কাগজের তুমি আমি দ্বিতীয়_অধ্যায়,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
– তুই তো মানুষ ভালো না, বউ হওয়ার আগেই টিপিক্যাল বউদের মতো স্পাইগিরি করছিস।
কথাটা কানে আসতেই চমকে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। বুকের উপর হাত বেধে সুক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে অনল। আসলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিলো ধারা। যদিও ইচ্ছেকৃত নয়, কিছুক্ষণ আগে সুভাসিনী বেগম অনলকে খুজছিলেন বিধায় ধারাকে পাঠিয়েছেন তার ছেলেকে ধরে আনতে। অনলকে খুজতে বাগানের কোনায় আসতেই মাহি এবং তার কথোপকথন শুনতে পায়। তখন আর তাদের সামনে যেতে ইচ্ছে হয় নি, লজ্জায় একেই অনলের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না, তার উপরে অনলের এমন কথা শুনে আরো অপ্রীতিকর অবস্থাতে পড়ে যায় ধারা। আমতা আমতা কর বলে,
– না, আসলে
– কি আসলে? আসল কথা তুই আমার স্পাইগিরি করতে আসছিস। তোদের মেয়েদের সমস্যা কিরে? এতো সন্দেহপ্রবণ কেনো? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতি। না তোর তো সি.আই.ডি এর এ.সি.পি হওয়া লাগবে। আমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশ সন্দেহ হচ্ছে। কোনো মেয়ের সাথেই তো কথা বলতে দিবি না দেখছি বিয়ের পর। হায় খোদা আমার কি হবে
মাথায় হাত দিয়ে এমন ভাবে কথাগুলো বলছে অনল যেনো সত্যি খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছে ধারা। হা করে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধারা। কি বলবে শব্দ খুজে পাচ্ছে না। নিজের বোকামির উপর নিজের ই রাগ উঠছে, নিজের কপালে জোরে চাটি লাগাতে মন চাচ্ছে। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই ধারা বললো,
– তুমি ভুল বুঝছো, আমাকে তো ফুপি
– কিহ! লুকিয়ে কথা তুই শুনছিলি, আমার উপর নজরদারি তুই করছিলি আর দোষটা দিচ্ছিস আমার মার। মা বলেছে তোকে এগুলো করতে?
অনলের কথা শুনে আবার ও ভাষাহীন হয়ে যেতে হলো ধারাকে, এই মানুষটাকে বুঝানো অসম্ভব। এখন নিজের মনেই নিজেকে হাজারো বকা দিয়ে নিলো ধারা। এই লোকের এমন বিদিকিচ্ছির স্বভাব জানা সত্ত্বেও প্রতিবার একই ভুল করে ধারা। এই লোকের প্রতি যখন ই একটু কৃতজ্ঞতা বোধ হতে লাগে, যখন ই ভাবে অনলকে সম্মান করবে তখন ই এমন কিছু কথা শুনতে হয় সে অনলের মাথা ভেঙ্গে ফেলতে মনে চায় তার। তার খুব ইচ্ছে দেখার লোকটার মাথায় কি আসলেই ভুষি ভরা কিনা! সবসময় দু কদম বেশি বুঝে।
– তার কত গালাবি, মনে মনে তো গালি দিতে দিতেই মেরে ফেলসিস। কি বউ জুটলোরে বাবা।
অনলের কথা শুনে বেশ চটে গিয়েই বললো ধারা,
– তোমাকে গালাবো কেনো? গালাচ্ছি নিজেকে। নিজের গাধামির জন্য নিজেকে গালাচ্ছি। গাধা না হলে কি বারবার তোমার মতো মোটা বুদ্ধিকে বুঝানোর মতো কাজ করতে যাই। ক্ষেমা দাও, ফুপি তোমাকে ডাকছিলো বিধায় আমার এখানে আসা। তোমার উপর নজরদারি করতে না বয়েই গেলো বুঝলে
বলেই সামনে হাটা দিলো ধারা। মনে মনে অনলের গুষ্টির ষষ্ঠী করছে সে। তার মধ্যেই কানে আসে,
– আমার উপর ই তোর যত চোটপাট, বাহিরের মানুষ যখন দু কথা শোনায় তখন এই তেজ কোথায় যায়?
অবাক নয়নে পেছনে তাকাতেই আবার অনল বলে উঠে,
– কি ভুল বললাম? আর একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদছিলি, সেটা কেনো? তেজ দেখানোর বেলায় অনল আর এমনি সময় লবডংকা
– মাহি আপু তো ভুল কিছু বলেন নি।
– সে ভুল কি ঠিক সেটা টো আমি জানতে চাচ্ছি না। আমার বউ হতে যাচ্ছিস এখন খামছি দিতে আসলে কামড়ে দিবি। বাকিটুকু আমি দেখে নিবো। আমি তোকে এই শেষবারের মতো বলছি, এই ফ্যাসফ্যাসানি যদি আরেকবার দেখি না ঠাটিয়ে কান লাল করে দিবো বলে দিচ্ছি। চল মা অপেক্ষা করছেন
বলেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো অনল। ধারা অনলের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। বড় অদ্ভুত এই লোক, এতো রহস্যময়ী এই লোকটা। তার ট্যারা ট্যারা কথাগুলো শুনে মনে অজানা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধারার। কেনো যেনো মনটা খুব সহজেই চাঙ্গা হয়ে গেলো। না জানি কি জাদু আছে লোকটার মাঝে। মন খারাপের রেশটা ঝাড়ি দিয়েই হাওয়া বানিয়ে দেয়। এর সাথে সারা জীবনের পথচলাটা খুব মন্দ হবে না_____
রাত ১১টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা, এলোকেশে মন্দ লাগছে না মেয়েটিকে। বারান্দার গ্রিল ধরে বাহিরের মনোরম প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। হীম বাতাসে চুল উড়ছে ধারার। নভেম্বরের এই সময়ে বেশ কুয়াশা পড়ে। খুব দ্রুত পৌষে পা রাখবে প্রকৃতি। এই সময়টা খুবই প্রিয় ধারার। আকাশে আজ চিকন শুভ্র চাঁদ উঠেছে। নতুন চাঁদ, আমাবস্যার অন্ধকার কাটিয়ে ক্ষীণ আলোতে প্রকৃতিকে একটা মায়াময় সাজে সাজিয়েছে। অনেকটা তার জীবনের মতো, ঘন কালো আধারের মাঝে অনল এই শুভ্র চাঁদটির ন্যায় তার জীবনকে নতুন রুপ দিয়েছে। আজকাল মনটা বেশ অন্যরকম হয়ে গেছে, মুড সুইং এর জন্য হয়তো এমন হয়। এই ভালো থাকছে আবার থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। কাল অনলের সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। কথাটা ভাবলে একদিকে যেমন নিজের বাচ্চার কথা ভেবে ভালো লাগছে আবার খারাপ লাগছে নিজের আপনদের ফেলে যেতে হবে বিধায় কান্না পাচ্ছে। অবশ্য তার পরিবারের মানুষেরা তাকে পার করতে পারলেই হয়তো বাঁচেন তবুও ধারার খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে নিজের মার কোলে আচড়ে পরে কাঁদতে, কিন্তু আপনজনের সাথে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। চাইলেও তারা তাকে আপন করে নিচ্ছেন না, সেও আগাতে পারছে না। কথাটা ভাবতেই মনটা আবার হু হু করে উঠলো। আনমনেই পেটে হাত চলে গেলো ধারার, মলিন কন্ঠে বলতে লাগলো,
– তুই ও কি আমাকে এমন একা করে দিবি? যখন নিজের পরিচয় জানতে পারবি তুই ও কি আমাকে ভুল বুঝবি?
উত্তর পাবে না জেনেও কথা বলছে। মনের শান্তি, কেউ তো কথা বলছে না, লাবণী, ছোট বোনটাও কথা খুব কম কথা বলে। হয়তো বুঝেও না কি বলতে হবে। শুধু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। এই দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলতে পারতো! কিন্তু ওই ভাগ্যের পরিহাস। সহ্য করতেই হবে
– ধারা কি ঘুমিয়ে গেছো?
সুরাইয়া বেগমের কন্ঠ কানে আসতেই বারান্দা থেকে রুমে আসে ধারা। বেশ কিছু গয়না, শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোটের কোনায় হাসির রেখা একে ধারা বললো,
– আমার ঘরে আসতে কি এখন তোমার পারমিশন লাগে মা
– না ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছিস কি না
– আসো না মা
ধারার কন্ঠের আকুতি দেখে সুরাইয়া বেগমের চোখ ছলছল করছে। মেয়েটাকে কাল অন্যের হাতে তুলে দিবেন। এই একটা সপ্তাহ তার মুখ দর্শন ও করেন নি। কিন্তু মা তো আর থাকতে পারছিলেন না। নাহয় একটা পাপ করেই ফেলেছে তাই বলে নিজের নাড়ির টানকে অস্বীকার করবেন কিভাবে। সেদিন মেয়েটা তার মা আকড়ে বসেছিলো শুধুমাত্র নিজের অংশকে বাঁচাতে। মেয়েটার মুখটা দেখে মনটা কেঁদে উঠলো। পুতুলের মতো মেয়েটা এই এক সপ্তাহেই কি লাশের মতো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির স্তর। মুখটা যেনো শুকিয়ে আছে। হাসতে গেলেও দশবার ভাবে। তবুও নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করলেন না; শক্ত কন্ঠে বললেন,
– এই গয়না গুলো তোমার জন্য গড়িয়েছিলাম। কাল এগুলো পড়বে। আর এই শাড়িটা তোমার ফুপি পছন্দ করেছেন। কালকে এটাই পড়বে তুমি। এই শাড়িগুলো আমার কাছে ছিলো। বেশ কিছু কেনার সুযোগ দেয় নি তোমার ফুপি। তাই এগুলোই সুটকেসে গুছিয়ে নাও।
– আর কিছু বলবে না মা
– ধন্যবাদ, চুপচাপ বিয়ে করার জন্য। অনল ছেলেটা অনেক ভালো, আমরা সারাটাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ। তোমার বিয়েটা না হলে লাবনীর জন্য ও আমাদের কষ্ট পোহাতে হত। এই বিয়েটা শুধু তোমার বাচ্চাকে প্রাণে বাছাচ্ছে তা নয়, আমাদের সম্মান ও বাচাচ্ছে। ও বাড়িতে ফুপির খেয়াল রেখো। তিনি যে কাজ করছেন, তার জায়গায় আমি হলে এতো মহত্ব দেখাতে পারতাম না। তাকে কোনো কষ্ট পেতে দিও না। এমন কোনো কাজ আবার করো না যাতে তার কাছে আমরা ছোট হয়ে যাই।
সুরাইয়া বেগমের গলা ধরে এসেছে, আর দাঁড়িয়ে থাকলে তার দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি জিনিসগুলো খাটের উপর রেখেই বেড়িওয়ে গেলেন তিনি। ধারার মনে এক রকম চাপা কষ্টের আবির্ভাব হলো, সেখান থেকে অভিমান। এই অভিমানের রেশটা নিজের কাছেও একটা দূরত্বের তৈরি করছে। মা-মেয়ের অভিমানের পালা যে কবে শেষ হবে তা হয়তো উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না______
পরদিন,
রাত ১২টা,
অনলের রুমে বসে রয়েছে ধারা। বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ঘন্টা দুয়েক আগে এ বাড়িতে এসেছে সে। লাল বেনারসি পড়ে বধুবেশে অনলের খাটে বসে রয়েছে। যদিও এইটাও সুভাসিনী বেগমের আইডিয়া। ধারা চেয়েছিলো সুভাসিনী বেগমের রুমেই থাকবে। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতে শাশুড়ির ঘরে বউ থাকছে ব্যাপারটা হাস্যকর। মানুষ তো জানে না এই বিয়েটা কাগজের একটা সই মাত্র। এর মর্ম বর বউ কারোর কাছেই নেই। তবুও সামাজিক জীব হওয়ার দায়ে মানুষ কি ভাবছে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। বুকটা কেনো জানে টিপটিপ করছে। কেনো সেই উত্তর জানা নেই ধারার। যতই হোক বিয়ে তো হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে…………………
চলবে
কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
৮ম_পর্ব
বুকটা কেনো জানে টিপটিপ করছে। কেনো সেই উত্তর জানা নেই ধারার। যতই হোক বিয়ে তো হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে ধারার। দরজা ঠেলে অনল রুমে প্রবেশ করে। অনলকে আজকে বেশ সুন্দর লাগছে, গোল্ডেন শেরোয়ানিতে বেশ মানিয়েছে তাকে। এমনেই মাশাআল্লাহ শারীরিক গঠন তার উপরে বরের সাজসজ্জা তাকে আরোও অসহ্যরকম হ্যান্ডসাম করে তুলেছিলো। অবশ্য ধারাকেও আজ লাল বেনারসীতে বেশ চমৎকা্র লাগছিলো, যেন লালে মোড়া কোনো মায়াবতী। সবার এক কথা ছিলো বিয়েতে বর বউ এর জুটি নাকি অনেক মানিয়েছে। ধারা এক নজরে অনলকে দেখে যাচ্ছে। কেমন জানে বিধ্বস্ত লাগছে, যেনো মনের সাথে হাজারো যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। অনল রুমে প্রবেশ করতেই ধারা ধীর পায়ে তার নিকট এগিয়ে যায়। তাকে দেখতেই অনল ভ্রু কুচকে থমথমে কন্ঠে বলে,
– তুই এই রুমে? আমি তো বলেই ছিলাম তুই মার সাথে থাকবি
অনলের এরুপ কথায় বেশ আমতাআমতা করেই ধারা জানায়,
– আসলে, আমি ফুপিকে বলেছিলাম। কিন্তু উনি বললেন নতুন বউ বাসরের রাতে শাশুড়ির সাথে থাকবে এটা কেমন দেখায়, তাই আজ রাতে এখানে থাকতে বললেন।
ধারার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অনল। অনলের নীরবতা দেখে ধারার পুনরায় তাকে বলে,
– তোমার যদি কোনো সমস্যা থাকে আমি নিচে শুয়ে যাচ্ছি।
– থাবা খাইছোস?
– হ্যা?
অনলের এমন কথায় বেশ হতবাক হয়ে যায় সে। অনলের বিশ্বাস নেই, থাবা মেরেও দিতে পারে। কিন্তু ভুল কি বললো সেটাই তো বুঝতে পারছে না ধারা। গালে হাত দিয়ে অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে এবং জিজ্ঞেস করে,
– কেনো?
এবার অনল ধমকের সুরে বলে,
– বাচ্চার মা হতে যাচ্ছিস বুদ্ধি হবে কবে? ঠান্ডার সময় নিচে শুয়ে ঠান্ডা লাগাবি আর দোষ হবে আমার বউ অত্যাচারের। বুঝি না আমি? যা ফ্রেশ হয়ে খাটে ঘুমা
– তুমি?
– আমার চিন্তা তোর করতে হবে না।
বলেই বারান্দায় চলে যায় অনল। আজ রাত তার ঘুম হবে না, মনটা বেশ অস্থির তার। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত সে। ধারা আর কোনো কথা বলে না, ভারী পোশাক ছেড়ে একটা হালকা সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয় সে। অনল তখন একের পর সিগারেটে সুখ টান দিতে ব্যাস্ত। নিজের অস্থিরতা নিকোটিনের ধোয়ায় উড়াতে ব্যস্ত সে। তখন পিছন থেকে ডাক পড়ে,
– তুমি ফ্রেশ হবে না?
কথাটা শুনেই পেছন ফিরে তাকায় অনল। ধারাকে দেখে মনের মাঝের অস্থিরতাটা যেনো দ্বিগুন হয়ে যায়, গোলাপি সালোয়ার কামিজে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে ধারাকে যেনো কোনো ভাস্কর্যের হাতের নিপুন শিল্প। মুখের কাছে লেগে থাকা পানি গুলো যেনো মুক্তদানার ন্যায় লাগছে। পরক্ষনেই নজর সরিয়ে নিলো অনল। কি করছে সে, দূর্বলতার কোনো স্থান নেই তার মনে। ধারার প্রতি সম্পর্কটা কেবল এবং কেবল কাগজের। কোনো কথা না বলে গটগট করে ওয়াশরুমে চলে যায় অনল। অনলের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না ধারা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। নিজের মনে একটা খচখচানি রয়েই গেলো, অনল কি বিয়ে টা করে পচতাচ্ছে!
রাত ২টা,
ধারা গভীর ঘুমে মগ্ন, অনল তখন ও বারান্দায় বসা। আজকে দিনটার অপেক্ষা পাঁচ বছর আগেও তার ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে সেদিন রিক্ত হস্তে ফেরত দিয়েছিলো। মনটা আজ হু হু করে উঠছে বারবার। প্রিয়তমার শুন্যতা আজ মনকে ব্যাহত করে তুলছে। দুঃখ ভুলাতে মদের বোতলে হাত বাড়ায় অনল। আচ্ছা মানুষটা না থাকলে কি ভালোবাসাও উবে যায়? চোখ ছলছল করছে অনলের, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সিক্ত নয়নে দেখতে থাকে। হোমস্ক্রিনে মায়াবী মুখশ্রী ভেসে উঠে। কি কোমল হাসি মেয়েটার, শ্যাম বর্নের এই নারীর বাস অনলের হৃদয়ে সর্বক্ষণ। ছবিটির দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো অনল বলে,
– অনন্যা, আমি তোমাকে দেওয়া কথা রেখেছি, বিয়ে করে নিজের জীবনে একটা পুতুলের মতো বউ এনেছি। কিন্তু আমি যে তোমার স্থান কাউকে দিতে পারবো না। আমার বুকে তোমার জায়গা ছিলো, আছে এবং থাকবে। আমার ভাবনার গহীনে তোমার বিচরণ অনন্যা, অন্য কোনো নারীকে কিভাবে সেই স্থান দিবো অনন্যা। আমি ক্লান্ত, না চাইতেও ধারার প্রতি এক রকম আকর্ষণ কাজ করছে। কি করবো আমি অনন্যা? আমি যে ক্লান্ত। তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, কাউকে বলতে পারি না। সবাই ভাবে আমি অনেক ভালো আছি। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারি না আমার ভালো থাকার উপায়টাই আমার কাছে নেই। কেউ বুঝে না অনন্যা। কেনো আমাকে একা করে দিলে তুমি? ভালোবাসি বললেই আমাকে একা হয়ে যেতে হয়। আমি তাই আর কোনো দিন কাউকে ভালোবাস বলবো না, কখনো না
রাতের আধারে অনলের অশ্রুগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। কেউ টের না পেলেও কেউ ঠিক ই সাক্ষী হচ্ছে এই অশ্রুগুলোর। এতো কঠোর মানুষ ও কাঁদতে পারে সেটা তার ধারণা ও ছিলো না। চোখ বুঝে অনলের দুঃখগুলো অনুভব করতে পারছে ধারা। কিন্তু নীরব থেকে মূহুর্ত গুলোর সাক্ষী হলো সে। হয়তো এটাই তাদের ভেতরের সম্পর্কের সুতো। তারা নিজেরাও জানে না তাদের এই সুতো কতোটা মজবুত। এই সুতোটাই হয়তো তাদের সম্পর্কের নতুন আরম্ভ হবে, কে জানে______
সূর্যের প্রখর রশ্নি মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় অনলের। মাথাটা টনটন করছে তার। কাল রাতে ইমোশোনাল হয়ে একটু বেশি নেশা করে ফেলেছে সে। চোখ ঢলে উঠে বসে সে। হঠাৎ খেয়াল করলো তার গায়ে একটা চাদর দেওয়া। যতটুকু তার মনে আছে কাল রাতে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। এবং তার কাছে কিছুই ছিলো না। কিন্তু এখানে তার গায়ে চাদর দেওয়া শুধু সেটাই না একটা বালিশে তার মাথা ছিলো। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে সামনে রাখা মদের বোতল কিংবা এশট্রে টাও নেই। তার অগোচরে এগুলো কে করলো? ধারা। রুমে সে ব্যাতীত কেউ নেই ও। কিন্তু সে তো ঘুমিয়ে ছিলো। উফফফ মাথাটা টনটন করছে, এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।
– মুখটা ধুয়ে চা খেয়ে নাও
কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকালে দেখতে পায় সামনে ধারা কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা। নীল শাড়ি পরিহিতা নারীকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। ভেজা এলোকেশে দাঁড়িয়ে আছে সে। অনল ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধারা বলে,
– মেহমান যতোদিন থাকবেন আমাকে এই রুমেই থাকতে বলেছেন ফুপি। আর একটা কথা মানুষকে তো সারাক্ষণ জ্ঞান দিতে থাকো অথচ ডাক্তার হয়ে নিজের লিভার নিজেই নষ্ট করছো। এটা যদি তোমার প্যাশেন্টরা জানতে পারে, তোমার কাছে আসবে? ভেবে দেখো
বলেই হাটা দিলো ধারা, এই প্রথম অনলকে দু কথা ঠেস মেরে বলতে পেরেছে সে। মজা লাগছে ধারার। সারাটাক্ষণ তাকে খুব ধমকের উপর রাখে লোকটা। কাপে চুমুক দিতে দিতে মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে অনলের। মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হতে লেগেছে। এখন সময়ের প্রতীক্ষা যখন তার জীবনধারার স্বাভাবিকতার_____
রাত ৮টা,
আজ অনল ধারার বৌভাত। ধারাকে গোলাপী ল্যাহেঙাতে বেশ সুন্দর লাগছে। ধারার পরিবারের সবাই এসেছে শুধু সুরাইয়া বেগম ব্যাতীত। সুভাসিনী বেগম যখন সেলিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিউত্তরে তিনি বলেন,
– একটু পর জামাই মেয়ের আসবে সেটার প্রস্তুতি করছে সে।
সুরাইয়া বেগমের না আসার কারণটা সুভাসিনী বেগমের বেশ ভালো করেই জানা। তাই বেশী ঘাটান না তিনি। ধারাকে দেখে লাবণী দৌড়ে যায় তার কাছে, হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
– আপু কেমন আছিস রে?
– আলহামদুলিল্লাহ, তুই?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– মা কে দেখছি না ( আশেপাশে দেখে)
লাবনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– আপু তোকে খুব সুন্দর লাগছে
– কথা ঘুরাচ্ছিস?
– না আসলে
– থাক, মায়ের রাগ পড়লেই না হয় তার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো হবে।
– বাদ দে না আপু। আচ্ছা তোর কথা বল, ফুপি, অনলভাই ভালো তো?
– খুব ভালো তারা। এতো ভালো মানুষ হয় নারে?
– আচ্ছা অনল ভাই কই রে? আসার পর থেকে দেখছি না
– অনল ভাই তা কলিগদের সাথে আছে।
– তুই এখনো তাকে ভাই বলেই ডাকবি? সে বুঝি তোর ভাই হয়?
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে লাবনী। ধারাও বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। আসলেই তার মুখ থেকে ভাই বাদে কিছু বের হতে চায় না। তার কি দোষ!
অপরদিকে,
অনলের সব কলিগরাও এসেছে। শামীম, রাফিদরা মজার ছলে অনলকে বলে,
– ভাই, আপনারে তো বিয়ের পর আরো বেশি হ্যান্ডসাম লাগতেছে। ভাবী আপনার প্রেমে মনে হয় প্রতিনিয়ত পড়ে। (শামীম)
– ভাবী কি কম সুন্দর নাকি? (রাফিদ)
– তোদের পগানোর কারণটা কি রে?
– পগাবো কেনো? যাহা বলি সত্য বলি
শামীম বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে। এর মাঝেই মাইসা বলে উঠে,
– ভাই বলেন না ভাবী আগে প্রপোজ করেছে নাকি আপনি?
– সিক্রেট।
বলেই চোখ টিপ্পনী দেয় অনল। সে বিয়েতেও মাহিকে দেখে নি, আজ ও মাহি আসে নি। তাই কৌতুহল কন্ঠে মাহির কথা জিজ্ঞেস করতেই মাইসা তাকে জানায়,
– মাহি আপুর শরীর ভালো নেই ভাই। তাই আসতে চায় নি। এই দুদিন হাসপাতাল থেকেও ছুটি নিয়েছে সে।
অনল কথাটা শুনে চুপ হয়ে যায়। সে খুব ভালো করেই জানে মাহি জেদের বশে কাজ গুলো করছে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটি কল আসে অনলের ফোনে। নাম্বারটা অচেনা লাগছে অনলের। কলটা রিসিভ করতেই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি