মায়াজাল
৫ম পর্ব,৬ষ্ঠ পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা
৫ম পর্ব
‘ স্যার ওনার শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে। অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ার কারণে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তার দেখে গেছে ওনাকে আর কিছু মেডিসিন দিয়ে গেছে। আশা করা যায় কিছুক্ষণ রেস্ট করলে উনি সুস্থ হয়ে যাবেন। ‘
‘ আচ্ছা দিশা একটা কথা বলেন তো ! ‘
‘ কী বলবো স্যার? ‘
‘ আপনার কাছে কী মনে হয়? আরজে রূথিলা ৩টি খুনের আসামী? উনি কেন এমনটি করতে গেলেন? উনি আসলেই অত্যন্ত রহস্যময়ী। কোনো এক রহস্যে ঘেরা মায়াজাল হয়তো উনি। ‘
‘ আমার কোনো ধারণা নেই স্যার তবে সে কোনো ভয়ানক সত্য আড়াল করে রয়েছেন। ‘
‘ কি করে যে এই রহস্যে ঘেরা মায়াজালের জট খুলবে? ওনার সাথে আবার কথা বলতে হবে। ‘
‘ ঠিক বলেছেন স্যার। একমাত্র রূথিলার দ্বারাই এ মায়াজাল উন্মোচিত হতে পারে। ‘
__________________
বিয়ের পর থেকে রূথিলার জীবনে যেন সকল আধারগুলো কেটে গিয়ে আলোর দিশা আসতে শুরু করেছিল। খুব আনন্দে কেটেছে রূপক ও রূথিলার বিবাহ পরবর্তী দিনগুলো। রূথিলা রূপকের সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে নিজের অতীত যন্ত্রণাগুলোকে ভুলতে শুরু করেছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিলো এবার বুঝি সুখপাখি তাকে ধরা দিয়েছে।
এভাবেই কাটছিল রূথিলার বিবাহিত জীবন, লেখাপড়া, জব। রূপক তার প্রচুর খেয়াল রাখত। কিন্তু এই সুখ রূথিলার জন্য দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বিয়ের প্রথম দুই বছর তারা বেশ সুখী ছিল কিন্তু মনমালিন্যের শুরুটা দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর পর থেকেই। একদিন হঠাৎ,
‘ রূপ তোমার কী হয়েছে? তুমি আজকাল আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছ কেন? জানতে পারি? ‘
‘ মানেটা কী? আমি আবার তোমার সাথে কি করেছি? ‘
‘ তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কি করেছ? ‘
‘ না তো…! ‘
‘ তুমি বিগত ৪ দিন যাব্ৎ বাসায় আসোনি। আমি কল করলে রিসিভ কর নাই। আবার কিছু জিজ্ঞাসা করলে যা ইচ্ছে তা বলছ। ‘
‘ বেশ করেছি। তোমায় বিয়ে করেছি বলে আমার মাথা কিনে নিয়েছ? আমার যেখানে খুশি আমি থাকব সেই কৈফিয়ত আমি তোমায় দিতে যাব কেন? ‘
‘ খবরদার রূপ চিৎকার করবে না। ‘
‘ একশো বার করব। তোর কি? ‘
‘ রূপক, তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে পারলে। ‘
‘ বেশ করেছি, এখন থেকে রোজ তুলব। ‘
এইকথা বলে রূপক বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। দুই বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম রূপকের এমন হিংস্র রূপ পরিলক্ষিত হলো রূথিলার কাছে। সে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় রূপকের এহেন আচরণে। কি কারণে রূপক তার সাথে এ ধরনের আচরণ করছে জানা নেই রূথিলার। তবে কোনো এক ভয়াবহ বিপদের আভাস পাচ্ছে রূথিলা। আচ্ছা রূপক কি কোনো ভাবে তাকে ঠকাতে চাইছে? হঠাৎ স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো তার অতীত জীবনের ভয়ানক কালো স্মৃতি। ঘটনাটির সূত্রপাত সেদিন থেকে প্রায় ৯ বছর আগে।
______________________
২০০৪ সাল। রূথিলার বয়স তখন ১৭ পেরিয়ে ১৮। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কেটেছে ১১টি বছর। এখনো সে তার বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতিটুকু হাতড়ে বেড়ায়।
যদিও অনেকগুলো দিন কেটে গেছে তবুও যেন স্মৃতি গুলো আজও তার অমলিন। এতিম হয়ে বেচে থাকাটা যে কত বড় সংগ্রাম তা এতদিনে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে রূথিলা। আজ বহুদিন পর নিজের বাড়িতে সে একা রয়েছে। একা বললে ভুল হবে আরো একজন রয়েছে। সে হলো নিরব।তার মেঝ চাচা, চাচি কোনো এক দরকারে দুদিনের জন্য ঢাকা ছেড়েছেন। আর ছোট চাচা তার পরিবার নিয়ে আমেরিকা প্রবাসী। তারা বছরে একবার দেশে এসে ঘুরে যান। এই বাড়িতে রূথিলা ওর মেঝ চাচা, চাচি আর চাচাতো ভাই নিরব থাকে। নিরব বয়সে রূথিলার চেয়ে ৬ বছরের বড়। রূথিলা নিরবকে একদম সহ্য করতে পারে না। এই ছেলেটার হাতে কত মেয়ের জীবন যে নষ্ট হয়েছে ! এসব জানে তার বাবা-মা। তবুও বাধা দেননি নিজেদের ছেলেকে। এজন্য যথা সম্ভব নিরবকে এড়িয়ে চলে রূথিলা। কিন্তু নিরব যে সবসময় তাকে কামনার দৃষ্টিতে দেখে তা জানা আছে রূথিলার। তাই রূথিলার নজরে এই ব্যক্তি চরম ঘৃণার পাত্র। অনেকবার চাচা-চাচিকে এসব নিয়ে বলেছে সে। কিন্তু তার কথা শোনা তো দূরে থাক উল্টো চরম অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে রূথিলার শ্রদ্ধেয় চাচা-চাচি। তাই এই খালি বাসায় থাকতে খুব ভয় আর অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে রূথিলার। কিন্তু করার কিছুই নেই। এমন নানান চিন্তা ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল সে। হঠাৎ নিরবের কণ্ঠ ভেসে আসল,
‘ কীরে রূথিলা রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছিস কেন? ‘
‘ ভাইয়া পড়ছি কালকে পরীক্ষা আছে তো তাই। ‘
‘ তো দরজা আটকে কেন? ‘
‘ আমার রুমের দরজা আমি আটকে রাখি তো সবসময়। ‘
‘ ওহ্। তা এখন খোল একটু। ‘
‘ কেন? কোনো দরকার? ‘
‘ এতো প্রশ্ন করিস কেন? খুলতে বলেছি খোল। ‘
‘ না ভাইয়া আমি খুলবো না। ‘
‘ তুই আমার কথার অবাধ্য হচ্ছিস? আসুক বাবা মা দেখ আমি কী করি। ‘
‘ প্লিজ ভাইয়া। ‘
‘ দরজা খোল। ‘
রূথিলার মন বড্ড কু ডাকছে। দরজা খোলার সাহস কিছুতেই সঞ্চার করতে পারছে না। এদিকে নিরব ক্রমাগত ডেকে চলেছে। কি করবে রূথিলা? যদি কোনো বিপদ ঘটে? দরজা খোলাটা কী ঠিক হবে? এমন নানান প্রশ্নে তার ভেতরটা জর্জরিত।
_________
চলবে
মায়াজাল
৬ষ্ঠ পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা
‘ এটা আমি কি করে ফেললাম ! নিরব ভাইয়া, ভাইয়া। এই ওঠো না। দেখ আমার ভয় করছে। তুমি যা বলবে তাই করব। প্লিজ ওঠো না। ‘ কাঁদতে কাঁদতে রূথিলা নিরবকে ডাকছে।
_________________
কিছুক্ষণ পূর্বে,
রূথিলা নিরবের ডাকে সাড়া দিয়ে দরজা খুলে ছিল। তার বিশ্বাস ছিল তার ভাইয়া আর যাই করুক নিজের আপন চাচাতো বোনের কোনো ক্ষতি করবে না। নিজের মনকে স্বান্তনা দিয়ে অবশেষে দরজা খুলেই ফেলল রূথিলা। কিন্তু এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। নিজেকে ছাড়া পৃথিবীতে কাউকেই সরল মনে বিশ্বাস করতে নেই। কেননা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা কেউই যথাযথ ভাবে দিতে জানে না। কোনো না কোনো ভাবে, জেনেবুঝে বা অজান্তে বিশ্বাসঘাতকতা করবেই। সবাইকে একই বিচারের মাপকাঠিতে আবার বিচার করা ঠিক না। কেননা ভালো মানুষের উপস্থিতি আছে বলেইতো পৃথিবী আজও টিকে আছে। রুমের দরজা সামান্য খুলতেই নিরব এক ধাক্কায় পুরো দরজা খুলে রূথিলার চুলের মুঠি চেপে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় রূথিলা হতবাক হয়ে গেল। নিরবের করা কাজটি মস্তিষ্কে পৌঁছতেই রূথিলা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকল।
‘ ভাইয়া আমার লাগছে। প্লিজ ছাড়ো। ‘
‘ তোর দেমাগ বাড়ছে তাই না। জমিদার হইতে চাস, কতবার কইলাম দরজা খুলতে? এতোক্ষন লাগল কেন? তোর রূপের বাহার দেহাস আমারে। ‘
‘ আহ্ ভাইয়া প্লিজ ছাড়ো। ভাইয়া ওড়না ধরছো কেন? ভাইয়া প্লিজ, ওড়নাটা দাও। ‘
‘ তোর আজকে কি করি দেখ। কতবার কত ভাবে বুঝাইছি তোর শরীর আমার চাই। এই শরীর আমারে আকর্ষণ করে। কিন্তু তুই তো ঢং দেহাস। আজকে আর ছাড় পাবিনা। এই নিরবের চোখে যারে একবার ধরে তারে সে যেকোন মূল্যেই ভোগ কইরা ছাড়ে। ‘
‘ ভাইয়া ভালো হচ্ছে না ছাড়ো বলছি। চাচা, চাচি আসলে আমি বলে দেব সব। ‘
‘ আমি কমু তুই আমারে জোর করছস। এই বাড়িতে তোর কথার কোনো দাম আছে? আরে এমন সুযোগের অপেক্ষা কতগুলো দিন করছি ! আজকে তোরে পাইছি। তোর সব দেমাগ এক্কেবারে ছুটায় দিমু। বেশি ছটফট করিস না। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে দে। ‘
‘ তোমার শার্ট খুলছো কেন? এগুলো করতে পারো না তুমি। ভাইয়া তুমি তো আমার ভাই এমন করো না। আমাকে সবাই ছিঃ ছিঃ করবে। ‘
‘ আমি কি পারি আর কি পারি না সেই সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই তবে আজ পেয়ে যাবি। ‘ কথাটা বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে নিরব।
এদিকে নিজেকে রক্ষা করার অবিরাম চেষ্টা করে চলেছে রূথিলা। অনেক আকুতি করছে নিরবের কাছে রূথিলা কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের অমানুষটার কাছে তা গ্রাহ্যই হচ্ছে না। দুজনের মধ্যকার হাতাহাতি এখন ধস্তাধস্তির পর্যায়ে। নিজের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে অমানুষটার বিষাক্ত ছোয়ায় ভেতরটায় দহন হচ্ছে। রূথিলার আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এই আর্তনাদ শুনে অমানুষটা পৈশাচিক আনন্দ লাভ করছে। রূথিলা নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করল কারণ নিরবের সাথে যে গায়ের জোরে ও পেরে উঠবে না তা বেশ বুঝতে পারছে। হঠাৎ রূথিলার চোখ তার পড়ার টেবিলে গেল। তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। খুব ধীরে সে তার টেবিল থেকে পেন্সিল কম্পাস তুলে নিল তারপর সজোরে নিরবের পিঠে ঢুকিয়ে দিল। আকস্মিক আক্রমণের জন্য নিরব প্রস্তুত ছিল না। ফলে তীব্র জ্বালায় তার হাত আগলা হয়ে আসে। রূথিলা নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। গিয়ে একটা ছুরি ডান হাতে নিয়ে নিল এবং বাম হাতে কাচের জগ নিল। আর একবার জানোয়ারটা কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলে জঘন্য কিছু করে ফেলবে বলে ধাতস্থ করেছে রূথিলা। শরীরের বিধ্বস্ত অবস্থা তার। কামিজের বিভিন্ন স্থানে ছেড়া, শরীরে নখের আঁচড়, বুকে ওড়না পর্যন্ত নেই। ওদিকে নিরব জঘন্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। পায়ের আওয়াজ যতই নিকটবর্তী হচ্ছে রূথিলার ভয় ততই জাঁকিয়ে বসছে। তার বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে।
‘ মা* তোর সাহস বাইরা গেছে না। সারাজীবন আমার বাপের টাকা খাইছস আর এহন দুইদিনের বৈরাগী হইছস। ‘
‘ কাছে আসবি না জানোয়ার। আমি কিন্তু খুন করে ফেলব। ‘
‘ খা** তুই আমারে মারবি? এই নিরবরে? ‘
রূথিলার দিকে এগোতেই সে নিরবের হাতে ছুরিকাঘাত করে। বেশ অনেকটা গভীরেই ছুরি ঢুকে যায়। এতে নিরব প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। রূথিলা থেমে না থেকে হাতে থাকা কাচের জগটা দিয়ে নিরবের মাথায় সজোরে আঘাত করে। এতে নিরব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাথার আঘাতটা ব্রেনের সবচেয়ে দুর্বল অংশে গিয়ে লাগে ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিরব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আঘাত করার পর রূথিলার হাত থেকে কাচের জগটা পরে যায়। ঝনঝন শব্দে জগটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। হাতে থাকা ছুরিটা দিয়ে নিরবের পিঠে বেশ কয়েকবার আঘাত করার পর রূথিলা শান্ত হয়। এতোক্ষন সে যেন একটা ঘোরের মাঝে ছিল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই তার হাতের ছুরি নিক্ষিপ্ত হয় ময়লার ঝুড়িতে। রূথিলা মাটিতে বসে পড়ে। কান্নায় ভেঙে পরে সে। কি করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারল রূথিলা? নিরবের পিঠে হাত রেখে নিরবকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে সে কিন্তু কিছুতেই নিরব সাড়া দিচ্ছে না।
___________________
চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে রূথিলা কথা বলা থামিয়ে দিল। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। চাপা কান্নার দরুন চারিপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। অফিসার সাগ্রতের চোখ ছলছল করছে। আর দিশা পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করছে। বেশ অনেকটা সময় লকাপের ভেতরে শোকসভা চলল। নিরবতা ভেঙে সাগ্রত ধরা গলায় বলল,
‘ তারপর লাশটার কি করলেন আপনি? ‘
‘ আমার এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ‘
‘ তাহলে এতটুকু বললেন কেন? ‘ বেশ রাগান্বিত হয়েই কথাটা বলল সাগ্রত।
‘ আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই, ‘ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলে চোখ মুছলো রূথিলা। তারপর আবার বলে উঠল , ‘ একজন খুনির জন্য আপনারা পুলিশ হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন? ‘
কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হাসল রূথিলা।
_________
চলবে