দেখছি বেয়ান।”বলতে বলতে একটা স্বর্ণের চেইন আমার গলায় পরিয়ে দিলেন।বললেন
“বিয়ের উপহার হিসেবে কিছু দিতে পারিনি তাই এখন দিলাম।তা তোমার নাম কি?”
আমি বললাম” সৃজা।”
” তোমার বাবা কি করে?নিশ্চয় ঢাকার কোনো বড় বিজনেসম্যান।”
“জ্বী না আমার বাবা গ্রামে থাকে উনি চেয়ারম্যান।গ্রামে মাছের আড়ত আছে।আমাদের ফসলি জমিও আছে।”
“ওহ্ আই সি।তা বেয়ান আমার মেয়ে কম ছিলো কোথায়? শুধু একটু শ্যাম বর্ণের।এছাড়া আমাদের তো টাকার অভাব নেই।আপনাদের মতো নেই তবে কম তো নেই।” আমাকে পাশে বসিয়েই আম্মার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন তিনি।আমাকে সরাসরি অপমান করলেন তিনি।কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না।অপমানে শুধু মাথাটা নিচু করে রাখলাম।
আম্মা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“সৃজা তুমি উপরে যাও।পড়া রেখে এখানে বসে থাকার দরকার নেই।চৌধুরী বাড়ির বউ এতোটা সস্তা নয়,যে কেউ অপমান করবে আর তাকেও সহ্য করতে হবে।”
একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে আমি চলে গেলাম।যেতে যেতেই শুনলাম
“বেয়ান আপনারা এসেছেন অতিথি হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পাবেন।তাই বলে আমার বাড়ির বউকে অপমান করার অধিকার আপনার নেই।আর রইলো আপনার মেয়ে চৌধুরী বাড়ির বউ হতে সৌন্দর্য বা টাকার কোনো প্রয়োজন নেই দরকার যোগ্যতা।আর আপনার মেয়ের যোগ্যতা কতটুকু এটা আপনি ভালো জানেন।”
মুখটা কাচুমাচু করে তিনি বললেন
“আমাদের রুমটা দেখিয়ে দেন বেয়ান।ক্লান্ত লাগছে।” এমনভাবে বললেন যেনো ওনাকে কিছু বলাই হয়নি।
টিউলিপের দাদীর একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে ওনার মেয়ে।এ মেয়ের সাথে আবার সাফওয়ানের কিছু ছিলো নাকি।মাথায় প্রেশার নিলাম না। পড়তে হবে।হয়তো অনুষ্ঠানের কিছুদিন পড়াশোনা হবেনা।কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাও খুব কাছাকাছি।
রাতে আম্মার সাথে ডিনারের আয়োজন করার সময় সাফওয়ান এলো ওর সাথে একটা মেয়ে এলো।মেয়েটা খুবই মডার্ণ। অফ স্লিভ টপস আর হোয়াইট জিন্স পরে আছে।আবার সাফওয়ানের হাতও ধরে রেখেছে।আমার চোখটা তাদের হাতের দিকেই আগে গেলো।সাফওয়ান আমার চোখ অনুসরণ করে হাতটা ছোটানোর চেষ্টা করলো।তবে মেয়েটা ছাড়ছেনা।
টিউলিপের দাদীর দিকে গিয়ে বললো
“মাম্মী আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।এখন ঘুমাবো।আমার রুম কোনটা।”
তাহলে এই সে।আমি আর অপেক্ষা করলাম না।বেলাল্লাপনার একটা সীমা আছে।সবার সামনে দিয়েই একবার সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে গটগট করে উপরে উঠে এলাম।
অসহ্য লাগছে সবকিছু। আমার জীবনটাই কেনো এমন।আর ওই লোকটা কেনো বোঝে না আমার এসব অসহ্য লাগে।রাগে ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারলাম।বিকট শব্দ করে আয়নাটা ভেঙে গেলো।
সাফওয়ান নক করছে দরজায়।আজ দরজা খুলবো না থাক বাইরে।
“সৃজা ওপেন দ্য ডোর।লেট মি এক্সপ্লেইন প্লিজ হানি।”
“রাখুন আপনার হানি।আজ আপনার এ রুমে জায়গা নেই।কি বলেছিলেন আমায় অন্য মেয়েকে ছুবেননা।তাহলে ওই মেয়ের হাত ধরা কি ছিলো।?”
“আমি বুঝিয়ে বলছি।তুমি দরজা খুলো।মানুষের সামনে এভাবে সিনক্রিয়েট করো না।আর এটা ওদের ওই দেশের সংস্কৃতি। ওরা ছেলে-মেয়ে হাত ধরাতে কিছু মনে করে না।এটা স্বাভাবিক তাদের কাছে।আর ওর সাথে আমার কিছু নেই।সত্যি বলছি।”
মনটা তবুও বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।দরজা খুললাম না।বিছানায় এসে শুয়ে পরলাম।সাফওয়ান কতক্ষণ নক করলো।পরে আর আওয়াজ পেলাম না।ঘুমিয়ে গেলাম।আমার এখন শান্তি দরকার।কাল কত মানুষকে সামলাতে হবে কে জানে।হয়তো টিউলিপের দাদীর মতো আরো কেউ আসবে অনুষ্ঠানে।তাদের কথাও তো ভাবতে হবে আমাকে।আমিতো এখন কারো মেয়ে নই কারো বউ।
ঘুম গভীর হতেই বুঝতে পারলাম কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার গলায় পরছে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু চোখ দুটো খুলতে ইচ্ছে করছেনা।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম সাফওয়ান আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।আজও আমার শাড়ির আঁচলটা ওর শরীরের নিচে।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।এতে হাতের বন্ধন আরো গভীর হলো।আমি এবার চেঁচিয়ে বললাম
“এই আমাকে ছাড়ুন।যান ওই মেয়ের কাছে যান।আমার কাছে আসবেন না।”
“এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে সৃ।আমি গতকালই তোমাকে বলেছি আমি এলিজাকে ধরিনি উল্টো ও নিজে থেকে আমার হাত ধরেছে।আর তুমি নিজেও দেখেছো এটা আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেছি।”
“তবুও ধরবেন না আমায়।আমার অসহ্য লাগছে আপনার কথা।”
সাফওয়ানের ছোঁয়া আরো গভীর হলো।যত হোক পুরুষ সে এবং যুগ যুগ ধরে পুরুষের চেহারা পাল্টালেও তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য একই থাকে।তেমন সাফওয়ানও অন্য পুরুষের মতো স্ত্রীর উপেক্ষাকে পাত্তা দিলো না। সে তার উল্টোটাই করছে।এবার সৃজার সহনীয় পর্যায় অতিক্রম করছে।সে ব্যথা পাচ্ছে।এটা সাফওয়ানের বোধগম্য হচ্ছে না।সে নিজের কাজে ব্যস্ত।
সৃজা মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করলো কিন্তু সাফওয়ান দিলো না।একসময় সাফওয়ান নিজেই বুঝতে পারলো সে তার বউকে কষ্ট দিচ্ছে।নিজে থেকেই উঠে গেলো সে।সৃজা বিছানায় অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় কাতরাচ্ছে।তার চোখের পানি আর শরীরের কাঁপুনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাফওয়ান।
পরক্ষণেই সৃজাকে জড়িয়ে ধরলো সে।সৃজার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
“এই মেয়ে তুমি কেনো বুঝো না তোমার জন্য সবকিছু ছেড়েছি আমি।তুমি রাগ করো কেনো এতো।আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।”
সৃজা মিনমিন করে বললো
“আপনিও তো আমাকে বোঝেন না।” তার চোখের পানি সাফওয়ানের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।সাফওয়ান তা বুঝতে পারছে।এই একটা জিনিস তার পছন্দ না।কিন্তু তার বউটা অনেক কাঁদে।সে বুঝে পায়না এই মেয়ের চোখে এতো জল থাকে কিভাবে।
“চলো ফ্রেশ হবে।আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান। আজ প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করো না।” সৃজাকে কোলে করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো।সৃজাও চুপ রইলো।
সাফওয়ান আর সৃজা একসাথেই নিচে নামলো।এলিজা দৌড়ে আসলো সাফওয়ানের হাত ধরার আগেই সাফওয়ান খুব জোরে বললো
“এলিজা প্লিজ আমার হাত ধরবেনা।ব্রিটিশ কালচার এখানে ফলো করবেনা।এন্ড মিট মাই ওয়াইফ সৃজা।” সৃজার হাতটা ধরে বললো।
এলিজা কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলো।খুটিয়ে খুটিয়ে কতক্ষণ সৃজাকে দেখলো।একজন নববধুর সকল ছাপই রয়েছে তার চেহারায়।মেয়েটা তার থেকে বেশি সুন্দরী।ভেবেই মুখটা বিকৃত করেই বললো
“আমি জানি।” তারপরই আবার নিজের স্থানে ফিরে গেলো।
সৃজা ওর ব্যবহারে অবাক হলেও সাফওয়ানের কথায় বুকের ভারটা নেমে গেলো তার।
সৃজা আজ একটা নীল শাড়ি পরলো।শাশুড়ীর দেয়া চুড়িগুলোর সাথে মিলিয়ে হিরের একটা লকেট আর কানে ছোট দুল পরলো।সাফওয়ানের ব্যস্ততার মাঝে একবার রুমে আসলো কাপর বদলাতে।সৃজাকে দেখে সে কিছুটা থমকালো।তারপর কাছে এসে পিঠ আর পেটের দিকটা দেখিয়ে বললো
“এখানে দুইটা সেইফটিপিন লাগাও।শাড়ি পরতে শেখোনি তুমি।আগের গুলাতো ঠিক ছিলো।এটার ব্লাউজ এমন কেনো?”
সাফওয়ানের মুখটা দেখে সৃজার হাসি পেলেও আটকে রেখে বোঝালো সেইফটিপিন লাগিয়েই বাইরে যাবে।
টিউলিপকে প্রিন্সেস ড্রেস পরানো হয়েছে।তার মাথার মুকুটটা অনেক দামী।এটা নিয়েই আশেপাশে কানা-ঘুষা হচ্ছে।আমি আর সাফওয়ান একসাথে নিচে নামলাম।আমার শ্বশুরমশায় তার সমবয়সী কিছু মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
“মিট মাই ডটার-ইন-ল সৃজা।চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ৫১℅ মালিকানা যার নামে।”কথাটা শোনা মাত্র আমি চকিত শ্বশুরমশায়ের দিকে তাকালাম।তিনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন।আম্মাও পাশে ছিলেন।তাকে দেখে মনে হলো তিনি আগে থেকেই জানতেন এ ব্যাপারটা।
আমি নিজেকে ধাতস্থ করে তাদের সাথে কথা বললাম।তবে প্রচন্ড জড়তা কাজ করছিলো।ওনারা একসময় সাফওয়ানকে ডেকে বললেন
” ইয়াং মেন একবার মিসেসের সাথে দাড়াও, আমরাও দেখি তোমাদের একসাথে কতটা মানায়।”
সাফওয়ান আমার পাশে এসে দাড়ালো।তাদের কুশল জিজ্ঞেস করলো।কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তিনিও এ ব্যাপারটা জানতেন।তবে আমি জানিনা কেনো।আর এতো সম্পত্তি আমার নামেই কেনো।সব উত্তর পাবো আম্মার কাছে।
কতক্ষণ পর আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষ মাকে দেখতে পেলাম।মা এসেছে। তার গায়ে এতো গয়না দেখে আমি অবাক হলাম।হয়তো আমার ধনী শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই নিজের অনিচ্ছা স্বত্তেও এগুলো পরেছে।বাবাকে দেখেও মনটা কিছুটা নরম হলো।যতই হোক বাবা তো বাবাই।মাকে নিয়ে আমার রুমে গেলাম।মাতো এসব দেখে অবাক।বারবার আমায় বললেন আমার কপালে এ সুখ যেনো স্থায়ী হয় হে আল্লাহ্।মাকে জড়িয়ে ধরে রইলাম কতক্ষণ। সাফওয়ান এসে মায়ের সাথে দেখা করে গেলো।তার ব্যবহারে মা খুবই খুশি।
অনুষ্ঠানের মাঝপথে সাফওয়ান জরুরী কাজে বাইরে গেলো।সৃজাকে বলে গেলো আসতে দেরি হবে।ডিনার করে ঘুমিয়ে পরতে।
চলবে……
#সৃজা
পর্বঃ১৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
ক্ষনেক বাদে নিচ থেকে ডাক এলো টিউলিপ কেক কাটবে,তাকে খুজছে।অগত্যা নিজের মাকে রেখে ছোট মায়ের কাছে যেতে পা বাড়ালো সৃজা।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় কতগুলো উৎসুক চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো।সাধারণের মাঝেও অসাধারণ সে।সৃজার চলনে প্রকাশ পাচ্ছে সে এ বাড়ির রাণী,আর রাণীর অপেক্ষায় সবাই দাড়িয়ে রয়েছে।নিজ মনে নামছিলো সৃজা।যখন সামনে তাকালো তখন এতোগুলো মানুষের দৃষ্টি দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।অনুষ্ঠানে আসা বেশিরভাগ মহিলাদের শরীরেই শোভা পাচ্ছে ভারী ভারী গহনা।অথচ সবচেয়ে ধনী পরিবারের বউ সৃজার গায়ে হালকা গহনা তারা অনেকেই হজম করতে পারলো না।
তবুও সৃজা যেনো দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারপাশে।সৃজার সৌন্দর্য যেনো অনুষ্ঠানে আসা প্রত্যেকটা মেয়েকে মনে মনে বলতে বাধ্য করলো হায়্ এ রূপ যদি আমার হতো।কতগুলো অসন্তুষ্ট চোখও তাকে দেখে অবাক হতে বাধ্য হলো।
টিউলিপ কেক কেটে ফেলেছে কিন্তু কারো মুখেই দিচ্ছে না।সবাই তাকে আদর করে কত কিছু বলছে।আমাকে দেখে তার ঠোঁট প্রসারিত হলো।দেখেই হাতের কেকের বাড়িয়ে দিয়ে বললো
“হা করো ডল মাম্মা।”
অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।অনেকটাই আশ্চর্যের ব্যাপার এটা তাদের কাছে।আমি তার পাশে গিয়ে হাটুগেড়ে বসলাম
“টিউলিপ সোনার জন্মদিন আজ তাই প্রথম কেকটা তার মাম্মাকে খাওয়াবে,ডল মাম্মাকে পরে খাওয়াবে।”
টিউলিপ বললো
“মাম্মা তো প্রতিবারই খায় এবার তুমি প্রথমে খাবে।” সানিয়াও সৃজাকে চোখের ইশারায় খেতে বললো।একটা ভাইয়ের বউ তার,বড় আদরের, প্রকাশ না করলেও।সানিয়ার আচরণে তা ঠিকই প্রকাশ পায়।অগত্যা কিছু অপরিচিত মানুষের গোলগোল চোখের ভিরে তাকে কেকটা মুখে দিতে হলো।সৃজা কি জানতো এতো মানুষের ভীরে তার বাবা নামক মানুষটার চোখ জুরিয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখে।
টিউলিপের দাদী বললো
“বাব্বাহ্ মামানীর সাথে ভাগ্নীর ভালোই ভাব হলো।এতো করে বললাম আমরা প্রথমবার তার জন্মদিনে আছি যেনো আমাকে প্রথম কেকটা মুখে দেয়।নাহ্ সে তো তার ডল মাম্মার জন্য অপেক্ষা করছিলো।”বলে একটা নকল হাসি উপহার দিলো।
কেক কাটা হয়ে গেলেই সৃজা টিউলিপকে নিয়ে গেলো।ওর ড্রেস বদলানো দরকার এই পরিবেশে এটা পরে ও হাঁপিয়ে গেছে।সানিয়াকে বলে টিউলিপকে সাথে করে নিয়ে গেলো।ওদের একসাথে দেখলে সানিয়ার মনটা প্রশান্তি পায়।সে নিজের মেয়েকে যে আনন্দটা দিতে পারছেনা,সেটা সৃজা ঠিকই দ্বিগুণ করে দিচ্ছে।কিভাবে শোধ করবে সে এ ঋণ!!
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এলিজা এখানে ছিলো না।সাফওয়ান ও নেই এলিজাও নেই। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্তনা দিলো সৃজা হয়তো বিষয়টা কাকতালীয়।
মেহমান বিদেয় হতে অনেক দেরি। আমি আর নিচে থাকলাম না।মায়ের কাছে এলাম।একা ছিলো এতক্ষণ। এটা স্বাভাবিক। মা অপরিচিত জায়গায় সহজে মানিয়ে নিতে পারেনা।কিন্তু আমাকে ঠিকই শেখাতো অপরিচিত জনদের মাঝে মানিয়ে নেয়া।শ্বশুর বাড়িতে সবার কথা শুনে চলতে।তবে অন্যায়ের সাথে আপোষ তিনি করলেও আমি সহজে করতে পারিনা।
মাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে তিনি।বয়স হলে বোধহয় সব পরিবর্তন হয়ে যায়।দিদির সাথেও বেশি দেখা হয় না মায়ের।একমাত্র দিদির সাথে সব শেয়ার করতাম আমি।বিয়ের পর দিদিও চলে গেলো মালয়েশিয়া বরের কাছে।দিদি চায় মা তাদের সাথে থাকুক কিন্তু স্বামীর মায়া ছেড়ে এই মহামানবী যেতে চান না।মা ঘুমিয়ে পরেছে।আমি চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাবাকে দেখে থেমে গেলাম।আমাকে বসতে বললেন।বিনা সংকোচে এই প্রথম আমি তার কথা মানলাম।নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন
“কেমন আছো মা?”
সৃজা কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললো
“ভালো।”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। কিছুটা থেমে বললেন
” হয়তো আমি জীবনে অনেক অন্যায় করেছি,তোর মাকেও কষ্ট দিয়েছি।এখনও দেই।আমার মতো খারাপ স্বামী,খারাপ পিতা দুটো নেই মা।”বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।
কিছুই বললাম না।মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।আজ এতোদিন পর এসব কেনো বলছে বাবা।তবে কি উনি শেষ বয়সে এসে নিজের ভুল বুঝতে পারছে।আর সব মানুষের ক্ষেত্রেও এটা হয়,জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে নিজের ভুলগুলো মনে পরে।কিন্তু হায়্!তখন কিছুই করার থাকেনা।
“আমি জীবনে অনেক পাপ করলেও তোমাদের সে পাপ ছুঁতে পারেনি।তবে তোমরা আমার পাপের সাথে সাথে আমাকেও ঘৃণা করলে।আমারই দোষ ছিলো।এই বিয়েতে তুমি রাজী ছিলে না কিন্তু আমারও বেশি উপায় ছিলো না।তাছাড়া জামাই এর মা আমার কোনো এক ভালো কাজের প্রতিদান স্বরূপ তোমাকে এ বাড়ির বউ করেছে।আমি বিয়ের আগেই জানতাম এ বাড়ির যত সম্পত্তি আছে তার অধিকাংশ সাফওয়ান চৌধুরীর বউয়ের নামে হবে।”
কথাটা শুনে চকিত হয়ে বাবা দিকে তাকালাম।তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।তারপর আবার বললেন
“এই সম্পত্তির জন্য হলেও তোমাকে এরা কখনো অবহেলা করবেনা।এখন তোমার প্রশ্ন থাকতেই পারে তোমাকে কেনো তারা বউ করলো?”
আমার দৃষ্টি বাবা পরতে পারলেন বোধহয়।বললেন
“সাফওয়ানের দাদা মৃত্যুর আগে উইল করে গেছেন সাফওয়ানের সম্পত্তি বিয়ের পর তার বউয়ের নামে হবে।আর তাই এ বাড়ির বউ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা অনেক সতর্ক ছিলো।আমাদের গ্রামে নতুন প্রজেক্টের জন্য জমি দেখতে গিয়েছিলো তারা।সেদিন তাদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম।পরিচয় হওয়ার পর তোকে দেখেছিলো সাফওয়ানের মা।সে থেকে ওনার ইচ্ছা তোকে এ বাড়ির বউ করবে।”
আমি শুধু অবাক হচ্ছি বাবার কথা শুনে।আবারও বললেন
“সেদিন আমার খুশি দেখে কে।আমার মেয়ের রাজ কপাল।সাথে সাথে রাজী হয়ে যাই।অথচ তোর অপদার্থ বাবা মেয়ের অনুমতিই নিলো না।” বলতে বলতে তার চোখ চিকচিক করে উঠলো।
“কিন্তু এখন আমি খুশি,আমার মেয়ে সত্যিই রাজরাণী।” কথাটা বলে একটু দম নিলেন।বুকে হাত দিয়ে বললেন
“একবার আমায় জড়িয়ে ধরবি মা?তোর এই স্বার্থপর বাবাটাকে ক্ষমা করে দিস।”
এতো আকুলতা সৃজার চোখের জলে প্রকাশ পেলো।ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।সত্যিই তো বাবা যা করেছেন তা আমার সুখের জন্য। কোন বাবা না চায় তার মেয়ে সুখী হোক।আমার এতোদিনের শূন্যস্থানটা আজ পূরণ হয়ে গেলো।মায়ের কাছে শুনেছি বাবা এখন অনেক বদলে গেছে।সব ব্যবসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।কিন্তু হুট করে এ পরিবর্তনের কারণ নিয়ে আর ভাবলাম না।
রাত এখন ১ঃ৩০টা,এখনো সাফওয়ান এলো না।কতবার ফোন দিয়েছি বন্ধ বলছে।এবার চিন্তা হচ্ছে।এর ক্ষাণিক বাদেই বাইরে আওয়াজ শুনলাম।নিচে নেমে দেখলাম বাড়ির প্রায় অনেকই হলরুমে,সাফওয়ান ও রয়েছে।সবাই মনোযোগ দিয়ে খবর শুনছে।
কিছু কথা আমার কানে এলো….এই মাত্র পাওয়া খবর শহরের অন্যতম ব্যবসায়ী জারিফ আহসানকে চোরাচালান ও ভেজাল পণ্য উৎপাদনের দায়ে আটক করেছে পুলিশ।………….
এর মাঝেই সাফওয়ান বলে উঠলো এরপর আর কোনো বাস্টার্ড এর সাহস হবে না সাফওয়ান চৌধুরীর পেছনে লাগার।তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি রেগেও আছেন আবার সেই সাথে কপট খুশিও।আমার শ্বশুর মশায় বললেন
“নিজেকে কন্ট্রোল করো।আর ভাষা সংযত করো।যাই করো না কেনো এ বাড়ির সম্মান যেনো এক চুলও না যায়,সেদিকে খেয়াল রাখবে।যাও রুমে যাও বউমা এখনো জেগে আছে।”
সাফওয়ান আসার জন্য পিছু ফিরতেই আমাকে দেখতে পেলো।বললো
“তুমি এতো রাতে জেগে আছো কেনো?ঘুমিয়ে পরতে বলেছিলাম।” এগিয়ে এসে সবার সামনেই হাতটা ধরে রুমে নিয়ে এলেন।কিছু না বলেই ফ্রেশ হতে গেলেন।
চলবে……