মায়াজাল ২য় পর্ব

মায়াজাল
২য় পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা

আমাদের একটা বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে সেই বিষয়টি হলো রূপকেরও পরিবার নেই , আমার মতো অনাথ । বিষয়টা এই কিছুদিন আগেই জানলাম । ও অবশ্য ওর খালামনির কাছে মানুষ হয়েছে । ওর বাবা একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যান সেই শোক সইতে না পেরে কিছুদিনের মাঝে ওর মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । শুনেছি রূপকের মুখে ওর বাবা , মা নাকি একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসতেন । তাদের অঢেল সম্পত্তি ছিল যা বর্তমানে রূপকের নিয়ন্ত্রণাধীন । ওর পরিবার ওকে ঠকায় নি , ওর প্রাপ্য ওকে বুঝিয়ে দিয়েছেন । পৃথিবীতে ওনাদের মতো কিছু মহৎ মানুষের কারণেই বিশ্বাস ও ভরসা এই শব্দদ্বয়ের উপস্থিতি পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে নয়তো কবেই এই শব্দদ্বয় পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যেত । বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । তবে আমি ওর মতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি । আমার মেঝ চাচা-চাচির কাছে বড় হয়েছি , তারা আমাকে এমন সব ব্যবহার উপহার দিয়েছে যা হয়তো কেউ তার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষের সাথেও করে না । আমার মনে হয় এর চেয়ে যদি কাজের মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াই শ্রেয় ছিল । কাজের মানুষ বলে কাউকে ছোট করছি না । এসব ভাবছি কারণ তারা আমায় আগলে নেয়নি নিজেদের মেয়ে হিসেবে । সেই সময় অনেক কষ্টে নিজের লেখাপড়া চালিয়েছি যার দরুন আজকে টিকে রয়েছি । আমার চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা নোনাজল বেরিয়ে এলো পুরনো স্মৃতি চারণ করে । এইরে এতো সব ভাবতে গিয়ে আমার তরকারিটাই পুড়ে গেল । এখন এই পোড়া তরকারিতেই কাজ চালাতে হবে । নতুন করে আবার রান্না করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটিই এখন আর নেই । আমি হোস্টেল ছেড়েছি তা প্রায় ৭ মাস হতে চললো । এখন একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকছি আর এই ফ্ল্যাটটা রূপকের পরিচিত মানুষের । ওই আমায় বাসা খুঁজতে সাহায্য করেছে । আর বর্তমানে লেখাপড়া , কাজ সবটা মিলে বেশ ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটছে ।

ঘড়ির কাটায় রাত সাড়ে ১১টা বাজতে চললো । তাই আর বিলম্ব না করে খাবার খেয়ে নিলাম । খাবার খেয়ে বারান্দায় এসে বসলাম , এটা আমার খুব পছন্দের জায়গা । বারান্দায় কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছি , চারিদিক ফুলের ঘ্রাণে সুবাসিত হয়ে রয়েছে । আকাশ তারকাময় , জ্যোৎস্নার আলো যেন গলে গলে পড়ছে । ফিরে যাওয়া যাক ফেলে আসা দিনে যখন আমার বাবা-মা জীবিত ছিলেন , আমার পরিবার ছিল ।

_____________
১৯৯৩ সালের ২রা জুন । রূথিলার বয়স তখন ছয় কি সাড়ে ছয় । ওর বাবা ছিলেন রিয়ান রহমান , একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা । আর মা ছিলেন টয়া হাসনাত , গৃহিণী । যৌথ পরিবারের সন্তান ছিল রূথিলা । দুই চাচা ও তাদের পরিবার আর রূথিলাদের পরিবার । রিয়ান রহমান পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন এবং তারা ৩ ভাই ছিলেন । তার মা-বাবা বেশ আগেই গত হয়েছিলেন । এই সকলকেই নিয়ে তার সংসার সাজানো ছিল । কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ের কবলে সবটাই তছনছ হয়ে যায় ।

সেদিন ছিলো এক রৌদ্রজ্জ্বল দিন তবে সেই উজ্জ্বলতা রূথিলার জীবনে কোনো সুখকর স্মৃতি বয়ে আনেনি ।
‘ আম্মু আমিও যাব তোমার সাথে , ‘ ছোট্ট রূথিলা তার আদরের মায়ের কাছে আবদার করে বসল ।
‘ না মামনি , আমাদের জরুরী একটা কাজ আছে । ‘
‘ তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না । ‘
‘ মামনি বোঝার চেষ্টা কর , তোমার বাপি আমার জন্য অপেক্ষা করছে । তুমি মেঝ মাম্মামের সাথে থাকবে । একদম দুষ্টুমি করবে না । আমি আসি মা , দেরি হয়ে যাচ্ছে । ‘
‘ ঠিক আছে আম্মু । বাপিকে বলবে আমার চকলেট যেন কিনে তারপর বাসায় আসে । তার রূথি মা তার বাপির সাথে রাগ করেছে । ‘
‘ ওকে মা , সাবধানে থাকবে আসছি । ‘

কে জানতো এটাই মা-মেয়ের শেষ দেখা , শেষ কথা । সেইদিন রূথিলার বাপি আর মা ফিরেছিলেন বাড়িতে তবে লাশ হয়ে । তাদের সাথে ঠিক কী ঘটেছিল তা অজানাই রয়ে গেল । কেউ তা জানার চেষ্টা করেনি । ছোট্ট রূথিলার কাছে বোধগম্য হয়নি তবে সে তার বাবা-মায়ের লাশের পাশে বসে কেঁদেছিল । ধারণা করা হয় মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়াটাই রিয়ান রহমান ও তার স্ত্রীর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । এরপর থেকে আস্তে প্রিয়জনদের রূপ পাল্টে যেতে দেখেছে রূথিলা । রূথিলার বাবা-মায়ের অঢেল সম্পত্তির লোভ তার আপনজনদের বদলে দিল । সব সম্পত্তি পেতে হলে রূথিলাকেই প্রয়োজন তাদের । পরিবারের প্রিয়জন থেকে প্রয়োজন হয়ে উঠলো রূথিলা । আর তার চাচারা ঠিকই সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয় । আর এরপর থেকে অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকে ।

_____________
হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল । বাস্তবতা কেন এতোটা নির্মম হয় ? চোখের জল গাল বেয়ে গলা অবদি নেমে গেছে । হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছে নিলাম । রোজ কাঁদি তাও এতো জল আসে চোখে কোথা থেকে ? বাইরের শক্ত খোলসের আড়ালে যে এক দুর্বল সত্ত্বার বাস তা কেউ জানে না । বারান্দা থেকে উঠে রুমে গেলাম । রাত এখন প্রায় দুটো পেরিয়েছে । বিছানায় শুয়ে ছটফট করছি কিছুতেই ঘুম আসছে না । ছোটবেলায় বাপি-আম্মুর সাথে কাটানো কিছু স্মৃতি ঝাপসা হয়ে দৃষ্টিপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে । বুকের ভেতরে শুধু হাহাকার । শেষরাতে চোখটা লেগে এলো ।

_________
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here