দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয়_অধ্যায়,১৪তম_পর্ব,১৫তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৪তম_পর্ব
নুশরাতের মনে হচ্ছে সে কারোর হাতের পুতুল, তাকে যেভাবে নাচতে বলা হচ্ছে সে যেভাবেই নাচছে। নয়তো এতোটা সূক্ষ্ণ সময়ে সে ম্যাসেজ করতে পারতো না। ইশরাকে পাওয়া গেছে ব্যাপারটা আনন্দদায়ক হলেও, লোকটির শেষ কথাটা নুশরাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কি পেনাল্টি দিবে সে? ঠিক তখন ই ফোন আসে নুশরাতের মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পায়,
“ম্যাডাম, তৌহিদ স্যারের জিপটা এক্সিডেন্ট করেছে, একটা বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ে গিয়েছে। আপনি দ্রুত বুড়িগঙ্গা ব্রীজে চলে আসুন ম্যাডাম”
বলেই ফোনটা কেঁটে দেয় লোকটি। নুশরাতের হৃদস্পন্দন মূহুর্তের মধ্যেই বেড়ে যায়। হাত থেকে ফোনটি পড়ে যায় নুশরাতের। মাথার পেছনটা যে অভিকর্ষণের দিকে ঝুকে যাচ্ছে। মূহুর্তের জন্য মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বুকটা কাঁপছে। ‘আগুন্তক’ নামের লোকটি কি এই পেনাল্টির কথাটাই বলছিলো। ইশরার জীবনের পরিবর্তে কি তৌহিদকে হারাতে হবে! অজান্তেই চোখ জলে টুইটুম্বর হয়ে গেলো নুশরাতের। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদার সময়টা নেই। এখন ই তাদের বুড়িগঙ্গা ব্রিজে যেতে হবে। নুশরাত উঠে দাঁড়ালো, ফোনটা হাতে নিয়েই ছুটে বেড়িয়ে গেলো ইশরার রুম থেকে। নুশরাতকে ছুটতে দেখে পারভীন বেগম প্রশ্ন করে উঠলেন,
“কোথায় যাচ্ছিস মা? তৌহিদ ফোন করেছে?”
“মা ইশরাকে পাওয়া গিয়েছে, তৌহিদ ওকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে, তৌহিদের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি ওখানেই যাচ্ছি, দোয়া করো মা, যাতে ও সুস্থ হয়ে উঠে। আমি ওখানেই যাচ্ছি।“
“তুই একা যাবি কেনো? আমিও যাচ্ছি। বিপদে বিপদ বাড়ে, তুই একা যাস না।“
“না মা তুমি বাসায় থাকো, আমি তোমাকে ফোন করবো। চিন্তা করো না, তুমি ওখানে গেলে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমি এক্সিডেন্টের জায়গায় যাচ্ছি। ওখানে এখন ভিড়, অশৃঙ্খলা থাকবে। জিদ করো না মা। আমি রহিমা আন্টিকে বলছি তোমার সাথে থাকতে।“
পারভীন বেগম তাকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু অতঃপর তিনি ব্যার্থ হন। নুশরাতের কথার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিলো। একেই একটা একটা এক্সিডেন্ট স্পট, উপরে বুড়িগঙ্গা ব্রিজ, ভীড়, ঠেলাঠেলি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। পারভীন বেগমকে সেই স্থানে নিয়ে যাওয়াটা ঝুকিপূর্ণই হবে। তাই একা একাই বেড়িয়ে গেলো নুশরাত। তার শরীর চলছে না। তার মনে হচ্ছে, তার পায়ে যেনো কেউ পাথর আটকে দিয়েছে। মনের জোর ও হার মেনেছে। সিএনজি তে উঠে তৌহিদের ফোনে ফোন করলো নুশরাত। না মোবাইলটা বন্ধ। বিকেলে শেষ দেখেছিলো লোকটিকে, এখন কি অবস্থায় আছে কে জানে। চোখের নোনাজলের বিদ্রোহ থামাতে পারছে না নুশরাত, আফসোস হচ্ছে তার। কেনো গতরাতে লোকটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো, কেনো তার প্রেম নিবেদনটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো! লোকটির প্রতি তার অনুভূতি গুলো যে আজও জীবন্ত, কথাটা অস্বীকার করবে কি করে সে! এটা যে নিরন্তন সত্য। পরম করুনাময়ের সাথে একটাই আকুতি নুশরাতের, লোকটি যেনো তার জীবন থেকে হারিয়ে না যায়। নতুন করে জীবনটা সাজানোর স্বপ্ন দেখিয়ে কেঁড়ে নেওয়ার থেকে নিষ্ঠুর ব্যাপার হয়তো আর কিছুই হবে না। এই নিষ্ঠুর অবিচারটা যেনো এবার অন্তত তার সাথে না হয়, তাহলে জীবন্ত লাশের ন্যায় বাঁচতে হবে তাকে। এটাই বাস্তব_______
হাসপাতালের ফরমালিটিস কমপ্লিট করেছে তৌহিদ। ইশরাকে আইসিউ তে রাখা হয়েছে। শারীরিক কোনো ইঞ্জুরি পাওয়া যায় নি তার। শুধু ব্রেইনে অক্সিজেন কম পৌছানোর কারণে সাময়িক অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারের ধারণা, ইশরার “claustrophobia” রয়েছে। তাই বদ্ধ স্থানে আটকে থাকার কারণে সে আতংকিত হয়ে যায়, তাই তার শারিরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। উপরন্তু তাকে হাই ডোজের ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে, সেকারণেও তার মস্তিষ্ক ধীর হয়ে গিয়েছিলো। অক্সিজেন পরিমান মতো পাচ্ছিলো না তার শরীর। এখন তার প্রেসার, অক্সিজেন স্যাচুরেশন মোটামোটি নরমাল, ট্রমা কমাতে রিল্যাক্সিং মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। এখন সে ঘুমোচ্ছে, আগামীকাল সকালে জ্ঞান ফিরবে। তৌহিদ হাফ ছেড়ে উঠলো। ইশরাকে বাঁচানো গেছে এটাই অনেক। এখন তার আর ক্রিমিনালের মাঝে মাত্র এক কদমের দূরত্ব। ইশরার জ্ঞান ফিরলেই সব ঝামেলার অন্ত হবে। করিডোরে বসতে বসতে বললো,
“হাবীব এককাপ এক্সপ্রেসো খেলে মন্দ হতো না।“
“খালি পেটে কফি খেয়েন না স্যার, বমি হবে। আপনি লান্স ও করেন নি।“
“কথাটা সঠিক, তুমি দশে দশ পেয়েছো।“
“স্যার আমি বলি কি, আপনি বাসায় যান। নাম্বার মালিক এক রাত হাজতে থাকুক। সকালে এমনেই সব উপড়ে দিবে। ম্যাডাম ও টেনশন করছেন। উনাকে জানানো হয় নি।“
“ভালো কথা মনে করিয়েছো, এতো টেনশনের মধ্যে আমি নুশরাতকে জানাতেই ভুলে গেছি। এখন ই ওকে একটা ফোন করছি।“
বলেই ফোনটা বের করে তৌহিদ। ফোনটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। হয়তো চার্জ শেষ। অথচ তার সেদিকে খেয়াল ই ছিলো না। নুশরাত হয়তো তাকে ফোন করেছিলো, বন্ধ থাকার জন্য ফোনটা তার অবধি পৌছাতে পারে নি। তৌহিদ একটু জোরেই “ধ্যাত” বলে উঠে। হাবীব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে স্যার?”
“তোমার ফোনটা দাও তো। আমার মোবাইলে চার্জ নেই।“
“এই যে”
বলেই ফোনটা এগিয়ে দেয় হাবীব। তৌহিদ ক্রমাগত নুশরাতকে ফোন করে। কিন্তু অপর পাশ থেকে শুধু একটা কথাই শোনা যাচ্ছে,
“কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন”
তৌহিদ বিরক্ত হয়ে উঠলো। এর পরে পারভীন বেগম কে ফোন করলো। পারভীন বেগম ফোন রিসিভ করলে সে বলে,
“আন্টি আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম সালাম, কে বলছেন?”
“আন্টি আমি তৌহিদ, নুশরাত কোথায়?”
“বাবা তুমি ঠিক আছো তো? যাক আলহামদুলিল্লাহ। তোমার এক্সিডেন্টের কথা শুনেই ছুটে বেড়িয়ে গেছে। আমি যেতে চেয়েছি, ও শোনে নি। যাক তুমি ঠিক আছো। নুশরাত বুড়িগঙ্গা ব্রীজের ওখানে যাচ্ছে।“
“আন্টি আমার তো এক্সিডেন্ট হয় নি, আমি ইশরাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।”
“কি বলো বাবা, নুশরাত তো তাই বললো। আল্লাহ, তাহলে নুশরাত কোথায় ছুটলো?”
“টেনশন কইরেন না আন্টি। আমি দেখছি।“
বলেই ফোনটা কেটে দেয় তৌহিদ। চুল গুলো দুহাত দিয়ে আকড়ে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এবার এক আর একে দুই মিলাতে পারছে সে। ক্রিমিনালের টার্গেট ইশরা কখনোই ছিলো না, তার টার্গেট ছিলো নুশরাত। এখন কাউন্টডাউন ঘড়ির সময়টা শেষ হতে আর দু মিনিট বাকি আছে। সে সবার চিন্তার সুই ইশরার কেন্দ্রভুত করেছে। ফলে ফাঁক বুঝে নুশরাতের উপর আক্রমণ করেছে সে। সে ভাল করেই জানতো নুশরাত বাড়ি থেকে বের হবে না সহজে, তাই তৌহিদের বাহানা করে তাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। তৌহিদের শরীর কাঁপছে। তার গলা শুকিয়ে আসছে। হাবীব তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?”
“আমাদের হাতে সময় নেই হাবীব, শয়তানটার দৃষ্টি নুশরাতের উপর। এখনি বুড়িগঙ্গা ব্রিজের ওখানে যেতে হবে। কোনো প্রশ্ন করো না, জিপ বের করো।“
“জ্বী স্যার।“
তৌহিদ উঠে দাঁড়ালো, তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, এবার নুশরাতের কিছু হতে দিবে না। যেভাবেই হোক এই দু মিনিটে ওকে সেখানে পৌছাতেই হবে। সময় কমছে, কমছে, কমছে_________
ব্রীজে পৌছাতেই গা শিরশির করে উঠে নুশরাতের। এখানে কোনো ভিড় নেই। রোডলাইটটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লোকের যাতায়াত বেশ কম। তার ফোনে যে নাম্বারটি থেকে ফোন এসেছে তাকে সে চিনে না, নাম্বারটি অজানা। সেই লোকটির কন্ঠস্বর ও বেশ অচেনা। বেশ মিহি কণ্ঠ, তবে মনে হচ্ছে লোকটির বয়স কম। কথা বলার ধরণ বেশ মার্জিত। আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলালো নুশরাত। দেখে মনে হচ্ছে না এখানে আদৌ কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে; পুলিশের জিপ পানিতে পড়ে গেছে এটা তো যেনো অবিশ্বাস্য। কোনো কোলাহল নেই, লোকের চলাচল স্মিত। এখন ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যাচ্ছে, কেউ তাকে ফাঁদে ফেলানোর জন্যই এই কাজ করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুশরাত। মোবাইলটা বের করে সেই নাম্বারটায় ফোন করে সে। নাম্বারটা খোলা, ফোন বাজছে। নুশরাত খেয়াল করলো তার ঠিক পেছনেই একটা ফোন বাজছে। সে চমকে উঠে পেছনে তাকায়। একটা কালো টিশার্ট পড়া লোক তার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটির মুখ আধারের কারণে দেখা যাচ্ছে না। নুশরাত ভ্রু কুচকে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
“কে! আপনি?”
“আপনার শুভাকাঙ্খি, উকিল ম্যাডাম”
লোকটির কথাটা শেষ হতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করলো নুশরাত। কেউ পেছন থেকে সজোরে আঘাত করেছে তার মাথায়। ঝনঝনিয়ে উঠেছে মাথাটা, তরতর করে ঝরছে রক্ত। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথাটা তলিয়ে যাচ্ছে। সে কি মারা যাচ্ছে? বাঁচার উপায় কি নেই তার? ফিসফিসে কন্ঠ কানে আসছে,
“এবার হিসেব মেলাতে হবে উকিল ম্যাডাম, অনেক হিসেব যে বাকি…………
চলবে…
দৃষ্টির_অগোচরে
দ্বিতীয়_অধ্যায়
১৫তম_পর্ব
লোকটির কথাটা শেষ হতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করলো নুশরাত। কেউ পেছন থেকে সজোরে আঘাত করেছে তার মাথায়। ঝনঝনিয়ে উঠেছে মাথাটা, তরতর করে ঝরছে রক্ত। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথাটা তলিয়ে যাচ্ছে। সে কি মারা যাচ্ছে? বাঁচার উপায় কি নেই তার? ফিসফিসে কন্ঠ কানে আসছে,
“এবার হিসেব মেলাতে হবে উকিল ম্যাডাম, অনেক হিসেব যে বাকি। ওয়ান ডান, ওয়ান টু গো”
কিসের হিসেবের কথা বলছে লোকটি? সে কি নুশরাতকে আগ থেকে চিনে? অজান্তে কখনো কি তার কোনো ক্ষতি করেছিলো নুশরাত? না আর ভাবতে পারছে না সে, মাথায় তীব্র ব্যাথা অনুভব করছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাবার কারণে লোকটির চেহারাটা আন্দাজ করতে পারছে না নুশরাত। তবে এই কন্ঠটা আগেও কোথাও শুনেছে, পরিচিত কন্ঠ। কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করছে নুশরাত, কিন্তু মাথায় ঝিম ধরে আছে। তার মনে হচ্ছে সে গভীর নীল সাগরে ডুবে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে অজানা গভীরে, যেখানে তল পাওয়া ভার। বৃষ্টি নেমেছে, রক্ত এবং বৃষ্টি মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো তৌহিদের স্নিগ্ধ মুখখানা আর দেখা হলো না নুশরাতের। একটি বার, একটি শেষবার দেখতে চায় সে। দেখতে চায় তৌহিদকে, তার শক্ত বাহুর আলিঙ্গনে নিশ্চুপ সময় ব্যতীত করতে চায় সে! প্রকৃতি কি সেই সময়টা দিবে? হয়তো, হয়তো না_______
ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছে হাবীব। কাউন্টডাউন ঘড়িতে আর সুয় রয়েছে ত্রিশ সেকেন্ড। এই ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে তাদের সেই স্থানে পৌছাতে হবে। এই ত্রিশটা সেকেন্ড অর্থাৎ আধা মিনিট শেষ হলে নুশরাতের জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে তৌহিদের তা জানা নেই। উত্তেজনায় তার বুক কাঁপছে, ঘামে ভিজে যাচ্ছে চুলের গোড়া। অল্প কিছুসময়ের পথটুকুও যেনো হাজারো ক্রোশ দূর মনে হচ্ছে। এই ভয়টি বিগত কিছুদিন তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ভয় পেয়েছে নুশরাতকে হারাবার। এজন্য বারংবার মানা করেছিলো সে যাতে মেয়েতী ঘর না ছাড়ে। কিন্তু কবে নুশরাত তো নুশরাত, সে কবে তৌহিদের কথা শুনেছে যে আজ শুনবে। তৌহিদ ঠোঁট কামড়ে বসে রয়েছে, তার চোখ মুখ খিঁচে রয়েছে। পুরুষদের কাঁদা বারণ, দূর্বল হওয়া বারণ। মেয়েদের কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় না কাঁদতে, তাদের যখন ইচ্ছে হয় তারা তখন কাঁদতে পারে। কিন্তু পুরুষেরা কাঁদলে তা চক্ষুশূল হয়ে যায় সমাজের কাছে। এতো বৈষম্য কেনো! কেনো!
জিপ দাঁড়ালো ব্রীজের উপর, কাউন্টডাউন ঘড়ি বেজে উঠেছে, সময় শেষ। অঝর ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আধার চুয়ে পড়েছে নদীর বুকে। শীতল পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে তৌহিদের শরীর। ঘড়িতে ঠিক কটা বাজে না নেই তৌহিদের। হাবীব আশপাশ টা দেখতে লাগলো। মানুষের চলাচল শুন্যপ্রায়। শান্ত কালো নদীর পারে নৌকা গুলো বাঁধা, মাঝিরা বাড়ি চলে গিয়েছে। সবজি ওয়ালা তার সবজির ঝুড়ি কাঁপড় দিয়ে বাঁধছে। অবিক্রিত সবজিগুলোতে পানিতে ভিজিয়ে রাখবে সে। টঙের দোকান চা ঝাল দিচ্ছে, তার সময় এখনো শেষ হয় নি। ফলের দোকানী তার শাটার দিচ্ছে। আলো বলতে গাড়ির হেডলাইট আর দোকানের এনার্জি বাল্ব। তৌহিদ হন্তদন্ত করে সব জায়গা খুজছে, নেই তার নুশরাত। হঠাৎ হাবীব চিৎকার করে উঠে,
“স্যার, এখানে”
তৌহিদ ছুটে গিয়ে দেখে এক জায়গায় কিছু রক্তের কুন্ডলী, বৃষ্টির কারণে পরিমাণ বোঁঝা যাচ্ছে না। তবে এখনো যেতেহু ধুয়ে যায় নি, তাই বলাই যায় রক্তের স্রোত মন্দ ছিলো না। তৌহিদ হাটু গেছে কর্দমাক্ত মাটিতে বসে পড়ে। তার চোখ বিদ্রোহ করছে। নোনা জলের বাঁধ ভেংগে গেছে। বৃষ্টির পানির স্রোতের সাথে সেই নোনা জল মিশে যাচ্ছে। তার জিন্সে কাঁদা লেগে যাচ্ছে কিন্তু তার হুশ নেই। সে ‘নুশরাত’ বলে চিৎকার করছে। বা হাতটা মুঠো করে মাটিতে সজোরে আঘাত করতে, খোয়া, ইট, পিচের অমসৃণ উচ্ছিষ্টে হাত হাতের খানিকটা কেঁটে ছিলে যাচ্ছে। রক্ত ঝরছে, বৃষ্টির পানির সাথে গাড় লাল রক্তের মিলনে লালচে পানি রাস্তায় ভেসে যাচ্ছে। হাবীব তৌহিদকে আটকাতে চায় কিন্তু লাভ কি! অবশেষে তৌহিদ ও তো রক্ত মাংসের মানুষ। তার ও হৃদয় আছে, সেখানেও অনুভূতি আছে। তার মনের বিস্ফোরণটা স্বাভাবিক। রাস্তার মানুষেরা ঘুরে ঘুরে তৌহিদকে দেখছে। তাদের চোখে কৌতুহল এবং বিদ্রুপের মিশ্র ছাপ। এতো দামড়া লোক রাস্তায় পাগলামি করলে তো মানুষ টিটকারী মারবেই। হাবীব তৌহিদকে টেনে উঠায়, ধীর স্বরে বলে,
“স্যার, কেঁদে ভাসানোর সময় নেই, এই সময় নিজেকে শক্ত রাখুন। ম্যাডাম বেঁচে আছেন। হয়তো আহত। কিন্তু বেঁচে ঠিকই আছেন। শয়তান যতই চালাক হোক তাকে হারতে হবেই, এটা আল্লাহ পাক নির্ধারিত করে রেখেছেন। তাই শক্ত হন। আপনি এখন ম্যাডামের শেষ ভরসা। শক্ত হন।“
তৌহিদের কন্ঠে আর্তনাদ, চোখ টলমল, কদম অবিন্যস্ত। কিভাবে শক্ত হবে সে! যে দৃষ্টির অগোচরে তার সাথে লড়াই কি এতো সোজা!
মৃদু আলো চোখে পড়ছে নুশরাতের। মাথা ঝিমঝিম করছে, মাথার পেছনে তীব্র চিনচিনে ব্যাথা নিজেকে জাহির করে বলছে, ‘আমি আছি’। টিপটিপ করে চোখ খুললো নুশরাত। সে কোথায় আছে, ঠাহর করার চেষ্টা করলো সে। এতা কি জান্নাত নাকি জাহান্নাম, কোনটা? নাকি কবরের সে সময় চলছে। যেখানে তাকে প্রশ্ন করবে ফেরেস্তা। তিনটি প্রশ্ন, উত্তর দিলে মুক্তি, না দিতে পারলে কবরের আজাব। মায়ের কাছে শুনেছিলও, এই আজাব নাকি খুব কঠিন। শরীর, রুহ পিসিয়ে ফেলে। তখন দোয়া ভিক্ষা চাইতে হয়ে পরম করুনাময়ের কাছে। নুশরাত চোখ ঘুরিয়ে তার অবস্থান পরীক্ষা করছে। সে কি কবরের নিচে? নাকি উপরে। বুঝতে সময় লাগলেও সে বুঝতে পারছে সে মারা যায় নি। বরং তাকে একটি অন্ধকার রুমে রাখা হয়েছে। একটা অন্ধকার রুম যেখানের শুধু একটা ছোট জানালা, হয় ৪ বাই ৪ হবে সাইজ। শিকলে মরিচা পড়েছে। সেই জানালা দিয়ে বাহিরের রুপালী সাদা আলো ঘরে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। নুশরাত উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা ঘুড়িয়ে উঠেছে, কিন্তু দেয়ালে হাত রেখে সামলে নিলো সে। ঘরটি বড়। তবে ফাঁকা, বাথরুম লাগোয়া। ঘরটির দেয়ালে আকাউকি করা, কিন্তু আধারের খেলায় ঠিক বুঝতে পারছে না কি আঁকা রয়েছে তাতে। মাথার পেছনে আঘাতের কারণে দৃষ্টি এখনো ঝাপসা। নুশরাতের এখন মনে পড়তে লাগলো, তখন কি হয়েছিলো। মনে পড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। সূক্ষ্ণ ভাবে কেউ তার খেলাটা সাজিয়েছে। নুশরাত হন্যে হয়ে তার মোবাইল খুজতে লাগলো। নাহ এখানে কিছুই নেই। শুধু আহত সে এবং তার একাকীত্ব। নুশরাত দরজার কাছে গেলো। সজোরে আঘাত করছে। চিৎকার করছে,
“দরজা খোলো, আমাকে এখানে আটকে রাখার কি মানে? আরে কাপুরুষ, সাহস থাকলে সামনে এসে আক্রমণ কর। এভাবে লুকিয়ে কাওয়ার্ডের মতো কেনো আক্রমণ করছিস? শালা বাস্টার্ড, শুয়োর। খোল দরজা। সাহস নেই? মায়ের দুধ খাস নি নাকি মা******। খোল দরজা”
কোনো সাড়া নেই, আদৌ দরজার ওপারে কেউ আছে কি না তার জানা নেই। খামোখা চিৎকার করছে সে। এখানে চিৎকার করে গলা ফাটালেও কেউ কিছু জানবে না। কারণ তার আশেপাশের পল্লী নিরব। পানির স্রোতের আওয়াজ কানে আসছে। পানি উপরে ভাসছে কি তবে? নুশরাত শান্ত হয়ে গেলো। মাথা গরম করে আসলেই লাভ নেই, এটা খেলা চলছে, নিপুন খেলা। ‘আগুন্তক’ নামক ব্যাক্তিটি তার পৈশাচিক আত্নতৃপ্তির জন্য একতা ভয়ানক জাল বুনেছে। যেমনটা বিষাক্ত মাকড়সা করে থাকে। তারা শীকারের জন্য জাল বুনে, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে। শীকারের সামনে ভালো সেজে থাকে, শীকার তাই নিজের সতর্কতার ঢাল নামিয়ে দেয়। ফলে অজান্তেই এই বিষাক্ত জালে নিজেকে পেঁচিয়ে ফেলে। আতংকে তখন নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রান চেষ্টা করে। কিন্তু ছাড়ানোর বদলে আরো বাজে ভাবে জড়িয়ে পড়ে। তখন ধীরে ধীরে তার জীবনী শক্তি কমতে থাকে, শেষ পর্যন্ত দম ছেড়ে মৃতুর দিকে পা বাড়ায় নির্বোধ শীকার। এখানে নুশরাত সেই নির্বোধ শীকার। তাই ধৈর্য হারিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলেই তার খেলা শেষ। তাকে বুদ্ধির প্রদর্শন করতে হবে। তার মস্তিষ্কের মরীচা পড়ালে হবে না, প্রতিটা কদম ধীর গতিতে ফেলতে হবে। যদিও সে নিরস্ত্র, কিন্তু তার বুদ্ধি হবে এখান থেকে বাঁচার উপায়। তাই চুপ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখতে লাগলো নুশরাত। কিছু বাদে বুঝতে পারলো সে একটা লঞ্চের কেবিনে আছে। অর্থাৎ পানিতে। এখন এই পানিপথে বাঁচার উপায় কি? কোনো ফাঁক কি রয়েছে? হঠাৎ থমকে গেলো নুশরাত। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ ঘষে ঘষে এগোচ্ছে তার রুমের দিকে। কে সে!
রাত পেরিয়ে ভোরের সোনালী আলো পড়ছে তৌহিদের উপর। বৃষ্টি থেমে গেছে। তার ভেজা জামা শুকিয়ে গেছে। কাঁদা বালি আর মাটিতে পরিণত হয়েছে। তার চোখ লাল হয়ে আছে। সারারাত ঘুম নেই, খাওয়া নেই; অজানার পেছনে ছুটছে সে। বুড়ীগঙ্গা ব্রীজ তন্ন করে খঁজা হয়েছে, না কোথাও কোনো ক্লু নেই। উপস্থিত কেউ ই কোনো মেয়েকে কিডন্যাপ করতে দেখে নি। অর্থাৎ কোনো এলিবাই নেই। আগের বার ও অজানা মানূষের পেছনে ছুটেছিলো সে। স্নিগ্ধের মতো ধূর্ত ব্যাক্তির ভালো মানুষী মুখোশ খুলতে পেরেছিলো সে। কারণ শত মিথ্যের মাঝেও সত্যের আলো ছিলো। স্নিগ্ধের সকল গল্প যে মিথ্যে ছিলো সেটার প্রমাণ ছিলো রেস্টুরেন্টের ছবি। স্নিগ্ধ তার এলিবাই এর কাহিনী সম্পূর্ণ বানিয়ে বলেছিলো সেটার প্রমাণ তৌহিদ পায় সেই রেস্টুরেন্টের ছবির দেয়ালটা দেখে। তখন তার মস্তিশকের নিউরণ জানান দেয়, এই ব্যাক্তি ছবি দেখে কাহিনী বানিয়েছে। আবার রবিনের উপর সন্দেহ তৌহিদের তখন হয় তখন আউট অফ নো হোয়ার রবিন স্নিগ্ধের কেস নুশরাতের কাছে নিয়ে যায়। সে চাইলেই নিজে স্নিগ্ধের উকিল হতে পারতো, কিন্তু সে তা করে নি। উপরন্তু রবিনের বাসা থেকে নুশরাত কিছু ছবি জোগাড় করে যা ছিলো প্রমাণ ,রবিনের আনন্দমোহন ভার্সিটির ছাত্র হবার এবং মাহিরদের সাথে পরিচিতির। কিন্তু এবার কোনো ক্লু নেই। কোন পথে আগাবে সেটাও বুঝে পাচ্ছে না তৌহিদ। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে হাবীব তার কাছে ছুটে এলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার, ব্যাপক ব্যাপার। ইশরার জ্ঞান ফিরেছে…………
চলবে…
মুশফিকা রহমান মৈথি