তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৪,১৫
অপরাজিতা টুয়া
পর্ব ১৪
সেদিন রাতে ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন নতুন করে আবার গম্ভীর হয়ে গেছে বাবাই, প্রায় দিন পনেরো হয়ে গেছে তারপর, কিন্তু স্নেহার সঙ্গে আর খুব একটা কথা বলছে না তেমন করে।
খারাপ ব্যবহার করেনা ঠিকই, কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে থাকে সব সময়। তাই স্নেহাও আবার গুটিয়ে গেছে একটু, আগের সেই অস্বস্তি টা যেনো ফিরে এসেছে নতুন করে, কিন্তু এর কারণ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ও।
আজ সকালে বাবাই বেরিয়ে যাবার পর কাজকর্ম সেরে ফেসবুক নিয়ে বসে ছিলো স্নেহা, খুলেই দেখলো একটা মেসেজ রিকোয়েস্ট আছে। মেসেজ টা খুলে দেখলো, সেই দিনের সেই ছেলেটা, যার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা রিমুভ করে দিয়েছিল ও।
মেসেজ টা একটু অদ্ভুত, তাই ইগনোর করতে গিয়েও পারলো না, আপনার হাজবেন্ডের বান্ধবীর সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই, কি করবে ঠিক করতে না পেরে শেষে মেসেজ টা খুলে রিপ্লাই দিলো স্নেহা। ছেলেটা সায়ন্তির সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়, বুঝতে পারছিলো ও কিন্তু সেটা ওকে কেনো, বাবাই কেই তো বলতে পারে, কেমন যেনো খটকা লাগছিলো স্নেহার।
রিপ্লাই দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটা মেসেজ করলো, কল করতে পারি আপনাকে? না বলে দিলো স্নেহা, কল ও ধরবেনা, কিছু বলার থাকলে মেসেজই বলুন, রিপ্লাই দিলো ও। আপনার হাসব্যান্ড কে আমি কন্টাক্ট করতে পারছিনা, উনি আননোন নম্বর ধরেন না বোধহয়, সায়ন্তি আমার কাছ থেকে অনেক গুলো টাকা নিয়েছে, এখন ফেরত দিতে চাইছে না, এই কথা গুলো একটু ওনাকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ। এই সম্বন্ধে আমার কিছু করার নেই, আপনাকেই কথা বলতে হবে বলেই, ছেলেটা কে ব্লক করে দিলো ও।
মন টা খচ খচ করছিলো, সায়ন্তি কি তাহলে বাবাই এর কাছেও টাকা নিয়েছে কখনও, কিন্তু এই কথা গুলো বাবাই কে জিজ্ঞেস করার মত সম্পর্ক ওদের নেই। সায়ন্তি র সম্বন্ধে এই লোকটার বলা কথাগুলোও ওর পক্ষে বাবাই কে জানানো সম্ভব নয়, যদি জানাতে হয় তো ওই জানাক, স্নেহা এর মধ্যে ঢুকতে যাবে না, মনে মনে স্থির করে নিলো ও।
একে তো বাবাই গম্ভীর হয়ে আছে, তার মধ্যে এই সব কথা বলে আরও নতুন কিছু অশান্তির সৃষ্টি হোক স্নেহা চায়না, ভাবতে ভাবতেই ফোন টা বেজে উঠলো, তাকিয়ে দেখলো বাবা, বাবা তো কোনো সময় ফোন করেনা!! মা ই ফোন করে ওকে, কি এমন হলো যে বাবা ফোন করলো একটু অবাক হয়েই ফোন টা ধরলো ও।
মাথা ঠাণ্ডা করে শোন, খুব শান্ত গলায় বলছিলো বাবা, মা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে , কালকেই ইমার্জেন্সী অপারেশন করতে হবে, বাবাই কেও জানিয়েছি, পারলে রাতের ট্রেনে আসার চেষ্টা করিস, চিন্তা করিস না বলেই ফোন টা রেখে দিলো বাবা।
আমার সঙ্গেই সব কিছু খারাপ হয় কেনো, মায়ের ওপর রাগ দেখিয়ে ফোন না করার জন্য খুব খারাপ লাগছে এখন, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছিলো না, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো স্নেহা।
একটু পরেই বাবাই আজ তাড়াতাড়িই ফিরে এলো, স্নেহা তখনও একই ভাবে বসে ছিলো, দরজা খুলে দিয়ে সোফায় বসে পড়লো আবার। আজ বাবাই এর জামা কাপড় রাখতে, বা খেতে দিতে উঠতেও ইচ্ছা করলোনা, মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।
বাবাই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো, তাও স্নেহা ভাত বাড়তে উঠলোনা দেখে বাবাই নিজেই ভাত বেড়ে টেবিলে এনে রাখলো,দুটো থালায়।
খেয়ে নাও, রিজার্ভেশন পেয়ে গেছি আজকেই, লাগেজ গুছিয়ে ফেলো তাড়াতাড়ি, ওর সামনে এসে দাঁড়ালো বাবাই।
কেমন শুন্য দৃষ্টিতে বাবাই এর দিকে তাকালো, মায়ের কিছু হবে না তো বলেই হটাৎ করে কেঁদে উঠে বাবাই কে জড়িয়ে ধরলো স্নেহা।
বাবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, হাত টা আস্তে করে স্নেহার পিঠের ওপর রেখে বললো
সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করোনা, খেয়ে নাও চলো, বলে ওকে ধরে টেবিলে এনে বসলো।
দু এক গ্রাস খেয়েই উঠে গেলো স্নেহা, বাবাই এর মনটাও খুব খারাপ লাগছিলো, ছোটো থেকে তো শাশুড়ি কেই মা বলে জেনে এসেছে, একসময় মামনি যে ওর নিজের মা সেটাও জানতো না ও।
তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দেবো, জানতে চাইলো স্নেহা,
না আমার কিছু নেবার নেই, ওখানে তো সব আছে, তোমার হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়বো, আর শোনো কিছু কিনে নেবো স্টেশন থেকে, তোমাকে এখন কিছু রাতের জন্য আর রান্না করতে হবে না।
সব খারাপের মধ্যেও কিছু ভালো আছে হয়তো, বাবাই এর সেই আগের মতন ব্যবহার টা কিছুটা ফিরে আসায় ভালো লাগছিলো স্নেহার। ও বাবাই কে জড়িয়ে ধরায় যে বাবাই রাগ করেনি তাতে একটু শান্তি পেলো ও। মা নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে, মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালো স্নেহা।
ট্রেনে উঠে মুখোমুখি বসে ছিলো দুজনে, স্নেহা চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে, ওর নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ, একটু কথা বললে মন খারাপ টা কাটতো কিছুটা হয়তো, কিন্তু, নিজের গম্ভীর ভাবটাকে তো কাটাতে চায়না ও, সব সময় স্নেহাই জেদ দেখাবে, আর ওকেই কথা বলতে হবে কেনো! সেদিনের পর থেকেই বেশ অভিমান জন্মে গেছে বাবাই এর।
কিন্তু এই সময় কি ওর জেদ ধরে বসে থাকা উচিত, ঠিক করে উঠতে পারছেনা ও।
মন খারাপ? চিন্তা করো না, মা ভালোহয়ে যাবে,অবশেষে কথা বলেই ফেললো বাবাই।
চিন্তা তো হচ্ছেই, কিন্তু বাবাই এর সামনে সেটা প্রকাশ করতে চায়না, তাই শুধুই ঘাড় নাড়লো ও। কতদিন পরে বাবাই আবার ওর সঙ্গে কথা বললো ভালো করে, যদি মা না অসুস্থ হতো, তাহলে তো বলতো না খুব অভিমান হচ্ছে স্নেহার। ও ও কোনো সহানুভূতি চায়না বাবাই এর কাছে, ও নিজেই নিজেকে সামলে নিতে পারবে ঠিক, জানলার দিকে চোখ ফেরালো স্নেহা।
বড্ড জেদী, ও নিজে থেকে কথা বললেও মুখে উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করছে না , কেনো যে ও কথা বলতে গেলো, আবার গম্ভীর হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো বাবাই। স্নেহা করুন মুখে জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছে,ওর খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু বাবাই এর সামনে ভাঙবে না ও, জানে বাবাই। এই জন্যই সেদিন থেকে রাগ হয়ে আছে ওর, সব সময় এত জেদ কেনো?
ওর খুব ইচ্ছা হচ্ছে স্নেহার হাত টা ধরতে, কিন্তু নিজে থেকে আর বেশি কিছু করবেনা ঠিক করে নিয়েছে ও। ও তো আগে কথা বললো, তাহলে তো এবার ওরই কথা বলা উচিত তাই না, কিন্তু তাও নিজের রাগটা কে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছেনা ও, সত্যিই তো বেচারীর মায়ের শরীর খারাপ এই সময় রাগ দেখানো উচিত নয়, পরে কোনো সময় দেখাবে নিশ্চয়ই, ও ভুলবে না , কিন্তু আজকের দিনটা আর রাগ দেখানো উচিৎ নয়।
কি ভাবছো এত?
কিছু না,
তাহলে চুপ করে আছো কেনো?
এমনই।
আমি কথা বলছি, আর তুমি শুধু ঘাড় নাড়ছো, এই ভাবে কথা বলা যায়, বেশ বিরক্ত গলায় বললো বাবাই।
বলছো কেনো? আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না, অভিমানের সুরে বললো স্নেহা।
ঠিক আছে, বলবোনা তাহলে, এবার সত্যিই গম্ভীর হয়ে গেলো বাবাই, যা বলার বলে দিয়েছে স্নেহা,এবার সত্যি ও আর কথা বলবে না, জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো দুজনেই।
চলবে
তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৫
মা হসপিটাল থেকে ফেরার পর থেকে মায়ের কাছেই আছে স্নেহা, বাবাই নিজের বাড়িতে আছে। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো, মাও সুস্থ হয়ে গেছে মোটামুটি, এবার ফিরতে হবে রাত্রে শুয়ে ভাবছিলো বাবাই।
স্নেহার সঙ্গে কথা বলতে হবে, ওকে নিয়েই ফিরবে, ঠিক করে নিয়েছে ও, এখন আর একা থাকার কথা ভাবতে পারেনা ও, সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে ওখানে গিয়ে এখন আর এত কিছু নিজে করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে।
সত্যিই কি তাই, শুধু নিজের সুবিধার জন্যই ও নিয়ে যেতে চাইছে, নিজের মনেই প্রশ্ন জাগছে, ওর কি স্নেহার উপস্থিতি ভালো লাগছে না এখন? বাড়ি ফিরে বেল দিলে ওর ছুটে এসে দরজা খোলাটা খুব ভালো লাগে, চাবি নিয়ে যাওয়া তো কবেই ভুলে গেছে ও, ওর নীরব উপস্থিতি নিয়েই কি ও ক্রমশ সরব হয়ে উঠছে বাবাই এর জীবনে, ভালোবেসে ফেলেছে ও বোধহয়, নিজেই চমকে ওঠে ও।
সেদিন সায়ন্তির সঙ্গে খেতে যাবার পর থেকেই একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো ওর মধ্যে, কিছুতেই স্নেহার সামনে স্বাভাবিক হতে পারছিলো না আর, স্নেহা বোধহয় কিছু ভেবেছে, ও ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে আরও, অথচ ও তো কিছু লুকায়নি স্নেহার কাছ থেকে, তাহলে সত্যি গুলো এখন আর স্বীকার করতে পারছে না কেনো, সায়ন্তির সঙ্গে খেতে যাওয়া,বা ওর মাথা ফাটার সত্যি কারণগুলো ও বলতে পারছেনা কিছুতেই, কেনো বারবার মনে হচ্ছে স্নেহা সত্যিটা জানলে কষ্ট পাবে, ওর কি সত্যি স্নেহার কষ্ট পাওয়ায় খারাপ লাগবে, আস্তে আস্তে স্নেহা ওর অভ্যেসের মধ্যে চলে আসছে যেনো।
সেদিন মায়ের খবর পেয়ে যখন স্নেহা ওকে জড়িয়ে ধরলো, ওরও খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে কাছে টেনে নিতে, কিছুতেই পারলোনা, নিজের চারপাশে নিজেই একটা দেওয়াল তুলে ফেলেছে ও, কিছুতেই সেটা ভাঙতে পারছে না আর।
এই দেওয়াল টা ওর সবার সঙ্গেই উঠে গেছে, কারোর কাছেই সহজ হতে পারছেনা ও। বাপি সেই থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলেনা, ও অনেকবার নিজে ফোন করবে ভেবেছে কিন্তু কিছুতেই করে উঠতে পারেনি, একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হয়। এখানে এসে বাপিকে প্রণাম করলো ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই, বাপি কিছু বললো না, ও ও আর এগোতে পারলো না নিজে। শুধু মামনি আর মা নিজেদের উদ্যোগে ব্যাপারটা সহজ করে দিয়েছে তাই, না হলে সেটাও হতো কিনা কে জানে!!
মায়ের অসুস্থতা একটু হলেও কাছাকাছি এনেছে ওদের, এতদিনের গুমোট ভাবটা কেটে গেছে, আবার একটু সহজ হতে পেরেছে স্নেহার সঙ্গে বাবাই।
কিন্তু সেদিনের ট্রেনের ঘটনার পর থেকেই রেগে গেছে ও, ইচ্ছে করেই ও এখানে থাকতে বলেনি স্নেহা কে, থাকুক ও মায়ের কাছেই। ও ভেবেছিলো স্নেহা মা সুস্থ হবার পরে নিশ্চয়ই নিজেই এসে থাকবে এখানে, কিন্তু মামনিই সব গন্ডগোল করে দিলো। আগেই বলে দিলো
তুই ওখানেই থাক, বাবাই এর কি ইচ্ছা একবারও জানতে চাইলো না। এমনিতেই অপারেশনের সময় যখন ও স্নেহার পাশে গিয়ে বসলো, যাতে ওর ভালো লাগে, ট্রেনের ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে নিজেই আবার কথা বলতে চেষ্টা করলো,তখনও স্নেহা একটাও কথা বললো না, আর চেষ্টা করবে না ও , মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে বাবাই।
কিন্তু, ওকে নিয়ে ফিরতে চায়, এটুকু তো বলতেই হবে অন্তত, কিভাবে বলবে, সেটা ভাবছে কাল থেকেই।
হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকলো একটা, কবে আসবি? খুলে দেখলো সায়ন্তি, সেদিন রাত্রে খেতে গিয়ে স্নেহাকে ফোন করতে দেখার পর থেকেই বাবাই এর ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়ে গেছে ও, বোঝে সেটা বাবাই, এখন নিয়ম করে ফোন আর মেসেজ করে, ওর মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছে ,দু এক দিনের মধ্যেই ফিরবে জানিয়ে দিয়ে ফোন টা অফ করে শুয়ে পড়লো বাবাই।
মা কে খেতে দিয়ে স্নেহা পাশেই বসেছিলো, দরজায় বেল বাজার আওয়াজে খুলে দেখলো বাবাই। এখন প্রতিদিনই মা কে দেখতে আসে এইসময়, তাই বুঝতেই পেরেছিলো স্নেহা,
চা খাবে তো, বসো আনছি, বলেই রান্না ঘরে ঢুকে গেলো ও।
সন্ধ্যের চাটা এখন মায়ের কাছে বসেই খায় বাবাই, মা খুব খুশি হয় ওকে পেলে,
আয় বোস,
আজ কেমন আছো? বলে ভেতরে ঢুকে গেলো বাবাই।
চা দিয়ে খাটেই বসেছিলো স্নেহা, বাবাই চা খেতে খেতে মা কে বললো
তোমার সঙ্গে কথা ছিলো মা,
হ্যাঁ বল না,
আসলে আর আমি থাকতে পারবনা, এবার ফিরতে হবে আমাকে, অনেকদিন হলো।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চলে যা, এখন তো আমি ঠিক হয়ে গেছি।
কিন্তু স্নেহা চলে গেলে তোমার খুব অসুবিধা হবে না তো? অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ফেললো বাবাই।
অবাক হয়ে তাকালো স্নেহা, বাবাই নিজে থেকেই ওকে নিয়ে যেতে চাইছে, ও তো ভেবেছিলো, মা কে দেখার অজুহাতে ওকে এখানে রেখেই চলে যাবে বাবাই। মায়ের মুখটা খুশিতে ভরে উঠতে দেখলো স্নেহা,
না, না, ওকে তো নিজের সংসারে ফিরে যেতেই হবে, আমি এখন একদম সুস্থ হয়ে গেছি, তোদের আমাকে নিয়ে একটুও ভাবতে হবে না, তুই টিকিট কেটে নে, বাবাই এর দিকে তাকিয়ে বললো মা।
তাহলে পরশুর টিকিট কাটছি, তুমি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও, স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো বাবাই।
তোমার কিছু জিনিস দেওয়ার আছে আমার ব্যাগে?
বাবাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছনে এসে দাঁড়ালো স্নেহা।
না, যেটুকু আছে, আমি নিয়ে নেবো, তুমি কি মায়ের কাছে থাকতে চাইছিলে? স্নেহার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো বাবাই।
স্নেহা চুপ করে থাকলো, বাবাই এর এক্সপ্রেশান দেখতে চাইছিলো ও,
থাকতেই পারো, কিন্তু আসলে ওখানে তুমি থাকলে একটু সুবিধা হয়, আমি কিছু পারিনা তো তাই,
স্নেহার চোখের দিকে তাকালো ও, স্নেহা কি কিছু বুঝে ফেললো!! বাবাই এর অস্বস্তি হচ্ছিলো। স্নেহা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে, কেমন যেনো ভেতর পর্যন্ত পড়ে ফেলছে, আস্তে করে চোখ টা নামিয়ে নিলো বাবাই।
স্নেহার মুখে মৃদু হাসি, ও বুঝে গেছে বাবাই ওকে রেখে যেতে চাইছে না, ধরা পড়ে গেছে বাবাই, বুঝতে পারছিলো নিজেও, কিন্তু নিজের ইমোশন কে আটকাতে পারছে না কিছুতেই, এখন যদি না বলে তাহলে স্নেহা কে রেখেই ওকে চলে যেতে হবে, সেটা ও কিছুতেই পারবে না, ওই ফ্ল্যাটে স্নেহা নেই ভাবলেই খারাপ লাগছে ওর, যে করেই হোক বলতে ওকে হবেই।
কদিন পরে এসো আবার, আমি দিয়ে যাবো এসে, এখন চলো, স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে ফেললো ও।
স্নেহা একটু হাসলো, ওখানে সব ছড়িয়ে ফেলে এসেছি, হটাৎ করে আসতে হলো তো, ফিরে যেতে তো হবেই, আমার গোছানো আছেই সব কিছু, তুমি টিকিট কাটো।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো, অনেক না বলা কথা লুকিয়ে ছিলো ওই তাকানোর মধ্যে, একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো বাবাই।
বাবাই বেরিয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকে চুপ করে বসেছিলো স্নেহা, ও ঠিক করেই নিয়েছিলো বাবাই নিজে থেকে নিয়ে যেতে না চাইলে, মা বা মামনি কারোর কথায় ও ফিরবেনা এবার। এবার তো ওর কাছে মায়ের অসুস্থতার অজুহাত আছেই, সেই অজুহাতেই থেকে যাবে ও। কিন্তু বাবাই নিজে বলায় ও সেই জেদ টা ধরে রাখতে পারলো না আর। ওর খুব আনন্দ হচ্ছে, নাহ! আর ও কোনো জেদ দেখাবে না বাবাই এর সঙ্গে, সেই ট্রেন থেকেই আর কথা বলছেনা, এবার যখন নিজে থেকে কথা বলেছে তখন ও ও কথা বলবে, ঠিক করে নিলো স্নেহা।
আমি পরশু ফিরে যাবো মামনি, খেতে খেতে টেবিলে বসে বললো বাবাই।
স্নেহাকে নিয়ে যাবি তো? উৎকন্ঠিত গলা মামনির।
হ্যাঁ, নিয়ে যাবো, বলেই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো ও।
ও জানে, মামনি খুব খুশি হয়েছে, বিকেলে মায়ের খুশি মুখও লক্ষ্য করেছে ও। স্নেহার ওপর আর এই মুহূর্তে কোনো রাগ নেই ওর, ও ভেবেছিলো ঠিক যেতে চাইবে না স্নেহা, মায়ের অসুখের অজুহাতে থেকে যেতে চাইবে নিশ্চয়ই, ওর যা জেদ!! কিন্তু ও অতো সহজে রাজি হয়ে যাবে, সেটা একটুও ভাবেনি বাবাই।
আসলে বাবাই ওকে নিয়ে ফিরতে চায়, বুঝে গিয়েছিলো ও, তাই ওকে পরীক্ষা করছিলো, সেটা বুঝেছে বাবাই, কিন্তু ঠিক আছে, ওটুকু না হয় মেনেই নেবে বাবাই, শেষ পর্যন্ত ফিরে তো যাচ্ছে ওর সঙ্গে। প্রতিবার ও নিজে থেকে কথা বলেছে, এটা নাহয় আর একবার বলতে হলো, কিন্তু ওকে একা ফিরতে তে হলোনা, তাই এতদিনের জমিয়ে রাখা রাগগুলো আর একটাও মনে রাখতে চায়না ও, মনটা খুব ভালো হয়ে গেছে এই মুহূর্তে।
স্নেহা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ওর খুব জানতে ইচ্ছা করছে, খুব শুনতে ইচ্ছা করছে একবার গলাটা, কিন্তু এই মুহূর্তে ফোন করার কোনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছে না বাবাই। কি বলা যায় ভাবতে ভাবতেই ডায়াল করে ফেললো,
মায়ের শরীর কেমন আছে এখন? তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? স্নেহা ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই বললো ও।
হ্যাঁ, ঠিক আছে, ভালোই হলো তুমি করলে, আমার ও তোমার সঙ্গে কথা ছিলো, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো ভেবে করিনি আর,
হ্যাঁ, বলো, কি বলার ছিলো
বাবাই যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, ওর অস্বস্তিটা কেটে গেলো একঝটকায়।
আমার কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার ছিলো ওই বাড়ি থেকে,
জিনিসের নাম গুলো বলে গুড নাইট জানিয়ে ফোন রেখে দিল স্নেহা। খুব সাধারণ কিছু জিনিস, সেগুলো কি এতটাই জরুরী ছিল, নাকি স্নেহা নিজেও ওর মতোই শুধু কথা বলতেই চাইছিলো!! বুঝে উঠতে পারছেনা বাবাই।
ফোন রাখার পর থেকেই নিজেরই হাসি পাচ্ছিলো স্নেহার, ও জানে বাবাই এমনই ফোন করেছিলো, কিন্তু ও একটুও অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি বাবাই কে, তাই ওকে এমনিই কিছু বলতে হলো, কিন্তু ওই অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে ও এখন কি করবে সেটা ঠিক করতে পারছেনা আর।
চলবে