দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,৪র্থ_পর্ব,৫ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪র্থ_পর্ব
লিফট নেমেছে অবশেষে। বিগত দশ মিনিট পূর্বে সে কল দিয়েছিলো। এখন সে অবশেষে গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসেছে। বড় বিল্ডিং হবার কারণে ভিড় ও প্রচুর। কোনোমতে সব ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো নুশরাত। যেই না গেটটা আটকাবে তখনই একটি হাত লিফটটিকে আটকে দিলো। লিফটের দরজা পুনরায় খুলে গেলো। একটি বাদামী রঙ্গের ব্যাগ হাতে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার উচ্চতা আনমানিক পাঁচ ফুট নয় হবে, লম্বাটে মুখ, কোট টাই পড়ে ফিট বাবুর মতো লাগছে তাকে। ভিড় ঠেলে নুশরাতের পাশে দাঁড়ালো সে। তার শরীর থেকে অসম্ভব মিষ্টি কিন্তু তীক্ষ্ণ একটি গন্ধ নাকে আসছে নুশরাতের। এই গন্ধটি তার পরিচিত। কিন্তু মনে করতে পারছে না কিভাবে পরিচিত! লোকটি রোবটের ন্যায় চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটিকে দেখে অহেতুক কারনে কৌতুহল জাগলো তার। নুশরাত লোকটিকে এর পূর্বে বিল্ডিং এ দেখে নি। খুব অদ্ভুত তার হাবভাব, গরমে যেখানে মানুষ সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে এই ব্যাক্তি রীতিমতো কোট, টাই পড়ে রয়েছে। লিফটে উঠে মানুষ প্রথমে এগিয়ে যায় কল করার জন্য, অথচ লোকটি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার যেনো জানা আছে, যে ফ্লোরে সে যাবে সেই ফ্লোরের কল আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে। চতুর্দশ ফ্লোরে যেতে লিফটের দু মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ড লাগলো। এই সময়টা নুশরাত আড়চখে পাশে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটিকে দেখে গিয়েছে। এই দুমিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডে লোকটা মোট দশবার তার ঘড়ি দেখেছে। হিসেব করলে দাঁড়ায়, প্রতি সোয়া উনত্রিশ সেকেন্ড একবার সে ঘড়ি দেখেছে। এই ধরণের স্বভাব বড় বড় ডাক্তার, ব্যাবসায়ীদের থাকে। আবার খুব বড় উকিলের মাঝেও এমন স্বভাব লক্ষ করা যায়। তবে কি লোকটি উকিল? হতেই পারে, কারণ এই বিল্ডিং এ ঢাকার হাইকোর্টের প্রায় উকিলের চেম্বার।
লিফট থেকে বের হয়েই নিজের চেম্বারের দিকে হাটা দিলো নুশরাত। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো রবিনের সব জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসেছে নতুন একটি টেবিল, নতুন গদি চেয়ার, নতুন ফাইলের সমাহার, নতুন পেনস্ট্যান্ড। রবিন কোনো এক কালে এখানে বসে কাজ করতো ব্যাপারটা যেনো হাওয়ায় উবে গেছে। নুশরাত মনে মনে হাসলো, কোনো মানুষ হারিয়ে গেলে সেই মানুষের কাটানো মূহুর্ত গুলো কয়েকদিন মনে পড়ে। এর পর সব আগের মতো হয়ে যায়। সেই মানুষের অনুপস্থিতি সময়ের চক্রকে আটকে রাখে না। সময় নিজের মতোই তার অনুপস্থিতির অভাব অমিট করে দেয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এই নিয়মেই পৃথিবী চলছে। মানুষ মারা যাচ্ছে, প্রকৃতি৷ সময়ের সাথে তাদের অনুপস্থিতিটির অভাবটি নানা ভাবে পূরণ করে দিচ্ছে। শোক তাপ ক্ষণিকের জন্য তীব্র হলেও সময়ের সাথে সাথে তা ক্ষীন হয়ে যায়। মানুষ নতুন করে নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদের শোক ভুলে যায়। আহারে জীবন!
নুশরাত নিজের চেয়ারে বসলো। ইতি চৌধুরীর হত্যার কেসটা তার সামনে খুললো৷ এই কেসটা রবিনের আন্ডারে ছিলো। কেসটা বেশ অদ্ভুত। খুব বিত্তবান ব্যাবসায়ী আতিয়ার চৌধুরীকে তার স্ত্রী ইতি চৌধুরীর খুনের দায়ে পুলিশ কাস্টেডিতে নেওয়া হয়েছে। এবং রবিন তার হয়ে এই কেসটা লড়ছিলো। আতিয়ার চৌধুরীর ভাষ্য, তিনি যেদিন বাসায় ই ছিলেন না। কাজের লোকের ভাষ্য, সে যখন কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলো তখন সাহেব আর ম্যাডামের ঝগড়া চলছিলো। তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়ার ফলাফল ই হয়তো ইতি চৌধুরীর মৃত্যু। আতিয়ার সাহেব কে সেটা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ঝগড়ার এক পর্যায়ে আতিয়ার সাহেব রেগে ঘর ছেড়ে চলে যায়। যখন ফিরে আসেন তখন ইতিকে মৃত হিসেবে মাটিতে লুটিয়ে থাকতে দেখেন। মাথা থেকে অঝর ধারায় রক্তের স্রোত বইছিলো। ফোরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী তার মৃত্যু রক্তক্ষরণের কারণে হয়েছে। ইতি চৌধুরীর বড় ভাই অর্থাৎ ইফতেকার আহমেদের মতে রাগের মাথায় আতিয়ার ইতিকে ধাক্কা দিয়েছে। তাই তার মাথা সিড়ির কর্ণারে যেয়ে লেগেছে। ফলে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কথাটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আতিয়ার সাহেব অত্যন্ত রাগী একজন মানুষ, তার পক্ষে এটা কথাটা অযৌক্তিক নয়। বাসায় কোনো সিসি টিভি ও নেই যা আতিয়ার সাহেবের ভাষ্য কে সত্য প্রমাণ করে৷ তবে গেটম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী আতিয়ার সাহেব বিকেল ৪.১৫ তে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। এবং বিকাল ৫.৩০ এ বাড়িতে ফিরেন। ইতির মৃত্যুর সময় বিকেল ৪-৪.৩০ টা। এমনটা হতেই পারে আতিয়ার সাহেব তাকে রাগের বশে ধাক্কা মেরেছে, তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। ফলে পাছে ইতি সিড়ির কর্ণারে আঘাত পেয়েছে সেটা যে দেখে নি। হতেই পারে। নুশরাতের মাথা ব্যাথা করছে। আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। তাই সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। তখন কেবিনে তীব্র গতিতে একটা লোক প্রবেশ করলো। লোকটি আর কেউ নয় বরং লিফটের সেই অদ্ভুত লোকটি। লোকটি অভদ্রের মতো নক ছাড়াই নুশরাতের কেবিনে ঢুকে পড়লো। এতে নুশরাতের মেজাজ রীতিমতো খিচে উঠলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
“এই যে মিস্টার, এভাবে অভদ্রের মতো রুমে ডুকে পড়লেন যে! আমার পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন টুকু বোধ করলেন না।”
“আমাকে বলছেন?”
“এখানে আপনি ছাড়া আর কাউকে তো আমি দেখছি না। সুতরাং আপনাকেই বলছি। তা ম্যানারস বলে একটা জিনিস থাকে সেটা কি গুলে মেরে দিয়েছেন না কি?”
লোকটা উত্তর দিলো না। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নুশরাত মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলালো। তার সূচালো দৃষ্টি নুশরাতকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলিয়ে দিলো। লোকটি গা জ্বলানো হাসি দিয়ে বললো,
“আমার কেবিনে আসতে আপনার পারমিশন লাগবে, ব্যাপারটা হাস্যকর নয়?”
“আপনার কেবিন? আপনি সেই নতুন ব্যাক্তি যিনি এই কেবিনটা ভাড়া নিয়েছেন?”
অবাক কন্ঠে কথাটা বলে নুশরাত। লোকটি পুনরায় গা জ্বালানো হাসি দিয়ে চেয়ারটি টেনে বসলো। বাদামী ব্যাগ থেকে নিজের ন্যামপ্লেটটি বের করলো। ন্যামপ্লেটটি দেখে মনে হচ্ছে এখন ই বানিয়ে আনা হয়েছে। কালো ন্যামপ্লেটের উপর সাদা রঙ্গে লেখা “এডভোকেট স্বর্ণ আহমেদ”। স্বর্ণ, নামটি কি ছেলেদের? নামটি বেশ আনকমন তাই হয়তো নুশরাতের মনে পড়ছিলো না। লোকটি হাসি মুখে বললো,
“স্বর্ণ আহমেদ, নাইস টু মিট ইউ রুমি। অহেতুক কারণে রেগে যাবার বদঅভ্যাসটা এবার ছাড়ুন। একসাথে কাজ করতে হবে, তাই রাগটি একটু কন্ট্রোলে রাখুন। অবশ্য রাগলে নারীদের মায়া বেড়ে যায়, কথাটা শুনেছিলাম। আজ দেখেও নিলাম।”
লোকটার কথাগুলো নুশরাতের গায়ে ফসকার মতো লাগছে। তার হাসিটা দেখেই গা জ্বলছে। এই লোকটির সাথে কাজ করা কি আদৌও সম্ভব!
মেহরাবের সামনে তৌহিদ বসে রয়েছে। লোকটিকে অবশেষে হাতের কাছে পাওয়া গিয়েছে। লোকটি গত আটদিন যাবৎ ঢুব মেরে ছিলো। ফোন আনরিচেবল, ল্যাবে তাকে পাওয়া যেতো না। আজ ভাগ্যক্রমে তৌহিদের হাতে পড়েছে সে। তৌহিদ হিনহিনে কন্ঠে তাকে বললো,
“পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন কেনো? আপনাকে তো সুবিধার লাগছে না মশাই! সাধারণত চোরেরা পালিয়ে বেড়ায়, আপনি তো পেশায় ডাক্তার। তাহলে চোরের ভঙ নিচ্ছেন কেনো?”
“পালাই নি তো? অনুসন্ধানে ব্যস্ত ছিলাম।”
ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি একে কথাটা বললো মেহরাব। তৌহিদ টেবিলে খানিকটা এগিয়ে এসে বসলো। তারপর গলা খাঁদে নামিয়ে বললো,
“কিসের অনুসন্ধান?”
“বিষের”
“বিষ?”
“আজ্ঞে, স্নিগ্ধের মৃত্যু বিষের প্রয়োগে হয়েছে। কিন্তু বিষটা বেশ অজ্ঞাত। তার মুখ নীল বর্ণ ধারণ করে, কিন্তু তার শরীরে নাইট্রেট এলিমেন্ট আমি পাই নি। আবার তার শরীরে আমি পারদ জাতীয় বিষ ও পাই নি, যা হার্ট এট্যাক করায়। তার শরীরে আমি এমন কোনো পদার্থ পাই নি যা তার মৃত্যুর কারণ। আমি সেকারণেই অনুসন্ধানে গিয়েছি।”
“আপনি কি উত্তর পেয়েছেন?”
তৌহিদের কন্ঠে উৎকন্ঠা। সে জানতে চায় স্নিগ্ধের মৃত্যুর কারণ। মেহরাব মাথা ঝাকিয়ে বলে,
“অবশেষে, স্নিগ্ধকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড দেওয়া হয়েছে। পটাশিয়াম ক্লোরাইড এক প্রকার বিষাক্ত মেডিক্যাল লবন। এইটা ঔষধ হিসেবে যেমন প্রয়োগ করা যায়, বিষ হিসেবেও প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু খুনি সেটা তাকে খাবারের সাথে দেয় নি৷ গ্যাসের ফর্মে তার সেলে সরবরাহ করা হয়েছে৷ যেহেতু ময়নাতদন্ত সাথে সাথে করা হয় নি। তাই এই পদার্থটি তার শরীরের সাথে ট্রেসবিহীন মিশে গেছে। খুব শার্প মুভ।”
“তাহলে তার মুখ নীলাভ কেনো হয়ে ছিল?”
“এইটা আমিও চিন্তা করেছি। শ্বাসরোধ হলে মানুষের শিরা নীলাভ রুপ নেয়। হতেই পারে এটা সে কারণে হয়েছে। তবে স্নিগ্ধের সেলে ধীরে ধীরে পটাশিয়াম ক্লোরাইডের প্রয়োগ হয়েছে। লাস্ট দিনের ডোজটা বেশি ছিলো। থানার ভেতরকার কেউ ছাড়া এমনটা করা সম্ভব নয়। তাই আপনাদের উচিত ভেতরকার তদন্ত করা। এবং সেলটার পুনরায় তদন্ত করা।”
তৌহিদের কপালে ভাজ পড়লো৷ সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। ঠিক তখন তার ফোনটি বেজে উঠে। ফোনটি রিসিভ করতেই শোনা গেলো…….
চলবে
দৃষ্টির অগোচরে
দ্বিতীয় অধ্যায়
৫ম_পর্ব
তৌহিদের কন্ঠে উৎকন্ঠা। সে জানতে চায় স্নিগ্ধের মৃত্যুর কারণ। মেহরাব মাথা ঝাকিয়ে বলে,
“অবশেষে, স্নিগ্ধকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড দেওয়া হয়েছে। পটাশিয়াম ক্লোরাইড এক প্রকার বিষাক্ত মেডিক্যাল লবন। এইটা ঔষধ হিসেবে যেমন প্রয়োগ করা যায়, বিষ হিসেবেও প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু খুনি সেটা তাকে খাবারের সাথে দেয় নি৷ গ্যাসের ফর্মে তার সেলে সরবরাহ করা হয়েছে৷ যেহেতু ময়নাতদন্ত সাথে সাথে করা হয় নি। তাই এই পদার্থটি তার শরীরের সাথে ট্রেসবিহীন মিশে গেছে। খুব শার্প মুভ।”
“তাহলে তার মুখ নীলাভ কেনো হয়ে ছিল?”
“এইটা আমিও চিন্তা করেছি। শ্বাসরোধ হলে মানুষের শিরা নীলাভ রুপ নেয়। হতেই পারে এটা সে কারণে হয়েছে। তবে স্নিগ্ধের সেলে ধীরে ধীরে পটাশিয়াম ক্লোরাইডের প্রয়োগ হয়েছে। লাস্ট দিনের ডোজটা বেশি ছিলো। থানার ভেতরকার কেউ ছাড়া এমনটা করা সম্ভব নয়। তাই আপনাদের উচিত ভেতরকার তদন্ত করা। এবং সেলটার পুনরায় তদন্ত করা।”
তৌহিদের কপালে ভাজ পড়লো৷ সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। ঠিক তখন তার ফোনটি বেজে উঠে। ফোনটি রিসিভ করতেই শোনা গেলো একজন নারীর চিৎকার। তৌহিদ চিৎকারটি শোনা মাত্র চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন হয়ে ফোনে বললে লাগলো,
“হ্যালো, হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো! কথা শোনা যাচ্ছে কি?”
পরমূহুর্তে বিপ ছাড়া কিছুই শোনা গেলো। তৌহিদ পুনরায় নাম্বারটিতে ফোন করলো, অপর পাশ থেকে শোনা গেলো,
“আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ”
তৌহিদ বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল একই। সে অস্থির কন্ঠে মেহরাবকে বললো,
“আমি আসছি, রিপোর্ট অফিসে পাঠিয়ে দিবেন।“
বলেই তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলো। মেহরাব তৌহিদের যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। তার ঠোঁটের কোনে এক বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠলো। এ হাসির কারণটা শুধু সেই জানে_________
একটি পুরোনো গোডাউনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৌহিদ। তীক্ষ্ণ বিরক্তি নজরে গোডাউনটিকে দেখছে সে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করছে না। কিছুক্ষণ পূর্বে যে ফোনটি এসেছিলো তা বন্ধ আগমূহুর্তের লোকেশন এই গোডাউনটাই দেখাচ্ছে। ফোন কোম্পানিগুলোর থেকে এই লোকেশনটাই পাওয়া গেছে। তৌহিদ টিম নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছে বেশ সময় পেরিয়ে গেছে। ছয়জনের একটা দল গোডাউনের ভেতরে তল্লাশি চালাচ্ছে। তৌহিদ বাহিরে দাঁড়ানো। তার ভেতরে প্রবেশ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অহেতুক কারণে গা গুলোচ্ছে তার। অবশ্য কারণটি অহেতুক হয়। এই গোডাউনের সাথে তার বিশ্রি একটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সাহসী তৌহিদুর রহমান ও ভয় পায়। ভয় মানুষের স্বভাবগত আচারণ। প্রতিটি মানুষ ভয় পায়। ব্যাক্তিবিশেষে ভয়ের ধরণ পালটায়। তৌহিদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। স্মৃতিটি পুরোনো, সেই স্মৃতি জড়ানো ভয়টিতেও জং ধরে ছিলো এতোকাল। যেই হঠাৎ স্মৃতির জায়গায় পুনোরাবৃত্তি হচ্ছে অমনি ভয়ের মরীচাগুলো একে একে সরে যাচ্ছে। তৌহিদের হাত ঘামছে, বিরক্ত লাগছে। কিন্তু পালাতে পারছে না। তখন ই ইন্সপেক্টর শাহান ছুটে এলো তার কাছে। ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার একটা মোবাইল ছাড়া কিছুই পাওইয়া যায় নি। মোবাইলের পাশে রক্তের ছিটা ছিলো। কিন্তু তা তাজা নয়, পুরোনো। আমরা স্যাম্পল কালেক্ট করে নিয়েছি।“
“শিওর, কিছু নেই?”
“না স্যার। আপনি কি ভেতরে যাবেন একবার?”
“নাহ, আমি যাবো না। তুমি স্যাম্পল ল্যাবে পাঠাও।“
আমতা আমতা করে কথাটা বললো তৌহিদ। তার মোটেই ভেতরে যেয়ে তল্লাশি করতে ভালো লাগছে না। সে এখন বাসায় যাবে। তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে। তৌহিদ জিপের কাছে রওনা দিলো। আলিফকে ধীর কন্ঠে বললো,
“বাড়ি যাবো, আলিফ”
আলিফ কথা বাড়ালো না। সে গাড়ি ছোটালো। তৌহিদ গা এলিয়ে দিলো জিপের সিটে। অতীত আজ তাজা হয়ে গেছে। আচ্ছা কেউ কি তাকে অতীতের স্মৃতি মনে করানোর চেষ্টায় লিপ্ত? অতীতের কোনো শত্রু কি ভিজে এসেছে হিসেব মিটাতে?
স্বর্ণ নামক ব্যাক্তিটি অতিমাত্রায় বিরক্তিকর। ক্ষণে ক্ষণে নুশরাতকে বিরক্ত করছে। তার হাতে তেমন কেস না আসায় তার বাতিক উঠেছে নুশরাতকে সাহায্য করার। নুশরাত মানা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয় নি। চুইঙ্গামের মতো পেছনে লেগেই আছে। নিজের ডেস্ক ছেড়ে নুশরাতের ডেস্কে এসে বসে আছে। নুশরাত চিন্তা করার চেষ্টা করছে কিন্তু একবার কলম নিয়ে খুট খুট করছে তো একবার ডেস্কের উপর তবলা বাজাচ্ছে। তার এখনের রুপের সাথে সকালের লিফটের রুপ কিছুতেই মিলাতে পারছে না নুশরাত। যেনো সকালে লিফটে সকলের সামনে ভঙ ধরেছিলো। এখন লোকটি প্যানস্ট্যান্ড থেকে এন্টিকাটার নিয়ে টেবিলে আঁচড় কাটছে। এতে করে একটা সুতীক্ষ্ণ শব্দ কানে সুচের ন্যায় লাগছে। রাগ সামলাতে না পেরে টেবিলে সজোরে আঘাত হানলো নুশরাত। হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
“সমস্যা কি আপনার?”
“আমার কি সমস্যা হবে? আমি একেবারে কমফোর্টেবল রয়েছি”
“তাহলে আমাকে কেনো আনকমফোর্টেবল করছেন? কেনো উত্যক্ত করছেন?”
লোকটা এন্টিকাটার রেখে দিলো। ভালো মানুষের মতো বললো,
“ওহ! সরি, বুঝতে পারি নি। আসলে আমি চিন্তা করার সময় অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোও এক্টিভ রাখি। ইট হেল্পস।“
“আমাকে হেল্প করছে না। আমার ইরিটেশন হচ্ছে। প্লিজ বন্ধ করুন।“
সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে কথাটা বললো নুশরাত। লোকটা অপরাধীর মতো মাথা নত করে নিলো। নুশরাতের আজকাল হুটহাট রাগ উঠে যাচ্ছে। বদরাগী সে আগেও ছিলো, এখন রাগটা সামলানো যেনো দায় হয়ে ঠেকেছে। লোকটার গো বেচারা মুখটা দেখে খানিকটা অনুশোচনা হল নুশরাতের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহি কন্ঠে বললো,
“দেখুন, কেসটা আমার নয়। এই কেসে আমি নতুন। হেয়ারিং সামনের সপ্তাহে। আমি চাই আমার ক্লাইন্ট ন্যায্য বিচার পাক। তাই আমাকে একটু মনোযোগ দিতে দেন। কেসটা যতটা সিম্পল ততোটাই জটিল লাগছে আমার কাছে। আম একটু অস্থির হয়ে পড়েছি। সরি ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয় নি আমার। বাট আপনি আমাকে বিরক্ত করছিলেন।“
স্বর্ণ এবার মুখ তুললো। একটু এগিয়ে এসে বললো,
“ইতি চৌধুরীর হাই প্রেসার ছিলো তাই না?”
স্বর্ণের উটকো প্রশ্নে বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকলো নুশরাত। সে কাকে কি বলছিলো! লোকটা কি একটা কথা তার শুনেছে! নুশরাত বিরক্তি নিয়ে বললো,
“থাকতে পারে! কিন্তু সেটার সাথে কেসের ই সম্পর্ক?”
“হাই প্রেসারে রোগীদের প্রেসার বেড়ে গেলে শরীর বশে থাকে না।“
“উনার মৃত্যু প্রেসার বাড়ার কারণে হয় নি, রক্তক্ষরণের কারণে হয়েছে?”
“হতেই পারে, আতিয়ার সাহেবের সাথে ঝগড়া করে উনার প্রেসার বেড়ে গিয়েছিলো। তিনি ব্যালেন্স না করতে পাড়ায় পড়ে গিয়েছেন। হাই প্রেসারের রোগীদের প্রেসার বেড়ে গেলে শরীর ব্যালেন্স এ থাকে না। পড়ে যাওয়ায় মাথাটা সিড়িতে আঘাত পেয়েছে। ফলে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। যতক্ষনে আতিয়ার সাহেব বাসায় এসেছেন সি ওয়াজ ডেড।“
স্বর্ণের কথা শুনে মাথায় হাত পড়ে নুশরাতের। এইভাবে সে চিন্তাও করে নি। স্বর্ণের ধারণা যৌক্তিক। নুশরাত গদগদ হয়ে বলে,
“অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি তো আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন।“
“স্বাগতম। কিন্তু আফসোস, এটা আপনি কোর্টে প্রমাণ করতে পারবেন না।“
স্বর্ণের কথায় কপাল কুচকে যায় নুশরাতের। তার চাহনী দেখে স্বর্ণ গা জ্বালানো হাসি দেয়, তারপর বলে,
“কারণ……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি