দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,৬ষ্ঠ_পর্ব,৭ম_পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,৬ষ্ঠ_পর্ব,৭ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৬ষ্ঠ_পর্ব

“হতেই পারে, আতিয়ার সাহেবের সাথে ঝগড়া করে উনার প্রেসার বেড়ে গিয়েছিলো। তিনি ব্যালেন্স না করতে পাড়ায় পড়ে গিয়েছেন। হাই প্রেসারের রোগীদের প্রেসার বেড়ে গেলে শরীর ব্যালেন্স এ থাকে না। পড়ে যাওয়ায় মাথাটা সিড়িতে আঘাত পেয়েছে। ফলে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। যতক্ষনে আতিয়ার সাহেব বাসায় এসেছেন সি ওয়াজ ডেড।“

স্বর্ণের কথা শুনে মাথায় হাত পড়ে নুশরাতের। এইভাবে সে চিন্তাও করে নি। স্বর্ণের ধারণা যৌক্তিক। নুশরাত গদগদ হয়ে বলে,
“অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি তো আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন।“
“স্বাগতম। কিন্তু আফসোস, এটা আপনি কোর্টে প্রমাণ করতে পারবেন না।“
স্বর্ণের কথায় কপাল কুচকে যায় নুশরাতের। তার চাহনী দেখে স্বর্ণ গা জ্বালানো হাসি দেয়, তারপর বলে,
“কারণ তার ডেড বডি অলরেডি কবরে। আতিয়ার সাহেবের প্রেমঘটিত সমস্যাটির কারণে এই পয়েন্টটা কোর্টে উপস্থাপন করলেও এটাকে কাউন্ট করা হবে না। ইতির কোনো প্রেসক্রিপশন এখানে নেই। ওটা ছাড়া উনার হেলদ ইস্যু প্রমাণ করা অসম্ভব।“

স্বর্ণের কথায় পুনরায় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো নুশরাত। আতিয়ার সাহেব এবং ইতির বিয়ের মূল সমস্যা আতিয়ার সাহেবের পরকীয়া। তিনি বিগত ছয় মাস এক নারীতে মত্ত হয়েছেন। যা কোনো ভাবে ইতির কানে যায়। এই কথাটা কিছুতেই সহ্য করতে পারে নি ইতি। ফলে তাদের মাঝে দৈনিক কলহ লেগেই থাকতো। আতিয়ার সাহেব বেশ কয়েকবার ডিভোর্সের কথাও তুলেন। কিন্তু ইতি তাতে রাজী হয় নি। ইতির মৃত্যুর দিন তাদের মাঝে ঝগড়াটিও যে কারণেই হয়। হাতের কাছের কলমটা নাড়াতে নাড়াতে আনমনে নুশরাত কথাগুলো ভাবতে থাকে। হঠাৎ হাতটা থামিয়ে বলে উঠে,
“যদি আমরা আতিয়ার সাহেবের বাসায় তল্লাশি করি তবে কোনো না কোনো ক্লু পেতেই পারি?”
“লুকিয়ে লুকিয়ে বোমক্যাশ বক্সী হবার শখটা এখনো রয়েছে দেখছি?”

গলা খাদে নামিয়ে কথাটা বলে স্বর্ণ। স্বর্নের বিদ্রুপের স্বরে বলা কথায় হতচকিত হয়ে উঠে নুশরাত। অবাক কন্ঠে বলে উঠে,
“কিছু বললেন?”

তখন স্বর্ণ ঠোঁটের কোনে রহস্যমাখানো হাসি দিয়ে বলে,
“না, কিশোরী বয়সে ফেলুদা আর তিন গোয়ান্দা পড়ে সবার নিজেকে সত্যান্বেসী বোমক্যাশ মনে হতো, এই ব্যাপারটা আপনার মাঝে এখনো রয়েছে দেখে অবাক হলাম। আমরা উকিল। আমাদের কাজ ওকালতি করা, এইসব তল্লাশির মাঝে না যাওয়াই উচিত।“

স্বর্ণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না নুশরাত, সে ঠিক কি ইঙ্গিত করতে চাচ্ছে? কিন্তু মেজাজটা অত্যধিক খারাপ হলো তার। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“আমার ক্লাইন্টের জন্য যদি আমাকে বোমক্যাশ ও হতে হয় আমার তাতে আপত্তি নেই। সুতরাং এই ফ্রি জ্ঞান নিজের কাছে রাখুন। আর ধন্যবাদ, হেল্পের জন্য।“

বলেই উঠে দাঁড়ায় নুশরাত। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সত্যান্বেসে। স্বর্ণ নুশরাতের যাবার পানে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি শুধু নুশরাতকেই অনুসরণ করছে। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের বক্সটা বের করে সে। বেনসনের নতুন প্যাকেটটা খুলে একটা সিগারেটে অগ্নিশিখা ছোয়ায়। দু তিনটে টান দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
“সত্যান্বেসী হওয়াটা মাঝে মাঝে লোকশানজনক হয় উকিল ম্যাডাম।“

বলেই নিকোটিনের ধূসর ধোয়া ছাড়তে থাকে সে। আহা কি শান্তি এই নিকোটিনের জ্বলন্ত টানে_________________

রাত ১১টা,
ব্যালকনির রেলিং এ রাখা গরম চায়ের মগটি থেকে ধোয়া উড়ছে। দেশের নিম্নচাপের প্রভাব কমে যাওয়ায় এখন বর্ষার প্রতাপ বেশ কমে গিয়েছে। কালো মেঘেরা দল বেধে ঘুরে বেড়ায় ঠিক ই কিন্তু কাঁদে না। বরং জ্বালাময়ী গরমে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। গরমে কালো পিচের শহরটাকে অগ্নিকুন্ডুর চেয়ে কম লাগছে না। এর মাঝে মানুষ সাধারণত বরফ গলিত শরবত খেতে বেশি পছন্দ করে, কিন্তু নুশরাত একটু আলাদা। তার ঘন্টায় ঘন্টায় চা খাবার বাজে অভ্যাস রয়েছে। এবং সেই চা ধোয়া তোলা অবস্থায় খেতেই বেশী ভালোবাসে। আর মাথা গরম থাকলে তো কথাই নেই। আজকের দিনটা ঠিক সেই রকম। প্রথমে স্বর্ণ নামক ব্যাক্তিটি তাকে উত্যোক্ত করে মাথার মগজ জ্বালিয়ে ফেলেছে, পরে ইতির বাসায় প্রবেশের কোনো উপায় না করে উঠার কারণে নিজের উপর ই বিরক্ত হয়ে গিয়েছে সে। উপর থেকে তৌহিদ নামক লোকটি একটা ফোন অবধি অরে নি। ফোনের স্ক্রিনে বারবার চেক করলেও ফলাফল শূন্য। লোকটি বলেছিলো সে নাকি মনের মানুষ এবং মানুষের মন দুটোই এবার জিতবে। কিন্তু সে তো ডুমুরের ফুল হয়ে গিয়েছে। নুশরাতের বুক চিরে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। যাক এটাও ভালো, নতুন করে দূর্বল হতে যায় না সে। এই দূর্বলতা কাটাতে বহু বছর লেগেছিলো তার। এবার দূর্বল হয়ে পড়লে হয়তো ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটবে। অতীতের সুবর্ণ মূহুর্তগুলো থাকটা ওভাবেই। সেগুলোর মাঝে থাকা নীল ভালোবাসাটা থাক না ওভাবেই। চায়ের কাপে চুমুক দিলো নুশরাত, নীলচে আধার আকাশে কালো মেঘ জমছে ধীরে ধীরে। হাওয়া ঘন হয়ে আসছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। হোক, তাহলে রাতে ভালো ঘুম হবে। নুশরাত রুমের দিকে পা বাড়ালো তখনই ফোনটি বেজে উঠে তার। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালে দেখতে পায় “তৌহিদ” নামটি ভেসে উঠেছে। নামটি দেখা মাত্র হাজারো অভিমান মনকে ঘিরে ধরে তার। ফোনটি কেটে দেয় সে। কিন্তু তৌহিদ তো নাছোড়বান্দা। সে ক্রমাগত ফোন করতে থাকে। টানা পনেরো বার কেটে দেবার পর ফোনটা রিসিভ করে নুশরাত। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
“ডাকাত পড়েছে ঘরে? এতোফোন দিচ্ছেন কেনো?”
“নিচে আসো।“
“পাগল নাকি? কেনো?”
“কারণ আমি নিচে। আসো না।“
“মাথা কি একেবারেই গেছে নাকি?”
“না যায় নি এখনো সুস্থ। তবে তুমি নিচে না এলে হয়তো পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে?”

নুশরাত বেক্কল বনে গেলো। কোন পাগল রাত এগারোটার সময় একটা মেয়েকে নিচে নামতে বলে। নুশরাত এক রাশ বিরক্ত নিয়ে বলে,
“পারবো না।“
“প্লিজ নামো না। না আসলে আমি সারারাত এখানেই থাকবো বলে দিলাম। দারোয়ান আমাকে ধরলে দোষ কিন্তু তোমার হবে। বলে দিলাম।“
“আচ্ছা জ্বালা তো!”
“ওহে প্রেয়সী, প্রেমের জ্বালা এমন ই হয়।“

তৌহিদের কথা শেষ না হতেই ফোনটা কেটে দেয় নুশরাত। নিচে না যেয়ে উপায় নেই। ব্যাটা যদি সারাটা রাত তার বাড়ির নিচে থাকে তবে একটা কেলেঙ্কারী বাধবে। তাই বাধ্য হয়েই চোরের মতো চাবি নিয়ে নিঃশব্দের বের হলো নুশরাত। পারভীন বেগম তখন গভীর ঘুমে। অবশ্য চাবী নেবার সময় ইশরার কঠিন জেরার সম্মুখীন হয়েছে সে। ছোটবোনগুলো এতো ত্যারা কেনো হয় ব্যাপারটা এখনো রহস্য! নুশরাতের নিজেকে একটা কিশোরী মনে হলো, যে কিনা তার প্রেমিকের সাথে রাত বিরাতে ঘুরতে বের হচ্ছে। ধরা খেলেই একটা কিল ও মাটিতে পড়বে না। এই কাজগুলো বারো বছর পূর্বে অনেক করেছে সে। রাতের বেলায় তৌহিদের বাইকে চড়ে লং ড্রাইভ। তখন এডভেঞ্চার জিনিসটার কথা ভাবলেই উম্মাদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তো নুশরাত। এখন সেই আবেগগুলো বয়সের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। তৌহিদ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুশরাতের ঝলক দেখেই ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি ফুটে উঠলো তার। মেয়েটি একটি কালো রঙ্গের সালোয়ার কামিজ পড়ে রয়েছে। কোকড়ানো চুলগুলো কাধ বেয়ে সাপের মতো নেমেগিয়েছে কোমড় অবধি। অতিসাধারণ গড়নের মাঝেও অসাধারণ লাগে মেয়েটিকে তৌহিদের। স্নিগ্ধ মুখখানা সোনালী আলোতে স্বর্ণের মতো চিকচিক করছে। নুশরাত তৌহিদের সামনে এসে দাঁড়ালো। অগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে কড়া কন্ঠে বললো,
“রাত বিরাতে কি মাথার স্ক্রু গুলো ঢিলা হয়ে যায় আপনার?”
“যদি তোমার তাই মনে হয় তবে তাই!”
“কেনো ডেকেছেন?”
“বাইকে উঠো, একটা জায়গায় নিয়ে যাবো”
“তৌহিদ!”

নুশরাত তৌহিদকে ডেকে থেমে যায়। তৌহিদ ধীর কন্ঠে বলে,
“শুধু আজকের জন্য, শুধু আমার জন্য।“

নুশরাত আর কোনো কথা বলে না। তৌহিদ বাইক স্টার্ট দেয়। বাইক চলছে, ঠান্ডা হাওয়া যেনো নুশরাতের চোখে, মুখে চুম্বন করছে। আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে তার সারা দেহে। এই অনুভূতি যেনো অন্য নেশার উৎস। আবাসিকের রাস্তা নিরব। অর্ধ শহর ঘুমন্ত। মেইন রোডে উঠতেই স্পিড বাড়ায় তৌহিদ। গাড়ির ভিড নেই। সিগনাল ফাঁকা। বাহু খুলে প্রকৃতির নীরবতাকে আলিঙ্গন করছে নুশরাত। সময় কেটে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এর মাঝে তার কানে আসে,
“ভালোবাসি।“

কথাটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে যায় নুশরাত। চোখ মেলে তৌহিদের দিকে তাকায় সে। তখন তৌহিদ ব্রেক কষে বাইকের। তিনশ ফিটের কাছাকাছি একটা জায়গা। তৌহিদ সেখানে বাইক থামিয়ে দেয়। নুশরাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভালোবাসি…………

চলবে

দৃষ্টির_অগোচরে
দ্বিতীয়_অধ্যায়
৭ম_পর্ব

এর মাঝে তার কানে আসে,
“ভালোবাসি।“

কথাটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে যায় নুশরাত। চোখ মেলে তৌহিদের দিকে তাকায় সে। তখন তৌহিদ ব্রেক কষে বাইকের। তিনশ ফিটের কাছাকাছি একটা জায়গা। তৌহিদ সেখানে বাইক থামিয়ে দেয়। নুশরাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভালোবাসি, কথাটা আরোও নাটকীয় ভাবে বললে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু নাটকীয় ভাবে বলার বয়সটা এখন আর নেই। তাই নাটকীয়তা ছাড়াই বললাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি।“

তৌহিদের কথা শুনে বেশকিছুক্ষণ চুপ করে তাকে নুশরাত। ঠিক কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তার জানা নেই। এই কথাটার অপেক্ষায় একটা সময় সে প্রহর গুনতো। কিন্তু সেগুলো তো বহু পুরনো কথা। এখন পুনরায় সেই অতীত খুড়ে কি হবে? মলিন হাসি একে ঠান্ডা গলায় নুশরাত বললো,
“ভালোবাসা শব্দটির আড়ালে একটি সুগভীর মর্মার্থ লুকিয়ে রয়েছে। আবেগের জালে জড়িয়ে অনুভূতিগুলো গুলিয়ে ফেলেছেন আপনি। তাইতো আকর্ষণকে ভালোবাসা বলে দাবি করছেন। আকর্ষণের মায়া কেটে গেলে এই ভালোবাসার মরীচিকাটাও উবে যাবে। ভালোই তো আছি, পুনরায় আসক্ত হতে চাই না। এই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলাটা মদ কিংবা নিকোটিনের নেশা থেকেও বিপদজনক। তাই এই খেলায় মত্ত হতে চাই না।“

নুশরাতের উদাস কন্ঠে বলা কথাটা শুনে হেসে উঠে তৌহিদ। নুশরাত তৌহিদের হাসির অর্থটি নুঝতে পারে না। কোনো মতে হাসি থামিয়ে তৌহিদ ধীর স্বরে বলে,
“তোমার কাছে আমার অনুভূতিগুলো যদি আবেগ বা আকর্ষণ মনে হয়, আমি প্রতিবাদ করবো না। তোমার চিন্তা, তোমার কাছে সেটা ঠিক। তবে আবেগ নামক শব্দটি বাইশ তেইশ বছরে ছোকরার সাথে যায়, সাইত্রিশ বছরে দামড়া ব্যাটার ক্ষেত্রে খাটে না। আর আকর্ষণ সেটা কিশোরীর প্রতি জন্মায়, একত্রিশ বছরের নারীর ক্ষেত্রে সেটা নয়।
“একত্রিশ বছরের বিধবা নারী”

তৌহিদের কথার মাঝেই বাধ সাধে নুশরাত। তৌহিদ থেমে যায়। নুশরাত খানিকটা এগিয়ে যায়। কালো কুচকুচে পিচের রাস্তায় হাটতে ভালো লাগছে। শরৎ এখনো আসে নি। তাই দুপাশের সাদা মেঘের মেলাটা এখনো বসে নি। তবে জায়গাটার সৌন্দর্য মেঘলা আকাশের নিচেও কমে নি। ঝিরিঝিরি হাওয়া তার কানে নতুন কাব্য লিখছে। আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে তার খোলা চুল। তৌহিদ এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। নুশরাত তার দিকে না তাকিয়েই বলে,
“আমি একজন বিধবা নারী তৌহিদ ভাই। আমাদের সমাজের ঘুনে ধরা কাঠামোতে একজন বিধরা নারীর প্রতি এই আহ্লাদি কান্ডকর্মটা বড্ড বেমানান।“
“তুমি উকিল, যুক্তিতর্ক দিয়ে বিশ্বজয় করতে চাও। কিন্তু আমার প্রেমিক হৃদয় তোমার যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। ব্যাপারটা যেদিন এই উকিলের হৃদয়টাও ভালোবাসায় মেতে উঠবে তখন যুক্তি ভুলে যাবে। যতই সমাজের ঘুনে ধরা কাঠামোর দোহায় দাও না কেনো তোমার অবাধ্য মন কিন্তু আজও বেপরোয়া। তাই তো এই মাঝরাতে আমার সাথে বেড়িয়ে এসেছো।“

নুশরাত উত্তর দেয় না। সে চুপ করে রাস্তার পাশের আধারে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তৌহিদ পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে ধীর কন্ঠে বলে,
“যাই হোক, বারোটা বেজে গেছে। শুভ জন্মদিন।“

আজ নুশরাতের জন্মদিন, অবাককর ব্যাপার তার নিজের ই মনে নেই। অথচ এই লোকটার এতো বছর পর ও তার জন্মদিন মনে আছে দেখে বেশ অবাক হয় নুশরাত। তৌহিদ তার হাতের বাক্সটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার কাছে তোমাকে দেবার মতো কিছুই নেই। সাধারণত জন্মদিনে প্রেমিকার জন্য উপহার কিনে কিশোর-যুবকেরা। কিন্তু সেই বয়সটাই হারিয়ে গেছে। আর প্রেমিকের দাবিটা তোমায় আমি করতে পারবো না। তাই ভাবলাম তোমার জিনিসটাই তোমাকে ফিরিয়ে দিলে হয়তো সেটা তোমার জন্য উপযুক্ত উপহার হবে।“
“আমার জিনিস?”

অবাক হয়ে প্রশ্নটি করে নুশরাত। তৌহিদ তার হাতটি নিয়ে বক্সটি ধরিয়ে দেয়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,
“খুলে দেখো। না পছন্দ হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।“

নুশরাত বাক্সটি খুলে। তাতে একজোড়া রুপোর নুপুর রয়েছে। ডিজাইনটা বেশ পুরোনো। এখন এমন ডিজাইন ঠিক চলে না। নুশরাত প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকা্য। নুশরাতের দৃষ্টির মর্মার্থ বুঝতে দেরি হলো না তৌহিদের। সে বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলে,
“ডিজাইনটা পুরোনো, বারো বছর পুরোনো। এখন এমন ডিজাইন দেখা যায় না। এক যুবকের পিনিক জেগেছিলো যে কিশোরীর প্রেমে পড়েছে তাকে রুপোর নুপুর দিয়ে ভালোবাসার অভিব্যাক্তি জানাবে। তাইও সদ্য পাওয়া চাকরির ক্ষুদ্র বেতনের কিছু অংশ সে প্রতি মাসে জমাতো। শেষমেশ কষ্ট করে সে তার পছন্দের নুপুর জোড়া কিনেও ফেলেছিলো। কিন্তু ভীতু যুবকের আর মনের কথাটা বলা হয় নি। তাই এই নুপুরজোড়া আমার কাছেই থেকে গেছে। তাই আমার মনে হলো আজ সেই ভীত যুবকের মনের অভিব্যাক্তিটা আমি ই করে দেই।“

নুশরাত মাথা নিচু করে রয়েছে। কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। হৃদয়ের মাঝে হাজারো প্রজাপতি ডানা তুলে ধরেছে। তারা উড়তে চায়। উড়তে চায় ভালোবাসার নীল আকাশে। কিন্তু একটা শিকল তাদের ডানা আটকে রেখেছে। এই শিকল থেকে মুক্তির উপায় হয়তো তার নিজের ও জানা নেই। নুশরাতকে চুপ থাকতে থেকে তৌহিদ মনে মনে হেসে উঠে। নিজের দূর্ভাগ্যের উপর হেসে উঠে। তারপর নুপুর গুলো হাতে নিয়ে নিজ হাতে নুশরাতকে পড়িয়ে দিতে নেয়। নুশরাত চমকে উঠে বলে,
“কি করছেন?”
“যার আমানত তাকে পড়িয়ে দিচ্ছি। আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ না করতেই পারো তুমি। কিন্তু এই নুপুরজোড়াকে অগ্রাহ্য করো না।“

নুশরাত আর বাধা দিতে পারে নি। যখন তৌহিদ তাকে নুপুরজোড়া পড়িয়ে দিচ্ছিলো তার লোমকূপ শিউরে উঠছিলো। এক অজানা অনুভূতির স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এসেছিলো। কাব্যের ভাষায় হয়তো একেই “হারানো প্রেমের অনুভূতি” বলা হয়। নুপুর পড়ানো শেষে তৌহিদ ঘাসের উপর রুমাল পেতে বসে। নুশরাত ও তার পাশে বসে। তখন তৌহিদ ধীর কন্ঠে বলে,
“জানো তো নুশরাত, ইহ জীবনে আমি অন্য কোনো নারীতে মত্ত হতে পারি নি। আমি প্রেমে পড়েছি বহুবার। তবে সেই প্রেমটি একটি নারীর প্রতিই। আমি একজন মায়াবন বিহারিনীতে মত্ত ছিলাম। হোক সেটা উনিশ বছরে্র আধাপাগলী, উম্মাদ, বেপোরয়া কিশোরী যে কি না পদে পদে বিপদকে চ্যালেঞ্জ করে। আর হোক সেটা একত্রিশ বছরের রমনী যে পদে পদে যুক্তিতর্কের ঢাল দিয়ে সমাজকে বদলাতে চায়। আমি এই একটি নারীর প্রেমেই নিজেকে ভাসিয়েছি। দায়িত্ব তো কেবল বাহানা! সত্যি বলতে অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসতে হবে ভেবেই বিয়ে থেকে পিছিয়ে আসতাম। তোমার সাথে মাহিরের বিয়েতেও সেই কারণেই আমি উপস্থিত ছিলাম না। সেদিন খুব কষ্ট হচ্ছিলো।“

তৌহিদের আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলা কথাগুলো বুকে তীরের মতো বিধে নুশরাতের। সে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠে,
“আটকাতে পারতেন, তখন বলতে পারতেন।“

নুশরাতের অভিমান দেখে তৌহিদ হেসে উঠে। বিদ্রুপের স্বরে বলে,
“ভীতু কাপুরুষের ন্যায় দরজা আটকে কেঁদেছি। কি মুখে আটকাতাম! যেখানে তুমি তাকে মন দিয়েছিলে।“

নুশরাত চুপ হয়ে যায়, হ্যা বিয়েটা তার মতেই হয়েছে। সত্যি ই তো কি মুখে আটকাতো তৌহিদ! নুশরাত শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকে। আধারের মাঝে দূরে হাজারো আলো জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্কা পিন্ডের মতো লাগছে আলোগুলোকে। কি মনোরম দৃশ্য! রাতের মেঘলা আকাশের নিচে দুজন হারানো প্রেমের সুর খুজছে আধারের মাঝে______________________

নুশরাতের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ এবং নুশরাত। রাত কয়টা বাজে তাদের খেয়াল নেই। তৌহিদের ইচ্ছে ছিলো সূর্যোদয় দেখা। কিন্তু হঠাৎ হাবিবের ফোন আসে। তাই জরুরী ভিত্তিতে থানাতে যেতে হবে তাকে। নুশরাতের গেটের সামনে তাই পৌছে দিতে এসেছে সে। আজ রাতটি অনেক বেশি বিশেষ মর্ম বহণ করে দুজনের জন্য। নুশরাত বাইক থেকে থেমে নিচু কন্ঠে বলে,
“সাবধানে যেয়েন”

এটুকু বলে সঠান ভেতরে হাটা দেয় সে। তৌহিদ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দেয়। নুশরাতের ঠোটে স্মিত হাসি। হঠাৎ তার হাসি মিলিয়ে যায়। এক রাশ ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। তার অনুভব হয় সিড়িঘরে সে একা নয়। একজন মানব অবয়ব তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। যে ঘাপতি মেরে ছিলো সিড়ির নিচে। অপেক্ষা করছিলো নুশরাতের ফেরার। এখন সে বেড়িয়ে এসেছে ঘাপটি ছেড়ে। গলা শুকিয়ে আসে নুশরাতের। ভয়ার্ত চোখে পেছনে তাকায় সে। তাকাতে দেখতে পায়……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here